পশ্চিমবঙ্গের দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়া সিপিএম সংগঠনের প্রতি দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের স্পষ্ট বার্তা — দলকে আশু কর্তব্য বুঝে সেই মতো লড়তে হবে। জ্যোতি বসুর 109 তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কলকাতায় আয়োজিত অনুষ্টানে সীতারাম ইয়েচুরির বক্তব্য, “ভারতীয় জনতা পার্টিকে হারাতে জোটবদ্ধ হতে হবে। দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়াকে রুখতে হবে।”
ইয়েচুরি তাঁর এ রাজ্যের সহকর্মীদের মনে করিয়ে দেন যে বর্তমানে দেশের রাজনীতি এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। সিপিএম দলের পূর্বতন নেতারা দেশের ভবিষ্যৎ রূপরেখা সম্পর্কে একটা নির্দিষ্ট ধারণা পোষণ করতেন, এবং এঁদের মধ্যে জ্যোতি বসু ছিলেন অনন্য। তিনি নতুন নতুন চিন্তাকে উসকে দিয়ে সেই ধারণাকে সমৃদ্ধ করে গিয়েছেন। এখন বিজেপি সুপরিকল্পিতভাবে সেই দেশকে ধ্বংস করে চলেছে। তিনি বলেন, 1947 সালে স্বাধীনতা অর্জনের সময় দেশের রাজনৈতিক নেতৃমণ্ডলী বেছে নিয়েছিলেন এক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারত গড়ে তোলার পথ, যা কিনা সামাজিক ন্যায় দিতে দায়বদ্ধ থাকবে ও অর্থনৈতিক দিক থেকে সার্বভৌমত্ব অর্জনের পথে হাঁটবে। কমিউনিস্টরাও সেই ধারণার শরিক ছিলেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে পরেই এখনকার মতোই সংবিধানের মূল ভিত্তি - ধর্মনিরপেক্ষতা, পরমতসহিষ্ণুতা, দেশের ফেডারেল কাঠামো, ন্যায় ও সমতা – এ সবই প্রবল সঙ্কটের মুখে পড়েছিল। ইয়েচুরি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, স্বাধীনতার 75 বছর পর এখন আবারও সেই সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ফ্যাসিস্ত, ঈশ্বরতন্ত্রে বিশ্বাসী ও উন্মাদের মতো অসহিষ্ণু শক্তিকে পরাস্ত করতে হবে, যারা যেন তেন প্রকারেণ দেশকে একটা তথাকথিত হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করতে উদ্যত।
জ্যোতি বসু যে এই সাম্প্রদায়িক শক্তির বিপদের সম্পর্কে বার বার সতর্ক করে দিতেন, সে কথা স্মরণ করে ইয়েচুরি বলেন, যা কিছু ধর্মনিরেপক্ষ ও উদারনৈতিক ভাবনাচিন্তা, তার সব কিছুই এই ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক শক্তি নষ্ট করে দিতে সমর্থ। স্বাধীনতার পরবর্তী প্রজন্ম যে সাম্প্রদায়িকতার বিপদ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন নয়, তা নিয়ে জ্যোতিবাবু উদ্বেগ প্রকাশ করতেন। দলের মধ্যে তরুণ বয়স থেকেই শীর্ষ নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে শিক্ষানবিশ হিসাবে কাজ করার সুবাদে জ্যোতি বসুকে ঘনিষ্টভাবে চেনার সুযোগ পেয়েছিলেন ইয়েচুরি। তাঁর বক্তৃতায় তাই জ্যোতি বসুর রাজনৈতিক চিন্তার সারাৎসারের উল্লেখ ও বর্তমান সঙ্কটে দলের সামনে করণীয় কর্তব্য সম্পর্কে দিশা দেখানোর প্রয়াসের এক সুসঙ্গত মিশেল দেখা যায়। সিপিএম সাধারণ সম্পাদক জোর দিয়ে বলেন, সঙ্কটের সময় আশু কর্তব্য নিরূপণ করা ও তা সাফল্যের সঙ্গে রূপায়ণ করতে পারাটা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, সেই প্রয়াস ব্যর্থ হলে কমিউনিস্টদের মতাদর্শগত লক্ষ্য সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা হারিয়ে যাবে।
সমস্যাটির বিশদে গিয়ে জ্যোতি বসুকে উদ্ধৃত করে ইয়েচুরিবলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে দুটি সম্ভাবনাই প্রবল ছিল — স্বাধীন ভারত হতে পারত একটা মুসলমান রাষ্ট্র, বা একটা হিন্দু রাষ্ট্র। 1937 সালে বিনায়ক দামোদর সাভারকর দুই রাষ্ট্রের তত্ত্ব খাড়া করে দাবি করেন, স্বাধীন ভারতের নাগরিক তাঁরাই হতে পারবেন, যাঁরা এই দেশকে মাতৃভূমি, পিতৃভূমি ও পুণ্যভূমি বলে মনে করেন। এই পুণ্যভূমি কথাটা যোগ করায় মুসলমানরা সহজেই ব্রাত্য হয়ে গেল, কারণ, মুসলমানদের কাছে মক্কা পুণ্যভূমি বলে গণ্য। আবার খ্রিষ্টানরাও বাদ পড়ল, কারণ, তাদেরও জেরুজালেম, ন্যাজারেথ ও বেথেলহেম পুণ্যভূমি। এর পর 1940 সালে মহম্মদ আলি জিন্না তাঁর দুই রাষ্ট্রের তত্ত্ব হাজির করেন। ইয়েচুরি মনে করিয়ে দেন, সাভারকরের মতাদর্শগত দুই রাষ্ট্রের চিন্তা এবং জিন্নার ইসলামী রাষ্ট্রের ভাবনার সংমিশ্রণে আজকের সাম্প্রদায়িকতা পুষ্ট হয়েছে।
জ্যোতি বসু ও হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ বার বার বলতেন যে 1947 সালে দেশভাগ হয়নি, শুধুই পঞ্জাব ও বাঙলা ভাগ হয়েছিল। সে কথা তাঁর ভাষণে ইয়েচুরি গুরুত্ব দিয়ে স্মরণ করেন। এর নিহিত অর্থ একটাই, পশ্চিমবঙ্গে দলের কর্মী, সমর্থকদের এটা বুঝতে হবে যে আগে বিজেপিকে পরাস্ত করতে হবে, তার পরে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। অন্যথায়, এ রাজ্যে সিপিএমের পুনরুজ্জীবন ঘটানো যাবে না, এবং দলের বৃহত্তর লক্ষ্য সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজও সুদূরপরাহত হবে।
কী করে বিজেপিকে হারানো যায় এটাই যখন দলের আশু কর্তব্য হয়, তখন আসন্ন রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনে সমস্ত বিরোধী দলকে একজোট হয়ে লড়ার একটা সুযোগ এনে দিয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে যেখানে সিপিএম প্রধানত শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে একটা ধারাবাহিক ও তিক্ত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, তুলনায় বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্ব কম, এবং কখনও কখনও কংগ্রেসের সঙ্গেও লড়াই করছে, সেই রাজ্যে দলীয় কর্মী ও সমর্থকদের কাছে লড়াইয়ের অভিমুখ প্রধআনত বি জে পির বিরুদ্ধে ঘুরিয়ে দেওয়ার কথা বলা এবং গ্রহণযোগ্য করে তোলা বেশ কঠিন।
পশ্চিমবঙ্গে টানা 34 বছর ক্ষমতাসীন থাকার স্মৃতি (যার মধ্যে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে 22 বছর) এবং 2011 সালে তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে নির্বাচনে পরাজিত ও ক্ষমতাচ্যুত হওয়া, এবং তার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে পরাজয়ের পর সিপিএম কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গোটা দেশের শত্রু হিসাবে বিজেপিকেই চিহ্নিত করলেও তার বিরুদ্ধে লড়ার বদলে এ রাজ্যে তারা স্থানীয় শত্রুর বিরুদ্ধে লডাইকেই গুরুত্ব দিয়ে চলেছে। দলের রাজ্য নেতৃত্বকে এই দুই শত্রুর মধ্যে এই সময়ে বেশি বিপজ্জনক শত্রুকে আলাদা করে বেছে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোঝানোর কাজটা যে সহজ নয়, তা ইয়েচুরি ভালো করেই জানেন। প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে আয়োজিত এই সভায় তাই তিনি দলের নেতা, কর্মী সমর্থকদের সামনে বর্তমান সময়ের সঙ্কটের গুরুত্ব, দলের আশু কর্তব্য এবং অগ্রাধিকার বেছে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেন।
তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে একমুখী তীব্র বিরোধিতার লাইন অনুসরণ করে চলার জেরে ইতিমধ্যেই রাজ্য সিপিএমকে বিরূপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সিপিএম ভোটের একটা বড় অংশ 2019 এবং 2021 সালের নির্বাচনে বিজেপির দিকে চলে গিয়েছে। এতটাই, যে বিজেপি এখন মোট ভোটের 40 শতাংশ পেয়ে যাচ্ছে। তৃণমূল কংগ্রেসও 48 শতাংশে পৌঁছে গেছে। অন্যদিকে, সিপিএম এবং কংগ্রেসের ভোট তলানিতে এসে ঠেকেছে। ইয়েচুরি যতই রাজ্য সিপিএমকে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করুন না কেন, 2021 সালের বিধানসভা নির্বাচনের পরবর্তী এক বছরের মধ্যে রাজ্য সিপিএমের তরফে ইয়েচুরির তথা দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পরামর্শে সাড়া দেওয়ার লক্ষণ এখনও দেখা যায় নি।
#JyotiBasu #SitaramYechury #Crisis_of_CPIM