বাঙালির সুকুমারি মন, ননসেন্স রাইমস লিখেও এখানে প্রফেট হওয়া যায়, গবেট নয়।
"আজি হতে শতবর্ষ পরে, কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি, কৌতূহল ভরে....'
খ্যাতিমান কবির মনেও তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে যেটুকু সংশয় ছিল, সেই সংশয়ের লেশমাত্র নেই শাসকের মধ্যে। শাসক নিঃসন্দিগ্ধ, ভাবনায় অবিচল যে সে কালোত্তীর্ণ। সাহিত্য, সমাজসেবা, চিকিৎসাবিজ্ঞান সবেতেই সে কৃতিত্বের দাবিদার। আধুনিক বিশ্বের পপুলিস্ট লিডারগুলো তো নাচতেও পারেন, গাইতেও পারেন, ছবিফবিও আঁকতে পারেন। ফ্যাসিগুলো (ফ্যাসিবাদী) তুলনায় সত্যবাদী। হিটলার যে অমন সুন্দর ছবি আঁকতেন, নারী ও সুরায় যে তাঁর কোনও আসক্তি ছিল না, তাই নিয়ে তিনি কি কোনওদিন মুখ ফুটে কিছু বলেছেন? বদনামের ভাগীদারই হয়েছেন শুধু। এই নিয়ে আফসোস হওয়া উচিত নব্য নাৎসিদের।
আর এদের সব এত স্তাবক, এত মোসাহেব তবু কী কিম্ভূতকিমাকার সব উপাখ্যান৷ নাকি রবীন্দ্রনাথ এসে পুরস্কৃত করে যেতেন! নিজেদের মধ্যমেধাকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দেওয়ার জন্য রবিঠাকুরকে বাঙালি এলিট সমাজ কেন বারবার ধার করে বোঝা যায় না। আরে বাবা, মোসাহেবি করারও তো নানা প্রকরণ আছে। তার জন্য রীতিমতো চর্চা ও অনুশীলন করতে হয়।
এই যে মস্ত এক যুদ্ধ চলছে ইউরোপে। ধুন্দুমার ব্যাপার। এদিকে মানবতার ভূলুন্ঠন নিয়ে ছিচিক্কার ব্যাপার! গরমটা আর একটু কমলেই কলকাতায় একটা যুদ্ধবিরোধী মিছিল বাঁধা। পুতিনের খান ছয়েক কুশপুতুল বানাতে দেওয়াও হয়েছে বলে সূত্রের খবর। এই হিংসা, সাম্রাজ্যবাদী আস্ফালনের সম্মুখে এক শাসক কবিতা লিখেছেন, কী বলো শশীকান্ত, একি অমার্জনীয় অপরাধ? কালাসনিকভ দিয়ে পড়শি দেশের লোকজনকে দুম ফটাস না করে, তুলি দিয়ে এঁকেছেন। হোক না সেই কাব্যি বা ছবি অং বং চং, তবু শাসকের মনের এক মর্মস্পর্শী তল তো খুঁজে পাওয়া যায়।
চোখ বুজে বলা যায়, এই এটুকু বললেই বাঙালির চোখের জল ভিজে যেত। সমালোচনা ছেড়ে বাঙালি টিস্যু খুঁজত। তীব্র পুরুষকারের সম্মুখে বাঙালি বুক চিতিয়ে বলত, বারুদের মাঝে সৃষ্টির কুঁড়ি আমরাই ফোটাতে পারি! তা নয় সটান রবীন্দ্রনাথ। তা রবীন্দ্রনাথ এসে পুরস্কার দিলেই সমালোচনা, হাসি, মস্করা থেমে যেত বুঝি? সুকুমার রায় অমন ননসেন্স রাইমস লিখেও অনেকের কাছে প্রফেট হয়েছেন; গবেট তো হননি। এই সব ভাবনার জন্য সুকুমারী মনোবৃত্তি চাই।
তৈলমর্দন এক শুভ কাজ, যদি অবশ্য শাসক তাতে প্রসন্ন হন। তাই উচ্চাকাঙ্খী সুবোধ বালকেরা স্থানে অস্থানে সরকারকে তৈলমর্দন করে থাকে। সুযোগসন্ধানীরাও সেখানে ব্রাত্য থাকেন না। কিন্তু নিজেদের ধান্দাবৃত্তির সাফাইতে রবিঠাকুরকে এনেই এরা গন্ডগোলটা করেন। এর বাইরে এদের কোনও অস্ত্র নেই। সলমন খান সিনেমা করার পাশাপাশি সলমন রুশদির মতো সাহিত্য রচনা করতেই পারেন। কার মধ্যে কখন প্রতিভার বিচ্ছুরণ দেখা দেবে, সেকি আগেভাগে বলা যায়? আর সৃষ্টি যদি এত জনপ্রিয় হয়, তবে স্রষ্টা তো হবেনই। আবার উল্টোটাও সত্য। স্রষ্টা আগেভাগেই জনপ্রিয় হলে, তিনি যা-ই সৃষ্টি করবেন তাই জনপ্রিয় হতে বাধ্য। কিছু সৃষ্টি না করলেও অনুরাগীরা জোর করেই কিছু সৃষ্টি করে দেন বহুক্ষেত্রে। কালেভদ্রে পুরস্কারও জুটে যায়। কেন ব্যাটার ছেলে চার্চিলটা সাহিত্যে নোবেল পায়নি? ট্রাম্পও ইরান আর মেক্সিকোর সঙ্গে ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেললে নিশ্চিত ভাবে নোবেল পুরস্কারটা হাতিয়ে ফেলতেন!
রাজনৈতিক ভাবে বহু (জোড়া) ফুল ফুটিয়েছেন, তাই কাব্যি করে "শতফুল বিকশিত হোক' লিখলে কোনও গর্হিত অপরাধ হয়ে যায় না। বক, টক, লক— এমন করে অন্তমিল খুঁজে খুঁজে ছড়া লিখলেও বুঝতে হবে, শাসক গদির চিন্তা ছেড়েও আমার আপনার মতো অবসরে এসব উদ্ভট চিন্তা করে। শুরুটা বেশ ভালই হয়েছিল। বাঙালি কাঁকড়ার জাত, পুরস্কারপ্রাপক সাবঅল্টার্ন, তাই ভদ্রজীবীদের রাগ হয়েছে। এই লাইনে এগোলে ভালই এগোনো যেত। হঠাৎ লাইন বদলে রবীন্দ্রনাথকে আনতে গিয়েই গন্ডগোলটি হল। কেন দাদা, শাসকের কবিতা বা ছড়ার দুর্বোধ্যতা অতিক্রম করে তা হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা একা বুঝি রবিঠাকুরেরই আছে? আপনাদের কারও নেই বলছেন?