4thPillar


নেতাজি-আবেগ আজকের শাসকের রাজনৈতিক পুঁজি

বিতান ঘোষ | 23-01-2022May 8, 2023
নেতাজি-আবেগ আজকের শাসকের রাজনৈতিক পুঁজি

ছদ্মবেশে তিনি কখনও আফগান চাচা জিয়াউদ্দিন, কখনও ইতালিয় রেডিও অপারেটর অরল্যান্ডো ম্যাৎসোটা। সংশয়ীদের কাছে তিনি কখনও "অলীক' গুমনামি বাবা কিংবা শৈলমারীর সাধু। তবু জন-আবেগের ভরকেন্দ্রে এখনও প্রবনভাবে বিদ্যমান নেতাজি (Netaji Subhash Chandra Bose)। বহু ও বিচিত্র নেতা-ধন্য এই দেশে যে নেতার নামে এখনও বহু মানুষের শরীরে শিহরণ খেলে যায়। যাঁর জন্মের 125 বছর পরেও তাঁর মৃত্যু এক অদ্ভুত রাজনৈতিক প্রহেলিকার জন্ম দেয়, গাদাগুচ্ছের নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়, মোটা টাকা ব্যয়ে তদন্ত কমিশন গঠিত হয়, তবে রহস্যের তল মেলে না। ব্যক্তি সুভাষ, রাজনীতিক সুভাষ, দেশপ্রেমিক সুভাষ— এদেরও কি তল মেলে?

সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর রাজনৈতিক জীবনে কী করেছেন, সকলেরই জানা। সুভাষ স্বাধীন ভারতে থাকলে কী করতে পারতেন, তাই নিয়েই আমাদের অধিক আগ্রহ। তাই 1945-এর 18 অগস্ট পরবর্তী "নিরুদ্দিষ্ট' সুভাষ আমাদের সকল মনোযোগ হরণ করে নেয়, প্রচলিত ব্যবস্থা প্রসূত আমাদের যাবতীয় হতাশা ও নৈরাশ্যের বিপ্রতীপে ওই একটি মানুষকে বিপদতাড়ন বলে মনে হয় আমাদের। মূলস্রোতের রাজনীতির ঘাতপ্রতিঘাত সয়ে আরও দীর্ঘ পথ ধরে সুভাষ হেঁটে গেলে হয়তো সেই মোহটাও আমরা ঘুচিয়ে ফেলতাম। ফেলিনি, কারণ সুভাষ বৃহৎ পরিসরে প্রশাসক হিসাবে পরীক্ষিত নন। কলকাতা পুরসভার মেয়র হিসেবে প্রশাসকের পরীক্ষায় তিনি সংশয়াতীত ভাবে উত্তীর্ণ নন।

তাঁর দেশপ্রেম কালোত্তীর্ণ। স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী তাঁকে "দেশপ্রেমিকদের দেশপ্রেমিক' আখ্যায় ভূষিত করেছেন, রবীন্দ্রনাথ "দেশনায়ক'। কিন্তু কোন আদর্শের দ্বারা প্রাণিত হয়ে এক কৃতী তরুণ আইসিএস-এর চাকরি ছেড়ে দেশের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন? কোন আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের বাইরে দ্বিতীয় রণাঙ্গনে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিলেন? এখানেই একটা ধোঁয়াশা আছে। সুভাষের রাজনৈতিক চিন্তার গোড়ায় পৌঁছলে কখনও কখনও মনে হতে পারে (এবং মনে হওয়াটা কোথাও ভুল নয়), তিনি বিংশ শতাব্দীর গোড়ার বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত। স্মরণে রাখতে হবে প্রাচীন শাক্তভূমি বাংলার প্রায় নিজস্ব এই আন্দোলন-ধারায় ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহার এবং দেশকে মাতৃজ্ঞানে দেখার প্রথম সচেতন প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। সুভাষ 1922 সালের ডিসেম্বর মাসে, কলকাতায় নিখিল বঙ্গ যুব সম্মিলনীর অধিবেশনে বলছেন, ""...আমাদের দেশের বেদনাময়ী মাতৃমূর্তি নয়নজলে ছিন্ন অঞ্চল ভিজিয়ে তোমাদেরই আশায় বসে আছেন। তোমরা জাগো ভাই, মায়ের পুজোর শঙখ বেজেছে, আর তোমরা তুচ্ছ দীনতা নিয়ে ঘরের কোণে বসে থেকো না।'' এই বক্তব্য যেন অরবিন্দ ঘোষকে স্বরণ করায়, কিন্তু সুভাষের রাজনৈতিক গুরু চিত্তরঞ্জন দাশের বাস্তববাদী চিন্তার প্রতিফলনের বিপ্রতীপ এই বক্তব্য। সুভাষ কি তবে আবেগপ্রবণ, না কুশলী?

 


নেতাজি-আবেগ আজকের শাসকের রাজনৈতিক পুঁজি

বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকেই সুভাষ স্বঘোষিত সমাজতান্ত্রিক, যদিও দেশের কমিউনিস্ট বা সোশ্যালিস্ট দলগুলোর সঙ্গেও তিনি বিশেষ সম্পর্ক রাখতে চান না। আবার এই সময় থেকেই তিনি ইউরোপের একনায়কতন্ত্রী দেশগুলোর নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক মডেল ও অন্যান্য উন্নয়ন চিন্তায় মুগ্ধ হচ্ছেন। অবশ্য আগাগোড়া মনে করছেন, ভারতবর্ষের জন্য গণতন্ত্রই একমাত্র পথ। এইখানেই সুভাষের সঙ্গে একটা পার্থক্য (প্রতিতুলনা নয়) গড়ে উঠতে পারে তাঁর একদা রাজনৈতিক সতীর্থ, "কমরেড' জহরলাল নেহরুর সঙ্গে। নেহরুর বিশ্ববীক্ষা প্রশ্নাতীত, তিনি ফ্যাসিবাদের বিপদ সম্পর্কে সচেতন। সুভাষ কি সচেতন নন? অবশ্যই সচেতন, কিন্তু সুভাষ বাস্তববাদী। নেহরুর মতো স্বপ্নবিলাসী নন, সংশয়ী তো ননই। কৌশলগত প্রয়োজনে তাই দুই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ করা। এই কাজের জন্য সুভাষ বিদগ্ধ মহলের একাংশের কাছে এখনও ধিক্কৃত ও নিন্দিত হন। কিন্তু এ কথাও ভুললে চলবে না 1941 সালে সুভাষ যখন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্য করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে দীর্ঘ স্মারকপত্র লিখে নাৎসী সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছেন, তখন হিটলার সোভিয়েত আক্রমনের ছক কষছেন। সুভাষ তা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেননি। জার্মানির ভূ-রাজনৈতিক সম্প্রসারণ ছাড়া ভারতের মুক্তি নিয়ে হিটলার আদৌ ভাবিত ছিলেন না, ভাবার কথাও ছিল না।

সুভাষ বাস্তববাদী, পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজের অবস্থান, কৌশল বদলেছেন৷ লক্ষ্যে ছিলেন স্থিতধী, দেশমাতৃকার মুক্তি। সুভাষ কি জানতেন না, এশিয়ার রণাঙ্গনে জাপান যখন পশ্চাদপসরণ করছে, যুদ্ধের চালচিত্র যখন বদলাচ্ছে, তখন বিজয়ী মিত্রশক্তি তাঁকে যুদ্ধবন্দি হিসাবে ভারতে নিয়ে আসতে পারে? হয়তো জানতেন। কিন্তু সুভাষের নেতৃত্বের একটা চৌম্বকত্ব ছিল, তাঁকে নিয়ে যে গণউন্মাদনা, সে-ও তো তাঁর এই Pragmatism- সঞ্জাত। আদর্শের সুনির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করে সুভাষের পথ হাঁটা নয়।

এই ধোঁয়াশা, এই আপাত স্ববিরোধই কি সুভাষ বন্দনায় মত্ত করে রাখে আজকের ভারত-শাসকদের? আজকের শাসকদল আদর্শগত ভাবে, কৌশলগত ভাবে গান্ধীবাদী সমাজতন্ত্র, নেহরুবাদী বিশ্ববীক্ষার বিরুদ্ধে। তাই এঁদের বিপ্রতীপে কখনও এনে দাঁড় করানো হয় ভগৎ সিং-কে। কখনও সর্দার প্যাটেলকে। আর সুভাষ তো রইলেনই। এই বিপুল জন-সম্মোহিনী শক্তি দ্বিতীয় আর কোন রাজ-নেতার মধ্যেই বা পাওয়া যেত? কিন্তু সুভাষকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করার মধ্যেও যে বিপদ দেখে শাসক! সুভাষ জাত ধর্মের ক্ষুদ্র গন্ডির বাইরে এক বৃহৎ জাতীয়তাবাদী পরিচয়কে সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়ার পক্ষে, সুভাষ মেয়েদের রণাঙ্গনে আনার পক্ষে, সুভাষ ব্যক্তিগত ধর্মাচরণে রাজনীতির আঙিনায় টেনে আনার বিপক্ষে। বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা ও খানিক "ভুল' কৌশল সত্ত্বেও সুভাষের দেশপ্রেম নির্বিকল্প। আজকের শাসকের আদর্শপুরুষদের মতো তিনি ব্রিটিশদের সঙ্গে কৌশলগত মিত্রতা কখনও করেননি। বরং ব্রিটিশ সূর্যকে অস্তমিত করতে সর্বতোভাবে চেষ্টা করে গেছেন।

গান্ধী-সুভাষ দ্বন্দ্ব সম্পর্কে নীরদচন্দ্র চৌধুরী বলছেন, এই "বিরোধ' আসলে শাক্ত সুভাষ আর বৈষ্ণব গান্ধীর মতাদর্শগত লড়াই। শক্তির উপাসক সুভাষ বিংশ শতাব্দীর তিনের দশক থেকেই সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে, গান্ধী সেখানে বৈষ্ণবীয় অহিংসাকেই তাঁর রাজনৈতিক পথ নির্মাণের প্রধান রসদ করে তুলছেন। তাই এই দু'জনের বিরোধ তো অবশ্যম্ভাবী। আবার রজনীপাম দত্তের মতো  ক্লাসিকাল তাত্ত্বিক বামপন্থীরা যখন হিটলারের মূল্যায়নে তখনও খানিক দ্বিধাগ্রস্ত, নেহরু তখনই স্বঘোষিত সোশ্যালিস্ট হওয়া সত্ত্বেও ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন। সুভাষ জাপানি সেনার সহায়তায় দেশে ঢুকলে, তাঁর পথ রুদ্ধ করবেন বলে জানাচ্ছেন। সুভাষ রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে ফিরে এলেও হয়তো দুই কমরেডের রাজনীতির পথটা ভিন্নই হত। আক্ষেপ এটাই যে এই 125 বছর পরেও সুভাষের কাজের কোনও মূল্যায়ন করল না কোনও শাসক। তাঁর নিরুদ্দেশ সম্পর্কিত কিংবদন্তিগুলোকে ধুনি বানিয়ে জল্পনার আগুন জ্বালিয়ে গেল। আর গান্ধীর স্বপ্নের রামরাজ্যের ওপর রামমন্দির বানাতে চাওয়া শাসক গান্ধী, নেহরুর প্রতিস্পর্ধী চরিত্র হিসাবে সুভাষকে ব্যবহার করল। সুভাষ থাকলেন বাঙালি অস্মিতার জাগরণ-প্রয়াসে, থাকলেন নেহরু-বিরোধী চরিত্র নির্মাণে। কিন্তু থাকলেন না সাধারণতন্ত্র দিবসের সুসজ্জিত রাজপথে। সুভাষকে এতটা গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজনও Opportunist শাসকের নেই যে!


New
নায়কের খোঁজে বাঙালি
নির্বাচনী বন্ড: সরকারকে সব জানালেও সুপ্রিম কোর্টকে বলতে কেন বিলম্ব স্টেট ব্যাঙ্কের
মুক্তমনের অম্লান ভাষ্যকার


Other Writings by -বিতান ঘোষ | 23-01-2022
হরেকৃষ্ণ হরে হরে মোবাইলে ঘোরে ঘোরে
হরেকৃষ্ণ হরে হরে মোবাইলে ঘোরে ঘোরে

"আকুল শরীর মোর বেয়াকুল মন।

বাঁশীর শবদেঁ মো আউলাইলোঁ বান্ধন।।"

 …


// Event for pushed the video