4thPillar


বিরোধী জোট আছে, রাজনীতি কই?

কুশল সিংহরায়April 12, 2024
বিরোধী জোট আছে, রাজনীতি কই?

ঝরনার জল নেমে আসছে গাছপালার ভিতর থেকে। নেকড়ে আর ভেড়ার ছানা সেই জলে তেষ্টা মেটাচ্ছে। নেকড়ে চটে লাল। ছানাকে বলে, কেন জল ঘোলা করছিস? ছানা বলে, আপনি তো উপরের দিকে রয়েছেন, আমি নীচে। আমি উপরের দিকের জল কীভাবে ঘোলা করব!

অকাট্য যুক্তিতে দমে না নেকড়ে। বলে, গত বছর তা হলে তুই উপরের জল ঘোলা করেছিলি। ভেড়ার ছানাটি জবাব দেয়, আমার তো এক বছর বয়সই হয়নি! মুশকিলে পড়ে যায় নেকড়ে। বলে, নিশ্চই তোর ভাইয়ের কাজ হবে। কিন্তু তার কোনও ভাই-ই নেই।

ভেড়ার ছানাকে উদরস্থ করতে যুক্তি বাধা হয়ে দাঁড়ায় নেকড়ের সামনে। সে বলে, তা হলে তোর বাবা-কাকা-দাদু-পিসে, কেউ এ কাজ করেছে। তাই তোকে আমি খাব!

ঈশপের এই গল্পটা সবারই জানা।

যদি কেউ থাকে নিশানায়, যদি কাউকে পকেটে বা জেলে পুরতে হয়, তা হলে যুক্তি লাগে না। স্রেফ ‘খেয়ে’ ফেললেই হল!

ভোটের ক্যাকোফনির মধ্যে এটাই সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ছে। বিরোধী নেতারা সকালে দাঁত মাজার আগে তাঁদের বাড়িতে এসে হাজির হচ্ছে এজেন্সি। ইডি, সিবিআই, আয়কর দফতর। আসছে, চলে যাচ্ছে কাগজপত্র নিয়ে বা খালি হাতে। কোথাও আবার দিন তিনেক ক্যাম্প করে বসে থাকছে।

ভোট এলে তদন্তের কাজ গুটিয়ে বাড়িতে বসে থাকতে হবে এজেন্সিকে, এটা কোথাও বলা নেই। ঠিকই। কিন্তু সারদার মতো একাধিক চিটফান্ড, নারদ স্ট্রিং এর মামলা যখন ইতিহাসের পাঠ্যবইয়ে ঢুকে পড়ার সময় হল, অথচ কারও কিচ্ছুটি হল না, তখন যদি প্রশ্ন করা হয়, ভোটের আগে এতো লাফালাফি কেন?

বিরোধী ইন্ডিয়া জোট এই প্রশ্ন বেশ জোরের সঙ্গে তুলছে। তারা কয়েকটি বড়সড় রাজ্যে আসনের ভাগ বাঁটোয়ারা সেরে ফেলেছে। 80টি কেন্দ্রের উত্তরপ্রদেশ, 48 আসনের মহারাষ্ট্র, 40 কেন্দ্রের বিহার বিজেপিকে বেগ দেবে। বঙ্গে বোঝাপড়া হওয়ার কথাও ছিল না। এখানে একা তৃণমূলই মোদী ব্রিগেডকে চ্যালেঞ্জ দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কেরল, তামিলনাড়ূ, তেলঙ্গানায় মারকাটারি ফলের স্বপ্ন অমিত শাহ কাঁচা ঘুমেও দেখছেন না। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, কর্নাটকে সরাসরি তাঁদের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের লড়াই। এ সব রাজ্যে বিজেপির আসন বাড়ার সম্ভাবনা নেই। 

সবমিলিয়ে পরিস্থিতি একটু গোলমেলে। এ সব মামুলি হিসেবনিকেশ মোদী-শাহ অনেক আগেই সেরে ফেলেছেন। এর সঙ্গে রয়েছে 10 বছরের শাসনে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ফ্যাক্টর। তাই গোড়া থেকে 400 পার করার ধুয়ো তুলে দিয়েছেন। যথার্থ কৌশল। তাতে যদি 300-র কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া যায়। কিছুটা কম হলেও অসুবিধা নেই। ফেন্সের পাশে বসে থাকা অনেকে ময়দানে ঢুকে পড়বেন। ফলে আরও পাঁচ বছরের জন্য নিশ্চিন্ত।

অর্থাৎ জয়ের সম্ভাবনা থাকলেও রাস্তাটা ফুল বিছানো নয়। কাঁটা অনেক। বিশেষ করে বিভিন্ন রাজ্যের ছোট দলগুলি বেশি জ্বালাচ্ছে। তাই কি আম আদমি পার্টি প্রধান টার্গেট হয়ে গেল? এই প্রশ্ন উঠছে। নির্বাচনী আচরণবিধি ঘোষণার পর দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হল। প্রধান সেনাপতি জেলে থাকলে তাঁর দল কীভাবে লড়বে?

কেন্দ্র এজেন্সি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেও ইন্ডিয়া জোটকে তেমন চাঙ্গা লাগছিল না। বৈঠকের মধ্যমণি হয়ে থাকতেন যে নীতীশ কুমার, তিনি পুরনো শিবিরে ফিরে গিয়েছেন। উত্তরপ্রদেশের রাষ্ট্রীয় লোকদল বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। তবে কেজরিওয়ালকে ইডি গ্রেফতার করার পর গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছে বিরোধী জোট। পাঞ্জাব ও দিল্লিতে প্রধান বিরোধী শক্তি আপ। আসন সংখ্যাও খুব বেশি নয়। কিন্তু অরবিন্দের গ্রেফতারি কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে বিরোধী শিবিরে।

এজেন্সি এতটা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠায় বিজেপির অসুবিধাই হবে, এটা অনেকে মনে করছেন। শিথিল বিরোধী জোট এতে আর একটু জমাট হয়েছে। আসন সমঝোতা মোটের উপর যত আসনে হয়েছে, তা বিজেপিকে বেগ দেওয়ার পক্ষে একেবারে মন্দ নয়। কিন্তু একটু দেরি হয়ে গিয়েছে।

সভায় সভায় মোদী বলছেন, 4 ঠা জুন ভোটের ফল বেরনোর পর দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তিনি কড়া ব্যবস্থা নেবেন। গত এক দশকে নেননি কেন? প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ওই 10 বছরে ট্রেলার দেখেছে দেশ। ট্রেলার যদি এত দীর্ঘ সময়ের হয়, সিনেমা কি তবে 50 বছর ধরে চলবে?

সুতরাং মোদীর দাবিতে নিখাদ আমোদ জেগেছে জনতার মধ্যে। অজিত পাওয়ার, ছগন ভুজবল, প্রফুল্ল প্যাটেল থেকে বাংলার শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন তদন্ত থমকে গেল বা যাচ্ছে, এই প্রশ্ন বিরোধীরা তুলছে। 

তা বলে বিরোধীদের নিরীহ, নিষ্কলুষ ভাবা কি ঠিক হবে?

জেলবন্দি প্রাক্তন মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠের বাড়ি থেকে কোটি কোটি টাকা মিলেছে। এজেন্সির দাবি, তৃণমূলের দাপুটে নেতার নামে কোটি কোটি টাকার ফিক্সড ডিপোজিট রয়েছে। জমি, জায়গা, বাড়ি, গাড়ি তো রয়েইছে। কেন সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরি হল? ভুয়ো প্রার্থীদের দেওয়া টাকা কোথায় গেল? কেন স্কুলে গণিত, বিজ্ঞান পড়ানোর শিক্ষক নেই?

কেন্দ্র হাজার হাজার কোটি টাকার বকেয়া আটকে রেখেছে। একশো দিনের কাজের টাকা দেয়নি। এ সব অভিযোগ যদি সত্যিও হয়, তা হলে কি নেতাদের বিপুল সম্পত্তি, নগদ টাকা, ফিক্সড ডিপোজিটের ধাঁধাঁ কেটে যায়! শুধু তৃণমূল কেন, রাষ্ট্রীয় জনতা দল থেকে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা, অনেকের তো জামায় দুর্নীতির কালি লেগে আছে। আর ইউপিএ আমলের একের পর এক কেলেঙ্কারি? বিজেপি বিরোধিতার নামে এক ছাতার নীচে এলেই কি সব ধুয়েমুছে যায়!

বিরোধীরা গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়েছেন। ভালো কথা। আরজেডি-র শাসনে বিহারের দেড় দশকের শাসনের ইতিহাস ঘেঁটে দেখুন। কিংবা সমাজবাদী পার্টির আমলে উত্তরপ্রদেশ। তৃণমূল নবীন দল। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, বিরোধীদের ভুয়ো মামলা দেওয়া, নির্বাচনে কারচুপি, ভোটের পর হিংসা, পুলিশকে দলদাস করে রাখা। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে নাকি বিডিওরা দায়িত্ব নিয়ে ব্যালট বাক্স বদলে দিয়েছেন, এ অভিযোগও উঠেছিল। সিপিএমের 34 বছরের শাসনে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী গণতন্ত্র কতটা স্বচ্ছ ও সুরক্ষিত ছিল, এই বিষয়ে বই লিখলে প্রচ্ছদে প্রয়াত সাংসদ অনিল বসুর ছবি না রাখলে কি তা বিকোবে?

এই পরিস্থিতিতে বিজেপি আছে, ভেড়ার ছানাকে খেয়ে ফেলার হুমকিও আছে। কিন্তু বিরোধীরা যে হাঁটি হাঁটি পা পা, অপাপবিদ্ধ মেষশাবক, এমনটাও তো নয়। দুর্নীতি থেকে গণতন্ত্রের হত্যা, বিরোধীদের উপর নির্যাতন থেকে পুলিশ লাগিয়ে জব্দ করার অপকর্ম, কোনটা তাদের রিপোর্ট কার্ডে নেই!


বিরোধী জোট আছে, রাজনীতি কই?

ভোটের জন্য এই বিরোধী জোট আছে। ভোটের জোট। কিন্তু বিকল্প রাজনীতি কই?

অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ থেকে সংবিধানের 370 ধারা বিলোপ, বিজেপি তার অ্যাজেন্ডা পূরণ করে ফেলেছে। বিরোধীরা পাল্টা মন্দির সফর শুরু করেছে। এক জেলবন্দি মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, নিখরচায় নিয়ে যাবেন অযোধ্যায়। 370 ধারা নিয়ে চুপ থেকেছেন। পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল ক্ষমতায় আসার 13 বছর পর মনে করেছে, এ বার রামনবমীতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা দরকার। তারা অযোধ্যার পাল্টা মন্দির গড়ছে। এই বিরোধীরাই শপথ নিয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান তারা রক্ষা করবে!

সাংবাদিক রজত রায় বলেন, "হিন্দুত্বকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা কারও নেই। ডিএমকে করছে আর দক্ষিণের কয়েকজন দলিত নেতা। তাই অযোধ্যায় মন্দির হলে পাল্টা জগন্নাথের মন্দির তৈরি হয়। কেউ বলতে পারেন না, অযোধ্যার রায়ে গলদ ছিল। 370 ধারা ফের কার্যকর করা হবে, এই কথা কোনও বিরোধীর মুখে শোনা যায় না।"

বিজেপির রাজনীতিকে তাদের অস্ত্রে বধ করার ছক সাফল্য পায়নি। দিল্লি প্রবাসী সাংবাদিক সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "গত 10 বছরের রাজনীতি দেখলেই বোঝা যাবে, অবিজেপি দলগুলি হিন্দুত্ব নিয়ে দোলাচলে রয়েছে। কংগ্রেস, তৃণমূল, আরজেডি সহ বাকি দলগুলি। বামপন্থীদের এর মধ্যে ফেলা যাবে না। দোলাচলের ফলে বিজেপির শক্তি আরও বেড়েছে। বিরোধীরা বুঝতে পারছে না, হিন্দুত্বের মোকাবিলায় তারা কোন কৌশল নেবে।"

মতাদর্শের অভাবেও বিরোধী শিবিরের রাজনীতি সঠিক চেহারা পাচ্ছে না। পথ আমাদের পথ দেখাবে, এই ঘোষণা কি সেটাই প্রমাণ করছে? 

সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র বলেন, "বিরোধী শিবিরের অধিকাংশ দলের স্পষ্ট মতাদর্শ নেই। কংগ্রেস বা ডিএমকে সেক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম। কংগ্রেসের এবারের নির্বাচনী ইস্তেহার দেখলেও সেটা বোঝা যাবে। মল্লিকার্জুন খাড়গে ও রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস চেষ্টা করছে মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে লড়াই এগিয়ে নিয়ে যেতে।"

ভারতীয় রাজনীতির একটা গুণগত পরিবর্তন করে দিয়েছে বিজেপি। শুভাশিসের বক্তব্য, "রামমন্দির আন্দোলন আমাদের সমাজে একটা বদল এনেছে। আন্তর্জাতিক সমীক্ষা বলছে, অন্যান্য দেশের নাগরিকরা যখন রাজনীতির ক্ষেত্রে ধর্মকে দূরে রাখতে চাইছেন, তখন ভারতীয়রা বেশি করে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। এটার পরিবর্তন করার জন্য আর একটা বড় সামাজিক আন্দোলন দরকার। তার সম্ভাবনা এখনই দেখা যাচ্ছে না।"

এমন ভারী ভারী কথায় জনতার মন ভেজে না। রেডিওতে বলছে, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের বর্ধিত টাকা এপ্রিল মাসেই এসে গিয়েছে অ্যাকাউন্টে। আর টিভি খুললে পাওয়া যাচ্ছে ভোটের ‘ফিল’। 

গরম এখন ক্রমেই বাড়বে। তেতেপুড়ে এক প্রবীণ প্রার্থী সুইমিং পুলে সাঁতার কাটছেন, এই ছবিটা ভাইরাল হয়েছে ক’দিন আগে।

কেউ আবার শরবত বিলি করছেন। ঠান্ডা, বরফের গুঁড়ো মেশানো জল। বিচি ফেলে পাতিলেবু চিপে দিচ্ছেন। 

জলে নামুন। খান, খাওয়ান। কিন্তু জল ঘোলা করবেন না, প্লিজ!


New
বিদায় পিটি নায়ার: কলকাতার ইতিহাসবেত্তা
এগজিট পোল মিলে গেলেও যে প্রশ্ন উঠবেই
কংগ্রেস সেঞ্চুরি না করলে কে রুখবে বিজেপিকে?


Other Writings by -কুশল সিংহরায়
এগজিট পোল মিলে গেলেও যে প্রশ্ন উঠবেই
এগজিট পোল মিলে গেলেও যে প্রশ্ন উঠবেই

লোকসভা ভোট পর্ব শেষ হওয়ার পর সব …

কংগ্রেস সেঞ্চুরি না করলে কে রুখবে বিজেপিকে?
কংগ্রেস সেঞ্চুরি না করলে কে রুখবে বিজেপিকে?

এবার আইপিএল ফাইনাল …

ভোটই তো গোনা, মজন্তালী সরকারের ঢেউ গোনা তো নয়
ভোটই তো গোনা, মজন্তালী সরকারের ঢেউ গোনা তো নয়

এবারের নির্বাচনে প্রথম দফার নির্বা…

তাপদাহে তপ্ত দেশ, ভোট দেবেন কীভাবে?
তাপদাহে তপ্ত দেশ, ভোট দেবেন কীভাবে?

কদিন আগেই খবরের কাগজে বেরিয়েছিল ছবিটা।

একটা ছোট পুকুর। তার এককোণে, সামান্য একটু জলে সবু…


4thPillar

Support 4thPillarWeThePeople

Admin Login Donate
আমাদের কথা

আমরা প্রশ্ন করি সকলকে। আমরা বহুত্ববাদী, স্বাধীন, যুক্তিবাদী। আমরা সংশয়বাদী; তর্কশীল; আবার সহিষ্ণুও বটে। আসুন কথা হোক; পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান, বিশ্বাস রেখে আলোচনা হোক। মননের ইতিহাসে শেষ কথা বলার স্পর্ধা কারও যেন না হয়; আবার কোনও স্বরই যেন অকিঞ্চিৎকর বলে উপেক্ষিতও না হয়। এই রকম ভাবনার একটা ইন্টারনেট-ভিত্তিক বিশ্বব্যাপী কমিউনিটি গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য।

© 2023 4thPillarWeThepeople. All rights reserved & Developed By - 4thPillar LeadsToCompany
// Event for pushed the video