4thPillar


নিজবাসভূমে পরভাষী

ডঃ সুস্মিতা ঘোষApril 2, 2025
নিজবাসভূমে পরভাষী

বেঙ্গালুরুর এক ভদ্রলোক জনপ্রিয় সমাজমাধ্যম X হ্যান্ডেলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এই বলে, যে আরবান কোম্পানি নামে যে সংস্থাটি  গার্হস্থ্য নানা খুচরো কাজের জন্য যে লোক সাপ্লাই করে, তারা তার অর্ডারটি ক্যান্সেল করেছে। তিনি চেয়েছিলেন তার বাথরুম পরিষ্কার করার জন্য যে লোক ওরা সরবরাহ করবে, সে যেন কন্নড় বলতে পারে। আরবান কোম্পানির তরফে যে ক্ষমাপ্রার্থনার উত্তর X প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে চিরাচরিত দায়সারা কর্পোরেট উত্তর ফুটে উঠেছে: এখন পারলাম না, ভবিষ্যতে চেষ্টা করব ইত্যাদি।  

এই চাপান উতোর যে সমাজমাধ্যমে সাড়া ফেলেছে তাতে সন্দেহ নেই। এনডিটিভি থেকে শুরু করে আরও অনেক খবরের চ্যানেল প্রকাশ করেছে এই ঘটনাটি। ভদ্রলোকের সমর্থক অবশ্যই বেশ কিছু আছেন, বিশেষ করে কন্নড়ভাষী X ব্যবহারকারীর দল। কিন্তু এনডিটিভি সাইট এ দেখলাম সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। লোকে ভদ্রলোককে রীতিমতো ট্রোল করা শুরু করেছে। কেউ বলছে, তিনি প্রতিবাদ পোস্টটি যদি ইংরেজিতে লিখে থাকতে পারেন, তাহলে তিনি ইংরেজিও জানেন। ইংরেজী জানা সত্ত্বেও কন্নড়ভাষী গার্হস্থ্য কাজের সহায়ক চাইছেন, শুধুমাত্র রাজনীতি করবেন বলে! সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনি ইংরেজিতে পোস্ট লিখেছেন, কারণ তিনি এখনও ব্রিটিশদের পদ-লেহনকারী !

কিন্তু খোদ বেঙ্গালুরুবাসী কন্নড়ভাষীকে বাড়ির মধ্যে কন্নড়ে কথা বলার জন্য ট্রোল করার রাজনীতিকে যদি বাদ দেওয়া যায়, এমন কি ভাষার প্রতি আবেগকেও যদি বাদ দেওয়া যায়,  তাহলেও দেখা যায় আমাদের বহুভাষিক, বহুমাত্রিক দেশে স্থানীয় ভাষা বা মাতৃভাষার দৈনন্দিন কাজে এখনও অনেক প্রয়োজন আছে। 

এই যেমন, এই আরবান কোম্পানি সংক্রান্ত এই উদাহরণটিই  ধরা যাক না কেন। এই কোম্পানি বড় বড় বিজ্ঞাপন দেয় যে ওদের কাজ এত-ই নিখুঁত যে কোন‌ও নজর রাখার প্রয়োজনই  হবে না।  এই কথাটিই অর্ধসত্য। অনেকেই চান তার ঘর গেরস্থালির কাজ তার নিজের হুকুম অনুযায়ীই হোক। প্রবীণদের মধ্যে এটা তো খুবই দেখা যায়।  কন্নড় ভদ্রলোকটি খুব খুঁটিয়ে না লিখলেও এরকম কিছু ইঙ্গিত করেছেন বৈকি।  হয়ত তার বাবা বা মা চান নিজের পছন্দ অনুসারে ঘর বাথরুম পরিষ্কার করাতে এবং এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক হতে পারে যে, তারা কন্নড় ছাড়া অন্য কোন‌ও ভাষায় ততটা স্বচ্ছন্দ না। 

শুধু এদের কথা কেন, বেশির ভাগ মানুষই স্বীকার করবেন যে, ঘর গেরস্থালির কাজে সহায়ক হিসেবে তাদের প্রথম পছন্দ হবে সেইসব মানুষকেই, যাদের সঙ্গে ভাষার ব্যবধান নেই, বা কম। হয়ত সেই কারণেই এখনও বাঙালি কর্তা গিন্নিরা “হিন্দুস্থানী” সহায়ক দিয়ে কাজ করাতে গেলে প্রবল উৎসাহে হাস্যকর হিন্দি বলেন। মাথায় থাকে, ওরা তো বাংলা জানে না (বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রে তারা কিন্তু জানেও )।

কয়েক দশক আগেও কিন্তু ভারতের জনগণ অন্য প্রদেশে কর্ম সূত্রে গেলে তাড়াতাড়ি স্থানীয় ভাষাটা শিখে নিত, ঠিক এই কারণে। দোকান বাজার করার জন্যেও প্রয়োজনীয়তা তো ছিলই।  এখন কিন্তু চিত্রটা অনেক পাল্টে গেছে। ভারতের বড় বড় শহরে দোকান বাজার করার জন্য স্থানীয় ভাষা জানার প্রয়োজন আর নেই, কারণ এখন অনেকেরই প্রথম পছন্দ অনলাইন কেনাকাটা।  সেইখানে app গুলি ব্যবহারকারীর মাতৃভাষায় হোক না হোক, তেমন কিছু যায় আসে না।

গৃহ সহায়ক/সহায়িকা খোঁজার ক্ষেত্রে বিশেষ করে বাঙালিদের এখনও চাহিদা তাদের নিজেদের মাতৃভাষা বলা লোকজন। এখন এই চাহিদা পূরণের অনেক উপায় আছে। এজেন্সি মারফত সহকারী আনানো  অনেক দিনের পুরোনো পদ্ধতি এবং দক্ষিণাও প্রচুর। প্রবাসী যেসব বাঙালিদের সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপ আছে, তাতে হামেশাই বিজ্ঞাপন দেখা যায় বাঙালি রাঁধুনী ও গৃহকর্মী চেয়ে। একজন আর একজনকে রেফারেন্স দিয়ে লোকের জোগাড় তো করেই, এখন অনেক সহায়কের নিজেরই একাউন্ট আছে। বলাই বাহুল্য, এই সব সহায়ক প্রবাসী, অর্থাৎ লোকাল সাপ্লাই। একজন গেলে আর একজন আসে। 

সারা ভারতের যে কোনও শহরে কন্নড় বা মরাঠি ভাষী সহায়ক ঠিক ততটাই সহজে পাওয়া যায় কিনা সেটা ঠিক বলতে পারব না। বাঙালি বা বাংলাভাষী প্রবাসী ছড়িয়ে পড়েছে সারা ভারতের প্রতিটি বড় শহরে এবং তাদের  সবরকম উচ্চপদের চাকুরি থেকে ফাই ফরমাস খাটার সংগঠিত এবং খুচরো ক্ষেত্রেও দেখা যায়। এই যে কন্নড়ভাষী ভদ্রলোক, এনার পোস্ট সংক্রান্ত নানা কমেন্টেও মনে হয় প্রচুর বাংলাভাষী এই আরবান কোম্পানির ছাতার তলায় কাজ করে। এদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো বাংলাদেশীও আছে। সেটা অবশ্য অন্য বিতর্কের প্রসঙ্গ, কিন্তু এই শ্রমিকরা বাংলার সঙ্গে হিন্দিও বলতে পারে কিছুটা, কিন্তু কন্নড়? বোধহয় পারে না। 


নিজবাসভূমে পরভাষী

শুরু করেছিলাম নিজের জন্মরাজ্যে নিজের মাতৃভাষা ব্যবহারের প্রসঙ্গ নিয়ে। 

বেশ কয়েক দশক হল এয়ারলাইন্সগুলো আর তাদের গন্তব্যস্থলের স্থানীয় ভাষায় ঘোষণা করেনা। তাদের ঘোষণাতে বলা থাকে অবশ্য, বিমান সেবকরা কোন্ কোন্ ভাষা বলতে পারে, কিন্তু যেভাবে ঘোষণা করা হয়, তাতে জীবনে প্রথমবার প্লেনে উঠেছে এমন অনেকের পক্ষেই বোঝা অসম্ভব। 

এদের মধ্যে বয়স্ক অনেকে আছে, অনেকে আছে পারিবারিক কোনও দুঃসংবাদে ছুটে যেতে হচ্ছে সাধ্যের অতিরিক্ত খরচ করে। এরকম অনেককেই দেখেছি নানারকম অসুবিধায় পড়তে। হঠাৎ হঠাৎ গেট পাল্টে দেওয়া নিয়ে এয়ারলাইন্সগুলো বোধহয় মাথাই ঘামায় না, যাত্রীরা কতটা অসুবিধায় পড়ল। এইরকম ঘোষণা বুঝতে না পারার জন্য যাত্রীদের প্লেন মিস করতে আমি একাধিকবার দেখেছি। কিছুদিন আগে আর একজনকে বলতে শুনলাম, কলকাতাগামী প্লেনে একজন যাত্রীকে বিমান সেবক জিজ্ঞাসা করছেন, প্রয়োজন হলে এমার্জেন্সি গেটের সামনে থেকে সে তাড়াতাড়ি উঠে অন্যদের বেরিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারবে কিনা। সেই বাঙালি যাত্রী কোনও ঘোষণারই কিছুই বোঝেন নি।  অন্য একজন সিট বদল করায় সমস্যার সমাধান হল।  গত সপ্তাহে সুরাট থেকে কলকাতাগামী একজন বাঙালি যাত্রীকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল। তার অপরাধ? সে প্লেনের বাথরুমে বিড়ি খেয়েছিল। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, সেও ঘোষণা বুঝতে না পারা আর একজন। এছাড়া বহু বাঙালি মহিলাকে দেখি অসম্ভব ভয়ে ভয়ে প্লেনে যাতায়াত করতে, কারণ তাদের নিজের ভাষায় বুঝিয়ে দেওয়ার কাজ কেউ করে না। সেই কারণে বাঙালি সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপে অনেকেই জানতে চায়, অমুক দিন অমুক ফ্লাইট এ বা অমুক ট্রেনে আর কেউ যাচ্ছে কিনা, যাতে তাদের বয়স্ক মায়ের যাত্রার সময় একটা অন্তত চেনা মুখ থাকে।

প্লেনে না হয় কম মানুষ চড়ে , কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে ইদানীং যে হিন্দির প্রকোপ দেখছি, তাতে শুধু যে অসুবিধেতে পড়ছি, তা নয় আতঙ্কিতও হচ্ছি। হাওড়া স্টেশন এ নেমে থেকে যে মানুষগুলোর কাছে রাস্তা দেখানোর নির্দেশ নিতে হয়, গত এক বছরে দেখছি সবাই হিন্দিভাষী। হিন্দি ভাষাটা শুধু মুখে বলে তাই না, ইদানিং দেখছি অনেকে বাংলা বুঝতেও পারে না। শুধু তাই নয়, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে, যেখানে একটাও হিন্দিভাষী বাসিন্দা নেই, সেখানের ব্যাংক এবং অন্যান্য কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত কেন্দ্রগুলিতে শুধুই হিন্দিভাষী। এমনটা তো ব্রিটিশ আমলেও ছিল না।  ব্রিটিশ, যারা ভারতে কাজ করতে আসত, তাদের নিজের দেশ থেকেই কিছুটা অন্তত দেশীয় ভাষা, বা বাংলা শিখে আসতে হত। স্বাধীনতা পরবর্তী কালেও, আমি যে মিশনারি স্কুলে পড়েছি, সেখানে এক ব্রিটিশ শিক্ষিকাকে আমি পেয়েছিলাম। তিনি নিজের দেশ থেকেই বাংলা ভাষার পরীক্ষা পাশ করে তবে এদেশে এসে কাজ করার উপযুক্ত হয়েছেন বলে বিবেচিত হয়েছিলেন। 

তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী নিজের রাজ্যে নিজের ভাষাকে সর্বস্তরে রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। মহারাষ্ট্রে কোনও কোনও রাজনৈতিক দল বেশি উগ্র অস্মিতা দেখালেও এখানকার সরকারি সমস্ত নথি মরাঠিতে লেখা, সমস্ত সাইনবোর্ডে মরাঠি বাধ্যতামূলক। শুধু তাই নয়, পুণে বিশ্ববিদ্যালয় এবং আরও কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাকা করার প্রথম শর্ত হল মারাঠি ভাষায় মাধ্যমিক স্তরের দখল প্রমাণ করা। গুজরাতেও সমস্ত সরকারি কাজে, হিন্দি না, গুজরাতিই ব্যবহার হয়।   

যারা কন্নড়ভাষী ভদ্রলোককে নিজ বাসভূমে নিজ ভাষা বলার দাবি তোলার জন্য ট্রোল করেছিলেন, তাদের বোঝা উচিত, ভারতের ঐক্য আসে বৈচিত্র্য থেকেই।  যে সব বাঙালি মনে করেন বাংলায় বাংলা ভাষার প্রাধান্য চাওয়া ক্ষুদ্র প্রাদেশিকতা, তাদেরকেও একই কথা বলব। যখন বাঙালি বাংলা মাধ্যম ইস্কুল থেকে পাশ করে সারা বিশ্বের মুখ উজ্জ্বল করেছিল, তখন বাঙালি সেরাই ছিল।  যবে থেকে বাঙালি আর বাংলা মাধ্যম স্কুলকে ভালোবাসতে পারল না, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ছল করে বাংলা ভাষার গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া হল, বাঙালির পতনের শুরু তখন থেকেই। 

 

ডঃ সুস্মিতা ঘোষ বায়োটেক স্টার্টআপ ডায়াগনোরাইটের প্রতিষ্ঠাত্রী, আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ কানেটিকাট থেকে বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সেস এর ডক্টরেট। 


New
পহেলগাম থেকে মুর্শিদাবাদ – এক বিদ্বেষের রাজনীতি
আপনি নিজে কজন মুসলমানকে চেনেন?
মহাকুম্ভের অমৃতবারি ও অন্ধদের হস্তিদর্শন


Other Writings by -ডঃ সুস্মিতা ঘোষ
পহেলগাম থেকে মুর্শিদাবাদ – এক বিদ্বেষের রাজনীতি
পহেলগাম থেকে মুর্শিদাবাদ – এক বিদ্বেষের রাজনীতি

‘সংস্কারী সনাতনীদের মহিলাদের ওপর অত্যাচার করাটা প্রশং…

মহাকুম্ভের অমৃতবারি ও অন্ধদের হস্তিদর্শন
মহাকুম্ভের অমৃতবারি ও অন্ধদের হস্তিদর্শন

প্রয়াগরাজের মেলা সংলগ্ন…

গীয়ান ব’রে সিনড্রোম (GB Syndrome) নিয়ে কিছু কথা
গীয়ান ব’রে সিনড্রোম (GB Syndrome) নিয়ে কিছু কথা

মহারাষ্ট্রের বাসিন্দারা চিন্তায় পড়ে…


4thPillar

Support 4thPillarWeThePeople

Admin Login Donate
আমাদের কথা

আমরা প্রশ্ন করি সকলকে। আমরা বহুত্ববাদী, স্বাধীন, যুক্তিবাদী। আমরা সংশয়বাদী; তর্কশীল; আবার সহিষ্ণুও বটে। আসুন কথা হোক; পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান, বিশ্বাস রেখে আলোচনা হোক। মননের ইতিহাসে শেষ কথা বলার স্পর্ধা কারও যেন না হয়; আবার কোনও স্বরই যেন অকিঞ্চিৎকর বলে উপেক্ষিতও না হয়। এই রকম ভাবনার একটা ইন্টারনেট-ভিত্তিক বিশ্বব্যাপী কমিউনিটি গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য।

© 2023 4thPillarWeThepeople. All rights reserved & Developed By - 4thPillar LeadsToCompany
// Event for pushed the video