4thPillar


রুশ দেশের মোড়লমশাই ও লকডাউনে নারী

সঞ্চারী সেন | 21-04-2020July 9, 2023
রুশ দেশের মোড়লমশাই ও লকডাউনে নারী

আমাদের ছোটবেলায় জন্মদিনে বই দেওয়ার প্রথা ছিল। শুধুই বই। সেইজন্যই বন্ধুদের জন্মদিন এলেও দারুণ আনন্দ হত। নতুন নতুন রঙিন সব অত্যাশ্চর্য সৃষ্টি পালা করে ভাগ করে নেওয়া হ’ত কিছুদিনের জন্য। সেইরকম এক সময়েই হাতে এসেছিল একটি অপূর্ব বই। অপূর্ব, কারণ এমন সুন্দর একটি জিনিস এর আগে আমার চোখে পড়েনি। বাঁধানো সাদা রঙের মলাটের উপর অসাধারণ একটি তৈলচিত্র, সাদা ধবধবে পুরু, মসৃণ পৃষ্ঠা। নাম সম্ভবতঃ "রুশ ইতিহাসের কথা ও কাহিনী।’ সেখানে পড়া একটা ঘটনার কথা বলি।

 

রাশিয়ায় কোনও কারণে সে সময়ে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। গ্রামে গ্রামে রেশনিং করে গমের বস্তা পাঠানো হচ্ছে। একটি গ্রামের কিছু কৃষক এইজন্য খুব রেগেমেগে এলেন মস্কোর ক্রেমলিনে। উদ্দেশ্য, নালিশ জানাবেন উপরমহলে। ক্রেমলিনের চত্বরে নানা মানুষের জটলা। কাকে অভিযোগের কথা বলতে হবে বুঝতে না পেরে ইতস্তত করছেন, এমন সময় এক টাকমাথা, ছোটখাটো চেহারার লোককে দেখে কৃষকরা জিজ্ঞেস করলেন, "হ্যাঁ হে, এখানকার মোড়ল কোথায় বসেন?’

 

"মোড়ল?’

 

"আরে এখান থেকে যে দেশ চালায়!’

 

"ও আচ্ছা। ওই যে ওখানে।’

 

মৃদু হেসে সামনের একটা জটলার দিকে হাত দেখাল লোকটি। সে জটলায় নানা ধরনের মানুষ ছিল- শ্রমিক, কৃষক, একটু বেশি লেখাপড়া করা মধ্যবিত্ত। কৃষকদের কথা শুনে তারা অবাক। একজন বলল, "তোমরা তো দেখলাম লেনিনের সঙ্গে কথা বলছিলে, তিনি আমাদের আবার মোড়ল বললেন কেন!'

 

আরেকজন হেসে উঠে বলল, "ওহো হো বুঝলে না, আমরা শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্তরাই দেশ চালাই, এই কথাই লেনিন বলতে চেয়েছেন।' উপস্থিত সবাইকে খুশি দেখাল। তারপর তারাই লেনিনের সঙ্গে কী করে দেখা হবে সেই কথা বলে দিল।

 

লেনিন অর্থাৎ সেই ছোটখাটো মানুষটি খুব মন দিয়ে কৃষকদের কথা শুনলেন। তারপর বললেন, "হ্যাঁ, কমরেড, আপনারা যখন বলছেন, বুঝতেই পারছি আপনাদের অসুবিধে হচ্ছে। তবে আমাদের সোভিয়েত দেশও বেশ সংকটের মধ্যে রয়েছে। তবু আমি নিশ্চিতভাবে চেষ্টা করব। ভাল কথা, এতদূর থেকে এসেছেন, আমাদের ক্যান্টিন থেকে খাওয়া সেরে যান। "কৃষকেরা খুব খুশি, খোদ মোড়লের জায়গা বলে কথা! কিন্তু খাবার দেখে তাঁদের চক্ষুস্থির। একেবারে অখাদ্য জাউ, গলা দিয়ে নামতেই চায়না। ওদিকে পাশের টেবিলে লেনিন পরম তৃপ্তি সহকারে সেই খাবার খাচ্ছেন। ওঁদের সঙ্গে চোখাচুখি হতে বললেন, "জাউটা বেশ ভালো বানিয়েছে, কী বলেন!'

 

গ্রামে ফিরে গিয়ে কৃষকেরা এই মর্মে চিঠি লিখে পাঠালেন, আমরা ভেবে দেখলাম আমাদের আর গমের প্রয়োজন নেই, বরং আমাদের গ্রামে যে অতিরিক্ত আলুর ফলন হয়, তা আমরা দেশের খাদ্য ভাণ্ডারে পাঠাতে চাই।

 

আশা করি বিশ্বাস করবেন, এতদিন পরেও এই কাহিনি লিখতে গিয়ে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। এমন একটা দেশের স্বপ্ন তো আমাদের মধ্যেও চারিয়ে গিয়েছিল, যেখানে ছায়াছবির দেশের মতো, "খেতে ফসল আছে, গাছে ফল আছে, ফুল আছে, পাখি আছে - দেশে শান্তি আছে, সুখ আছে, হাসি আছে...।' সেই সময় অনেক মানুষই সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সাফল্য নিয়ে গর্বিত হতেন। রুমানিয়ার নাদিয়া কোমানেচি ছিল আমাদের ঘরের মেয়ে।

 

এ অবশ্য গেল ছেলেবেলার কথা। পরে বড় হতে হতে যখন নারীর অকিঞ্চিৎকর মূল্যের কথা টের পেলাম, পুরুষসমাজের মনোরঞ্জন করা ছাড়া, সে ঘরেই হোক বা বাইরে, তার আর কোনও উপযোগিতা নেই, এমনকী অধিকাংশ মেয়েও যখন দেখা গেল কিছুটা ভবিতব্য হিসেবে, কিছুটা বা খুশি মনেই ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে, বিশেষ করে রূপসীরা, কারণ সেদিক থেকে তারা পুঁজিপতি, এ কথায় হাসবেন না যেন, সৌন্দর্য্যও একরকম বিনিয়োগ বটে এ সমাজে, একটু তলিয়ে দেখলেই বুঝবেন ব্যাপারটা, তখন খুব হতাশ লাগত। হতাশা এই কারণে নয় যে আমার নিজের যথেষ্ট পুঁজি নেই (আবার হাসছেন!), আসলে এই অর্ধ-মূল্য নিয়ে বেঁচে থাকার কোনও মানে হয়না বলে। আমাদের দেশের পুরুষদের অধিকাংশেরই নারী সম্পর্কে ধারণা সামন্ততান্ত্রিক যুগেই পড়ে আছে। কেমন যেন একটা রিচুয়ালের মতো, নিজস্ব অঞ্চলে নতুন কোনও মেয়ে এলেই, এখানে অবশ্য মেয়ের বদলে অন্য শব্দের প্রয়োগ হয়, তাকে দখল করার প্রতিযোগিতা শুরু!

 

তাই যখন দেখলাম লেনিন বলেছেন, না তারও আগে জার্মানির বিখ্যাত সোশালিস্ট সমাজতাত্ত্বিক অগাস্ট বেবেল এর কথা বলে নেওয়া ভাল, তিনি লিখেছেন, "মানুষ তো শুধু পশু নয়, তার যে মনুষ্যত্ব আছে। তাই তার সবচেয়ে প্রবল শক্তিশালী প্রবৃত্তি শুধু শারীরিক প্রয়োজন মেটালেই পরিতৃপ্ত হয়না, যার সঙ্গে তার যৌনজীবনের মিলন হয়, তার সঙ্গে তার মনের মিলনের প্রয়োজন আছে।' ফ্রেডরিক এঙ্গেলসও তাঁর গ্রন্থে দু'জন নারী পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমাজ-নিরপেক্ষ স্বাধীন সিদ্ধান্তকেই একমাত্র গুরুত্ব দিয়েছেন।

 

এবার যাঁর কথা বিশেষভাবে হচ্ছিল, এঁদের উত্তরসূরী, লেনিন, রাশিয়ার শ্রমজীবী নারীদের এক সভায় বলেছিলেন, "সমস্ত সভ্য দেশে, এমনকী সবচেয়ে উন্নত দেশেও নারীরা আজ এমন অবস্থায় আছে যে তাদের পারিবারিক দাসীই বলা চলে। ...প্রায় এক বছর হল আমাদের এখানে স্বাধীন বিবাহ-বিচ্ছেদ প্রথা চালু হয়েছে। বিবাহিতা এবং অবিবাহিতা মায়েদের সন্তানদের মধ্যে সামাজিক মর্যাদার যে পার্থক্য ছিল... সেই সবই আমরা আইন জারি করে দূর করেছি।...'

 

এ মাত্র একশ’ বছর আগের কথা।

 

আর ক্লারা জেটকিন, নারী দিবস পালনের অন্যতম পথিকৃৎ, জার্মান কমিউনিস্ট নেত্রীর সঙ্গে আলোচনায়, সেসময়ে তরুণদের মধ্যে চালু হওয়া নির্বিচার যৌনতা প্রসঙ্গে লেনিন বলেছিলেন, ভালবাসা হল বায়োলজি এবং কালচারের সম্মিলিত রূপ। লেনিন নিজে যদিও এই বিষয়ে এক "বিষণ্ণ সন্ন্যাসী', তবু তিনি বিশ্বাস করেন, "কমিউনিজম সন্ন্যাস ধর্ম আনবে না- আনবে জীবনের আনন্দ, জীবনের শক্তি, আর তা আনতে সাহায্য করবে প্রেমে পরিতৃপ্ত একটি জীবনই।'

 

আরও একটু বৃহত্তর পরিসরে যদি যাই, সকলেই জানেন সে সময় সোভিয়েত (যার অর্থ কাউন্সিল) দেখিয়েছিল সামাজিক নিরাপত্তা কাকে বলে। দেশীয় সংকটে কাজ চলে যাওয়া, বেতন না পাওয়া, অভুক্ত থাকা, অকল্পনীয় ছিল। কারণ গোটা উৎপাদন ব্যবস্থাটাই ছিল একটি মানবিক রাষ্ট্রের হাতে।

 

এর পরে আর একটিই কথা বলবার থাকে, তা হল, এখন এই অবরুদ্ধ সময়ে যখন চারিদিকে গার্হস্থ্য হিংসার খবর, তাছাড়াও গোটা পৃথিবীতে "মি টু' সংক্রান্ত নালিশের আবহে এবং কনজ্যুমারিজমের বাজারে এমনকী গৃহললনাদের অবস্থাও যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে, নারীর সম্মানের পুনরুত্থানের প্রশ্নে এই দেড়শ’ বছর বয়সী দূরদর্শী লোকটিকে সেই রাশিয়ান চাষীদের মত মোড়ল না মেনে আমার আর উপায় কী!

 

 

হাতের কাছে থাকা বইগুলি-

 

নারী, অতীত বর্তমান ভবিষ্যতে: অগাস্ট বেবেল,  অনুবাদ: কনক মুখোপাধ্যায়।

 

নারী মুক্তির প্রশ্নে মার্কস এঙ্গেলস লেনিন স্তালিন, অনুবাদ: কনক মুখোপাধ্যায়।


New
বিদায় পিটি নায়ার: কলকাতার ইতিহাসবেত্তা
এগজিট পোল মিলে গেলেও যে প্রশ্ন উঠবেই
কংগ্রেস সেঞ্চুরি না করলে কে রুখবে বিজেপিকে?


Other Writings by -সঞ্চারী সেন | 21-04-2020

// Event for pushed the video