শিল্পীর শিল্প কালোত্তীর্ণ হয় মানুষের দেওয়া শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সরকারের দেওয়া রাষ্ট্রীয় খেতাবে নয়
‘কী মিষ্টি দেখো মিষ্টি, কী মিষ্টি এ সকাল', সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের এই জনপ্রিয় গানটির মতোই বাঙালির স্বভাবচরিত্রও ভারী মিষ্টি স্বভাবের— এমনই ধারণা পোষণ করে থাকেন অনেকে। কিন্তু বাঙালির গোপন ব্যথা যে এভাবে বাঙ্ময় হয়ে উঠবে, তা কি আর আনুগত্য-প্রত্যাশী রাষ্ট্রশক্তি ঘুণাক্ষরেও জানত?
একটু তলিয়ে দেখলে অবশ্য দেখা যাবে, আজকের গড়পড়তা বাঙালি যতই গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসাতে অভ্যস্ত হোক না কেন, বাঙালি চরিত্রের মধ্যে প্রতিস্পর্ধা খুব বিরল ছিল না। 2022 সালে কেন্দ্রের পদ্ম-সম্মান ঘোষণাকে কেন্দ্র করে যে বিতর্ক, সেই বিতর্ককে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেল এই প্রতিস্পর্ধাই।
একজন শিল্পী খেতাবের প্রত্যাশায় শিল্পকে রূপদান করেন না। কিন্তু তাঁর শিল্পের বিশিষ্টতা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রত্যাশা করে। সমাজের মূলস্রোতও একজন শিল্পীর মহত্ত্ব বিচার করে এই প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির নিরিখেই। কিন্তু যে শিল্পী তাঁর শিল্পগুণে কালোত্তীর্ণ হন এবং সেই শিল্পগুণের প্রতি প্রত্যয় তাঁর নিজেরও থাকে, তিনি প্রতিষ্ঠান বা প্রাতিষ্ঠানিকতার ধার ধারেন না। অনেক সময় আবার প্রতিষ্ঠানকে বিদ্রুপ করেই শিল্প সুষমামণ্ডিত হয়। আপাতদৃষ্টিতে চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমাগুলির জনপ্রিয়তার পিছনে নির্মল হাস্যরসকে কারণ বলে মনে হলেও, আদতে সেগুলির মধ্যে ছিল তীব্র ফ্যাসিবাদ-বিরোধী বার্তা।
কলকাতার এক জনপ্রিয় গায়ক লিখেছিলেন, ‘যদি ভাবো কিনছ আমায় ভুল ভেবেছ'। প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের একাংশ মনে করেন শিল্প ও শিল্পীর বিরুদ্ধাচারণকে স্বীকৃতি দিলে শুকনো কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই তাঁরা শাসকের পক্ষে থাকবেন। কৃতজ্ঞ থাকার এই আশঙ্কা থেকেই বোধহয় জাঁ পল সাত্রেঁরা নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখান করেন, বাংলার শিশির ভাদুড়ি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়রা বিনা দ্বিধায় সরকারি পুরস্কার গ্রহণের প্রস্তাব নাকচ করেন।
দেশ বিদেশের কম বেশি সব পুরস্কার পাওয়ার অন্যতম একটি শর্ত হল শাসকের গুডবুকে নিজের নাম তুলে রাখা। সেই শর্ত পূরণের নিরিখেই এই দেশে জনৈক অভিনেতা কিংবা গায়ক চল্লিশোর্ধ্ব বয়সেই সর্বোচ্চ পদ্ম সম্মান পদ্মবিভূষণ পেয়ে যান, কিন্তু নবতিপর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় প্রায় জীবন সায়াহ্নে এসে পদ্মশ্রী পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন! অভিমানাহত সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় পদ্মে শোভিত হতে না চেয়ে তাই অক্লেশে বলে দেন, পুরস্কার তাঁর প্রয়োজন নেই, শ্রোতাদের ভালবাসাই তাঁর পুরস্কার।
স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতা-উত্তর বাঙালি মধ্যবিত্ত সম্পর্কে একটা বড় অভিযোগ ওঠে যে ক্ষমতার চাল কলা মূলো পেতে তারা শাসকের সঙ্গে থেকেছে বরাবর। প্রাজ্ঞজনেরা বলেন, বাঙালির চরিত্রেও বিবাদ-বিসংবাদ বিবর্জিত হয়ে নির্বিঘ্নে কালাতিপাত করার প্রবণতা আছে। কিন্তু সুমিষ্ট স্বভাবের বাঙালির মধ্যেও যে এত দ্রোহ ছিল তা কে জানত? জ্যোতি বসু কিংবা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পুরস্কার প্রত্যাখানের মধ্যে তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থান সহ আরও অন্যান্য বিষয় সংশ্লিষ্ট। কিন্তু শিশিড় ভাদুড়ি থেকে বাদল সরকার— রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রত্যাখানে বাঙালি মনীষা যে নজির রেখেছে, তার সমতুল কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না৷ নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ি ভারতবর্ষের প্রথম ব্যক্তি, যিনি পদ্ম-পুরস্কার প্রত্যাখান করেছিলেন।লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যারা পুরস্কার প্রত্যাখান করেছেন তাঁদের খ্যাতি বা পরিচিতি এই পুরস্কার না নেওয়ার জন্য এক ছটাকও কমেনি। বরং এঁরা এঁদের কাজ ও দৃঢ়চেতা মানসিকতার জন্য এক স্বাতন্ত্রতা বজায় রাখতে পেরেছেন। বাংলা ও বাঙালির এই দুর্দিনে এই স্বাতন্ত্র্যবোধই কি বাঙালির অভিজ্ঞান হবে?