4thPillar


ভোটই তো গোনা, মজন্তালী সরকারের ঢেউ গোনা তো নয়

কুশল সিংহরায়May 24, 2024
ভোটই তো গোনা, মজন্তালী সরকারের ঢেউ গোনা তো নয়

এবারের নির্বাচনে প্রথম দফার নির্বাচনের পর থেকেই সন্দেহের আবর্তে রয়েছে ভোটদানের হার। মোট কত মানুষ ভোট দিয়েছেন, এই প্রশ্নে সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর মিলছে না। শতাংশের হিসেবে ভোটের ফল ঘোষণা হয় না। ভোটে প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারিত হয় মোট প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে। এখান থেকেই বিতর্ক এবং সংশয়ের জন্ম। এবার মোট ভোটের সংখ্যা এবং শতাংশের হিসেব মিলতে যত দেরি হচ্ছে, তার কোনও নজির অতীতে নেই।

কেন মোট প্রদত্ত ভোটের সংখ্যাটি গুরুত্বপূর্ণ? ধরা যাক পশ্চিমবঙ্গের উদাহরণ। সাতটি বিধানসভা নিয়ে একটি লোকসভা কেন্দ্র। ধরা যাক প্রতি কেন্দ্রে 100 ভোটার। এবার ধরুন সাতটির মধ্যে ছয়টি কেন্দ্রে প্রথম প্রার্থী 80 শতাংশ ভোট পেয়েছেন, দ্বিতীয় প্রার্থী 10 শতাংশ। কিন্তু ভোট পড়েছে 10 শতাংশ করে। অর্থাৎ এই ছয়টি বিধানসভা কেন্দ্রের হিসেবে প্রথম প্রার্থীর ভোট 100 গুণ 80 শতাংশ গুণ 6 = 48। দ্বিতীয় প্রার্থীর ভোট মাত্রই 6।

এবার সপ্তম বিধানসভা কেন্দ্রে প্রথম প্রার্থী পেয়েছেন 10 শতাংশ, দ্বিতীয় প্রার্থী 90 শতাংশ, কিন্তু ভোট পড়েছে 100 শতাংশ। তার মানে এই বিধানসভা কেন্দ্রে প্রথম প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট 10, দ্বিতীয় প্রার্থীর 90। তা হলে যোগফল কী দাঁড়াল? সব মিলিয়ে প্রথম প্রার্থীর ভোট 48 + 10 = 58, আর দ্বিতীয় প্রার্থীর ভোট 6 +90 = 96!

তার মানে শতাংশের হিসেবে ছয়টি জায়গায় একজন এগিয়ে থাকলেও মাত্র একটি, সপ্তম জায়গায় অন্যজন থাকলেও তিনিই ভোটে জিতবেন! এই অঙ্কের কারবারই কি কেউ করার চেষ্টা করছে?

প্রশ্নটা এখানেই।

19 এপ্রিল প্রথম দফায় ভোটগ্রহণ করা হয়। এর 11 দিন পর ভোটদানের প্রকৃত হার জানানো হয়। দ্বিতীয় দফার ভোট নেওয়া হয় 26 এপ্রিল। এর চার দিন পর জানানো হয়, কত শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন। অর্থাৎ, 30 এপ্রিল দুই দফার ভোটদানের হার জানিয়েছে কমিশন। কেন এই বিলম্ব, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে

ভোটগ্রহণের দিন সন্ধ্যা সাতটায় যে হিসেব দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে চূড়ান্ত হারের তফাৎ ছয় শতাংশের মতো। প্রথম দফার নির্বাচনে 60 শতাংশ থেকে বেড়ে 66.14 শতাংশ, দ্বিতীয় দফার ক্ষেত্রে 60.96 শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে 66.71 শতাংশ

ইতিমধ্যে এ নিয়ে বিতর্ক পৌঁছেছে আদালতে। অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রাইট (এডিআর) সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছে। তারা প্রশ্ন তুলেছে, কেন শুধু প্রদত্ত ভোটের হার জানাচ্ছে কমিশন, কেন ভোটারদের নির্দিষ্ট সংখ্যা জানানো হচ্ছে না?

গত সপ্তাহে প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের এজলাসে এই মামলার শুনানি হয়। এডিআর-এর পক্ষে সওয়াল করেন আইনজীবী প্রশান্তভূষণ। তাঁর বক্তব্য, "অনেক দেরিতে কমিশন ভোটের চূড়ান্ত হার জানাচ্ছে। প্রাথমিক ভাবে যে হার বলা হচ্ছে, তার থেকে অনেক বেশি হচ্ছে চূড়ান্ত হার। এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ জন্ম নিচ্ছে।"

নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী মনিন্দর সিং এই সওয়ালের বিরোধিতা করেন। তাঁর বক্তব্য, নির্বাচনকে ব্যাহত করার জন্য এই আবেদন জানানো হয়েছে। এর আগে আদালত বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্র সংক্রান্ত একটি রায় দেয় 26 এপ্রিল। তার কথা উল্লেখ করে মনিন্দর বলেন, এ ব্যাপারে আগেই আদালত তার মত জানিয়েছে। যদিও প্রশান্তভূষণের সওয়াল, আদালত ভোটযন্ত্র নিয়ে বলেছে, ফর্ম 17সি নিয়ে সেখানে আলোচনা হয়নি

প্রাথমিক সওয়াল যুদ্ধে এডিআর-এর আইনজীবীর জয় হয়েছে। আদালত এই মামলা গ্রহণ করে 24 মে পরের শুনানির দিন ধার্য করেছেন। তার পরের দিন, 25 মে ষষ্ঠ দফায় নির্বাচন হওয়ার কথা


প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন করেছেন, "সন্ধ্যার মধ্যে যদি নির্বাচন সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়, তা হলে সেসব আপলোড করে দিতে সমস্যা কোথায়?"

এই বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে ফর্ম 17সি। বুথে উপস্থিত প্রত্যেক প্রার্থীর এজেন্টকে এই ফর্ম দেওয়া হয়। কী এই ফর্ম?


নির্বাচন পরিচালনা আইন, 1961-এর ধারা 89এস ও 56সি(2) অনুসারে ভোট পরিচালনাকারী প্রিসাইডিং অফিসারকে 17সি ফর্ম তৈরি করতে হয়। 17 এ, বি ও সি তিনটি ফর্মের মধ্যে শেষেরটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীদের কাছে, যেহেতু তাতে সংশ্লিষ্ট বুথের ভোটদানের হিসেব থাকে


ভোটগ্রহণের সময়সীমা পার হয়ে যাওয়ার পর ওই ফর্ম প্রিসাইডিং অফিসার তৈরি করেন। তাতে বুথের মোট ভোটার ও প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়। উপস্থিত এজেন্টদের হাতে সেই ফর্ম তুলে দেওয়া হয়। প্রার্থীর প্রতিনিধি হিসেবে এজেন্টরা ফর্ম হাতে পান। যে প্রার্থীর এজেন্ট বুথে থাকেন না, তিনি ফর্ম 17সি পাবেন না

এই ফর্মকে এককথায় প্রদত্ত ভোটের হিসেব বলা যেতে পারে। প্রিসাইডিং অফিসাররা এই হিসেব রিটার্নিং অফিসারের দফতরে জমা দেন। বিধানসভা অনুযায়ী সেগুলি হিসেব করা হয়। ভোটগ্রহণের পরের দিন সকালে সব তথ্য একত্রিত করার পর সেগুলির স্ক্রুটিনি করেন পর্যবেক্ষক ও রিটার্নিং অফিসাররা

 ভোটের পরের দিনই নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রদত্ত ভোটের হিসেব পাঠিয়ে দিতে হয়। একটি লোকসভা কেন্দ্রের অধীন সাতটি বিধানসভা থাকে। এই বিধানসভাওয়াড়ি প্রদত্ত ভোটের তথ্য তুলে দেওয়া হয় প্রার্থীদের হাতে

প্রাক্তন অতিরিক্ত মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক দিব্যেন্দু সরকার বলেন, "প্রথমে মক পোল করা হয়। তারপর সেটা মুছে শূন্য থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত কত ভোট পড়ল, তার হিসেব মেশিনে থাকে। ফার্স্ট পোলিং অফিসারের কাছে যে তালিকা থাকে, সেখানে তিনি ভোটারদের নামের পাশে দাগ দিতে থাকেন। এই দুটি সংখ্যা মিলিয়ে দেখা হয়। দুটোই লেখা থাকে ফর্ম 17সি তে।"


ভোটই তো গোনা, মজন্তালী সরকারের ঢেউ গোনা তো নয়

বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছে, কেন 2019 সালের নিয়ম এবার বদলে ফেলা হল? এর আগের লোকসভা নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা জানিয়েছে কমিশন, এবার কেন জানাচ্ছে না? ভোটের হার জানানো হচ্ছে, তাও আবার নির্বাচন হয়ে যাওয়ার অনেক দিন বাদে। দেখা যাচ্ছে, ভোটের হার অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে

বিরোধী দলের শীর্ষ নেতারা এ নিয়ে মুখ খুলেছেন। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জনসভায় বলেন, "বিজেপির ভোট যেখানে কম, সেখানে ভোট বাড়িয়ে দিয়েছে। ইভিএম কারা বানিয়েছে, সংখ্যাটা বাড়ল কী করে, কত ভোটার, কত মেশিন, আমরা জানতে চাই। কমিশনকে বলছি, মানুষের সন্দেহ দূর করুন। নিরপেক্ষ হোক কমিশন। আসল সত্যি জানাতে হবে।"

এআইসিসি নেতা জয়রাম রমেশ বলেছেন, "প্রাথমিক হিসেবের তুলনায় চূড়ান্ত সংখ্যায় এক কোটি 70 লক্ষ ভোটের ফারাক। গড়ে প্রতি লোকসভায় 28 হাজার ভোটের তফাৎ। এতে ভোটের ফল বদলে যেতে পারে। কী করে এত ফারাক হল, তার জবাব দিতে হবে কমিশনকে।"

পশ্চিমবঙ্গের মতো বিরোধী দলের শাসনে থাকা রাজ্যের ক্ষেত্রে, সেখানকার শাসক দলই সুবিধা পেতে পারে বলে মনে করেন দিব্যেন্দু সরকার। তিনি বলেন, "যে আধিকারিকরা নির্বাচন পরিচালনার কাজে যুক্ত থাকেন, তারা রাজ্য সরকারের কর্মী। যদি কোনও অনিয়ম হয়, তাতে রাজ্যের সুবিধা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যদি কেন্দ্র ও রাজ্যে একই দলের সরকার থাকে, তাহলে বিষয়টি আলাদা।"

নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা ফর্ম 17 সি র মাধ্যমে শুধু প্রার্থী বা তাঁর প্রতিনিধিকেই জানানোর কথা, সাধারণ মানুষ বা সংবাদমাধ্যমকেও নয়। নাগরিক সংগঠনগুলির দাবি, সন্দেহ দূর করতে, স্বচ্ছতার স্বার্থে ফর্ম 17 সি ভোটের পরপরই ওয়েবসাইটে আপলোড করা হোক

এক একটি লোকসভা কেন্দ্রে 2000 থেকে 2200 বুথ থাকে। দিব্যেন্দু বলেন, "প্রতিটা বুথে ফর্ম আপলোড করা একটা বিপুল কাজ। সারা দেশে লক্ষ লক্ষ ফর্ম আপলোড করতে হবে। এই তথ্যের সঙ্গে চূড়ান্ত হিসেবের একটা ফারাক থাকে। তাই কমিশন এই প্রাথমিক তথ্য দিতে চায় না। সেক্ষেত্রে পরে জটিলতা তৈরি হতে পারে।"

প্রদত্ত ভোটারের সংখ্যা নিয়ে বিরোধীদের এই মাথাব্যথা কেন? কেন তারা ভোট প্রক্রিয়ায় গরমিলের আশঙ্কা করছেন? এতে কি চূড়ান্ত ফল বদলে যেতে পারে?
দিব্যেন্দু সরকার বলেন, "ভোটার সংখ্যা যাই হোক না কেন, ইভিএমে যে ভোট বন্দি হয়েছে, তার গণনার ভিত্তিতে ফলাফল ঘোষিত হবে। ইভিএমে গরমিল করা যায়, এমন প্রমাণ এখনও পর্যন্ত মেলেনি। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনও চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। অর্থাৎ ইভিএমে যে মত জনতা দিয়েছে, সেটা বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।"

প্রাক্তন আধিকারিকের বক্তব্য, "ফর্ম 17 সি তে যে তথ্য থাকে, তার সঙ্গে গণনা কেন্দ্রে বিভিন্ন প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্টরা ইভিএমে প্রদত্ত ভোট মিলিয়ে দেখতে পারেন। সেখানে কম-বেশি হলে একটা প্রশ্ন তোলার অবকাশ থাকে।" 

যদিও সংখ্যার ব্যাপক বদল সম্পর্কে তাঁর মত, "প্রাথমিক যে হিসেব কমিশন দেয়, তার সঙ্গে চূড়ান্ত হিসেবে বিস্তার ফারাক থাকতে পারে। ছয় শতাংশ হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। ডেটা প্রসেসিংয়ের ক্ষেত্রে অদক্ষতা এই ফারাকের কারণ হতে পারে। তবে 11 দিন সময় কেন লাগল, সেটা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আগে এমনটা হয়নি, এটা বলতে পারি।


New
বিদায় পিটি নায়ার: কলকাতার ইতিহাসবেত্তা
এগজিট পোল মিলে গেলেও যে প্রশ্ন উঠবেই
কংগ্রেস সেঞ্চুরি না করলে কে রুখবে বিজেপিকে?


Other Writings by -কুশল সিংহরায়
এগজিট পোল মিলে গেলেও যে প্রশ্ন উঠবেই
এগজিট পোল মিলে গেলেও যে প্রশ্ন উঠবেই

লোকসভা ভোট পর্ব শেষ হওয়ার পর সব …

কংগ্রেস সেঞ্চুরি না করলে কে রুখবে বিজেপিকে?
কংগ্রেস সেঞ্চুরি না করলে কে রুখবে বিজেপিকে?

এবার আইপিএল ফাইনাল …

তাপদাহে তপ্ত দেশ, ভোট দেবেন কীভাবে?
তাপদাহে তপ্ত দেশ, ভোট দেবেন কীভাবে?

কদিন আগেই খবরের কাগজে বেরিয়েছিল ছবিটা।

একটা ছোট পুকুর। তার এককোণে, সামান্য একটু জলে সবু…

প্রথম লোকসভায় কলকাতার তিন মহারথী
প্রথম লোকসভায় কলকাতার তিন মহারথী

''সেই সময় সংসদের দুই কক্ষে এমন মানুষেরা ছিলেন, 


4thPillar

Support 4thPillarWeThePeople

Admin Login Donate
আমাদের কথা

আমরা প্রশ্ন করি সকলকে। আমরা বহুত্ববাদী, স্বাধীন, যুক্তিবাদী। আমরা সংশয়বাদী; তর্কশীল; আবার সহিষ্ণুও বটে। আসুন কথা হোক; পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান, বিশ্বাস রেখে আলোচনা হোক। মননের ইতিহাসে শেষ কথা বলার স্পর্ধা কারও যেন না হয়; আবার কোনও স্বরই যেন অকিঞ্চিৎকর বলে উপেক্ষিতও না হয়। এই রকম ভাবনার একটা ইন্টারনেট-ভিত্তিক বিশ্বব্যাপী কমিউনিটি গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য।

© 2023 4thPillarWeThepeople. All rights reserved & Developed By - 4thPillar LeadsToCompany
// Event for pushed the video