কুশল সিংহরায় কবি অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন, "তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর পরে রাগ করো। তোমরা যে সব বুড়ো খোকা বাংলা ভেঙে ভাগ করো।" শুধু 'বাংলা' শব্দটা পাল্টে নিলেই হয়। মণিপুর ভেঙে খানখান হয়ে গিয়েছে। সরকারের খাতায়, মানচিত্রে সেটা একটাই ভূখণ্ড, ভারতের অঙ্গরাজ্য। কিন্তু পাহাড়ের রানির হৃদয় টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। মেইতেইদের মণিপুর। কুকিদের মণিপুর। এই বিভাজনের বাতাস এখন জোরালো রাজ্যের আনাচেকানাচে। কেউ হিন্দু, কেউ খ্রিস্টান। কেউ মেইতেই, কেউ কুকি। একে অপরের দিকে বন্দুক-বেয়নেট তাক করে বসে আছে দুই শিবির। এভাবেই এলোমেলো হয়ে গিয়েছে সব, তার মধ্যে মাথাচাড়া দিয়েছে মেইতেই ও কুকিদের বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী। সাম্প্রতিক অতীতে এরা কিছুটা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। তবে গত কয়েকমাসে হাহাকার যত বেড়েছে, অনাস্থা ও সংশয়ের গলি দিয়ে ফের জনজীবনে এসে পড়েছে বন্দুকবাজরা। কোথাও গায়ের জোরে, কোথাও জনতাই তাদের কাছে টেনে নিয়েছে। এমনটাই বলছিলেন 58 বছরের রতনকুমার সিং। মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষ। হাইস্কুলে পড়ান। তাঁর কাছে সশস্ত্র যোদ্ধারা 'বিপ্লবী'। প্রতিটা মুহূর্তে যখন আতঙ্ক জাঁকিয়ে বসছে, সেই সময় এই যোদ্ধাদেরই রতনরা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। দিনটা ছিল গত বছরের 28 মে। মণিপুরের ছোট শহর সুগনু সশস্ত্র যোদ্ধাদের সাদরে কাছে টেনেছিল। কুকিদের হামলার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছিল না মেইতেইরা। তাদের সশস্ত্র গোষ্ঠী সুগনুতে এসে পৌঁছতে ছবিটা বদলে যায়। রতন বলেন, "কুকিরা আমাদের বাড়িতে আগুন দিচ্ছিল। পুলিশ ও আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা পাল্টা গুলি চালায়। কিন্তু ওদের বাগে আনা যাচ্ছিল না। বিপ্লবীদের দল এসে পড়ায় কুকিদের আমরা রুখে দিতে পেরেছি।" বিপরীত শিবিরেও ছবিটা এমনই। 60 হাজার সেনা, আধাসেনা ময়দানে থাকলেও হিংসার আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে মণিপুরে। এলাকা দখলের লড়াইয়ে সামনে চলে এসেছে মেইতেই ও কুকি যোদ্ধারা। তাদের পিছনে সাধারণ মানুষ, স্বেচ্ছাসেবক, এমনকী পুলিশও। মুখ্যমন্ত্রীর শাসন মণিপুরের একটা বড় অংশের মানুষ সংখ্যালঘু। তাদের রাজনৈতিক আচরণ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ বা দেশের অন্যান্য বড় রাজ্যগুলির মতো নয়। সেই কারণে বছর দুয়েক আগে বিজেপি সহজেই ইম্ফলের ক্ষমতা দখল করেছিল। এ রাজ্যের সংখ্যালঘু মাত্রেই বিজেপি বিরোধী ভোটার বলে ধরে নেওয়া হয়, মণিপুরে তা নয়। এন বীরেন সিংকে মুখ্যমন্ত্রী করার জন্য কুকিরাও মাঠে নেমেছিল। কুকি গণসংগঠন থেকে বিদ্রোহী গোষ্ঠী তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিল। পদ্ম প্রতীকে লড়েছিলেন কুকিরা। পাহাড়ের 10 টি আসনের মধ্যে পাঁচটিতে জয় পেয়েছিলেন বীরেনের সঙ্গীরা। জেডিইউয়ের টিকিটে জেতা দুই কুকি বিধায়ক পড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়ে সংখ্যাটা নিয়ে যান সাতে। সেই সময় ভোট প্রচারে গিয়ে বীরেনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন মোদী-শাহ। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, "অবরুদ্ধ রাজ্য থেকে মণিপুর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। পাহাড় ও উপত্যকার মধ্যে দূরত্ব দূর করতে আমাদের সরকার উদ্যোগী হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে বীরেন সিংয়ের নেতৃত্বে।" পাহাড়বাসী কুকিদের ধারণা, মেইতেইরা সব আর্থিক সুযোগসুবিধা ভোগ করে। বিজেপি নেতৃত্বের দাবি, কুকি ও মেইতেইদের মধ্যে এই ফারাক ঘুচে গিয়েছে তাঁদের শাসনে। বছর দুয়েক পড়েই মোদী ব্রিগেডের এই দাবি যে মুখ থুবড়ে পড়বে, কে জানত! অসম রাইফেলসের রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রীর নীতির ফলেই মণিপুরে আজ মেইতেই ও কুকিরা যুযুধান। মিত্রতার ভাষণ বছর দুয়েক পর কীভাবে বৈরিতার স্ক্রিপ্টে বদলে গেল?
আমরা এখানে আপনাদের কথা বলার জন্য প্রচেষ্টা করি। তার মধ্যে কিছু আপনাদের ভালো লাগে, কিছু হয়তো নাও লাগতে পারে। আমরা দুটোকেই সমানভাবে সন্মান করি। তাই আপনাদেরই কিছু মন্তব্য আমাদের উদ্দেশ্য , আমরা এখানে প্রত্যয়িত করলাম।.