পশ্চিমবঙ্গের ভূগর্ভস্থ জলের পরিমাণ যেমন কিছু জায়গায় বেশি আবার কিছু জায়গায় কম। রাজ্যের পূর্বপ্রান্তের জলে রয়েছে অধিক মাত্রায় আর্সেনিক প্রবণতা, পশ্চিম প্রান্তের জলে ফ্লোরাইডের পরিমাণ বেশি, আবার দক্ষিণপ্রান্তে রয়েছে লবণাক্ত জল।
2017 – 2021 সাল পর্যন্ত সেন্ট্রাল গ্রাউন্ড ওয়াটার বোর্ডের সমীক্ষা অনুযায়ী বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিলেন 2025 সালের মধ্যে কলকাতার ভূগর্ভস্থ জলের পরিমাণ 2.1 মিলিমিটার কমে যাবে। সেইসঙ্গে জলে আর্সেনিকের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে 18.6%। এই পরিস্থিতির মোকাবিলা যদি সঠিকভাবে করা না হয় তাহলে দেশের অন্যান্য রাজ্যের মত পশ্চিমবঙ্গেও জলের অভাব কঠিন আকার ধারণ করবে। এই প্রসঙ্গে সেন্ট্রাল গ্রাউন্ড ওয়াটার পোর্টের প্রাক্তন সদস্য ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ সিনহা রায়, 4thPillarWeThePeole- কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, “পশ্চিমবঙ্গের যে সমস্ত জায়গায় জলের উৎস বেশি রয়েছে সেই সমস্ত জায়গায় রিজার্ভার তৈরি করে ওয়াটার গ্রিডের মাধ্যমে যে সমস্ত অঞ্চলে জলের পরিমাণ কম সেখানে বিদ্যুতের সাপ্লাই লাইন নেটওয়ার্কের মতন যদি পাঠানো যায় তাহলে জলের একটি সুষম বন্টন সম্ভব”।
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের রাঢ অঞ্চলে বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার তাপমাত্রা দাঁড়িয়েছে 44 ডিগ্রির ওপরে। এই একই তাপমাত্রা এখন বর্ধমান, হুগলি, কলকাতাতেও দেখা যাচ্ছে। দামোদর, দ্বারকেশ্বর নদের জল তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ট্যাঙ্কারে করে জল পাঠাতে হচ্ছে। উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং এর মানুষ তিনধরিয়া থেকে আরও পাঁচ ছয় কিলোমিটার দূরে হেঁটে গিয়ে পানীয় জল নিয়ে আসে। তাপমাত্রা আরও বাড়লে এই পরিস্থিতি কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তাপমাত্রা যত বাড়বে পানীয় জলের সংকটও তত বাড়বে।
রাজ্যের পানীয় জলের পরিস্থিতি যেখানে এতটাই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে সেইদিকে রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলির নেতা নেত্রীদের কোনও হুঁশই নেই।
সারা ভারতের ভূখন্ডে বৃষ্টি বা তুষার আকারে ঝরে পড়া জল 4 হাজার মিলিয়ন কিউবিক মিটার। এই জলের সবটুকু ব্যবহারযোগ্য নয়। কিছুটা বাষ্পীভূত হয়, কিছুটা গড়িয়ে যায় কিছুটা মাটির তলায় প্রবেশ করে। ভারত সরকারের হিসেব মত 690 মিলিয়ন কিউবিক মিটার ভূপৃষ্ঠের ওপরের জল আর 432 মিলিয়ন কিউবিক মিটার মাটির নীচের জল অর্থাৎ দুটিকে যোগ করলে 1122 মিলিয়ন কিউবিক মিটার হয়, এটিই হচ্ছে আমাদের যোগান। এই মূহুর্তে 140 কোটির দেশে প্রতিদিন জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জলের এই যোগানের পরিমাণও ক্রমশ কমছে।
নদী বিশেষজ্ঞ ডঃ কল্যাণ রুদ্র এই প্রসঙ্গে 4thPillarWeThePeole- কে জানিয়েছেন, “এই শহরেরই এক তৃতীয়াংশ মানুষ যারা বস্তিতে থাকে তাদের অনেকের ঘরেই নিরাপদ পানীয় জল নেই। অথচ কলকাতা শহরের খোলা কলের মুখ দিয়ে প্রতিদিন যত জল পড়ে যায়, তা দিয়ে এই এক তৃতীয়াংশ মানুষের বাড়িতে জল পৌঁছে দেওয়া যেত। যেহেতু এখনও পর্যন্ত বেশিরভাগ মানুষকেই জলের মূল্য দিতে হয় না তাই তারা ভাবে জল অফুরন্ত। আমরা সারা বছর যত জল ব্যবহার করি তারমধ্যে মাটির নীচের 80% জলই সেচের কাজে ব্যবহার হয়। সুখা মরসুমে যে বোরো ধানের চাষ হয় তাতে সাধারণ চাষের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণ জল লাগে এবং এর সবটাই আসে মাটির নীচের ভূগর্ভ থেকে। কিন্তু এই জল চিরস্থায়ী নয়। এরফলে ভূগর্ভস্থ জলস্তর অনেক নেমে যাচ্ছে, অনেক জায়গায় নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, মাটি ধসে যাচ্ছে, বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে”।
ডক্টর কল্যাণ রুদ্র আরও বলেন, “সারাবছর দেশে গড় বৃষ্টি হয় 100 দিন। বছরের বাকি যে 265 দিন বৃষ্টি হয় না, সেই সময় মানুষ যে ভূগর্ভস্থ জমা জল ব্যবহার করে তার পরিমাণ কমে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত; সেইসঙ্গে রয়েছে প্রতিবছর বৃষ্টির ঘাটতি। এই অবস্থায় আমরা যদি আমাদের চাহিদা সংযত না করি এবং অপচয়ের বিষয়ে সতর্ক না হই তাহলে আমাদের জলশূন্য ভবিষ্যৎ অবশ্যাম্ভাবী”।
ভূতত্ববিদ ও সমুদ্র বিজ্ঞানী ডঃ সুগত হাজরা এই প্রসঙ্গে জানান, “সুন্দরবনের মত বায়োস্ফিয়ার অঞ্চলে যান্ত্রিকভাবে ডিজেল পাম্প ব্যবহার করে বেআইনিভাবে ভূগর্ভস্থ জল তুলে বোরো চাষ করা হচ্ছে, যেখানে সেই জল পানীয় হিসেবে ছাড়া অন্য কোনও ভাবে ব্যবহার করার কথা নয়। সুন্দরবনে শুধু যে বোরো ধান চাষে ভূগর্ভস্থ জল অপচয় হচ্ছে তা নয় চিংড়ির চাষেও প্রচুর ভূগর্ভস্থ জল অপচয় করা হয়। সুখা মরসুমে কম জল ব্যবহার করে যদি ডাল, মিলেট ইত্যাদির চাষ করা যায় তাহলে অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আনা যেতে পারে। অতিরিক্ত জল তোলা হয়ে গেলে সমুদ্রের নোনা জল চাষের জমিতে ঢুকে জমি নষ্ট করে দেয়।
মানুষ যদি নিজের জলের চাহিদার সংযমের উপায় না ভেবে শুধুমাত্র যোগানের ব্যবস্থা এবং উপায়ের কথা ভাবে তাহলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বরং প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্থ হবে”।
ডক্টর কল্যাণ রুদ্রের মতে এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচিত নির্দিষ্ট কয়েকটি জলনীতি তৈরি করা; যেমন –
জলের ডোমেস্টিক সাপ্লাই কখনই ফ্রি হওয়া উচিত নয়। দরিদ্র মানুষের জন্য তার সাবসিডির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত কৃষি কার্যের ক্ষেত্রেও মাটির নীচের জল ব্যবহার সীমায়িত করা প্রয়োজন। যাতে ভূগর্ভস্থ জল নিয়ে কেউ ব্যবসা না করতে পারে।
কৃষিক্ষেত্রে জলের অপচয় বন্ধ করা সেইসঙ্গে সুখা মরসুমে ফসল নির্বাচন ক্ষেত্রেও সতর্কতা প্রয়োজন।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যে সমস্ত বড় বড় হাউজিং গুলি আছে সেখানে সঠিকভাবে গ্রাউন্ড ওয়াটার রিচার্জ হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন আছে।
এই শহরাঞ্চলে রেন ওয়াটার হারভেস্টিং করে যদি গ্রাউন্ড ওয়াটারে পরিণত করা যায় তাহলে যেখানে স্যালাইন ওয়াটার আছে তা অনেকটাই ফ্রেশ ওয়াটারে পরিণত হবে।
পানীয় জলের যে চাহিদা রয়েছে তার অর্ধেকের বেশি খরচ হয় গৃহস্থালির কাজে। আমরা যদি ব্রাকিশ ওয়াটার রিচার্জ করে ব্যবহার করতে পারি তাহলে পানীয় জলের চাহিদাও অনেকটাই কমে যাবে।
বর্ষার সময় নদী নালা খাল বিল সংস্কার করে সেখানে রেন ওয়াটার হারভেস্ট করলে, তা ব্যবহারযোগ্য হয়ে ওঠে। মানুষের কাছে এই পরিশ্রুত জল পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকেই। সহজলভ্য বলে মানুষও তা কৃষিকার্যে কাজে ব্যবহার করতে পারবে। এতে জলের যোগান বাড়বে, ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহারও অনেকটাই কমে যাবে”।
পশ্চিমবঙ্গ যাতে ভবিষ্যতে জলশূন্য না হয়ে পড়ে তার জন্যে সাধারণ মানুষকে এখন থেকেই সচেতন হতে হবে। আর সাধারণ মানুষ সচেতন হলেই রাজনৈতিক দল এবং তার নেতারাও তখন এগিয়ে আসতে বাধ্য হবে নিজেদের দায়িত্ব কর্তব্য পালনে। যদিও কোনও রাজনৈতিক দলই তাদের ভোটের অঙ্গীকারে কোথাও জলের সমস্যা কিংবা প্রকৃতিকে রক্ষার কথা কখনও বলে না। সেই বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতনও করে না। তাই পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যদি জলের অপচয়ের বিষয়ে এখনও সচেতন না হয় তাহলে তারা নিজেরাই বেছে নেবে নিজেদের জলশূন্য ভবিষ্যৎ।