4thPillar


ভারতের প্রথম সফল স্টার্ট আপের আচার্য

সুস্মিতা ঘোষApril 19, 2023
ভারতের প্রথম সফল স্টার্ট আপের আচার্য

ওই একজন উস্কোখুস্কো চুলের শীর্ণকায় মানুষ, বিজ্ঞানী ছিলেন, বেঙ্গল কেমিক্যাল  না কি একটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা তারও আর নাম শুনি না আজকাল।  আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এখনকার বাঙালির কাছে সম্ভবত এটুকুই।

আজকালকার লোকজন বই টই তো পড়ে না। না হলে বলতাম তাঁর আত্মচরিতটা  একবার পড়ে দেখতে! এমন একজন মানুষের মতো মানুষ ছিলেন, এমন এমন কীর্তি রেখে গেছেন, এমন এমন কথা বলে গেছেন, তা আজকের দিনে বড় বেশি প্রাসঙ্গিক।  বিজ্ঞানী তাঁর একটা পরিচয় মাত্র। তাকে অতিক্রম করে তিনি সাহিত্যিক, তিনি ঐতিহাসিক, তিনি শিক্ষাবিদ, তিনি রাজনীতিবিদ এবং এখনকার দিনে সবচেয়ে জনপ্রিয় buzzword যেটা তিনি তাও - তিনি বাংলার প্রথম স্টার্ট আপ এর প্রতিষ্ঠাতা, এবং অবশ্যই সফল ব্যবসায়ী। 

আমার প্রজন্মের লোক অনেকেই তাঁর আত্মচরিত পড়েছে, কিন্তু দেখেছি, তাঁর ভেতো বাঙালি চরিত্র ছাপিয়ে যে পরিচয়গুলো, তা নিয়ে খুব একটা আলোচনা কেউ করে নি।  কিন্তু বর্তমান পৃথিবী তথা ভারতের পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর আত্মচরিত আবার পড়লে মনে হয় কই  রে আগের মানুষ কই? সেই ভাবনা থেকেই তাঁর জন্মদিনে নতুন করে আরও একবার তাঁর জীবন এবং আত্মজীবনীর বর্ণনা দেওয়ার এই প্রয়াস।  

প্রফুল্লচন্দ্রর পরিবার ও বড় হয়ে ওঠা 

তিনি জন্মেছিলেন 1861 সালে এখনকার বাংলাদেশের যশোর জেলার রাড়ুলি গ্রামের এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারে।  তাঁর ঠাকুরদা এবং, তাঁরও বাবা দুজনেই দেওয়ান ছিলেন, এবং প্রচুর অর্থ, ধনরত্ন আয় করেছিলেন - সবটা হয়ত সৎ পথেও নয়।  যেমন সে যুগে রীতি ছিল, ধনরত্নের বেশির ভাগই নানা গুপ্ত জায়গায় পুঁতে রাখা ছিল, কিন্তু বংশধর, অর্থাৎ প্রফুল্লচন্দ্রর পিতাকে তাঁর সন্ধান বলে যেতে পারেননি।  তাঁর পিতা কিন্তু দেওয়ানি করতেন না, জমিদার হিসেবে জনদরদী, শিক্ষিত এবং শিক্ষার প্রচারক ছিলেন, ব্যবসার ঝোঁক ছিল, কিন্তু ব্যবসা বুদ্ধি ছিল না।  বাড়িতে লাইব্রেরি ছিল, এবং দুই ছেলের সঙ্গে বন্ধুর মত ব্যবহার করতেন।  এ ধরনের মানুষের যা হয় তাই হল, ঋণের দায়ে জমিদারি বিকিয়ে গেল, কিন্তু তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামের মেয়েদের স্কুল, লাইব্রেরি ও নানা প্রতিষ্ঠান রয়ে গিয়েছিল অনেকদিন।  ছেলেদের কলকাতার ভাল স্কুলে পড়াবেন বলে সপরিবারে কলকাতায় এসেছিলেন, কিন্তু ঋণের দায়ে খরচা চালাতে না পেরে গ্রামে ফিরে যান। ছেলেরা হস্টেল মেস ইত্যাদিতে থেকে পড়াশুনা চালায়।  বারো বছর বয়সে সাংঘাতিক রক্ত আমাশা হওয়াতে তাঁকে দেড় বছর কলকাতার স্কুল ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে থাকতে হয়।  এই দেড় বছর তাঁর জীবনে নানা দিক থেকে কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটায়।  প্রথমত, স্কুলের গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে এসে এই দু বছর তিনি অগাধ বইয়ের সমুদ্রে সাঁতার কেটে সমবয়সীদের থেকে অনেক অনেক বেশি জ্ঞান আহরণ করতে সক্ষম হলেন।  কিন্তু দেড় বছর পর কলকাতা ফিরে এসে তাঁর পুরোনো স্কুল হেয়ার স্কুল তাঁকে সমবয়সীদের ক্লাসে নিল না, নিচু ক্লাসে পড়ার চেয়ে অন্য স্কুলে চলে যাওয়া শ্রেয় মনে করলেন। কেশবচন্দ্র সেন নতুন এলবার্ট স্কুল খুলেছেন তখন। শিক্ষকদের প্রায় সবাই ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণের কারণে জাতিচ্যুত যুবক। এঁরা পরম যত্নে প্রফুল্লচন্দ্রকে গ্রহণ করে তাঁর মনের ক্ষিদে মেটানোর যথাসাধ্য সাহায্য করতেন।  তখন ম্যাট্রিক উঁচু rank এবং স্কলারশিপ মোটমুটি হিন্দু এবং হেয়ার এই দুটি স্কুল থেকেই পেত - সেখানে পরীক্ষার জন্য আলাদা ঘষা মাজা হত।  বলা বাহুল্য, জ্ঞান সমুদ্রে সাঁতার কেটে বেড়ানো প্রফুল্লচন্দ্র স্কলারশিপ এর তালিকায় ছিলেন না। 

এই প্রসঙ্গটা প্রফুল্লচন্দ্র বেশ কয়েকবার তুলেছেন, কারণ আর সবার মতো ছোটবেলায় স্কুল জীবনে প্রাইজ, rank ইত্যাদির মোহ ছিল, তাই হয়ত ম্যাট্রিক এ স্কলারশিপ না পাওয়ায় সাময়িক দুঃখ ও হয়ত হয়েছিল, কিন্তু বৃহত্তর জীবনে প্রবেশ করে দেখলেন অনেক rank ধারীর চেয়ে তিনি অনেক সফল।  শিক্ষক হিসেবেও অনেক rank ধারীর মধ্যে জ্ঞানের অপ্রতুলতা ও শূন্যতা লক্ষ্য করেছিলেন।  তাঁর আত্মচরিতে তাই একাধিক অধ্যায়ে এই নম্বর সর্বস্ব পরীক্ষা ও ডিগ্রি এবং তার প্রতি ভারতীয়দের বিধ্বংসী মোহের কঠোর সমালোচনা করেছেনশিক্ষকের কার্যে আমার 45 বছর ব্যাপী অভিজ্ঞতায় আমি বহু ছাত্রের সংস্পর্শে আসিয়াছি । যাহারা বিদ্যালয় পরীক্ষায় কৃতিত্ব দেখাইয়া বৃত্তি প্রভৃতি হইয়াছিল তাহাদের অনেকের পরবর্তী জীবন ব্যর্থতার মধ্যে পর্যবসিত হইয়াছে।”


ভারতের প্রথম সফল স্টার্ট আপের আচার্য

 নিজের চেষ্টায় মাটি থেকে উঠে আসা ডিগ্রিহীন নায়কদের উদাহরণ দিয়েছেন বারবার ।  পড়লে মনে হয় যেন তিনি আজকের দিনের মানুষ- এখনকার বাবা-মাদের উপদেশ দিচ্ছেন। তিনি নিজে ফেল করা বা সুযোগ না পাওয়ার কারণে  ডিগ্রিহীন অনেককেই নিজের কম্পানিতে কাজ দিয়েছিলেন। 

আর একটা ঘটনা ঘটেছিল।  রক্ত আমাশা তাঁকে প্রায় মৃত্যুর দ্বারে পৌঁছে দিয়েছিল। ফিরে আসতে পারলেন খাওয়া শোয়ার কঠোর অনুশাসনে, যে অভ্যাস তাঁর জীবনে আরও 72টি বছর যোগ করেছিল সেই যুগে, যখন গড় আয়ু ছিল মাত্র 53  এই যুক্তিতে তিনি অতিভোজনবিলাসীদের কঠোর সমালোচনা করেছেন।  বড় আক্ষেপ করেছেন স্বামী বিবেকানন্দ এবং সুহৃদ গোপাল কৃষ্ণ গোখলের স্বল্পায়ুর জন্য, কারণ দুজনেই যে অতিভোজন বিলাসী ছিলেন! মিল পাই না, এখনকার যুগের সঙ্গে

ব্যবসা বুদ্ধি কিন্তু তাঁর  ছোট্ট বয়স থেকেই ছিল। তাঁর বাবা কারও পরামর্শে এক ইংরেজি সংস্কৃত অভিধান পুনর্মুদ্রণে অনেক টাকা লগ্নি করেন।  অর্ধেকের ও কম বিক্রি হল, তাও লোকসান দিয়ে।  বাকি বই গুলি বইয়ের প্রতি স্বাভাবিক মমত্বে প্রফুল্লচন্দ্র রদ্দির দরে বিক্রি করতে দেননি, বয়স তাঁর তখন বারো।  পাঁচ বছর ধরে উইপোকা ও ইঁদুরের হাত থেকে সেই বই গুলিকে রক্ষা করে চললেন।  ইতিমধ্যে ঋণের চাপে তাঁর বাবা মা কলকাতার বাস উঠিয়ে যখন গ্রামে ফিরে চললেন, প্রশ্ন উঠল এই বইগুলির কি হবে? সতের বছরের প্রফুল্লচন্দ্র খবরের কাগজে এমন একটি বিজ্ঞাপন দিলেন যেন এই বইটি ভীষণ প্রয়োজনীয়, কিন্তু দুষ্প্রাপ্য, মাত্র কয়েক কপিই আছে।  ডাকে পাঠানো অর্ডারে বিক্রি হবে।  যে দাম ধরেছিলেন, তাতে সব বই বিক্রি হয়ে পুরোনো লোকসানও উঠে গেল। এরকম অবস্থায় ক্ষুদে জিনিয়াস ব্যবসায়ীরা যা করে, তিনিও তাই ভেবেছিলেন- পুস্তক বিক্রেতা হবেন।  খালি গিলক্রাইস্ট স্কলারশিপ জুট যাওয়ায় সব গণ্ডগোল হয়ে গেল।  ভবিষ্যতে তাঁরই ছাত্ররা যখন “চক্রবর্তী এন্ড চ্যাটার্জি” খুলল, তিনি সান্ত্বনা পেয়েছিলেন।  


ভারতের প্রথম সফল স্টার্ট আপের আচার্য

কেমন ছিল তাঁর বিদেশে ছাত্রাবস্থা

তাঁর আত্মচরিতের এই অংশটিও পড়লে মনে হয় ঠিক যেন স্কলারশিপের টাকায় বিদেশে পড়তে যাওয়া কোনো ছাত্রের আখ্যান।  যদিও তিনি রবীন্দ্রনাথের সমবয়সী, এবং একই বয়সে বিলেত গিয়েছিলেন, দুজনের অভিজ্ঞতা কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। প্রফুল্লচন্দ্র নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেছিলেন বিদেশ বিভুঁইয়ে জাহাজ থেকে নেমেই অথৈ জলে পড়তে হয়নি। জাহাজ ঘাটায় তাঁকে আনতে এসেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু, যিনি বছর খানেক আগেই ওখানে পড়তে গিয়েছিলেন।  ওখানে থাকার প্রয়োজনীয় টিপস ওঁরাই দিয়ে দেন।  তারপরে পড়াশুনো, গবেষণা, কম পয়সায় খরচ চালানো, সেই সূত্রে ওদেশের গরিবদের জীবন যাপন জানা।  বিলেত বাসের অন্য আকর্ষণীয় দিক গুলোও কিন্তু বাদ দেননি। বল নাচের আসরেও গেছেন, মেয়েদের সঙ্গে কথা বলেছেন, কিন্তু তেমন মিশতে পারেননি।  সব চেয়ে আনন্দ করেছেন উইক এন্ড এ স্যান্ডউইচ পকেটে নিয়ে স্কটল্যান্ডের পাহাড়ে পাহাড়ে ট্রেক করে বেড়িয়ে।  সস্তায় ইউরোপ দর্শনও সেরে ফেলেছেন।  

সেই যুগে ইংরেজ ভারতে বসে ভারতীয়দের ওপর যতই অত্যাচার করুক না কেন, নিজের দেশে তারা ভদ্র ছিল।  কাজেই বিলেতে বসে তাঁকে বর্ণ বৈষম্যের শিকার হতে হয় নি, এবং ইংরেজদের দেখে সাহসী ও স্পষ্টবাদী হয়েছেন।  বিজ্ঞান শিক্ষার ফাঁকে ফাঁকে ওখানের সংবাদপত্রে পরাধীন ভারতের নানা অনাচারের প্রতিবাদ করেছেন।  

এসবের পরে যেটা বলা বাহুল্য, বিলেত থেকে তিনি শ্রেষ্ঠ ছাত্র ও শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীর তকমা নিয়ে ফিরেছিলেন।  ওখানে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ অবশ্যই ছিল, যেমন ছিল জগদীশ চন্দ্র বসুর।  এ হেন রবীন্দ্রনাথের মত মানুষও জগদীশ চন্দ্রকে পরামর্শ দিয়েছিলেন বিজ্ঞানের খাতিরে ওনার বিলেতে থেকে যাওয়া উচিত।  কিন্তু দেশের খাতির দুই আচার্যের কাছেই অনেক বড় ছিল, তাই দুজনেই অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হবেন জেনেও ফিরে এসেছিলেন ভারতে।  ভারতের বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস তাই দুজনের কাছেই কৃতজ্ঞ। 

বিলেত থেকে ফিরে  আসার সময়ে তাঁকে সেই সব অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল, যার  আজও বিদেশ থেকে শিক্ষা শেষ করে দেশে ফিরতে চাইলে সামনে আসে। তার কয়েক বছর আগে ইংরেজ নিজেদের শাসনকার্য পরিচালনার স্বার্থে সিভিল সার্ভিস চালু করেছিল, যাতে মেধাবী ভারতীয়দেরও  কাজে লাগানো যায়।  তবে যতই মেধাবী হোক না কেন, ভারতীয়ের মাইনে কিছুতেই ইংরেজের দুই তৃতীয়াংশর বেশি হতে পারত না।  উপরন্তু ছিল আমলা তন্ত্রের নানা জটিল নিয়ম। এইসব জটিল নিয়মের আর একটা কারণ ছিল, উচ্চ শিক্ষিত ভারতীয়ের মধ্যে তখন আত্মমর্যাদা এবং জাতীয়তাবোধ জেগে উঠছে, অনেক ভারতীয়ের অবস্থিতিই তখন ধীরে ধীরে ব্রিটিশের পক্ষে অস্বল্তিকর হয়ে উঠছে, কাজেই সেটা রোধ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করা হত।  এই সব কারণে জগদীশ চন্দ্র বসু এবং প্রফুল্লচন্দ্র দুজনকেই ছাত্রাবস্থা শেষ করে ভারতে ফিরে আসার পর নানা রকম বাধার সম্মুখীন হতে হয়।  প্রফুল্লচন্দ্রকে একবছরের বেশি সময়ে চাকুরিহীন অবস্থায় থাকতে হয়।  এই সময়টা তিনি জগদীশচন্দ্রর সঙ্গে উদ্ভিদ  বিদ্যা চর্চা করে কাটান।  অবশেষে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের নবনির্মিত রসায়ন বিভাগে অধ্যাপকের কাজ পেলেন। ব্যক্তি প্রফুল্লচন্দ্রের মানব সমাজের সম্পত্তি হয়ে ওঠার সেটাই প্ৰথম সোপান

ভারতে দুর্নীতি ব্রিটিশের আমদানি এই কথাটা প্রফুল্লচন্দ্র বহুবার বলেছেন।  পলাশীর যুদ্ধ জয় হয়েছিল উৎকোচ দিয়ে।  পরবর্তী কালে ব্রিটিশ ঘনিষ্ঠ দেওয়ান, নায়েব ইত্যাদি (যাঁদের মধ্যে রাজা নবকৃষ্ণ দেব ও পড়েন), এঁদের মাইনে ছিল খুব কম, কিন্তু মাতৃদায়ে সেই বাজারে ৯ লক্ষ টাকা খরচ করা এঁদের কাছে খুব সাধারণ ব্যাপার ছিল।  দুর্নীতির ইঙ্গিত তুলেছেন, তবে সরাসরি অভিযোগ করেননি।  

 

শিক্ষাব্রতী প্রফুল্লচন্দ্র 

প্রফুল্ল চন্দ্রের আবিষ্কার কী? আমাদের ছোটবেলায় সাধারণ জ্ঞানের বইতে বা এখন গুগল করলে লেখা থাকে মার্কিউরাস নাইট্রাইট।  নাইট্রাইট যৌগগুলি খুব অস্থায়ী, তাদের সংশ্লেষ করার এক নতুন পদ্ধতি তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, যেটাকে আবার প্রমাণ করতে প্রায় একশ বছর লেগে গিয়েছিল।  কিন্তু এ ধরণের আবিষ্কার ছোট বড় মাঝারি বৈজ্ঞানিকরা প্রতিনিয়ত করে চলেছেন, তাঁরা কেউ প্রফুল্লচন্দ্র নন। প্রফুল্লচন্দ্রর প্রকৃত অবদান হল একটা ক্ষতবিক্ষত, পরাধীন, অশিক্ষিত, কুসংস্কারে নিমজ্জিত দেশে  বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্র প্রসারিত করা। তাঁর আবিষ্কার এক ঝাঁক কৃতী বিজ্ঞানী ছাত্র, যাঁরা  অনেকেই রসায়নশাস্ত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা করেছিলেন। এই ছাত্র গোষ্ঠী “স্কুল অফ কেমিস্ট্রি” নাম পরিচিত এবং এঁরা  প্রাক্-স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রসারে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন।  

আত্মচরিতে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনক হিসেবে সার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নাম বারবার উল্লেখ করেছেন।  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছিল সম্পূর্ণ ভারতীয়দের দ্বারা। ব্রিটিশের নীতি এবং ব্যবহারে পদে পদে অপমান ও সংঘাত মেলায় সার আশুতোষ ব্রিটিশ সরকারের সাহায্য পরিহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।  আইনজীবী রাসবিহারী ঘোষ ও খয়রার রাজা শ্রীযুক্ত পালিত নিজেদের ব্যক্তিগত সমস্ত সম্পত্তি এই কাজে উজার করে দিয়েছিলেন।  তারপরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ভারতে সর্বোচ্চ স্থানে আনার প্রায় পুরো কৃতিত্বই প্রফুল্লচন্দ্রর।  ব্যাঙ্গালোর এবং বোম্বেতে দুটি গবেষণার কেন্দ্র ছিল , টাটা ও ব্রিটিশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত (যারা আজও অন্য নামে বিদ্যমান)। প্রফুল্লচন্দ্র লক্ষ করলেন সেখানে প্রচুর অর্থ থাকা সত্ত্বেও গবেষণার মান উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে উঠতে পারেনি। তার একটা বড় কারণ হল উচ্চ পদাধিকারীরা সেখানে সবাই ইংরেজ, এবং তাদের কাজ করার কোনও যোগ্যতা নেই। অন্যদিকে উজ্জ্বল ভারতীয় তরুণ অধ্যাপকদের নামমাত্র বেতন দেওয়া হয়।  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা না থাকতে পারে, কিন্তু তিনি এমন অনুপ্রেরণার পরিবেশ তৈরি করলেন যে দলে দলে উজ্জ্বল অধ্যাপকরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েই কাজ করতে এল।  

 

তিনি নিজের গবেষণা ভারতীয় পত্রিকাতেই প্রকাশ করতেন।  যে যুগে ভারতে  বিজ্ঞান পত্রিকা ছিল না। প্রফুল্লচন্দ্র নিজের গবেষণা এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন, এবং তাতে আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেতে অসুবিধা হয়নি।  কিন্তু তিনি দেখলেন, তাঁর ছাত্ররা আন্তর্জাতিক সম্মানের জন্য আন্তর্জাতিক পত্রিকায় গবেষণা প্রকাশ করছেন।  তখন তিনি ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করলেন এবং তার মুখপত্র বিজ্ঞান পত্রিকাও প্রকাশ করলেন।  আচার্য জগদীশচন্দ্রর মত তাঁরও পুরো মাত্রায় আত্মবিশ্বাস ছিল যে ভারতে বসেই, ভারতীয় গবেষক দ্বারা বিশ্বমানের গবেষণা করা সম্ভব।  জগদীশচন্দ্র তো বাংলাতে গবেষণা পত্রও লিখেছেন এবং বলেছেন যে মৌলিক গবেষণা  যদি উচ্চ মানের হয়, তবে সেটা বাংলাতে প্রকাশ করলে তার সম্বন্ধে জানার জন্য বিশ্বের বিজ্ঞানী বাংলা শিখবে, ঠিক যেমন তাঁরা ফরাসি জার্মান শেখেন।  জগদীশচন্দ্রর ধারণা এতটুকু অলীক ছিল না। কারণ সমসাময়িক রবীন্দ্রনাথের প্রকাশিত বহু রচনার রস পাওয়ার জন্য এবং নিজের ভাষায় অনুবাদ করার জন্য সারা বিশ্বের বহু কবি সাহিত্যিক বাংলা শিখেছেন।  রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে চীন, জাপান, ইয়োরোপের বহু দেশ, রাশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা সর্বত্র জনগণ রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়েছিলেন এবং তাঁর ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন।  জার্নাল অফ ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি অবশ্য ইংরেজিতেই প্রকাশ হয়।  

 

প্রফুল্লচন্দ্র নিজে বিদেশেই উচ্চশিক্ষা করেছিলেন, কিন্তু বিদেশী স্কলারশিপের কৃপায়।  ধনীদের মধ্যে অনেক সময়েই চল থাকে সন্তানকে বিদেশে শিক্ষা নিতে পাঠানোর - যেমন এযুগে এক প্রচণ্ড হিড়িক হয়েছে।  এই চলটা কে তিনি সমালোচনা করেছেন। তাঁর বক্তব্য ছিল এই যে, এই ভাবে শিক্ষার মান সব সময়ে খুব যে বাড়ে তা নয়, কারণ বিদেশে সব কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান খুব কিছু আহামরি নয়।  বরং এইভাবে আমাদের গরিব দেশের অর্থ সম্পদ বিদেশে চলে যায়  এই কথাটা আজও প্রবলভাবে সত্য।  তাঁর সামনে জাজ্জ্বল্যমান উদাহরণ ছিলেন সি ভি রামন, যিনি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে বিদেশ যাত্রা ও করেননি , ডক্টরেট উপাধি নেওয়ারও চেষ্টা করেননি।  

 

শিক্ষাবিদ হিসেবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অসার ডিগ্রির কারখানাতে পর্যবসিত হওয়ার তিনি কঠোর সমালোচনা করেছেন।  ভীষণ অপছন্দ করেছেন বাবা-মায়ের চাপে সন্তানের যে বিষয়ে আনন্দ বা ব্যুৎপত্তি নেই, সেই বিষয়ে তাকে জোর করে উচ্চশিক্ষা করতে বাধ্য করা।  বারবার বলেছেন, যে, বেশির ভাগ পেশাতেই  ডিগ্রি এবং উচ্চ শিক্ষার আদৌ কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। এর সপক্ষে তিনি দেশ বিদেশের অজস্র উদাহরণ হাজির করেছেন।  তাঁর সহজ বক্তব্য, যা একই সঙ্গে কঠিনও বটে - উচ্চ শিক্ষার নামে এই প্রহসনের কোনও প্রয়োজন নেই।  কঠিন কঠিন দুর্বোধ্য বিষয় পড়ার চেষ্টা করে কৈশোর যৌবনের সোনার দিন গুলো ধ্বংস করার প্রয়োজন নেই।  বুনিয়াদি শিক্ষা হোক মজবুত-  তারপর যার সত্যিকারের উচ্চ শিক্ষা, গবেষণাতে আসক্তি, শুধু তারাই এগোক উচ্চ শিক্ষার দিকে।  বড় সত্যি কথা, কিন্তু তোমার কথা হেথা কেহ তো শোনে না ! 

 

বেঙ্গল কেমিক্যাল: ভারতের প্রথম স্টার্ট আপ 

স্টার্ট আপ শুরুর মূলমন্ত্র হল কোনো একটা বৃহৎ সমস্যাকে সনাক্ত করে তার এমন কোনও সমাধান বার করা, যা ব্যবসায়িক সাফল্য আনতে পারে।  প্রফুল্লচন্দ্র দেখলেন যে সেই সময়ে বাজারে ক্যালসিয়াম ফসফেট এর প্রচুর চাহিদাযোগান কম। যেটুকু পাওয়া যায় বিদেশী, অসম্ভব দাম। অথচ ক্যালসিয়াম  ফসফেট তৈরী হয় হাড় থেকে, যার অন্ততঃ কলকাতা শহরে কোনো অভাব নেই। দুঃসাহসিক প্রফুল্লচন্দ্র রাজাবাজার থেকে গরুর হাড় এনে একটি বাড়ি ভাড়া করে, তার ছাদে রোদে হাড় শুকিয়ে কিছু সহজ রাসায়নিক পদ্ধতিতে ক্যালসিয়াম ফসফেট বানানো শুরু করলেন।  হিন্দু প্রতিবেশীরা ধার্মিক কারণে আপত্তি করেছিল কিনা জানা নেই, কিন্তু ছাদে হাড় শুকোনোর কারণে কাক চিলের উপদ্রব নিয়ে প্রতিবাদ করেছিল। তখন বাগমারীর দিকে প্রচুর জমি খোলা- প্রফুল্লচন্দ্র সেরকম একটি জমি নিয়ে ফসফেট বানাতে শুরু করলেন।  একটি অর্ধ শিক্ষিত দালাল রাখলেন বিক্রি করার জন্যে।  বিক্রি ভালই হতে লাগল।  এবার ফসফেটের পাশাপাশি অন্য রাসায়নিক, বিশেষ করে অ্যাসিড, সালফিউরিক অ্যাসিড।  কারখানায় বিশাল আকারে উৎপাদন করার আগে তাঁর ল্যাবরেটরিতে ছোট আকারে, অর্থাৎ পাইলট স্কেলে রাসায়নিক পদ্ধতি প্রস্তুত করা।  এই কাজে সহায়ক পাওয়ার ভাগ্য প্রফুল্লচন্দ্রর বড়ই অপ্রসন্ন।  উৎসাহী সহযাত্রী পেয়েছিলেন একাধিকবার।  কিন্তু দুৰ্দৈবে নানা কারণে নানা সময়ে তাঁদের অকালমৃত্যু প্রফুল্লচন্দ্রকে এই বিশাল কর্মযজ্ঞে বার বার একলা ফেলে রাখে।  কিন্তু কোনও কিছুই তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি - ধাপে ধাপে তাঁর স্টার্ট আপ বেঙ্গল কেমিক্যাল বড় হয়।  প্রথম মহাযুদ্ধের বাজারে অ্যাসিড বিক্রি করে প্রচুর লাভ করে।  এরপরে আরো বড় হয়ে ওষুধ বানানোর সঙ্কল্প নিয়ে পাব্লিক কোম্পানি হয় বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস। প্রফুল্ল চন্দ্রের মৃত্যুর পরেও অনেক দশক এই কোম্পানি অত্যন্ত লাভজনক ছিল. আশির দশকের বাংলা আর পাঁচটা কারখানার মত একেও রুগ্ন  শিল্পের পর্যায়ে ফেলে দিল।  

তাঁর আত্মচরিতের বেঙ্গল কেমিক্যাল অধ্যায় হতে পারে যে কোনো এন্ত্রেপ্রেনিউর এর অনুপ্রেরণার স্থল। আজকাল সাকসেস স্টোরি প্রচারের একটা চল হয়েছে। এই বইটিকে নির্দ্বিধায় সাকসেস স্টোরি ও বলা যায়।    

যতই ব্যবসা বুদ্ধি থাকুক না কেন প্রফুল্লচন্দ্র মানবতাকে সবার উপরে স্থান দিতেন। তিনি জানতেন আধুনিক বিজ্ঞান যে নতুন নতুন ওষুধের জন্ম দেবে, তার থেকে বিশাল ওষুধের বাজার তৈরি হবে। কিন্তু নতুন ওষুধের গবেষণা ব্যয় এবং শ্রম সাপেক্ষ । সেই জন্যে তিনি প্রস্তাব রেখেছিলেন যদি ছোট ছোট ওষুধ কোম্পানি প্রতিযোগিতা ভুলে গিয়ে যৌথ ভাবে গবেষণায় উদ্যোগী হয়, তবে গবেষণার খরচ ও সময় অনেক কমে। মানুষের লোভ এই যৌথ প্রচেষ্টার অন্তরায় হতে পারে এও তিনি ভালো ভাবেই জানতেন। কোভিডের আমলে এই যৌথ প্রচেষ্টার অভাব বিশ্ব জুড়ে জনগণ অসহায় ভাবে প্রত্যক্ষ করল, কিন্তু লোভী ব্যবসায়ীগণ ত্রাতার মুখোশ পরে প্রতিযোগিতা ও মুনাফা ছাড়তে রাজি হল না। 

 

বহুভাষাবিদ ও ইতিহাসবিদ  প্রফুল্লচন্দ্র 

প্রফুল্লচন্দ্র কতগুলো ভাষা জানতেন? বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত, লাতিন, ফারসি  ও ফরাসি।  যেমন তেমন জানা নয়, প্রতিটি ভাষাতেই তাঁর অসাধারণ দখল ছিল।  ছোটবেলা থেকে অপরিসীম জ্ঞানের ক্ষুধা থাকায় এতগুলি ভাষা নিজের চেষ্টাতেই শিখতে পেরেছিলেন এবং এইসব ভাষায় লেখা মূল ঐতিহাসিক গ্রন্থ গুলিও পড়তে পেরেছিলেন।  লাতিন ও ফরাসি তাঁর বিদেশ বাসের সময়ে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় কাজে এসেছিল।  কিন্তু তাঁর সংস্কৃত ভাষার দখলের অসামান্য ফসল হিন্দু রসায়নের ইতিহাস গ্রন্থাবলী। ব্রিটিশরা আমাদের দেশের অনেক কিছু ধ্বংস করেছিল বটে, কিন্তু ব্রিটিশ আমলেই প্রচুর প্রাচীন পুঁথি সংরক্ষণ ও অনুবাদ শুরু হয়।  ব্রিটিশরাই প্রথম লক্ষ করে যে প্রাচীন ভারতে অত্যন্ত উন্নত মানের বিজ্ঞান চর্চা হত  তারা ভারতীয় দর্শন ও গণিতের নানা বিভাগ, যেমন পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান এমনকr চিকিৎসা বিজ্ঞানেরও অনুবাদ করে, কিন্তু রসায়ন বাদ রয়ে যায়। খুব সম্ভবতঃ যোগ্য লোক অর্থাৎ রসায়ন এবং সংস্কৃতে সমান পান্ডিত্য সম্পন্ন ব্যক্তির অভাবই তার কারণ ছিল।  প্রফুল্লচন্দ্র এই দুরূহ কাজটির দায়িত্ত্ব নিলেন, এবং তিন বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম (ভারতের এবং লণ্ডনের সমস্ত পুঁথির সংরক্ষণাগার খোঁজা এবং ভাণ্ডারকার, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখ পুঁথি বিশারদদের সঙ্গে পরামর্শের ফসল হল History of Hindu Chemistry বইটি আন্তর্জাতিক মহলে প্রভূত সাড়া ফেলে।

 

এই সাফল্যে তিনি খুশি হলেও এই তিন বছরে আধুনিক রসায়ন যে লম্বা পায়ে অনেকটাই এগিয়ে গেছে, এবং তিনি “ইতিহাস” লিখতে গিয়ে পিছিয়ে গেছেন এটা তাঁর কাছে সাময়িক ক্ষোভ উৎপন্ন করে।  হাস্যকর লাগে যখন এই যুগে প্রাচীনকালের ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি আধুনিক পাঠ্যক্রমে অন্তর্গত করার চেষ্টা করা হয়।  কোন তন্ত্র বা কোন পুঁথিতে কী কী বৈজ্ঞানিক তথ্য আছে তা শুধু প্রফুল্লচন্দ্র স্তরের জ্ঞানী বিজ্ঞানীর পক্ষে বুঝে সহজ ভাষায় সহজপাঠ্য বই লেখা সম্ভব।  এই যুগে সেই রকম জ্ঞানী কোথায় যে পাঠ্যপুস্তক স্তরে প্রাচীন ভারতের জটিল বিজ্ঞান বা ইঞ্জিনিয়ারিং এর কথা ছাত্রদের বোঝাবে? শুধু তাই নয়, অনাবশ্যক অতীতকে খুঁজতে চাওয়া মানে উল্টো পথে হেঁটে বর্তমান থেকে পিছিয়ে যাওয়া। প্রফুল্লচন্দ্র বুঝেছিলেন, এখনকার অতিউৎসাহী সনাতন ধর্ম অন্বেষীরা কবে বুঝবে

 

এছাড়া আত্মচরিত লিখতে লিখতে তিনি বহু দেশের ইতিহাসের অবতারণা করেছেন।  অষ্টাবিংশ শতকের বাংলার ইতিহাসের যা বর্ণনা ও ব্যাখ্যা এনেছেন বারেবারে তা অত্যন্ত মূল্যবান।     

 

বঙ্গপ্রেমিক প্রফুল্লচন্দ্র 

প্রফুল্ল চন্দ্রের বাঙালি সুলভ কী কী গুণ ছিল? অবশ্যই  জ্ঞানলিপ্সা , সাহিত্য প্রীতি, কবিতা-প্রেম। বাঙালি সুলভ দোষ, অর্থাৎ অলসতা , ক্ষুদ্রতা, কুসংস্কার, পরশ্রীকাতরতা, ঔদরিকতা - এগুলো তাঁর চরিত্রে একেবারেই ছিল না।  কিন্তু তাঁর মতো বাংলার অবক্ষয়ে প্রাণ খুব কম বাঙালিরই কাঁদে।  তাঁকে তাই বাঙালি না বলে বঙ্গপ্রেমী আখ্যা দিলে বোধহয় বেশি ভাল হয়।  তাঁর আত্মচরিতকে বাঙালির অবক্ষয়ের ইতিহাস ও বলা যায়।  তিনি দেখিয়েছেন, ইংরেজ আমলের আগে বাংলা সত্যি সত্যি সোনার বাংলাই ছিল, অর্থাৎ হাতে হাতে কাজ ছিল - হোক না সে জাতি ভিত্তিক কাজ। ইংরেজরা আসার সঙ্গে সঙ্গে এল বাবু সংস্কৃতি - অলসতা বাঙালিকে পেয়ে বসল।  পেশা বলতে কলম পেষা ছাড়া অন্য কোনো পেশা তাদের পছন্দ হল না।  এদিকে সুজলা সুফলা সোনার বাংলার সম্পদের খোঁজ পেয়ে গেল বিহার এবং তার ও পশ্চিমের রাজ্য গুলি।  সেখান থেকে দলে দলে বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে বাংলার সমস্ত পেশা এক এক করে তাদের দখলে চলে গেল।  রাজস্থান মাড়োয়াড় থেকে বানিয়ার দলের হাতে চলে গেল বাংলার সমস্ত ব্যবসা বাণিজ্য।  এদের অনেকেই শুধু লোটা কম্বল হাতে বাংলায় এসে অর্জিত ধন দৌলত সব পাঠিয়ে দিত নিজের রাজ্যে- বাংলার উন্নতির জন্য এক পয়সা দেন বা ব্যয় তারা করত না

 প্রফুল্লচন্দ্র অনুযোগ করেছেন যে বাংলার বহু শহর, এবং কলকাতার বহু অঞ্চলে বাঙালি  সংখ্যালঘু।  যারা আছে তারা নিজেদের মধ্যে মামলা মোকদ্দমা করতে করতে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে যাচ্ছে, তবু অলসতা কাটিয়ে উঠে নিজের, জাতের এবং রাজ্যের উন্নতির কোনো চেষ্টা নেই।  অন্য রাজ্য থেকে আসা মানুষ জন কে ঠিক বহিরাগত হিসেবে দেখেননি, কিন্তু বানিয়া বৃত্তির সঙ্গে যে লোভ, যে অসততা আছে, তাকে তিনি ঘৃণা করেছেন।  তিনি অনুযোগ করেছেন যে বিড়লাদের সম্পদ মূলতঃ বাংলা থেকে, কিন্তু তারাও বাংলা উন্নতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ইত্যাদিতে কখনো কোনো দান ধ্যান করে নি , বরং নিজের রাজ্যে পিলানিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে। বাঙালিদের প্রিয় একটি পেশা সম্বন্ধে তাঁর উষ্মা ছিল - সেটি হল ওকালতি।  উষ্মার একটা কারণ হল বাঙালিদের অবক্ষয়ের বিরাট কারণ হল আত্মঘাতী মামলা বাজি - এবং এই পেশাটি তাতে ইন্ধন যোগায়।  তিনি বলেছেন ওকালতি প্রিয় হওয়ার একটা কারণ হল পূর্ব প্রজন্মের সংস্কৃতজ্ঞ তর্করত্ন, তর্কবাগীশদের গুণ পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হওয়া।  তিনি লক্ষ করেছেন ওকালতি পড়তে আসা বা ওকালতিকে জীবিকা হিসেবে নেওয়া বাঙালির তুলনায় সফল আইনজীবী নগণ্য।  যাঁরা সফল তাঁদের মধ্যে খুব হাতে গোনা কয়েকজনই  মাত্র দেশের উন্নতির জন্য দানধ্যান করতেন। এদের মধ্যে রাসবিহারী ঘোষ ও তারকনাথ পালিতের নাম উল্লেখ যোগ্য।  বাকি সফল আইনজীবীদের সম্বন্ধে প্রফুল্লচন্দ্রর অনুযোগ ছিল যে তাঁরা অত্যন্ত ধনী, বিলাস ব্যসনে টাকা ওড়াতে তাঁদের কোনো সঙ্কোচ নেই, কিন্তু কিন্তু গঠন মূলক কাজে তাদের দেখা পাওয়া যায় না।  

 

দেশপ্রেমিক, রাজনীতিক ও সমাজসেবী  প্রফুল্লচন্দ্র 

আজকাল আত্মনির্ভরতা একটা বড় রাজনৈতিক চাল হয়েছে। এই স্লোগানের আড়ালে ভারতের বাজার আরও বেশি করে বিদেশ নির্ভর, বিশেষ করে চীন নির্ভর করে তোলা হচ্ছে।  কিছু মানুষের মধ্যে বেশ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দেশপ্রেম’, জাতীয়তাবাদ এসব জাগিয়ে তোলা হচ্ছে।  প্রফুল্লচন্দ্রের আত্মচরিত পড়লে বোঝা যায় এ চিত্রটা একেবারেই নতুন নয়।  পরাধীন ভারতে, স্বদেশী আমলে রাজনৈতিক নেতারা এবং শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা এর থেকে ভালই ফায়দা তুলেছে।  

 

প্রফুল্লচন্দ্র যথেষ্ট বাস্তববাদী ছিলেন।  সঙ্গে সৎ এবং দেশপ্রেমী ছিলেন।  তিলে তিলে  বেঙ্গল কেমিক্যাল গড়ে তোলা ছিল তাঁর দেশপ্রেমের সবচেয়ে বড় উদাহরণ।  ভারতকে রাসায়নিক এবং ওষুধের ক্ষেত্রে আত্মনির্ভর করে তোলা।  আগেই বলেছি বেঙ্গল কেমিক্যালের অ্যাসিড প্রথম মহাযুদ্ধে বিক্রি হয়েছিল। বহুবছর পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে বেঙ্গল কেমিক্যাল সালফিউরিক অ্যাসিড এর একচেটিয়া উৎপাদক ছিল।  সেই প্রফুল্লচন্দ্র অত্যন্ত যন্ত্রণা পেতেন স্বদেশী’-র নামে গরীব মানুষের সামর্থ্যের মধ্যে থাকা বিদেশী বস্ত্র ইত্যাদি পুড়িয়ে দিয়ে ধ্বংসোল্লাস দেখতে।  এই সব স্বদেশী গরfব মানুষের কষ্টার্জিত অর্থের বিনিময়ে কেনা কাপড় ইত্যাদি কেড়ে নিয়ে জ্বালিয়ে দিয়ে আত্মপ্রসাদ ভোগ করত, কিন্তু বিনিময়ে তাদের জন্য কোনও ব্যবস্থা করার কোনো ইচ্ছেই তাদের বেশির ভাগের ছিল না।  চরকা এবং খাদি আন্দোলনকে প্রচার করা হয়েছিল স্বনির্ভরতার প্রতীক হিসেবে এবং প্রফুল্লচন্দ্র নিজেও তার প্রচারক ছিলেন।  তাঁর জনপ্রিয় ছবিতে তাঁকে  মোটা খাদির ধুতি-ফতুয়াতেই দেখা যায়।  কিন্তু সমসাময়িক রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন, শুধু চরকা কেটে দেশের সব সমস্যার সমাধান হয় না। বরং স্বাধীনতা আন্দোলন (যাকে তিনি স্বদেশী আন্দোলনের থেকে আলাদা মর্যাদায় রেখেছিলেন), চরকাকেন্দ্রিক হয়ে গিয়ে লক্ষ্য থেকে সরে যাচ্ছে।  চরকা আন্দোলন নেতা-নেত্রীদের ব্যক্তিগত স্বার্থ কী ভাবে চরিতার্থ করছে তা তিনি একাধিক ছোট গল্প ও উপন্যাসের চরিত্রে এঁকেছেন।  

 

প্রফুল্লচন্দ্র নিজে শিল্পপতি হওয়ায় শিল্প বাণিজ্য ভালই বুঝতেন।  তিনি দেখলেন এই স্বদেশী আন্দোলনের ধুয়োতে আমদানি সংক্রান্ত কিছু কিছু আইন পরিবর্তিত করা হল, কিন্তু তা বোম্বাই অঞ্চলের শিল্পপতিদের স্বার্থ মেনে।  তিনি দেখলেন জার্মানি থেকে আসা সস্তা টিনের শীট বন্ধ হয়ে গেল, তার জায়গায় এল দেশি শিল্পপতি, টাটা ইত্যাদিদের উৎপন্ন অনেক দামি শীট।  বাংলার হত দরিদ্র গ্রামবাসীর  আগে তাও বর্ষা থেকে মাথা বাঁচানোর সামর্থ্য ছিল, পরে আর সেটুকুও রইল না।  আক্ষরিক অর্থে তাদের মাথার উপর থেকে ছাদ সরে গেল।  

 

তিনি আরও লক্ষ করেছিলেন, বহু ব্যবসায়ী আইনের ফাঁক গলে কিন্তু ওর মধ্যেই বিদেশী জিনিস আমদানি করে স্বদেশী ছাপ লাগিয়ে দু তিন গুণ দাম বাড়িয়ে প্রচুর পয়সা লুটে নিচ্ছে।  আমার ঠিক জানা নেই, এই সব আমদানি সংক্রান্ত স্বদেশী আইন শুধুমাত্র নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল কিনা।  কারণ প্রফুল্লচন্দ্র দেখেছেন, মনোহারী অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ঠিক মফস্বল এবং গ্রামে পৌঁছে যাচ্ছে এবং অশিক্ষিত গ্রামবাসীকে লুব্ধ করছে।  দরিদ্র গ্রামবাসীরা লোভে পড়ে কষ্টার্জিত সঞ্চয় শেষ করে এই সব লোভের জিনিস কিনছে।  এসব লোভের জিনিস হয় পলকা। কাজেই অচিরেই কষ্টের টাকা জলে গিয়ে তাদের দারিদ্র ও দুর্দশা অপরিবর্তিতই থাকছে।  লোভনীয় জিনিসের মধ্যে একটা উদাহরণ দিয়েছিলেন - টর্চ।  হঠাৎ শুনলে মনে হবে টর্চ তো গ্রামে গঞ্জে অপরিহার্য জিনিস। কিন্তু তিনি লক্ষ করেছিলেন যে ক্রেতারা এতই নির্বোধ ও অশিক্ষিত যে ব্যাটারি শেষ হয়ে গেলেই তারা টর্চ ফেলে দেয়।  

 

তিনি নিজে ব্যবসায়ী মানুষ, এবং বিজ্ঞাপনের শক্তি সম্পর্কে কৈশোর থেকেই অবগত।  কিন্তু দেশের স্বার্থে, দরিদ্র জনগণের স্বার্থে মুনাফাবাজির বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়েছিলেন।  নিজে বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদ বলে যন্ত্রকে তিনি ভালো বুঝতেন।  যন্ত্র প্রচুর মানুষকে কর্মহীন করে এটা অস্বীকার করলেও ধ্রুব সত্য। তাই তিনি যন্ত্রের ব্যবহার ততটাই সুষম রাখতে উপদেশ দিয়েছেন, যাতে প্রতিটি হাতে কাজ যেন থাকে।  এ তাঁর ভাবী স্বাধীন ভারতবর্ষকে সুখী, শান্তিপূর্ণ ভারতবর্ষের রেসিপি।  

 

এছাড়া অকুতোভয় প্রফুল্লচন্দ্র ইংরেজের প্রতিটি ভুল কাজের যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা করতে কখনো পিছপা হতেন  না।  যে ভাষায় তিনি সমালোচনা করতেন সভা-সমিতি, সংবাদ পত্রে , আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানে তাঁর প্রগাঢ় সম্মান না থাকলে হয়ত সিডিশনের দায়ে ইংরেজ তাঁকে জেলে পুরে দিত।  

তাঁর আত্মচরিত প্রথমে বেরিয়েছিল ইংরেজি ভাষায়, লণ্ডন থেকে।  বইটি এতই সমাদৃত হয়েছিল যে নেচার এবং নানা বিদেশী পত্রিকা  তাকে সুপাঠ্য এবং অবশ্যপাঠ্য আখ্যা দেয়।  আত্মচরিতের দ্বিতীয় খণ্ড, যেখানে তিনি নানা ধরণের গঠন মূলক সমালোচনা করেছেন, সেখানে ইংরেজের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা ও আছে। সেই তীব্রতা ইংল্যাণ্ডবাসী শিক্ষিত ইংরেজের আত্মশ্লাঘাতে লাগতে পারত।  কিন্তু সত্যভাষণকে তাঁরা নিন্দা প্রশংসা কোনোটাই না করে “তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্য”, “ভারতের নিজস্ব সমস্যা” ইত্যাদি বলে এড়িয়ে গেছেন।  

 

তিনি নিজে অবশ্য রাজনীতিক তকমা লাগা সম্বন্ধে বলেছেন যে রাজনীতিক হতে গেলে যে সময় দেওয়া দরকার, যত বক্তৃতা করতে এখানে ওখানে যেতে হয়, তার সময় তাঁর ছিল না। অর্থাৎ কিনা পেশাদার রাজনীতিক হওয়াকে তিনি প্রাধান্য দেন নি।  

 

প্রত্যক্ষভাবে সমাজ সেবা কিন্তু তিনি করেছেন। নিজের প্রাণের মায়া না করে বিধ্বংসী উত্তর বঙ্গের বন্যায় এবং প্লেগ মহামারীর সময়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আর্তের ত্রাণে।     

 

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের আত্মচরিত প্রকাশিত হয়েছিল 90 বছর আগে, 1932 সালে।  এর মধ্যে ভারত স্বাধীন হয়েছে তাঁর মৃত্যুর ঠিক পরে পরেই , তাও পঁচাত্তর বছর হয়ে গেল।  কিন্তু বদলায়নি অনেক কিছুই।  বদল যেটা হয়েছে, তখন আচার্য রায়ের মত খাঁটি মানুষ ছিল, আজ নেই।  কই রে আগের মানুষ কই


New
নায়কের খোঁজে বাঙালি
নায়কের খোঁজে বাঙালি
নির্বাচনী বন্ড: সরকারকে সব জানালেও সুপ্রিম কোর্টকে বলতে কেন বিলম্ব স্টেট ব্যাঙ্কের
নির্বাচনী বন্ড: সরকারকে সব জানালেও সুপ্রিম কোর্টকে বলতে কেন বিলম্ব স্টেট ব্যাঙ্কের
মুক্তমনের অম্লান ভাষ্যকার
মুক্তমনের অম্লান ভাষ্যকার


Other Writings by -সুস্মিতা ঘোষ
মিসেস চ্যাটার্জিদের কথা
মিসেস চ্যাটার্জিদের কথা

সে 90 দশকের মাঝামাঝির কথা। আমি তখন নতুন মা, আবার আমেরিকার একটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রাজুয়েট স্টুড…


// Event for pushed the video