4thPillar


আজ আমেরিকায়, কাল ভারতে নয় তো?

সঞ্চারী সেন | 28-06-2022July 9, 2023
আজ আমেরিকায়, কাল ভারতে নয় তো?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুপ্রীম কোর্টের গর্ভপাত বিরোধী রায় দক্ষিণপন্থী দেশগুলিতে নারীদের উদ্বেগের কারণ 

প্রত্যেক মানুষের মনের মধ্যে একটি মরূদ্যান আছে, সেটি হল সংসারদাহ থেকে কিছুক্ষণের জন্য মুক্তি পাওয়ার একটি জায়গা। সেটি হতে পারে পছন্দের কোনও মানুষের সঙ্গে সময় কাটানো, সাহিত্যপাঠ বা গান শোনা কিম্বা খেলা দেখা, প্রিয় কোনও বস্তু বা বিষয়ের চর্চা, সামাজিক কাজকর্ম করা, নতুবা হয়তো কোনও না কোনও নেশার ঘোরে বুঁদ হয়ে যাওয়া।

এছাড়াও বহির্বিশ্বের একটি দেশ তার মাথায় থাকে, তার ধারণায় বাস করে, যাকে বলা যায় সব পেয়েছির দেশ। সেখানকার মানুষের কোনও অভাব নেই, অভিযোগ নেই, সেটি আধুনিকতায় সর্বোত্তম, ব্যক্তি স্বাধীনতায় সর্বশ্রেষ্ঠ গণরাজ্য। যাঁদের দক্ষিণপন্থায় আপত্তি নেই, অর্থাৎ যাঁরা মনে করেন যে সব মুষ্টিমেয় মানুষ জন্মসূত্রে কিছুটা আর্থিক সাচ্ছল্য  বা আর্থিক কৌলীন্যের অধিকারী, তাঁদের দেশ ও দেশবাসীর স্বার্থের কথা বিস্মৃত হয়ে, নানাবিধ সুযোগসুবিধার সদ্ব্যবহার করে আরও আর্থিক সম্পদশালী হওয়ার অধিকার  রয়েছে, সেইসব মানুষের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা আমেরিকা এমনই এক স্বর্গরাজ্য।

অবশ্যই মহামন্দার সময়ে, অর্থনীতির ধসের খবর, একের পর এক ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য সংস্থার দেউলে হয়ে যাওয়ার সংবাদ এঁদের কানে পৌঁছয় না। যাই হোক সে অন্য প্রসঙ্গ, কিন্তু বেশ কিছু যুক্তিবাদী মানুষও আমেরিকার গণতন্ত্রের প্রতি, হোক তা দ্বি-দলীয়, গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করেন। কিছু ক্ষেত্রে তাঁদের চিন্তার যাথার্থ্যও অস্বীকার করা যায় না। অনেকে আবার উন্নত মেধার উৎকৃষ্ট বিচরণক্ষেত্র হিসেবে দেশটাকে দেখেন। তাতেও, মস্তিষ্ক নিষ্কাশনের বিষয়টি মেনে নিয়েই, খুব ভুল রয়েছে এমনটাও বলা চলে না।

কিন্তু  এই বিশ্বাসে প্রবল এক ধাক্কা লেগেছে  মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের গর্ভপাত সংক্রান্ত নতুন রায়ের ফলে। প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে 1973 সালের একটি মামলা, 'রো বনাম ওয়েড' এর ক্ষেত্রে  গর্ভপাতকে আইনসিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই কেস-হিস্ট্রি মেনেই এতদিন চলছিল মার্কিন আদালতগুলি। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতের গর্ভপাতকে নিষিদ্ধ করার এই রায়দানের ফলে, একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছেও এক আশ্চর্যজনক চূড়ান্ত রক্ষণশীল মনোভাব প্রকাশের ফলে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার প্রশ্নে দেশটা পিছিয়ে গেছে অনেকখানি। পাশাপাশি উল্লাসধ্বনি শোনা গেছে ভ্যাটিক্যানের প্রচারযন্ত্রেও, যা বহুকাল ধরেই জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করে আসছে।

এই সাম্প্রতিক আইনের কারণে জননের স্বাধীনতা বা রিপ্রডাক্টিভ লিবার্টি ভয়ানক ভাবে ক্ষুণ্ন হতে চলেছে সে দেশের নাগরিকদের।

অথচ, একটু গভীরে গিয়ে দেখলে, আধুনিক মানবসভ্যতার ইতিহাসে কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই প্রারম্ভিক পর্যায়ে গর্ভপাতের অধিকারকে স্বীকৃতিই দেওয়া হয়েছে। ইসলামি দেশের আইনও লক্ষ রেখেছে মায়ের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি। বলেছে ধর্ষণ এবং incest বা পরিবারের অভ্যন্তরে যৌন সম্পর্ক হলে এবং আর্থিক বা সামাজিক কোনও যথাযথ কারণ থাকলেও গর্ভপাতকে বৈধ বলে মানা হবে। যদিও দেশভেদে নিয়মের হেরফের রয়েছে কিন্তু তুরস্ক ও তিউনিশিয়ায় শর্তহীন গর্ভপাতও আইনের মান্যতা পেয়েছে।

ইতিহাস বলছে প্রাচীন ইওরোপে গ্রীক ও রোমান সভ্যতায় এ বিষয়টি নিয়ে খুব বেশী মাথাব্যথা ছিল না শাসকের। অ্যারিস্টটল তাঁর 'পলিটিক্স' গ্রন্থে, গর্ভাধানের প্রথম কয়েকটি সপ্তাহের মধ্যে প্রয়োজনে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণকে সমর্থনই জানিয়েছিলেন। তবে গর্ভাধানের পরবর্তী পর্যায়টিতে, যাকে quickening বা ভ্রূণের নড়াচড়ার সময়কাল বলা হয়, সেক্ষেত্রে গর্ভমোচনের অনেক দেশের আইনই বেশ কড়া, কারণ সে সময়ে জননীর প্রাণসংশয়ের বিষয়টিও সামনে চলে আসে বইকি।

ওল্ড টেস্টামেন্ট অবশ্য বিষয়টি দেখেছে অন্যভাবে। সন্তান তার চোখে আদতে তার জনকের 'সম্পত্তি'। যদি কোনও ঘটনায় দুটি বিবদমান পুরুষের মধ্যে পড়ে কোনও সন্তানসম্ভবা নারীর গর্ভপাত ঘটে যায়, তবে অপরাধী পুরুষটি অজাত সন্তানের জনক এবং আদালতের বিচার অনুযায়ী জরিমানা দিতে বাধ্য। আর এর ফলে যদি নারীটিরও মৃত্যু ঘটে তাহলে... a tooth for a tooth, an eye for an eye.... চোখের বদলে চোখ, প্রাণের বদলে প্রাণদণ্ড!

প্রকৃতপক্ষে বাইবেলে গর্ভপাত সংক্রান্ত কোনও নিদান নেই, কিন্তু যে হারে ঈশ্বরসৃষ্ট প্রাণের নিধন চরম অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে সেখানে, তাতে খ্রীষ্টধর্মে প্রকারান্তরে গর্ভপাতও সমানভাবে অনভিপ্রেত বলে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

আর হয়তো ভাবনার এই ছিদ্রপথেই নারীর অধিকারকে মারণ দংশনের কালসর্প প্রবেশ করেছে মার্কিন আদালতে।

নিজের দেশের দিকে, বিশেষ করে বাংলার দিকে, আরও ভাল করে বললে কলকাতা শহরের দিকে যদি নজর ঘোরাই তাহলে দেখব উনিশ শতকে সেখানে অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারেই গর্ভপাত একটি সাধারণ বিষয়। পরিবার পরিকল্পনা সেকালের মানুষের আয়ত্তে ছিল না এটা মোটেই কোনও কারণ নয়, যেহেতু বিবাহিত দম্পতিরা বেশ কিছু সন্তানের গর্বিত জন্মদাতা ছিলেন। আসল কারণ ছিল সমাজ অননুমোদিত সম্পর্কের ফলে গর্ভসঞ্চার। বাল্যবিধবাদের জীবন যে কী পরিমাণ দুর্বিষহ ছিল এক্ষেত্রে, তা ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ সংক্রান্ত আবেদনের মধ্যেই স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান রয়েছে।

হুতোমের বর্ণনায় সেকালের সমাজজীবনের  বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়:

“আমরা বেস জানি অনেক বড় মানষের বাড়ি, মাসে একটি করে ভ্রূণহত্যা হয় ও রক্ত কম্বলের শিকড়, চিতের ডাল ও করবীর ছালের, নুন তেলের মত উঠনো বরাদ্দো আছে! যেখানে হিন্দুধর্ম্মের অধিক অধিক ভড়ং, যেখানে দলাদলির অধিক ঘোঁট ও ভদ্রলোকের অধিক কুৎসা, প্রায় সেখানেই ভেতর বাগে উদোম এলো...” (বানান অপরিবর্তিত)।

সে সময়ে নারীর অবস্থান জানলে যে কোনও আত্মসম্মানজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের ক্ষোভের অন্ত থাকে না:

“এমনকি একজন বড় মান্ষের বাড়ির পাশে একটি গৃহস্থের সুন্দরী বউ কি মেয়ে নিয়ে বাস করবার যো নাই... যত দিন সুন্দরী বাবুর মনস্কামনা পূর্ণ না কর্ব্বে তত দিন দেখতে পাবেন বাবু অষ্ট প্রহর বাড়ির ছাদের উপর কি বারাণ্ডাতেই আছেন, কখন হাঁসচেন, কখন টাকার তোড়া নিয়ে ইসারা করে দ্যাখাচ্চেন, এ ভিন্ন মোসাহেবদেরও নিস্তার নাই, তাঁরা যত দিন তাঁরে বাবুর কাছে না আনতে পার্ব্বেন, তত দিন মহাদায়গ্রস্ত হয়ে থাকতে হবে... ক্রমে কলে কৌশলে সেই সাধ্বী স্ত্রী বা কুমারীর ধর্ম্ম নষ্ট করে শেষে তাড়িয়ে দেওয়া হবে- তখন বাজারে কশব করাই তার অনন্য গতি হয়ে পড়ে। শুধু এই নয়; সহরের বড়  মানুষরা অনেকে এমনি লম্পট যে, স্ত্রী ও রক্ষিত মেয়ে মানুষ ভোগেও সন্তুষ্ট নন, তাতেও সেই নরাধম রাক্ষসদের কাম ক্ষুধার নিবৃত্তি হয় না- শেষে ভগ্নি ভাগনি- বউ ও বাড়ির যুবতি মাত্রেই তাঁর ভোগে লাগে- এতে কত সতী আত্মহত্যা করে বিষ খেয়ে এই মহাপাপীদের হাত এড়িয়েচে।”

সেই সময় থেকে পঞ্চাশ বছর পরে ইওরোপের নারীর অবস্থা কি খুব আলাদা ছিল? মারি ফারারের ভ্রূণহত্যার কথা মনে আছে কি? সেই যে সাদাসিধে একটা মেয়ে, অপ্রাপ্তবয়স্ক, কুমারী, অনাথ, জন্ম এপ্রিল মাসে, কারো কামনার শিকার হয়েছিল? ব্রেখটের লেখা কবিতা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ও কেয়া চক্রবর্তীকৃত বাংলা অনুবাদ আমাদের বলে:

মশাইরা, রাগ ঘৃণাকে আটকান-

কেন রাগ, কেন ঘৃণা? কারণ মারি ফারার নিজের হাতে তার সন্তানকে হত্যা করেছিল।

বাচ্চাটা যখন সকলের অগোচরে গভীর রাতে স্নানাগারে জন্ম নিয়েছিল আর তারপর হঠাৎ প্রাকৃতিক নিয়মেই চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল, তখন লোক জানাজানির ভয়ে, কাজ চলে যাওয়ার ভয়ে নিরূপায় জননী মারি তাকে প্রবল কিল চড় ঘুঁষিতে চুপ করিয়ে দিয়েছিল। ঠান্ডা শীতের রাতে আরো কনকনে শীতল সন্তানের শরীরটাকে বুকে আগলে রেখে, ভোরবেলা আলতো করে  শুইয়ে দিয়েছিল আস্তাবলের মাটির নীচে। এতে যদি অপরাধ না হয়, অপরাধ আর হবে কীসে! তাই শাস্তিস্বরূপ মারিকেও জেলের অন্ধকারে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল।

মারি ফারার, অপ্রাপ্তবয়স্ক কুমারী জননী, একজনের কামনার শিকার হয়েছিল।

আরো কত মেয়ের গল্প বলেছেন ইসমত নামের সাহিত্যিক। মারির মতোই ভাগ্যবিড়ম্বিত তারা।

পুরুষ সঙ্গীর অসাবধানতায় অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে তাদের জন্য দাওয়াই ছিল মুঠি কিম্বা মালিশ। মালিশ হল পূর্ণগর্ভার পেটের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে লাফানো।

মুঠির বিষয়টি  কিছু অন্যরকম।

জরায়ু মুখে হাত ঢুকিয়ে ভ্রূণের শরীরকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে আনা। হ্যাঁ ঠিক পড়েছেন।

কিন্তু বাবু বিবিরা, ক্রোধ ঘৃণাকে আটকান- কারণ যে জন্মেছে, আর যে জন্মায়নি, সে জন্মানোদের সাহায্য চায়।

পৃথিবীর অধিকাংশ পুরুষের কাছে যা নিতান্তই সম্ভোগ, যার ফলে অক্লেশে এক নারী থেকে অন্য নারী বা অন্য বিষয়ে বিচরণ, পৃথিবীর অধিকাংশ নারীর কাছে তা মধুর মিলন। মিলনের সেই মধুরিমা সে বহন করে চলে তার মনে। শুধু সন্তানই বহন করে না। কিন্তু তার মনের মাঝের সুধা চায় কে!

তাই শুধুই রমণী কিম্বা জননী হয়ে থাকা!

কথার প্রবাহে অনেকেই একথা ভুলে যাবেন যে মেয়েদের মা হওয়া বা না হওয়ার স্বাধীনতা প্রথম যে দেশে স্বীকৃত হয়েছিল 1920 সালে, সে দেশটির নাম ছিল সোভিয়েত রাশিয়া। আর তার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এর নাম অবধারিত ভাবেই ছিল ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন।

এবং উনিশ শতকের যে মানুষটি বলেছিলেন, দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নরনারীর সম্পর্ক শুধু তারা দুজনেই নির্ধারণ করবে, সেখানে রাষ্ট্রের কোনও ভূমিকা থাকবে না, তিনিও ঘটনাচক্রে দক্ষিণপন্থী ছিলেন না। তাঁর নাম ছিল ফ্রেডরিক এঙ্গেলস।

একটি ব্যাপার দেখে রীতিমতো কৌতুক বোধ হচ্ছে, দক্ষিণপন্থার পৃষ্ঠপোষক সংবাদপত্রগুলোও এই জঘন্য রায়দানকারী বিচারপতিদের দক্ষিণপন্থী বলে গাল দিচ্ছে!

মার্কিন মুলুকের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের দেশের ফ্যাসিবাদী সরকার মেয়েদের নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে কী আইন আনবে আর সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগে পাশও করিয়ে নেবে, কে বলতে পারে!

 


New
বিদায় পিটি নায়ার: কলকাতার ইতিহাসবেত্তা
এগজিট পোল মিলে গেলেও যে প্রশ্ন উঠবেই
কংগ্রেস সেঞ্চুরি না করলে কে রুখবে বিজেপিকে?


Other Writings by -সঞ্চারী সেন | 28-06-2022

// Event for pushed the video