এর আগে গুল দিয়েছিলেন তিনি। এবার মৌতাতে হুঁকো ধরালেন স্বপ্নময় চক্রবর্তী।
হুঁকো
শান্তিনিকেতনে খোয়াইতে প্রতি শনিবার নানা শিল্পসামগ্রীর হাট বসে। অবশ্য ছোট করে প্রতিদিনই বিকেলে। শান্তিনিকেতনের খোয়াইয়ের হাট থেকে একটা একতারা কিনেছিলাম। তারপরই একটা থেলো হুঁকো কেনার শখ হল। আমার শৈশবে দেখেছি বাগবাজার, শ্যামবাজার, শোভাবাজারের বাজারের ভিতর দু’একটা দোকানে হুঁকো পাওয়া যেত, তারপর অদৃশ্য হয়ে গেছে।
কিছুদিন আগে কোম্পানি বাগানের কাছে নতুনবাজারেও চোখে পড়েছিল। সেদিন গেলাম কিনতে, না নেই, পাওয়া গেল না।
কোম্পানি বাগান মানে বিডন স্কোয়ার। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যে প্রথম বাগানটা করেছিল, সেটাই কোম্পানি বাগান। পরে সাহেবরাই বিডন সাহেবের নামে বিডন স্কোয়ার বানালেন, এখন রবীন্দ্রকানন। রবীন্দ্রকাননের উল্টোদিকের বিরাট বাজারটির নাম নতুনবাজার, যদিও ওটা অন্তত দেড়শ’ বছরের পুরনো।
নতুনবাজারে খোঁজ করতে গিয়ে জানা গেল এখানেও হুঁকো পাওয়া যায় না আর, বড়বাজারে হুঁক্কাপট্টিতে পাওয়া যাবে।
অগত্যা বড়বাজারের সত্যনারায়ন পার্কের কাছে গিয়ে হুঁক্কা গলির খোঁজ করলাম। ফলপট্টি পেরিয়ে হুঁক্কাগলি পেলাম। একসময় ওখানে পরপর হুঁকোর দোকান ছিল নিশ্চয়ই, এখন মূলত মশলার দোকান। খুঁজে পেতে একটা দোকান পেলাম যেখানে মাদুর, দড়ি, খসখস এসব বিক্রি হয়, ওরা জানাল হুঁকো আছে, কিন্তু ভালো হবে না। এখন রাখি না, আর কেউ কেনে না। যা পেলাম তাই সই। নারকোলের মালাটা সুগোল নয় এবং ছোট। তা হোক। একটা যুগের স্মৃতি হিসেবে ঘরে তো থাক।
অথচ একটা সময় ছিল, যখন হুঁকোর কি রমরমা। সমস্ত গেরস্ত ঘরে একাধিক হুঁকো থাকতো। স্বামী বিবেকানন্দের বাল্যকালের গল্পটা তো সবাই জানি। তথাকথিত নিচু জাতের জন্য বরাদ্দ হুঁকোটা টানতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন। তার কৌতুহল ছিল, জাতটা কিভাবে যায় সেটা দেখবেন।
কোনও বাড়িতে অতিথি আপ্যায়নের প্রথম উপায় হ’ল হাতে হুঁকো ধরিয়ে দেওয়া। যাঁরা হুঁকো দেখেননি, তাঁদের বলি -
একটা নারকোলের মালার বাইরেটা বেশ পালিশ করে দু’টো ফুটো করে নিতে হয়। ভিতরের শাঁসটাস বের করে নিয়ে বড় ফুটো দিয়ে একটা কাঠের নল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, যার মাথায় থাকে কলকে। কলকেতে টিকা জ্বালিয়ে গুড়-তামাকের মিশ্রন দিয়ে জ্বালিয়ে দিতে হয়। নারকোল মালাটি জলে ভরা থাকে। ছোট ফুটো দিয়ে টানলে তামাকের ধোঁয়া জলের ভিতর দিয়ে কিছুটা পরিশ্রুত হয়ে ফুসফুসে প্রবেশ করে।
হুঁকো হ’ল সাধারণ মানুষের ব্যবহার্য। উচ্চস্তরের মানুষদের জন্য গড়গড়া, আলবোলা ইত্যাদি। পদ্ধতিগত ব্যাপারটা একই। নারকোল মালার পরিবর্তে পেতল, তামা বা রূপোর পাত্র। এবং সঙ্গে একটি নল। হুঁকোর নারকোল মালায় মুখ দিয়ে টানতে হয়, গড়গড়ায় শুয়ে, বসে, আরাম করে নলে মুখ লাগিয়ে টানা যেতে পারে। এই গড়গড়া নবাবদের কাছ থেকে অর্জন করেছিলেন সাহেবরা। অনেক সাহেবরাই গড়গড়া ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন, এমন কি মেমসাহেবরাও।
হুঁকো বা গড়গড়া খাবার আদর্শ সময় ছিল লাঞ্চ শেষ হ’লে। ভোজন শেষ হলেই বেহারা তোয়ালে নিয়ে এবং হুঁকাবরদার হুঁকো বা গড়গড়ার নলের শেষ প্রান্ত ধরে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকত। আভিজাত্যের মাপকাঠি ছিল গড়গড়ার পাত্রটি। সোনা বাঁধানো রূপোর গড়গড়া ছিল একনম্বর। রূপোর দু’নম্বর। রূপোর রং দেওয়া তামা তিন নম্বর। নলগুলো অনেক লম্বা ছিল। হুঁকোবরদারেরা নলের শেষ প্রান্ত ধরে সাহেবের পিছনে পিছনে ঘুরতো। সাহেব পায়চারি করতে করতে নাকি সোফায় বসে নাকি কোচে আধাশোয়া হয়ে ধুম্রসেবন করবে, হুঁকোবরদারেরা কি করে জানবে। সাহেব যখন বাইরে যেতেন, হুঁকোবরদারদেরও সাজসরঞ্জাম নিয়ে সাহেবের সঙ্গে যেতে হত।
মেমসাহেবরা প্রথমদিকে তামাকের গন্ধ সহ্য করতে পারতেন না, কিন্তু ক্রমশ তেনারা তামাকের প্রেমে পড়ে গেলেন। অনেক মেমসাহেব সাহেবদের সঙ্গেই ধুম্রসেবন করতেন, কিন্তু তাদের আলাদা নল থাকত। পার্টিতে প্রত্যেকের জন্য আলাদা নলের ব্যবস্থা রাখতে হত। নলে নলে জড়াজড়ি হয়ে গেলে গৃহস্থের বদনাম হত।
একটা বিশেষ গড়গড়া ছিল, যেটায় চারটে করে নলের সংযোগ করা যেত। কলকেতে আগুন এবং তামাকের ঘাটতি পড়লেও গেরস্থের অকল্যাণ হ’ত। হুঁকোবরদারদের মধ্যে একজন সর্দার বরদার ছিল। তাকে কলকে এবং আগুনের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হ’ত। হুঁকো, সত্যি বলতে কি অনেক বেকারদের চাকরি দিয়েছিল। হুঁকোবরদারদের সংখ্যা ছিল বেয়ারাদের ঠিক পরই।
আরব, পারস্য এসব দেশে নারকোল নেই, তাই নারকেল মালার হুঁকোও হ’তে পারল না। অগত্যা ধাতব পাত্র, সেখানে জল ভরা থাকত। জলের পরিবর্তে নবাব টবাবরা গোলাপ জল দিত। গোলাপ জলের ভিতর দিয়ে সুগন্ধি তামাকের ধোঁয়া প্রবাহিত হ’ত, যার নিকোটিন বেশ কিছুটাই জলে শোষিত।
আমাদের শরৎচন্দ্র-তারাশঙ্কর-সমরেশ, সবাই হুঁকো টানা মানুষের গল্প লিখেছেন। আমি আমার কোনও চরিত্রের মুখে-হাতে হুঁকো ধরাতে পারিনি। তবে ঝড়েশ্বর, নলিনী বেরা ধরিয়েছেন। ওরা গ্রামের মানুষদের নিয়ে অনেক লিখেছেন কিনা...।
কিন্তু গ্রাম থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে হুঁকো। আমি দত্তপুকুর, বামনগাছি, জামুরিয়া, দেগঙ্গা কোনও হাটেই হুঁকো দেখিনি।
কিন্তু সুকুমার রায় লিখেছিলেন - হুঁকোমুখো হ্যাংলা বাড়ি তার বাংলা।
বাঙালির কত কী গিয়াছে, হুঁকোও।