প্রয়াগরাজের মেলা সংলগ্ন নদী কি দূষিত, না পবিত্র, না “বিসলেরি বোতলের জলের মতো” শুদ্ধ ?
এই নিয়ে বাক-বিতন্ডা, রাজনৈতিক তুমুল বিতর্ক চলছে। বিজ্ঞান নিয়ে টানা হেঁচড়াও চলছে।
আসুন আমরা ঠান্ডা মাথায়, স্বচ্ছ চোখে, কমনসেন্স ব্যবহার করে কী কী তথ্য আছে, তা বিশ্লেষণ করি:
1. রাষ্ট্রীয় সবুজায়ন ন্যায়পীঠ (National Green Tribunal, NGT) উত্তর প্রদেশ প্রদূষণ নিয়ন্ত্রক বোর্ডকে প্রশ্ন করেছে, কুম্ভ মেলার “পবিত্র” নদীজলের মধ্যে কত জীবাণু আছে তার তথ্য কেন দাখিল করেনি। এই মাসের শুরুতেই কেন্দ্রীয় প্রদূষণ নিয়ন্ত্রক বোর্ড একটি অত্যন্ত গোলমেলে রিপোর্ট দাখিল করেছে NGT র কাছে। তাতে বলা হয়েছে, প্রয়াগরাজে সঙ্গমস্থলে অত্যন্ত বেশি পরিমাণে মল বাহিত জীবাণু, যাকে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় fecal coliforms বলে, পাওয়া গেছে। এই পরিমাণ জীবাণু থাকলে কোন জলকেই পানের তো দূরের কথা, স্নানের ও অযোগ্য বলে ঘোষণা করার কথা। সেখানে কোটি কোটি পুণ্যার্থী পূণ্যস্নান করে যাচ্ছে দিনের পর দিন। উত্তরপ্রদেশের সংস্থা কেন্দ্রীয় সংস্থার কাছে জানতে চেয়েছে ঠিক কোন কোন জায়গা থেকে জল স্যাম্পল নিয়ে এই বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আর NGT জানিয়েছে উত্তরপ্রদেশ রাজ্য সংস্থা যেন 28 ফেব্রুয়ারির মধ্যে তাদের সমস্ত রিপোর্ট দাখিল করে।
28 ফেব্রুয়ারি! তখন তো এই পুণ্য স্নানের হিড়িকই শেষ হয়ে যাওয়া উচিত!
2. কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া পদ্মশ্রী সম্মানপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী অজয় সোনকর, ঘোষণা করেছেন গঙ্গার জলে, বিশেষ করে প্রয়াগরাজের সঙ্গমস্থলে জল বিশুদ্ধ, কারণ জলের মধ্যে স্বপরিস্রবণ (self purifying) ক্ষমতা আছে। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে তাঁর পরীক্ষাতে গঙ্গার জলে 1100 রকম bacteriophage অর্থাৎ জীবাণু খেকো ভাইরাস পাওয়া গেছে। এরা নাকি যাবতীয় মলবাহিত জীবাণুকে সতত ধ্বংস করে চলেছে।
3. অনেকে যুক্তি দেখাচ্ছেন, (তাদের মধ্যে অবশ্য বিখ্যাত কোনও বিজ্ঞানীর নাম শোনা যায়নি,) গঙ্গা বহমানা, স্থির জল নয়। কাজেই দূষণ সেখানে আটকে থেকে রোগ ছড়াবে না।
বিজ্ঞানী হিসেবে এবার কতক গুলো তথ্য জানাই। Bacteriophage-কে একটু আগে জীবাণু খেকো ভাইরাস নামে খুব সরলীকৃত একটা বাংলা নাম দিয়েছিলাম। এটা পুরোটা সত্যি না। Bacteriophage সম্বন্ধে খুব সংক্ষেপে কিছু তথ্য জানাই:
ক) bacteriophage নামে ব্যাকটেরিয়া কথাটা আছে কারণ এই ধরণের ভাইরাস শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণুর ওপরেই গজাতে পারে। এই প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দিই, কোনও ভাইরাসই একা একা বেঁচে থাকতে পারে না। এরা সম্পূর্ণভাবে পরজীবী। এইডস এর ভাইরাস HIV যেমন শুধুমাত্র মানুষের শরীরেই গজাতে পারে, এই bacteriophage (সংক্ষেপে ফেজ) রাও তেমনি শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়াতেই গজাতে পারে। শুধু তাই নয়, অনেক ফেজই আছে, যারা শুধু এক জাতের ব্যাকটেরিয়াতেই গজায় অন্য কোন ব্যাকটেরিয়াতে গজায় না।
ফেজ যখন তার পছন্দের ঘরওয়ালা ব্যাকটেরিয়াকে পায়, তখন ব্যাকটেরিয়ার নিজস্ব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে প্রজনন শুরু করে এবং একবারেই একটি ভাইরাস অর্থাৎ ফেজ থেকে 100 টি সন্ততি জন্মায়। এই প্রজননকালে কিছু জাতের ফেজ তাদের ঘরওয়ালা ব্যাকটেরিয়াটিকে ধ্বংস করে ফেলে। আবার মনে রাখতে হবে, আরেক ধরণের ফেজ আছে, যারা তার ঘরওয়ালা ব্যাকটেরিয়াটিকে ধ্বংস করে না। ব্যাকটেরিয়ার ক্রোমোজোমের মধ্যে নিজের ক্রোমোজোমকে বিলীন করে দেয়। মধ্যে মধ্যে তার সন্ততি উৎপাদন করে, সন্ততিগুলি ব্যাকটেরিয়ার কোষের প্রাচীরের ফুটো দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে নতুন ব্যাকটেরিয়াদের সংক্রমণ করে। অর্থাৎ ফেজ মাত্রেই ব্যাকটেরিয়া খেকো নয়।
খ) ফেজ একমাত্র গঙ্গায় পাওয়া যায় না। পৃথিবীর সমস্ত জলাধার, জলরাশিতে নানা ধরনের বিচিত্র ফেজ আছে। 1100 সংখ্যাটা কাজেই নিখুঁত নাও হতে পারে। ওর চেয়ে বেশি সংখ্যায় ফেজ গঙ্গায় থাকলে আমি আশ্চর্য হব না।
ফেজ এবং তার আশ্রয়দাতা ব্যাকটেরিয়ারা জলাশয়ে সহাবস্থানই করে থাকে, ফেজের উপস্থিতির জন্য জল পরিস্রুত হয়ে গেল এরকম তথ্য কিন্তু জানা নেই।
গ) ফেজ তার আশ্রয়দাতা ব্যাকটেরিয়াকে মারতে পারে এই চমকপ্রদ তথ্য নিয়ে আজ থেকে প্রায় 100 বছর আগে থেকে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন ফেজকে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করার। কিন্তু সেইভাবে সাফল্য আজও আসেনি।
ঘ) আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিজ্ঞানী অজয় সোনকর এর bacteriophage নিয়ে কত গবেষণা আছে খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম প্রখ্যাত ডেটাবেস PUBMED এ, যেখানে চিকিৎসা বিজ্ঞান, জীবন বিজ্ঞান এবং জৈব প্রযুক্তি সংক্রান্ত যাবতীয় প্রকাশিত গবেষণার খবর পাওয়া যায়। আমি কিন্তু এরকম কোনও গবেষণা খুঁজে পাই নি যাতে তাঁকে ফেজ বিশেষজ্ঞ বলতে পারি। অন্য কেউ অন্য কোনও ভাবে চেষ্টা করে দেখলে বাধিত হব।
এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি আমি ব্যক্তিগত ভাবে প্রায় বিশ বছর নানা ধরণের ফেজ নিয়ে গবেষণা করেছি।
এবার ব্যক্তিগত পর্যায়ে এ বছরের মহাকুম্ভস্নান সম্বন্ধে কি কি জানতে পেরেছি:
মধ্যবিত্ত অনেক আত্মীয় বন্ধু এ বছর মহাকুম্ভ স্নান করে এসেছে। তাদেরকে কোনও নিন্দা মন্দ করতে শুনিনি। “ব্যবস্থা ঠিকঠাক” “ব্যবস্থা ভাল” “অনেক টয়লেট আছে” “অনেক পোশাক পাল্টানোর জায়গার ব্যবস্থা আছে” “খুব ঠান্ডা” এসবই তাদের কাছে শুনেছি। এরা কেউ ভিআইপি নয়।
এরা কিন্তু সবাই প্রয়াগরাজ পৌঁছেছে গাড়ি করে এবং কোনও বিশেষ দিনে স্নান অর্থাৎ শাহী স্নান করেনি এবং তুলনায় ভিড় কমই পেয়েছে।
আমি যেহেতু মহাকুম্ভে যাইনি কাজেই সঠিকভাবে বলতে পারব না সর্বমোট পুণ্যার্থীদের এরা 5% এর বেশি কিনা। সরকারি এবং সরকার বিরোধী সব সংবাদ মাধ্যমই কিন্তু কোটি কোটি স্নানার্থীর ছবি দেখিয়েছে। যতই টয়লেট বানাক না কেন, এই কোটি কোটি মানুষের কেউ কেউ কিন্তু সঙ্গমের পূতঃ জলেই কিন্তু মলত্যাগ করেছে, কারণ আমাদের দেশের অনেকেই সেটা করে থাকে। তাদের সংখ্যা যদি 0.01% ও হয়, তাহলেও সঙ্গমের জলে মলবাহিত জীবাণু থাকবেই এবং পাওয়াও গেছে তাই।
কিন্তু প্রশ্ন হল এখনও পর্যন্ত কিছু বিক্ষিপ্ত অসুস্থতার কাহিনী ছাড়া বড় রকমের কোনও প্রাদুর্ভাবের কথা শোনা যায়নি। কি সে রহস্য তাহলে?
সাংবাদিক রভীশ কুমার বলেছেন, আমাদের দেশের আপামর জনসাধারণ কিন্তু মহাকুম্ভের বেশি পরিছন্নতার সুযোগ পায় না। কাজেই তারা এই জলেই অভ্যস্ত। এই জল তাদের আবার নতুন কি ক্ষতি করবে? নমামি গঙ্গে বা স্বচ্ছ ভারত মিশনের পরেও এটাই অত্যন্ত বাস্তব, রূঢ় বাস্তব!
আমার পরিচিত জনেরা কেন অসুস্থ হয়নি, তার একটা বৈজ্ঞানিক কারণ আমার মাথায় এসেছে। কে না জানে ঠান্ডায় জীবাণু কাবু হয়। যে কারণে আমরা খাবারদাবার ঠিক রাখতে বাড়িতে রেফ্রিজারেটর রাখি। এরা সবাই স্নান করেছিল কোন কোন ব্রাহ্মমুহূর্তে যখন জল অতীব ঠান্ডা, অর্থাৎ জীবাণুরা বেশ কাবু।
শরীরে ঢুকে রোগ ঘটানোর ক্ষমতা হারিয়েছিল। তাছাড়া এরা কেউই তেমন ভিড়ে গেছে বলে শুনিনি।
আমার অনুমান, সরকারি সংস্থা যারা জলের স্যাম্পল সংগ্রহ করতে যায়, দিন মানে যায়, তখন দিনের তাপমাত্রা বেশি হওয়াতে অবশ্যই জীবাণু অনেক বেশি থাকবে।
কাজেই পুরো চিত্রটাতে সত্য অনেকগুলোই। গঙ্গার জলে জীবাণু আছে, দূষণ আছে, ব্যাকটেরিওফেজ আছে। পুণ্যার্থীদের সুবিধার জন্য মোটামুটি ব্যবস্থা আছে। আর আছে ভারতীয়দের বিখ্যাত ইমিউনিটি!
এসব নিয়েই গঙ্গা যমুনা বয়ে চলেছে।
ডঃ সুস্মিতা ঘোষ বায়োটেক স্টার্টআপ ডায়াগনোরাইটের প্রতিষ্ঠাত্রী, আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ কানেটিকাট থেকে বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সেস এর ডক্টরেট।