4thPillar


আয়ুর্বেদ চিকিৎসকরা কি অ্যালোপ্যাথদের সমান?

সুস্মিতা ঘোষApril 27, 2024
আয়ুর্বেদ চিকিৎসকরা কি অ্যালোপ্যাথদের সমান?

সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করেছে আয়ুর্বেদ ডিগ্রিধারীরা এমবিবিএস ডিগ্রিধারীদের সমতুল্য বেতন ও অন্যান্য সুবিধা পাওয়ার যোগ্য। যে মামলার পরিপ্রেক্ষিতে এই ঘোষণা, তাতে বলা হয়েছিল যে, আয়ুর্বেদ ডিগ্রিধারীরা যদি এমবিবিএস ডিগ্রিধারীদের সমতুল্য দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে বেতন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পৃথক হবে কেন? আপাত দৃষ্টিতে যুক্তিটি অকাট্য, সম্ভবত এই কারণে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এই নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় তোলেনি। কিন্তু বাস্তবটা কী? এদিকে সরকারি উদ্যোগে প্রবল বেগে সনাতন চিকিৎসা শাস্ত্র, চরক সংহিতা, আয়ুর্বেদ ইত্যাদির সপক্ষে প্রচার চলছে। তাহলে কি সত্যি সত্যিই আমাদের দেশে প্রকৃত আয়ুর্বেদ মতে চিকিৎসা হচ্ছে বা হতে চলেছে সর্বত্র? আয়ুর্বেদ চিকিৎসা কি এই মুহূর্তে জীবনদায়ী?

আমি আয়ুর্বেদ পড়িনি, কিছু আয়ুর্বেদ চিকিৎসক এবং গবেষকের কাছাকাছি এসেছি মাত্র। নিজের অল্পস্বল্প রসায়নের জ্ঞান থেকে এই প্রত্যয় জন্মেছে যে, এর মধ্যে বিজ্ঞান আছে। ছোটবেলা থেকেই প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানী অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের নাম শুনেছি- আয়ুর্বেদে বর্ণিত উচ্চ রক্তচাপ এবং উন্মাদ রোগে ব্যবহৃত সর্পগন্ধা থেকে তিনি বিশুদ্ধ রাসায়নিক পদার্থ রেসারপিন এবং আরও কয়েকটি যৌগ আবিষ্কার করেন। বিশুদ্ধ রেসারপিন অ্যালোপ্যাথিক মতে ব্যবহৃত একটি উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ। উদ্ভিদজাত রসায়ন অর্থাৎ phytochemistry নামে রসায়নের যে শাখা আছে, তাতে আয়ুর্বেদে ব্যবহৃত অনেক উদ্ভিদ থেকেই এই রকম অনেক রাসায়নিক ভেষজ বস্তু বিশুদ্ধিকরণ করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ আধুনিক বিজ্ঞান বা রসায়নে আয়ুর্বেদকে স্থান দেওয়া যেতেই পারে।

কিন্তু এখানে একটা বড় ‘কিন্তু’ আছে। অ্যালোপ্যাথিক শাস্ত্র অনুযায়ী তৈরি ওষুধের মধ্যে যে যে সক্রিয় ভেষজ বস্তু আছে - যাকে অ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট (API) বলা হয়, তার প্রতিটি উপাদান কিন্তু ওজন করে মেশানো হয়। আলাদা আলাদা কোম্পানির তৈরি, আলাদা আলাদা ব্যাচে বানানো ওষুধের উপাদান আলাদা হয় না। আজকাল যদিও আয়ুর্বেদ এবং অন্যান্য উদ্ভিদজাত ওষুধের শিশি ইত্যাদির গায়ে উপাদানের পরিমাণ লেখা নিয়ম হয়ে গেছে, কিন্তু সূক্ষ্মভাবে কেন, স্থূলভাবেও দু’টি কোম্পানির ওষুধ বা দু’টি আলাদা ব্যাচের ওষুধ সম্পূর্ণভাবে এক হতে পারে না। এর সবচেয়ে বড় কারণ হল একই ভেষজ উদ্ভিদের বিকাশ বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন হবে এবং ফলস্বরূপ API-এর পরিমানও কম বেশি হবে। সেই কারণে অনেক আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞ নিজস্ব ঔষধি বাগানের ওপর নির্ভর করেন। অনেক ওষুধ টাটকা টাটকা বানিয়ে দেন। বলাই বাহুল্য, এই যুগে প্রকৃত আয়ুর্বেদ চিকিৎসা অনেক বেশি সময়-সাপেক্ষ ও ব্যয়-সাপেক্ষ হতে পারে। কাজেই, টিভিতে বিজ্ঞাপনে যে দেখা যায় বাবা রামদেব বন বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে জড়িবুটি সংগ্রহ করছেন, সেটা বিরাট মিথ্যাচার। তার কারণ পতঞ্জলি সাম্রাজ্যে বিক্রি যে পরিমাণে হয়, সেখানে অত অত ভেষজ ওইভাবে সংগ্রহ করা তো সম্ভবই নয়। বৃহৎ ভাবে যে কোনও অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ তৈরি করা সম্ভব, কিন্তু একই ভাবে আয়ুর্বেদ ওষুধ বানালে তার গুণ আদৌ থাকবে তো? আর একটা কথা, বিশুদ্ধ মধু বহু আয়ুর্বেদ ওষুধের উপাদান বা অনুপান। গত বছরে ভেজাল মধুর কারবারি হিসেবে যে সমস্ত সংস্থার নাম উঠে এসেছিল, পতঞ্জলি তার মধ্যে অন্যতম।

তাহলে জনসাধারণের কাছে আইনানুগভাবে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা বলতে কী রইল? আজকাল যেসব পঞ্চকর্ম চিকিৎসালয় ইত্যাদি এবং অল্টারনেটিভ মেডিসিন নামে যেসব হলিস্টিক চিকিৎসালয় বেরিয়েছে, সেগুলি কিন্তু প্রচুর ব্যয় সাপেক্ষ। বিদেশি এবং অতি ধনীদের ‘হেলথ ট্যুরিজম’-এর কথা না হয় বাদ-ই দিলাম। সাধারণের জন্যে পড়ে রইল খবরের কাগজ থেকে শুরু করে নানা মিডিয়াতে ঘরোয়া ফল তরকারি মশলার ঔষধি গুণের প্রচার, সঙ্গে কিছু ঘরোয়া নয় এমন কিছু ঔষধির বর্ণনা। আগেকার দিনে, যখন খবরের কাগজ, রেডিও, টিভি-ই একমাত্র মাধ্যম ছিল, তখন সত্যিকারের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও মতামত পাওয়া যেত। আজকাল মিডিয়াতে যা ঘোরে, তার একটা বিরাট অংশই ভুয়ো। আর পাওয়া যায় কিছু বৃহৎ পরিমাণে উৎপাদন করা ‘আয়ুর্বেদিক ভেষজ’ ছাপ মারা বড়ি, সিরাপ ইত্যাদি- যা ওষুধের দোকান থেকে সুপার মার্কেট, মনিহারি দোকান সর্বত্র বিক্রি হতে পারে।


আয়ুর্বেদ চিকিৎসকরা কি অ্যালোপ্যাথদের সমান?

এইসব over the counter ওষুধ বিক্রিতে যোগ বা জীবনযাত্রার গুরু থেকে বহুজাতিক সংস্থা, কেউ পিছপা নয়। কিন্তু কাজ হয় কি? সুস্থতা আসে? কয়েকটা উদাহরণ দিই: শল্লকী নিয়ে কিছু গবেষণা হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে দিনে 1500 মিলিগ্রাম করে এটি খেলে সন্ধিবাতের উপশম হয়। কিন্তু বাজারে যা বড়ি পাওয়া যায়, তাতে খুব বেশি হলে দিনে 500 মিলিগ্রাম পর্যন্ত খাওয়া সম্ভব। তবে? যাঁরা খেয়ে ভাল আছেন বলছেন, তাঁরা কতটা এটার জন্য, কতটা ব্যায়াম, বিশ্রাম ইত্যাদির জন্য, আর কতটাই বা নিছক বিশ্বাস অর্থাৎ placebo effect -এর জন্যে, কে বলতে পারবে? সেই তথ্য কই? শল্লকী, তুলসী ইত্যাদির ওপরেও যে সব আয়ুর্বেদ ওষুধ সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়, সেগুলি হল পেটের গোলমালের। এই ওষুধগুলির বেশির ভাগই জোলাপ ছাড়া কিছু নয়। আয়ুর্বেদিক ওষুধ নিরাপদ, এমন একটা ধারণা প্রচলিত থাকায় এবং ‘বেল’, ‘লিভার’ এমন সব শব্দ মনে করিয়ে দেয়, এমন নাম থাকার জন্যে বহু মানুষ পেট বা লিভার ভাল রাখার জন্য এগুলি নিয়মিত সেবন করেন। এইসব ওষুধে বেল ইত্যাদি নামমাত্র থাকে, বেশিরভাগ অংশটাই থাকে senna, অর্থাৎ সোনাপাতা, যার হলদেটে রঙের জন্যে বোধহয় আরও অনেকে ভাবে উপাদানের মধ্যে বেল আছে। সোনাপাতা একটি অত্যন্ত কড়া জোলাপ, এবং ডাক্তারি শাস্ত্রে এক সপ্তাহের বেশি এটি খাওয়া নিষেধ আছে। প্রতিদিন জোলাপ খাওয়াতে আবার জোলাপ খাওয়ার অভ্যাস বা নেশা দাঁড়িয়ে যায়। জোলাপের এমনিতেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হল গ্যাস, পেট ব্যথা, আরও নানা অস্বস্তি- যেগুলোকে অনেকে কোষ্ঠবদ্ধতা ভেবে আরও বেশি করে এই জোলাপ গুলি খায়। ফলস্বরূপ ক্রনিক খাদ্য শোষণ না হওয়া বা খাওয়ায় অরুচি, গ্যাস ইত্যাদির প্রকোপে রীতিমতো অসুস্থতার শিকার হয়, যাকে inflammatory bowel disease (IBS) বলে।

আমাদের দেশের প্রচুর বয়স্কদের মধ্যে এই অবস্থা দেখা যায়। মজার ব্যাপার হল, এঁরা অসুস্থতার কথা বলার সময়ে কখনও ভাবেন না যে, এই জোলাপগুলিই তাঁদের অসুস্থতার মূল কারণ। কাজেই ডাক্তার (অবশ্যই অ্যালোপ্যাথিক)-কে অনেক সময়েই জোলাপ রহস্য জানানো হয় না। অতিরিক্ত জোলাপ ব্যবহারে অন্ত্রের যে ক্ষতি হয়, তা কিন্তু অনেক সময়ে আর সম্পূর্ণ সারানো যায় না। এত কথা থেকে একটাই সিদ্ধান্তে আসা যায়- আমাদের দেশের লোকের self medication -এর প্রবণতা অত্যন্ত বেশি তো বটেই, চিকিৎসকের কাছে যেতে হলে তাঁরা ডাক্তার, অর্থাৎ অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা যাঁরা করেন তাঁদের কাছেই যান।

তাহলে, বিশেষ করে পশ্চিম ভারতে যে আয়ুর্বেদিক শিক্ষাকেন্দ্র গুলি হয়েছে, যাদের ছাত্ররা সাধারণত ডাক্তারির প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হয়, তারা কোথায় যায়? সেই BAMS ডিগ্রিধারীরা? পঞ্চকর্ম বা অল্টারনেটিভ মেডিসিনের ক্লিনিক গুলি দেখলে অনেক সময় কিন্তু এদের পাবেন না। এই ক্লিনিকগুলিতে দেশ বিদেশের নানা অদ্ভুত ডিপ্লোমাধারী নাম থাকে অনেক সময়ে। BAMS-দের সব চেয়ে বেশি দেখতে পাওয়া যায় বেসরকারি হাসপাতালে বা ক্লিনিকে, বড় ডাক্তারের সহকারী হিসেবে কাজ করতে। অনেকে আবার নিজেরাই ক্লিনিক খুলে বসেন, নামের আগে Dr. লেখেন, এবং প্রেসক্রিপশনের মাথায় কোথাও ছোট্ট অক্ষরে আসল BAMS ডিগ্রিটা পাওয়া যেতেও পারে। এরা চিকিৎসা করেন সম্পূর্ণ অ্যালোপ্যাথিক মতে। যে বিদ্যাটা তাঁরা প্রথাগত ভাবে শেখেনইনি। বেসরকারি হাসপাতাল এদের নিযুক্ত করে MBBS ডিগ্রিধারীদের চেয়ে অনেক কম বেতন দেবে বলে। গত সাত আট বছরে এদেরকে ‘ডাক্তার’ বলে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সরকারি তরফে নানা রকমের প্রচেষ্টা চলছে। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক বিধান তারই ফল। সাম্প্রতিক ইউক্রেন সংকট আবারও নতুন করে প্রমাণ করেছে যে, আমাদের দেশে ডাক্তারি শিক্ষার সুযোগ প্রয়োজনের চেয়ে বহু গুণ কম। যারা BAMS ডিগ্রি নিতে গিয়েছিলেন, তাঁদের আলাদা করে কি বিশুদ্ধ আয়ুর্বেদের প্রতি কোনও ভালবাসা ছিল? নাকি তাঁরা ডাক্তার হতে চেয়েছিলেন, এমবিবিএস কোর্সে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে আয়ুর্বেদ পড়তে গেছিলেন? লোক সংখ্যা বাড়ার সমানুপাতে ডাক্তারি শিক্ষার কলেজ ও আসন বাড়ানোর প্রচেষ্টা কোনও সরকারই করেনি। এই BAMS ডিগ্রিধারীরা হাতেকলমে ট্রেনিং পান, কিন্তু অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার তত্ত্ব শেখার কোনও সুযোগ পান না। ব্রিজ কোর্সের কথা উঠেছিল বটে, কিন্তু সেটা চাপা দিয়ে অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তারকে আয়ুর্বেদ শেখানোর চেষ্টা বেশি সক্রিয় ছিল। হিপোক্রেটিসের শপথের সঙ্গে চরকের শপথের কোনও সংঘাত নেই, কিন্তু তাতে আসল চিকিৎসা বিদ্যা শেখার ব্যাপারটা এক কদনও এগোবে কি? অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার আয়ুর্বেদ শিখুন, তাতে অসুবিধে নেই। কিন্তু কে শেখাবেন? আমাদের দেশে কি যথেষ্ট সংখ্যক প্রাজ্ঞ আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ও শিক্ষক আছেন? না হলে গুরুতর প্রাণঘাতী রোগের চিকিৎসা অ্যালোপ্যাথিক উপায়েই কেন করতে হয়?

 

(ড: সুস্মিতা ঘোষ বায়োটেক স্টার্টআপ ডায়াগনোরাইটের প্রতিষ্ঠাত্রী, আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ কানেটিকাট থেকে বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সেস-এর ডক্টরেট)


New
চতুর্থ দফার ভোটে কে কোথায় এগিয়ে?
কোভিশিল্ড বিতর্ক কি কোনও চিন্তার বিষয় ?
তৃতীয় দফার ভোটে কে কোথায় এগিয়ে?


Other Writings by -সুস্মিতা ঘোষ
মিসেস চ্যাটার্জিদের কথা
মিসেস চ্যাটার্জিদের কথা

সে 90 দশকের মাঝামাঝির কথা। আমি তখন নতুন মা, আবার আমেরিকার একটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রাজুয়েট স্টুড…

ভারতের প্রথম সফল স্টার্ট আপের আচার্য
ভারতের প্রথম সফল স্টার্ট আপের আচার্য

ওই একজন উস্কোখুস্কো চুলের শীর্ণকায় ম…


// Event for pushed the video