কুশল সিংহরায়
একদিন পরেই বড়দিন। উৎসবে ঝলমল করে ওঠার কথা কাংপোকপি পাহাড়তলির। কিন্তু কেমন যেন জড়োসড়ো হয়ে রয়েছে গোটা জনপদ।
দুই তরুণের মুখ থমথমে। অথচ কাল বড়দিন। বছর 19-এর চোনমিনলাল কিপগেন আর 26 বছরের পাওলাল কিপগেন। গির্জার ঘণ্টা, কেকের গন্ধ, সান্তাক্লজ কোথায়?
পার্বণের ঠিক আগের সন্ধ্যায়, একটা অস্থায়ী বাঙ্কারে পাওয়া গেল দুই কুকি তরুণকে। হাতে তাদের বন্দুক। অপলক চেয়ে আছে উপর থেকে। কোথাও একটা আবছা মূর্তি সরে গেলেও যেন গর্জে উঠবে কিপগেনদের অস্ত্র।
উৎসবের তারিখ এসেছে, উৎসব আসেনি! আসেনি ঝোলা কাঁধে সান্তা ক্লজ। খুশির আলো জ্বলেনি মণিপুরের পাহাড়ে।
উপত্যকাও কি ভালো আছে? নভেম্বরে রাজধানী ইম্ফলের মেতে থাকার কথা নিনগল চাকৌবা পার্বণে। মেইতেইদের প্রধান উৎসব। বিবাহিত মহিলারা থাকেন এর কেন্দ্রে। তারা যান বাপের বাড়ি। পরিবারের সবার সঙ্গে চড়ুইভাতি করেন। এরপর আসে উপহারের পালা; ঘরের মেয়েকে সবাই উপহার দেন।
রকমারি বাহারি রান্নার গন্ধে এই কদিন ঘোর লেগে থাকে মেইতেই বসতিতে। কিন্তু গত বছর শুধু ক্যালেন্ডারের পাতায় দাগ রেখে চলে গিয়েছে চাকৌবা বা চড়ুইভাতির পর্ব। পুড়ে যাওয়া বাড়িঘর, স্বজন হারানোর কান্না, হামলার আশঙ্কা ঢুকে পড়েছে ইতিহাসের পাতায়।
এই মৃত্যুপুরীতে উৎসব আসে না। এগারো মাস ধরে শুধু লড়াই, ভ্রাতৃঘাতী লড়াই চলছে। এমন দীর্ঘ জাতি হিংসার কোনও ইতিহাস এদেশে নেই একুশ শতকে।
হিংসার দিনরাত
মাসের পর মাস, অগুনতি হিংসাত্মক ঘটনায় 219 জনের মৃত্যু হয়েছে মণিপুরে। 1100 মানুষ আহত। মাথার উপর ছাদ হারিয়েছেন 60 হাজার মানুষ। হামলার ভয়ে মেইতেই ও কুকি তরুণরা বন্দুকের ট্রিগারে হাত রেখেছেন। যারা সকাল সকাল কাজে যোগ দিতে বেরোতেন, কলেজের জন্য গুছিয়ে নিতেন ব্যাগ, তারা পালা করে বাঙ্কারে ডিউটি দিচ্ছেন।
মেইতেইরা প্রধানত হিন্দু। কুকিরা সংখ্যালঘু, খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। জনসংখ্যায় কুকির দ্বিগুণ মেইতেই, মণিপুরের জনসমষ্টির প্রায় অর্ধেক। ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির মিশেলে দেশজুড়ে যে অসহিষ্ণুতার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, তার কালো মেঘ মণিপুরকে ঢেকে ফেলেছে ক্রমে। দশকের পর দশক পাশাপাশি বাস করা দুই জাতি একে অপরের উপর চড়াও হচ্ছে অবলীলায়।
এ কি শুধুই জাতিবিদ্বেষ, পরস্পরের জীবন ও জীবিকা কেড়ে নেওয়ার লড়াই। সেনা আছে, আধাসেনা আছে। রাষ্ট্রের প্রবল পরাক্রম আছে। তা সত্ত্বেও কেন শান্ত হচ্ছে না মণিপুর? রাজ্যে সক্রিয় আধাসামরিক বাহিনী অসম রাইফেলস তাদের গোপন রিপোর্টে চলমান হিংসার নানা কারণ তুলে এনেছে। সেই রিপোর্ট হাতে এসেছে দি রিপোর্টার্স কালেক্টিভ-এর।
সরকারের ভূমিকা
কেন্দ্রে ক্ষমতায় বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মণিপুরে ক্ষমতায় বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং। এককথায়, ডাবল ইঞ্জিনের সরকার। তবু উত্তর-পূর্বের হিংসার অভিযান তাঁরা রুখতে পারছেন না। অসম রাইফেলসের রিপোর্টে তাই বীরেন সিংকে অনেকটাই দায়ী করা হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার কী করছে?
মণিপুরে আগুন জ্বললেও তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কদাচিৎ মুখ খুলেছেন। নানা বিষয়ে বক্তৃতা করেছেন, টুইট করেছেন, কিন্তু পাহাড়ের রাজ্যটি থেকে গিয়েছে আড়ালে। লোকসভা নির্বাচনে 19 এপ্রিল রাজ্যের একটি কেন্দ্রে ভোট নেওয়া হবে। তার আগে মোদী দাবি করেছেন, কেন্দ্রের যথাযথ হস্তক্ষেপে মণিপুরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
অথচ রাজ্য সরকার কার্যত অসহায় হয়ে পড়েছিল ব্যাপক হানাহানির সামনে। দিনের পর দিন গড়িয়ে যাচ্ছে। ভোটের মরশুম এসে পড়লেও বিপন্মুক্ত হয়নি মণিপুরীদের জীবন। 26 এপ্রিল রাজ্যের অন্য কেন্দ্রটিতে ভোট নেওয়া হবে। রাজ্যের ভোট নয়, তবু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আস্থা জানিয়েছেন বীরেন সিংয়ের প্রতি। এই দুটি কেন্দ্রেই জয় চাই তার দলের। জয় এলেও এতো মানুষের মৃত্যুর কৈফিয়ৎ কি দিতে হবে না?
হিন্দুপ্রধান মেইতেইরা রাজ্যের সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী। তাদের বিজেপির প্রতি সমর্থন প্রশ্নাতীত। মেইতেইরা তফসিলি উপজাতির মর্যাদা পাওয়ার দাবি তুলেছে। এতে সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণের সুবিধা মিলবে। কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রেও বাড়তি সুযোগ। সংখ্যা গুরুর এমন দাবি শুনে ঘাবড়ে গেল তফসিলি উপজাতির তালিকায় থাকা কুকিরা। অন্যান্য উপজাতিরাও। এদের সংখ্যা মেইতেইদের তুলনায় অনেক কম। যদি সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী সংরক্ষণ পেয়ে যায় তা হলে সংখ্যালঘুদের কী হবে?
শত্রুতার প্রেক্ষাপট
এই বৈরিতার মেঘ ক্রমশ ঘনিয়ে উঠছিল। অসম রাইফেলসের রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এই বিরোধে বাধা হয়ে দাঁড়াননি। বরং তার পদক্ষেপ কুকি ও মেইতেইদের মধ্যে টানাপড়েনে ঘি ঢেলে দেয়। মায়ানমার সীমান্ত লাগোয়া পাহাড়ে আফিম চাষ হয়, কুকিরাই বংশ পরম্পরায় এই কাজের সঙ্গে জড়িত। বীরেন সিং আফিম চাষ বাতিল করতে উঠে পড়ে লাগলেন। সরকারি নজরদারি কঠোর হল। জীবিকা থেকে কার্যত উচ্ছেদের ভয়ে দিন গুনতে থাকলেন কুকিরা।
তাঁদের মনে ভয় বাসা বাঁধল, ইচ্ছে করেই বিজেপি নেতৃত্ব তাদের নিশানা করেছেন।
অসম রাইফেলসের রিপোর্টে মারাত্মক অভিযোগ তোলা হয়েছে। তারা বলেছে, রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসন হিংসার প্রতি নীরব সমর্থন জুগিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিরপেক্ষ থাকেনি পুলিশ। কুকি নেতৃত্বের দাবি, নিরাপত্তা বাহিনী মেইতেইদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এতে তারা আরও কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।
বীরেন সিংয়ের নীতির ফলে তিরতির করে বইছিল অবিশ্বাসের স্রোত। ক্রমশ কুকিরা মনে মনে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন মণিপুরের মূল ধারা থেকে। শুধু আফিম চাষের বিরোধিতা নয়, আরও কয়েকটি কারণ তুলে ধরা হয়েছে আধাসেনার রিপোর্টে। মায়ানমার, নেপাল থেকে অনুপ্রবেশকে হাতিয়ার করেছে বিজেপি সমর্থিত গোষ্ঠীগুলি। দাবি উঠেছে এনআরসি-র। কুকিল্যান্ডের দাবি মাথাচাড়া দিয়েছে। এর সঙ্গে ডাক পড়েছে মেইতেই পুনর্জাগরণের— অর্থাৎ ফিরে যেতে হবে আদি ধর্ম অনুশীলনে।
গত এপ্রিলে পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নেয়। মণিপুর হাই কোর্ট রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেয়, তফসিলি উপজাতি হওয়ার যে দাবি মেইতেইরা তুলেছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে। সংরক্ষণের কথা আগেই বলা হয়েছে, এর সঙ্গে গুরুত্ব পেল জমির অধিকার। মণিপুর ভূমি সংস্কার আইন, 1960 অনুযায়ী তফসিলি উপজাতিভুক্ত মানুষরাই শুধু পাহাড়ে জমি কিনতে পারেন। মেইতেইরা এই মর্যাদা পেলে পাহাড়ের জমিতে অধিকার পেতে তাদের সামনে বাধা থাকবে না।
অবিশ্বাসের মেঘ
অবিশ্বাসের স্রোত এতে গতি পায়। আফিম চাষ নিয়ে দোলাচল ছিলই, এ বার পাহাড় হাতছাড়া হওয়ার ভয় চেপে বসে কুকি-সহ অন্যান্য উপজাতিদের মনে। জোট বাঁধতে থাকে তারা। অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন সংহতি যাত্রার ডাক দেয়। ৩ মে সেনাপতি, উখরুল, কাংপোকপি, তামেংলং, চূড়াচাঁদপুর, চান্দেলে মিছিল হয়।
এই মিছিল ঘিরে উত্তেজনা ছড়ায়। সঙ্গে গুজবও। চূড়াচাঁদপুরে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সশস্ত্র তরুণদের ছবি সামনে আসে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রটে যায়, কুকি জনতা আক্রমণ করেছে মেইতেই বসতিতে। অসম রাইফেলসের রিপোর্ট অনুযায়ী, সেই 3 মে শুরু হয়ে যায় হানাহানি। মেইতে ও কুকিদের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলি সক্রিয় হয়। বেছে বেছে একে অপরের উপর হামলা চালাতে থাকে। খোদ ইম্ফলে উত্তেজিত জনতা আইন হাতে তুলে নেয়।
মণিপুরের রাজধানীতে কুকিরা কেনই বা পারবে মেইতেদের সঙ্গে! 3 মে-র ভয়ঙ্কর রাতটা মনে আছে 43 বছর বয়সী গামপাও খোংসাইয়ের। ইম্ফলের কুকি পাড়া খোংসাই ভেংয়ে থাকেন তিনি। বলেন, "কালো শার্ট পরা কয়েকজন আমাদের বাড়িঘরের উপর হামলা চালাতে আসে। আমরা শূন্যে গুলি ছুড়ি। তারা কিছু সময়ের জন্য পিছু হঠে, আবার ফিরে আসে। ওরা ক্রমাগত পাথর ছুড়ছিল। বলছিল, কুকিদের খতম করে দিতে হবে।"
খোংসাই সপরিবার চলে যান একটি স্কুলে। উপত্যকার হাজারো কুকি জনতা ঘরছাড়া হয়ে সেখানে আশ্রয় নেন। কুকিরা চূড়াচাঁদপুরে সংখ্যাগুরু। অনেকে পাড়ি জমান সেই অনিশ্চিতের উদ্দেশে।
আগুন যখন জ্বলেছে, তা কি কাউকে ছাড়ে? মেইতেইদের ছাড়েনি। পাহাড় ও পাহাড়তলিতে কুকিদের জোর বেশি। সেখানে নিশানায় মেইতেইরা। সেই 3 মে-র রাত। বিষ্ণুপুর জেলার পাহাড় লাগোয়া এলাকায় সশস্ত্র কুকিরা হামলা চালায়। প্রাণভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে অনেকে পালিয়ে যান। মহিলারাও রেহাই পাননি।
তখন সন্তানসম্ভবা ছিলেন ওয়ারেপাম রামেশ্বরী। বলেন, “আমাদের চারপাশে কুকিদের গ্রাম। ওদের হাতে সব অত্যাধুনিক অস্ত্র। আমাদের লক্ষ করে গুলি চালাতে থাকে। আমাদের কাছে কোনও অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। আমি পালিয়ে যাই এক আত্মীয়ের বাড়ি”।
3 থেকে 23 মে উত্তেজনা ছিল চরমে। সুন্দর নিসর্গে ঘেরা মানুষের তথাকথিত সভ্যতা দেখতে পায়, নরকের চেহারা কেমন হয়! প্রথম দিনেই দেড় হাজারের বেশি মেইতেই ও কুকি তরুণ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। 300 বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়, পুড়িয়ে দেওহয় গাড়ি। সেইসঙ্গে চলে যথেচ্ছ ভাঙচুর।
অজস্র অভিযোগ
অসম রাইফেলসের রিপোর্ট বলছে, এই তিন সপ্তাহের মধ্যে 79 জন কুকি ও 18 জন মেইতেই প্রাণ হারান। চারপাশে তখন জাহান্নামের আগুন, বৃদ্ধ-নারী-শিশুর আর্তনাদে চাপা পড়ে যায় পাহাড়ি পাখির গান।
রিপোর্টার্স কালেক্টিভ হাজার হাজার এফআইআরের সন্ধান পেয়েছে, যা বুঝিয়ে দেয়, গত মে মাসে আগুনের সঙ্গে ঘর করতে হয়েছে মণিপুরীদের। শুধু মে মাসে 5818টি এফআইআর দায়ের হয়, জুন মাসে 2351টি।
সেই সময় রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। ছিল কেন্দ্রের সরকার। রাজ্যে সেনা ছিল। আধাসেনাও। কিন্তু এই 20 দিনের ইতিহাস মণিপুর কখনও কি ভুলতে চাইবে, যখন একের পর এক থানায় আক্রমণ চালায় দুষ্কৃতীরা। 4 মে প্রথম হামলা হয় ইম্ফলের পুলিশ প্রশিক্ষণ কলেজে। এফআইআর অনুযায়ী 157টি ইনসাস, 54টি এস.এল.আর ও এ.কে. 47 লুট হয়।
কয়েকদিনে প্রায় ছয় হাজার আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়ে যায় পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে। এমন ঘটনার সংখ্যা ছিল 79। 7831টি ভাঙচুর ও 189টি খুনের অভিযোগে এফআইআর হয়েছিল। ছিল যৌন নিগ্রহের অভিযোগ, নিখোঁজ মানুষের জন্য ডায়েরি।
এমন নৈরাজ্যের শহরে বসে বীরেন সিং হয়ে উঠেছিলেন এ যুগের নিরো!
অনাচার বৃত্তান্ত
কিভাবে চলতে থাকল এই অনাচার? অবাধে থানা থেকে কিভাবে অস্ত্র নিয়ে গেল দুষ্কৃতিরা? এসব প্রশ্নেই কি আছে গভীর ষড়যন্ত্রের বীজ! উত্তর-পূর্বের নিরাপত্তা নিয়ে ওয়াকিবহাল এক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ আধিকারিকের কথায়, "সাধারণ মানুষ বিনা বাধায় থানায় ঢুকে অস্ত্র নিয়ে চলে যাচ্ছে, এটা এককথায় অসম্ভব, যদি না রাজ্য সরকারের তাতে প্রচ্ছন্ন অনুমোদন থাকে। এর সাহায্যে মেইতেই জনতা ও তাদের গোষ্ঠীর হাতে অস্ত্র এসে যায়।
মে মাসের শেষ থেকে সংঘাতের চরিত্র কিছুটা বদলে গেল। এর মধ্যে অমিত শাহ চারদিনের ইম্ফল সফর করলেন। রাজ্য পুলিশ ও সেনাকে এক হাতে নিয়ন্ত্রণের জন্য উচ্চপদস্থ আধিকারিক নিয়োগ করলেন। দুই জাতিগোষ্ঠীর এলাকার মধ্যে দেওয়া হল অদৃশ্য কাঁটাতার। নিরাপত্তা বাহিনী তৈরি করল বাফার জোন বা নিরপেক্ষ অঞ্চল।
এসব উদ্যোগে শহরের উত্তেজনায় কিছুটা লাগাম টানা গেল বটে, কিন্তু সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ল গ্রামীণ এলাকায়। ছোট ছোট গ্রাম, জনপদ চলে এল হিংসার কবলে। যেখানে কুকি পরিবারের উঠোনে ছায়া ফেলত মেইতেইদের গাছ, সেখানে যেন রাতারাতি গজিয়ে উঠল বৈরী দেশের মধ্যেকার কাঁটাতার। জুন মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলতে থাকল হানাহানি। কিন্তু কেউ কি প্রশ্ন করল, এতো রক্ত কেন!
চলুন, এমন একটা গ্রামে নিয়ে যাই। মেইতেই অধ্যুষিত পশ্চিম ইম্ফল জেলার সিংদা কাদাংবন্দ। মাসের পর মাস বিনিদ্র রাত কেটেছে গ্রামবাসীর। গ্রামের প্রান্তে গড়া হয়েছিল 10টি বাঙ্কার। 165টি পরিবারের 170 জন পুরুষ সেখানে পালা করে দাড়িয়েছেন, বন্দুকের নল উঁচিয়ে রেখেছেন কোনও ভিন্ন জাতির মানুষকে নিশানা করার জন্য।
বাতাসে যখন বারুদ, মানুষের পোড়া চামড়ার গন্ধ, তখন জেগে উঠেছে বোতলের দৈত্য। মেইতেই, কুকি, নাগাদের কমবেশি 30টি সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে। এগুলি তেমন সক্রিয় ছিল না চলতি সঙ্কটের আগে। সরকারের কৌশল কিংবা শান্তিচুক্তির দৌলতে জনতা থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল অস্ত্রধারীরা। বন্দুকের ডগা থেকে বুলেট বেরোতেই দুষ্কৃতীরা নেমে পড়েছে শিকারে।
মণিপুরের এত কথা যখন কান্না আর ক্রোধের মধ্যে দিয়ে যাত্রা করে একটা অন্ধকারের সামনে এসে দাঁড়ায়, তখনও মুখোমুখি সেই 19 বছরের তরুণ। চোনমিনলাল কিপগেন।
ক্লান্ত, হলুদ মুখে প্রতিশোধের ধার যতটা, তাকে অসহায় লাগে তার থেকে বেশি। বড়দিনের সকালে সদ্য তরুণের মা নিংখনগাহ কিপগেন বলেন, “নিজের ছেলেকে লড়াইয়ের ময়দানে পাঠাতে কার মন চায়? আমি শুধু প্রার্থনা করতে পারি, ও যেন নিরাপদে থাকে”।
এমন কত তরুণ ও তাদের মায়ের জাগরণের মধ্যে দীর্ঘ রাত মরে যায়। সকাল হয় না। মণিপুরের পাহাড় দাঁড়িয়ে থাকে আলো আসবে বলে।
কুশল সিংহরায়