লোকসভা ভোট পর্ব শেষ হওয়ার পর সব এগজিট পোল সমীক্ষাই দেখিয়েছে, নরেন্দ্র মোদী টানা তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন এবং বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ জোট সা়ড়ে তিনশোর বেশি আসন নিয়ে ক্ষমতায় ফিরছে।।
বিরোধীরা এই সমীক্ষা খারিজ করে দিয়েছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী একে 'মোদী পোল' বলেছেন। তাঁর দলের দাবি, ইন্ডিয়া জোট 295 আসন পেতে চলেছে। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে গত রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে এগজিট পোল ভুল হয়েছিল। এবারও তাই হবে। বিজেপির পাল্টা দাবি, বিরোধীরা হার নিশ্চিত জেনেও তাকে মানতে পারছে না।
গত তিনটি লোকসভা নির্বাচনে বিভিন্ন এগজিট পোলের গড় ফলাফলে দেখা যাচ্ছে যে কোন পক্ষ জিতবে – এই পূর্বাভাস প্রতিবারই মিলেছে।
কিন্তু আসন সংখ্যার পূর্বাভাসে বড়সড় থেকে মারাত্মক ভুল হয়েছে। এগজিট পোলে যত সংখ্যক আসনের কথা বলা হয়েছিল, বাস্তবে তার থেকে বিচ্যুতি হয়েছে 15 থেকে 52 শতাংশ।।
বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের তুলনায় কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোটের আসন সংখ্যার পূর্বাভাস দিতে বেশি ভুল হয়েছে এগজিট পোলে। এনডিএ জোটের ক্ষেত্রে হিসেবের ভুল 15 থেকে 18 শতাংশ। কিন্তু ইউপিএ জোটের ক্ষে্ত্রে ভুল হয়েছে 22 থেকে 52 শতাংশ।
2009 সালে চারটি বুথ ফেরত সমীক্ষাকে গড় করলে দেখা যাচ্ছে, পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, এনডিএ 185 আসন পাবে। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ পাবে 195। ফল বেরোতে দেখা যায়, এনডিএ সমীক্ষার তুলনায় 17 শতাংশ আসন কম পেয়েছে। তাদের প্রাপ্ত আসন ছিল 158। অন্যদিকে, ইউপিএ 34 শতাংশ আসন বেশি পেয়েছিল। তাদের প্রাপ্ত আসন ছিল 262।
2014 সালে আটটি এগজিট পোলকে গড় করলে দেখা যাচ্ছে, এক্ষেত্রেও পূর্বাভাসে বেশ বড় মাপের গরমিল হয়েছিল। সমীক্ষা বলেছিল, এনডিএ 283 আসন পাবে। ইউপিএ পাবে 105 আসন। ফলাফলে দেখা যায়, এনডিএ 336 আসন পেয়েছে, যা পূর্বাভাসের তুলনায় 18 শতাংশ বেশি। ইউপিএ 60টি আসন পেয়েছে, যা 52 শতাংশ কম ।
গত লোকসভা নির্বাচনে 13টি সমীক্ষাকে গড় করলে দেখা যাচ্ছে, এনডিএকে সমীক্ষক সংস্থাগুলি দিয়েছিল 306 আসন। ইউপিএকে 120 আসন। যদিও বিজেপি জোট 353টি আসন পায়, পূর্বাভাসের তুলনায় 15 শতাংশ বেশি। অন্যদিকে, ইউপিএ পূর্বাভাসের তুলনায় 22 শতাংশ আসন কম পায়। তাদের আসন সংখ্যা ছিল 93।
গত তিনটি লোকসভা নির্বাচনে এগজিট পোলের আসন সংখ্যার হিসেবে পূর্বাভাসে ভুল হলেও মোটের উপর কোন পক্ষজিতবে, তাতে কিন্তি ভুল হয়নি। 2004 সালে কিন্তু ঠিক সেটাই হয়েছিল। অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসবে, এ কথা বলেছিল সব শীর্ষস্থানীয় সংস্থা। কিন্তু তিনি হেরে যান। কংগ্রেসের নেতৃত্বে সরকার তৈরি হয়।
2017 সালে উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে ত্রিশঙ্কু ফলের পূর্বাভাস দিয়েছিল অধিকাংশ এগজিট পোল। বিজেপি বৃহত্তম দল হিসেবে উঠে আসবে বলে ঘোষণা করেছিল তারা। যদিও বিজেপি তিন-চতুর্থাংশ আসন জিতে ক্ষমতা দখল করে।
2020 সালে বিহারের বিধানসভা নির্বাচন এগজিট পোলকে বোকা বানিয়ে দিয়েছিল। রাষ্ট্রীয় জনতা দলের নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে জয়ী বলে ঘোষণা করেছিল বুথ ফেরত সমীক্ষা। কিন্তু জয় পায় এনডিএ।
2021 সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে ভুল প্রমাণিত হয় বুথ ফেরত সমীক্ষা। সংস্থাগুলি বিজেপিকে সম্ভাব্য জয়ী হিসেবে দেখায়। যদিও আসন সংখ্যা বাড়িয়ে, বিপুল জনমত নিয়ে ক্ষমতায় ফেরেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
গত বছর ছত্তিশগড় বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ক্ষমতায় ফেরা নিশ্চিত বলে জানিয়েছিল অধিকাংশ বুথ ফেরত সমীক্ষা। যদিও বিজেপি কংগ্রেসের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়।
বিশ্ব জুড়ে এগজিট পোল একটি স্বীকৃত পদ্ধতি, যার মাধ্যমে নির্বাচনী ফলের আগাম আভাস দেওয়া হয়। কিন্তু ভারতে যে সমীক্ষা চালানো হয়, তার নমুনা চয়ন ও প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন আছে।
আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানববিদ্যা বিষয়ের অধ্যাপক অশোক সরকার বলেন,
"এগজিট পোল যাদের জয়ী বলে দেখায়, তাদের 75 শতাংশ সত্যিই জয় পায়, কিন্তু 25 শতাংশ জয় পায় না। আসনের ক্ষেত্রে যে পূর্বাভাস সমীক্ষাতে দেওয়া হয়, তা অনেকটাই ভুল প্রমাণিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই সমীক্ষার ক্ষেত্রে নমুনা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নমুনা কতটা পর্যাপ্ত ও প্রতিনিধিত্বমূলক, সেটা বিবেচনা করা দরকার।"
দু-একটি ব্যতিক্রমী সংস্থা ছাড়া বাকি সমীক্ষক সংস্থাগুলি সমীক্ষার পদ্ধতি প্রকাশ্যে আনেন না। এতে ওই সমীক্ষার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। এর ফলে তার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়ে। যে ব্যতিক্রমী সংস্থাগুলি পদ্ধতি কথা জানায়, সেটাও অসম্পূর্ণ বলে মত অধ্যাপক সরকারের।
অ্যাক্সিস মাই ইন্ডিয়া দাবি করেছে, তারা 5 লক্ষ 80 হাজার ভোটারের সঙ্গে কথা বলেছে। 912 জন সমীক্ষককে কাজে লাগানো হয়েছে। 22 হাজার 288টি গ্রাম ও শহরে গিয়ে তাঁরা নমুনা সংগ্রহ করেছেন। 3 হাজার 600 বিধানসভা এলাকা এর মধ্যে রয়েছে।
অধ্যাপক সরকার বলেন, "এবার 64 কোটি ভোট পড়েছে সাত দফায়। অ্যাক্সিসের নমুনা সংখ্যা এই ভোটারদের দশমিক এক শতাংশ। বিজ্ঞানের চোখে এটি পর্যাপ্ত সংখ্যক নমুনা। কিন্তু এই নমুনা প্রতিনিধিত্বমূলক কিনা, তা সংস্থাটি স্পষ্ট করেনি।"
অধ্যাপক রায়ের বক্তব্য, "সমগ্র পদ্ধতি এগজিট পোলের সমীক্ষক সংস্থা আমাদের সামনে তুলে ধরে না। এর ফলেই সন্দেহের জন্ম হয়। অংকে ভুল হতেই পারে। কিন্তু কী পদ্ধতিতে কাজ করা হল, তার বর্ণনা না থাকলে সমীক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। বিশেষত ভারতের মতো একটা দেশে, যেখানে এত ভাষা, জাতি, ধর্ম, পেশা, সংস্কৃতির বৈচিত্র। কাদের কী প্রশ্ন করা হবে, কত ধরনের মানুষের ভিতর থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হবে, সেটাই একটা গবেষণা।"
বিজ্ঞানসম্মত ভাবে, যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করে সমীক্ষা করা হলেও তাতে বিচ্যুতি থাকতে পারে। তার ব্যাখ্যা দিতে হয় সংশ্লিষ্ট সমীক্ষকদের। সংবাদমাধ্যমে ঢালাওভাবে প্রচার করা কোনও সমীক্ষা ভুল হলে তার দায় কে নেবে?