বসন্তের সকালে মিঠে রোদ আকাশ জুড়ে, দখিনা বাতাস জানান দিচ্ছে তার উপস্থিতি। মানিকতলা খালধারের বস্তিজীবন আড়মোড়া ভাঙছে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানে। মাইকের চারপাশে ইয়াসিন, রুবেলদের ভীড়, তারা হাঁটবে ভাষা দিবসের প্রভাত ফেরিতে। এভাবেই শুরু হল মানিকতলা খালপাড় অঞ্চলে শিশু-কিশোর কিশোরীদের ভাষা দিবসের সকাল, আয়োজনে ‘ভাষা ও চেতনা সমিতি’।
ভাষা দিবস বহন করে বহুমাত্রিক চেতনা, স্থান কাল ভেদে তার চরিত্রও ভিন্ন। 1952-তে আবদুল, বরকতরা উর্দু ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পথে নেমেছিলেন ভাষার নিশান হাতেই। মাতৃভাষার অধিকারের সেই লড়াই শেষ হয়নি পদ্মাপাড়ে, সাতের দশকে শিলচর উপত্যকার ভাষা আন্দোলন রচনা করেছে আরও এক রক্তস্নাত ইতিহাস। সাবেক ভাষা শহীদ স্তম্ভের লাল সূর্যটি যেন কমলা, হিতেশদের রক্তবিন্দুতে রাঙা হয়ে ওঠে আজও। একুশে ফেব্রুয়ারি এবং তার চেতনা-স্পর্ধা আজও রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণের বাইরে। স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির মুক্তচিন্তার ক্ষেত্র জুড়েই তার উদযাপন। উদযাপন মফ:স্বল পাড়ার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে।
মাতৃভাষা দিবস উদযাপনে ক্রটিও কম নয়। শাসকের থেকে দূরত্বে অবস্থান করেও একুশে ফেব্রুয়ারি অজানা-অপরিচিত থেকে গেছে নাসরিন, ইকবালদের কাছে। শ্রেণীগত অবস্থানের জন্যই সাংস্কৃতিক চেতনাও বাধা পড়েছে। দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘরে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। ওদের অস্তিত্ব সুশীল সমাজের চেতনার মানচিত্রে ধরা পড়ে না। তবু, ওরাও গান গায়, কবিতা বলে বাংলা ভাষাতেই। রবীন্দ্রসদন বা আকাদেমি নয়, খালপাড়ে।
মহা উৎসাহে প্রভাত ফেরির লাইন ঠিক করে বছর 12-এর স্বঘোষিত ক্যাপ্টেন। বর্ণপরিচয় হাতে ছেলেমেয়ের দল স্লোগান দেয়, ‘জয় বাংলা’, ‘সকলের শিক্ষার অধিকার চাই’... কেউ খালি পায়ে, কেউ বা স্কুল ড্রেস পরে সামিল হয়েছিল একুশের প্রভাত ফেরিতে। ওরা প্রতি সপ্তাহে একসঙ্গে লেখাপড়াও করে এক অবৈতনিক পাঠশালায়। ভাষা ও চেতনা সমিতির উদ্যোগে তাই একদিন নয়, প্রতিদিনই চলে এই অনুশীলন। ভাষা শিক্ষার, সমাজের মূলস্রোতে নিজেদের তুলে ধরার হাতিয়ার। ওদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকার লড়াই-ও জন্ম দেয় এক চেতনার, ভাষার। বঞ্চনার বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে।
মিছিল শেষে ওরা স্কুলে গেল, কেউ কেউ ফিরল কাজে। একদিন প্রতিদিনের লড়াইতে থেকে গেল ভাষা দিবসের চেতনা। উঠে দাঁড়ানোর জেদ।