চলে গেলেন কলকাতার ইতিহাসবেত্তা পি টি নায়ার ; তাঁর স্মৃতিচারণে প্রাক্তন আই এ এস ও রাজ্যসভার সদস্য জহর সরকার কলকাতার অনেকের মতোই আমি ও আমার স্ত্রী বিষণ্ণ হয়ে পড়েছি একটি খবরে। পিটি নায়ার আর নেই। কেরলের আলুভায় নিজের বাড়িতে ৯১ বছর বয়সে জীবনাবসান হয়েছে এই 'খালিপায়ে ইতিহাসবিদের'। কলকাতার মানুষ পরমেশ্বরন থানকাপ্পান নায়ারকে এই শহরের ইতিহাসবিদ বলেই জানে। কিন্তু আমার কাছে তিনি একজন বন্ধু। যদিও নায়ার আমার থেকে বয়সে প্রায় দুই দশকের বড় ছিলেন। কলকাতার ইতিহাস নিয়ে আমার যে চর্চা, সে ব্যাপারে তিনি আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেই সময়টা 1970 ও 1980-র দশক। তখন আমি একজন তরুণ সরকারি অফিসার হিসেবে কাজ করছি। 1955 সালে নায়ার কলকাতা এসেছিলেন কেরলের এর্নাকুলামের একটি ছোট্ট গ্রাম থেকে। শুরু করেছিলেন টাইপিস্টের কাজ। এরপর ভালো বেতনের সরকারি চাকরি পান তিনি। কিন্তু কলকাতা থেকে অন্য শহরে বদলি হতে হবে বলে সেই চাকরি নেননি। এই শহরকে তিনি ভালোবেসে ফেলেছিলেন। গবেষণা ও লেখালেখির জন্য সরকারি চাকরি ছেড়ে দিতে পারেন, এমন খুব বেশি মানুষ আমার চেনা নেই। প্রকাশকরা কখনওই তাকে বেশি সাম্মানিক দিতেন না। তবু তিনি কায়েক্লেশে আঁকড়েছিলেন কলকাতাকে। একসময়ের ঔপনিবেশিক এই শহরের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াতেন পিটি। খুঁজতেন বিভিন্ন রাস্তা ও এলাকার ইতিহাস। যে তথ্য আহরণ করতেন, তা গ্রন্থাগারের বই ও রিপোর্টার সঙ্গে মিলিয়ে দেখে নিতেন। কলকাতার জনসংখ্যা ক্রমশ বেড়েছে। বহু মানুষকে জায়গা করে দিতে প্রাচীন ভবন ভেঙে গড়ে উঠেছে বহুতল। কেউ যদি এই ঝকঝকে কলকাতার আগের ছবিটা খুঁজে পেতে চান, তাহলে তাঁকে নায়ারের বই দেখতেই হবে। কাঁসারিপাড়া লেনের এক কামরার ঘরে থাকতেন পিটি। অনেক সময় তাঁর এই ছোট আস্তানায় আশ্রয় নিতেন কলকাতায় আসা মালায়লি পড়ুয়া বা কর্মপ্রার্থীরা। এই ঘরে বইয়ের পাহাড়ের মধ্যে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যেত। নায়ারের সংগ্রহে ছিল অনেক বিরল বই। তাঁর কোনও টেলিফোন বা মোবাইল ছিল না। ইমেইল ছিল না। যদি কেউ পিটির সাক্ষাৎ পেতে চাইতেন, তাহলে তাঁর দরজার সামনে অপেক্ষা করতে হতো তিনি বাড়ি ফেরা পর্যন্ত। এই এক কামরার ঘর আমাদের মিন্টো পার্কের সরকারি আবাসনের খুব কাছেই ছিল। কখনও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজন হলে, আমি কাঁসারিপাড়ায় চলে যেতাম। প্রতিবেশী কাউকে প্রয়োজনীয় কথা বলে আসতাম। সকলেই তাঁকে চিনতেন। প্রতিদিন সকাল ন'টায় খাওয়া-দাওয়া সেরে নিতেন পিটি। এরপর দুই কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছে যেতেন জাতীয় গ্রন্থাগারে। সকাল থেকে লাইব্রেরি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত কাজ করতেন। তিনি জানতেন লাইব্রেরির কোথায় তাঁর প্রয়োজনীয় বইটি আছে। কোন বিভাগ বা কালেকশনে গেলে কাঙ্খিত তথ্যটি পাওয়া যাবে। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সংক্রান্ত তথ্য ছিল 'আশুতোষ কালেকশন' এ। এই সংক্রান্ত বই ও অন্যান্য তথ্য রাখা ছিল লাইব্রেরির মূল ভবন থেকে কিছুটা দূরে অন্য একটি ভবনে। সেখানে বই খুঁজতে গিয়ে আমার সঙ্গে নায়ারের দেখা হয়ে যেত। যদিও তিনি যখন কাজ করতেন, পুরোনো বই থেকে হাতে লিখে নোট নিতেন, তখন তাঁকে বিরক্ত করা যেত না। চুপচাপ অপেক্ষা করতে হতো, কখন তিনি কাজ শেষ করেন। নোট শেষে মুখ তুললে কথা বলা যেত নায়ারের সঙ্গে। ব্রিটিশ আমলে কলকাতার সমাজ কেমন ছিল, এ বিষয়ে পিটিকে এনসাইক্লোপিডিয়া বলা চলে। বিস্তর গবেষণা করলেও তাঁর প্রকাশ পন্ডিতদের মতো ছিল না। তিনি বলতেন, গবেষকরা শুধু নিজেদের জন্যই লেখেন, অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বোধ্য ভাষায়। তাই তিনি লিখতেন সহজ ভাষায় যা মানুষকে ছুঁতে পারে। নায়ারের ইংরেজি লেখার ক্ষমতা হয়তো ততটা ভালো ছিল না, কিন্তু অনেকের থেকে বেশি তথ্য মিলতো তাঁর লেখায়। তিনি বাংলা জানতেন না। তাই বাঙালি গবেষকরা তাঁকে বাঁকা চোখে দেখতেন। পিটি বাংলা বুঝতে পারতেন, কিন্তু লিখতে বা পড়তে পারতেন না। তবে বাংলায় কিছু পড়ে শোনালে তিনি স্বচ্ছন্দে তা নোট করে নিতেন। কখনও আমাদের ফ্ল্যাটে চলে আসতেন পিটি। কলকাতা বিষয়ে নতুন পাওয়া কোনও তথ্য আমাদের জানতেন। কখনও তর্কে মেতে উঠতেন। সব সময় কেমন একটা তাড়াহুড়োর মধ্যে থাকতেন, বেশিক্ষণ আমাদের ফ্ল্যাটে থাকতেন না। কোনও খাবারও খেতে চাইতেন না। তবে আমার স্ত্রী নন্দিতা ওঁকে ছাড়তো না। ওর আবদারে তিনি কিছুটা জিরোতেন আমাদের ফ্ল্যাটে, খাবার খেতেন। 70টির মতো বই লিখেছিলেন নায়ার। অধিকাংশই ইংরেজিতে। এই বইগুলিতে ব্রিটিশ শাসনাধীন কলকাতার সামাজিক জীবন ফুটে উঠেছে। ভারতীয়দের প্রতি সেই সময়ের শাসকদের মনোভাব কেমন ছিল, সেটাও বোঝা যায় তাঁর বই পড়লে। মাতৃভাষা মালায়ালামে লিখতেন তিনি, অসাধারণ লেখক ছিলেন। পিটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বই 'হিস্ট্রি অফ ক্যালকাটাজ স্ট্রিটস', বইটি খুবই নির্ভরযোগ্য আর তথ্যে ঠাসা। তিনি একটি বই আমাকে উৎসর্গ করেছিলেন। পিটির লেখা অন্যান্য স্মরণীয় বইগুলির মধ্যে রয়েছে 'দ্য ফার্স্ট সার্কুলেটিং এন্ড কলেজ লাইব্রেরিজ অফ ক্যালকাটা', 'ক্যালকাটা টারসেন্টেনারি বিবলিওগ্রাফি' ইত্যাদি। কলকাতার ইতিহাসের পাশাপাশি অন্যান্য বিষয় সম্পর্কেও যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন নায়ার। তাঁর বইয়ের বিষয় ভাবনা দেখলে সেটা বোঝা যায়। যেমন 'ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সংস এন্ড সিম্বলস', দ্য ম্যাংগো ইন ইন্ডিয়ান লাইফ এন্ড কালচার', 'সাউথ ইন্ডিয়ান ইন কলকাতা' ইত্যাদি। কলকাতা পিটিকে অনেকবার সম্মানিত করেছে। কিন্তু তাঁর প্রাপ্য ছিল আরও বেশি। নায়ারের বিরল বইগুলি কিনে গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত করেছে কলকাতা পুরসভা। কলকাতার পাট চুকিয়ে কেরলে ফিরে যান নায়ার। সেখানেও তাঁর কলম থেমে থাকেনি। জীবনের শেষ পর্যন্ত লিখে গিয়েছেন। কেরল থেকেই তিনি শেষবার আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন বছর তিনেক আগে। জানিয়েছিলেন, লেখালেখি নিয়ে খুবই ব্যস্ত আছেন। তাঁর কথায় বিষাদ ছিল কলকাতাকে নিয়ে, এই শহরকে হারিয়ে ফেলার বেদনা। 1950 ও 1969-এর দশকে তিনি যে কলকাতাকে দেখেছেন, সেই শহরটি আজ হারিয়ে গিয়েছে। সব ব্যস্ত মানুষেরই একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। ঈশ্বর তাঁর আত্মাকে বিশ্রাম ও শান্তি দিন। অনুবাদ - কুশল সিংহরায়
আমরা এখানে আপনাদের কথা বলার জন্য প্রচেষ্টা করি। তার মধ্যে কিছু আপনাদের ভালো লাগে, কিছু হয়তো নাও লাগতে পারে। আমরা দুটোকেই সমানভাবে সন্মান করি। তাই আপনাদেরই কিছু মন্তব্য আমাদের উদ্দেশ্য , আমরা এখানে প্রত্যয়িত করলাম।.