4thPillar


কর্পোরেট-মন্ত্রে আবেগরুদ্ধ বাংলার ফুটবল

বিতান ঘোষ | 27-11-2021July 7, 2023
কর্পোরেট-মন্ত্রে আবেগরুদ্ধ বাংলার ফুটবল

সব খেলার সেরা আছে কিনা জানা নেই, তবে 
ফুটবলটাই আর বাঙালির নেই !  

ইলিশের পেটটা আলতো টিপে নিশিকান্তবাবু টিপ্পনী কাটলেন, ‘‘আমরা হচ্ছি গিয়া বাঙালের পোলা, আজ ঘটিদের কম সে কম হাফ ডজন গোল দিয়াই দিমু।’’ বাজারে হন্যে হয়ে গলদা চিংড়ির সন্ধান করা প্রমথেশবাবু প্রত্যুত্তরে বললেন, ‘‘খালি আপনাদের বক্তিমে। ওই যেমন বলেন, দ্যাশে আমাদের অমুক ছিল, তমুক ছিল। আরে মশাই লিখে রাখুন, আমরা অন্তত দু'জোড়া গোল দেব আপনাদের।’’

 

মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল এই দ্বৈরথ, ঘটি-বাঙাল তর্কযুদ্ধ বাঙালির চিরন্তন কিছু ঐতিহ্যের অন্যতম। শুধু কি খেলা? নাকি খেলার বাইরেও আরও বেশি কিছু? দেশভাগ দেখা বাংলা, দু'বার উদ্বাস্তু স্রোত দেখা বাংলায় এই ফুটবল দ্বৈরথ নিছক দুই প্রধানের ফুটবল নৈপুণ্যের লড়াইতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, কত স্বপ্ন, কত স্বপ্নভঙ্গের সাক্ষী থেকেছ ময়দান। বাংলার বিস্তীর্ণ কলোনি অঞ্চলে ইস্টবেঙ্গল শব্দটা কোথাও গিয়ে আত্মপরিচয়ের প্রতীক। ইন্টারনেটহীন, কালার টিভি হীন, ঘনঘন লোডশেডিং কবলায়িত সে দিনের বাংলায় তবু গোটা পাড়া ভেঙে পড়ে কোনও এক সম্পন্ন গেরস্থের রেডিও'র সামনে। ওই জমায়েত জানে ইস্টবেঙ্গলের একটা গোল বা একটা জয় তাদের রিফিউজি অভিধা ঘুচিয়ে আত্মসম্মান প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।

 

উত্তর কলকাতার গলি, তস্য গলির অন্দরে পতপত করে ওড়ে সবুজ-মেরুন পতাকা। খেলা শুরুর আগে বাড়ির থালা-বাটি বাজিয়ে, মোহনবাগানের নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে মিছিল করে যায় তরুণ ছেলেপুলেরা। মোহনবাগান তাদের কাছে ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের প্রতীক। বাবা, দাদুর মুখে 1911-র শিল্ড জয়ের গল্প শুনে এদের মনে হয়, মোহনবাগান জাতীয়তাবাদের প্রতীকও বটে।

 

কয়েক বছর আগেও এই জমায়েত, এই মিছিলের দেখা মিলত পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায়, পরগনায়। ভুবনায়নের দুর্বার স্রোতেই কিনা জানা নেই, এই সব ছেলে, এই সব পাড়া কোথায় যেন হারিয়ে গেল। এদের উত্তরাধিকাররা কেউ শিফট করল বেঙ্গালুরু, কেউ বা পোস্টেড হল সুদূর টরেন্টোয়। সমর্থকদের একাংশের ভালবাসায়, সক্রিয় উদ্যোগে কোনওক্রমে রয়ে গেল এই দুই যুযুধান ফুটবল ক্লাব। মহামেডান কিংবা টালিগঞ্জ অগ্রগামীর মতো তারা প্রায় হারিয়ে গেল না।

 

এখনও দুই দল ময়দানে নামে, ক্রীড়াসূচি মেনে ইস্ট-মোহন দ্বৈরথও হয়। কিন্তু গত দু'টো দশকে বদলে গেছে অনেক কিছুই। পূর্বের আইএফএ শিল্ড, ফেডারেশন কাপ কিংবা কলকাতা লিগ তাদের কৌলীন্য হারিয়েছে বহু দিন হল। দেশের সর্বাপেক্ষা সম্ভ্রান্ত লিগ এখন ইন্ডিয়ান সুপার লিগ। দেশের জনৈক ধনকুবেরের সংস্থা এখন মোটা টাকা ঢালে এই লিগটির জন্য। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে "আধুনিক' হতে হয় মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলকে-ও। কিন্তু আধুনিক তো শুধু মননে হলে চলবে না, তার জন্য আরও পরিকাঠামো চাই। চাই আরও আরও টাকা। সেই টাকা জোগাবে কে? তার জন্য গালভরা কয়েকটি নাম আছে। যেমন, স্পনসর, ইনভেস্টর ইত্যাদি৷ বহিরঙ্গে এদের ভাবখানা এমন যেন তারা সংশ্লিষ্ট ক্লাবের ফুটবল উন্নতিকেই জীবনের ধ্রুবতারা করেছে, কিন্তু মনোভাবটা সেই দখলদারিরই। তাই আজ সব কিছুই বড় ঝাঁ চকচকে। গ্যালারি, টিম ম্যানেজমেন্ট, বিদেশি কোচ, টিভি স্বত্ব— সবই ভীষণ ঝাঁ চকচকে, কেতাদুরস্ত। মনোরঞ্জনের উপাদানও নেহাত কম মজুত নয়।

 
কিন্তু যে ফুটবল বাঙালির কাছে আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার লড়াই ছিল, ঐতিহ্য রক্ষার লড়াই ছিল, সেই ফুটবলটা কোথায় হারিয়ে গেল? নয়ের দশকের শেষ দিক থেকে দেশে মুক্ত অর্থনীতির জোয়ারে অনেক কিছুই ভেসে গেছে। বাঙালির শিল্প, কৃষ্টি, সংস্কৃতির অনেকাংশও তাতে ভেসে গেছে। কিন্তু তার পরও যে জিনিসটা বাঙালি বড় আপন করে রেখেছিল, তা হল তার ফুটবল। ফুটবলের মক্কা কলকাতার দুই প্রধানের এক একটা গল্প যেন এক একটা কিংবদন্তি। ক্লাবকর্তাদের হাতযশে অন্য টিম থেকে প্লেয়ার তুলে আনা, ম্যাচের আগের "ভোকাল টনিক' কিংবা অভূতপূর্ব কৌশল "ডায়মন্ড সিস্টেম'— এ সবের পিছনে বিশুদ্ধ পেশাদারিত্ব থাকলেও, একইসঙ্গে ছিল একটা আবেগ, শিকড়ের প্রতি অমোঘ টান। এখন সেই রামও নেই, অযোধ্যাও নেই। তাই শতবর্ষের ডার্বি নিয়ে মিডিয়া নিনাদিত হলেও, কর্পোরেট প্রভুদের কাছে বাঙালির উচ্ছ্বাস, আবেগের আতিশয্যও নিয়ন্ত্রিত, সংযত। এই প্রজন্ম আবেগের অভ্যাসটা কাটিয়ে উঠলে এই পেশাদারি দুনিয়ায় ঠুনকো আবেগের কদর থাকবে কিনা সন্দেহ।


New
আয়ুর্বেদ চিকিৎসকরা কি অ্যালোপ্যাথদের সমান?
মাদক ব্যবসা ও বিভাজনের রাজনীতির আবর্তে আজকের মণিপুর
ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে রাষ্ট্রীয় মদত? বিস্ফোরক রিপোর্ট অসম রাইফেলসের


Other Writings by -বিতান ঘোষ | 27-11-2021

// Event for pushed the video