"আকুল শরীর মোর বেয়াকুল মন।
বাঁশীর শবদেঁ মো আউলাইলোঁ বান্ধন।।"
শ্রীমতি রাধা কৃষ্ণের মোহনবাঁশিতে এমনই পাগলপ্রায় হয়েছিলেন। বড়ু চন্ডীদাস তাঁর শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে অন্তত এমনটাই জানাচ্ছেন। কিন্তু ঘোর তমসাচ্ছন্ন কলিতে এমন কৃষ্ণপ্রেমের জোয়ার দেখে সংশয়ী মনগুলো পর্যন্ত বৃন্দাবন বৃন্দাবন ঠেকছে!
'1176 হরেকৃষ্ণ'— সমাজ মাধ্যমে গত কয়েকদিন ধরে এই লেখাটি ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঈশ্বরের নাম ও প্রসঙ্গ যখন আছেই, তখন স্বভাববশেই অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে ভক্ত ও ভক্তির অনুবর্তী হচ্ছে বিচার ও যুক্তিবোধ। কিন্তু কী এমন জাদু লুকিয়ে রয়েছে এই সংখ্যা ও নামে? এমনটি লেখার পরেই নাকি স্বয়ং কৃষ্ণের কৃপায় মাত্র 48 ঘন্টার মধ্যে সুখবর আসবে!
ভারতবর্ষের সমাজ ও রাজনীতিতে গত তিন দশক ধরে অবশ্য পুরুষোত্তম রামের একচেটিয়া আধিপত্য। এক্ষেত্রে কৃষ্ণ বিশেষ কল্কে পাননি। এর একটা সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, কৃষ্ণ প্রেমিক মানুষ, তদুপরি ক্যাসানোভা চরিত্রের, আস্ফালনের রাজনীতি কৃষ্ণের বংশী শুনে স্বভাবতই আকুল হতে পারেনি। অপরদিকে রঘুপতি রাঘব রাজা রাম, যতই প্রজাপালক হোক, রাজধর্ম পালনে নিজের স্ত্রীকেও রেয়াত করেন না, অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয় সীতাকেও। হালের রাজনীতিতে রামের যখন এই মৌসরিপাট্টা, তখন হঠাৎ কৃষ্ণনামে পাগল কেন জনতা জনাদর্ন?
এর মধ্যেও কিন্তু একটা স্ববিরোধ আছে। একটু তলিয়ে দেখলেই দেখা যাবে, কৃষ্ণনামে যে সুখবর প্রাপ্তির কথা বলা হচ্ছে, তা মূলত কাঞ্চনমূল্যেই পরিমাপ করা সম্ভব। মানে চাকরির প্রোমোশন কিংবা হঠাৎ লটারিপ্রাপ্তি হলেই বুঝতে হবে কৃষ্ণের কৃপাদৃষ্টি আপনার ওপর বর্ষিত হয়েছে। কিন্তু প্রায় গোটা হিন্দু পুরাণ জুড়ে যে বলা হয়েছে ত্যাগেই মুক্তি আর ভোগেই বিপদ! স্বয়ং কৃষ্ণও তো কাব্যিক ঢঙে অর্জুনকে সেই উপদেশই দিয়েছেন। তবে এই প্রবঞ্চনা কেন? শ্রীক্ষেত্র কিংবা মথুরাধাম— যেখানে 'প্রভু'র অধিষ্ঠান, সেখানেও কাঞ্চনমূল্যের বিনিময়ে আশীর্বাদ বিক্রি হয়— ধনসম্পদ হবে, বড়লোক হবে। আরে মশাই, প্রভহু যে বলেছেন ফকির হতে, এত ধনদৌলত নিয়ে তো ভোগসর্বস্বটায় নিমজ্জিত হয়ে যাবে সংসারী মানুষ!
আক্ষেপ অন্যত্র। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে যখন কুসংস্কার, অপবিজ্ঞান প্রায় মহামারীর মতোই ছড়িয়ে পড়েছে, তখন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু ভাকরা নাঙ্গাল বাঁধের উদ্বোধন করে বলেছিলেন, এটাই আধুনিক ভারতের মন্দির। খরাপ্রবণ পূর্ব পাঞ্জাবকে শস্যশ্যামলা করার এই মহতী উদ্যোগকে এর থেকে ভালভাবে আর হয়তো ব্যাখ্যা করা যেত না। কিন্তু পরবর্তী সাত দশকে এই মন্দিরের ধারণাই তো ক্রমে বদলে গেল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একটি বিতর্কিত মন্দিরের দ্বারোদঘাটন করেন, ভোটের পালে হাওয়া জোগাতে নিজের নির্বাচনী কেন্দ্রে মন্দির সংস্কার করেন। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত বিশ্বাস কেন জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর বিশ্বাসের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে, সেই প্রশ্ন অবান্তর হয়ে যায়। সবকিছুই স্বাভাবিক লাগে আজকাল। স্বঘোষিত বাবারা রাজনৈতিক প্রসাদ লাভের গুণে যথেচ্ছাচার করে বেড়ালেও, নিশ্চুপ থাকে ধর্মভীরু জনসমাজ। এক্ষেত্রে বাম ডান কিংবা মধ্য— কেউই দায় এড়াতে পারে না। ইন্দিরা গান্ধী থেকে শুরু করে বহু প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এইসব ধর্মগুরু বা স্বঘোষিত বাবাদের অনুমোদন দিয়েছেন। বামশাসিত 'প্রগতিশীল' বঙ্গেও বালক ব্রহ্মচারীর মরদেহকে ঘিরে তাঁর 'সন্তান'রা যা সমস্ত কাজ করেছেন, সাধারণ যুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ কখনও তা মেনে নিতে পারেন না। এ ছাড়াও লিফলেট ছাপিয়ে অমুক ভগবানের মহিমা প্রচার করে ভাগ্য ফেরান, এমন ধর্মীয় নিদান এখনও এই গ্রামবাংলায় দেখা যায়। তবে ভার্চুয়াল জগতে এমন কৃষ্ণনাম জপার হিড়িক এই প্রথম।
প্রাপ্তিযোগের আশায় যুক্তি-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষজনও যেভাবে এইসব হুজুগে তাল মেলাচ্ছে, তাতে অর্জুনকে সারথী কৃষ্ণ অলক্ষ্যে হয়তো বলছেন, 'পার্থ, ওই দেখো যুক্তি, বিচারবোধ, বিজ্ঞানমনস্কতা। চিন্তা কোরো না, ওদের সকলকে আমি আগেই হত্যা করে রেখেছি। তুমি নিমিত্ত মাত্র।'