গোটা দেশ জুড়ে করোনার জন্য লকডাউন ঘোষনা হয়েছে। তার আগে গোটা দেশ জুড়ে প্রতিদিন যে কজন অভুক্ত থাকতেন, দুবেলা ঠিকমত খাবার পেতেন না তাদের সংখ্যাটাও বেড়েছে পরিস্থিতির জন্য। বহু শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। মাসে যে সামান্য অর্থটুকু তারা উপার্জন করতেন সে পথ বন্ধ। অনেক নিম্নবিত্ত মানুষ যাদের অবস্থা আক্ষরিক অর্থেই 'দিন আনি দিন খাই' তারা কিন্তু কোনদিন খেতে পেতেন না এমনটা নয়। ধরা যাক যিনি আমার আপনার পাড়ায় রিক্সা চালান, টোটো চালান, দিনমজুরের কাজ করেন, সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করেন, হাসপাতালের আয়া, চায়ের দোকানি, গুমটির দোকানি এরকম আরও অনেকে প্রতিদিনের রোজগারের ওপর বেঁচে থাকতেন। এরা কেউ একেবারে খেতে পেতেন না এমনটা কিন্তু নয়। কিন্তু এখন রুজি বন্ধ তাই খাবার কিনতে পারছেন না। দেখে ভাল লাগে কত বন্ধু, কত পরিচিত প্রত্যেকদিন সেই অভুক্ত থাকা মানুষগুলোর আহার জোগাড় করছে চলেছেন যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। কোথাও চাল, ডাল, তেল দেওয়া হচ্ছে রান্না করার জন্য। কোথাও যারা রান্না করতে পারেন না তাদের জন্য কমিউনিটি কিচেন তৈরি করে রান্না করে খাবার বিলি করছেন সতীর্থরা। সত্যিই তো আমাদের বাড়ির কোন আত্মীয় যদি কখনও খেতে না পান আমরা কি হাত গুটিয়ে বসে থাকি? আজ সত্যিই এই কাজগুলো দেখে মনে হয় গোটা দেশটাই আমার পরিবার, আমরা পরিজনদের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছি।
কিন্তু এই পাশে দাঁড়ানোর ছবি যখন পোজ দিয়ে তুলে এই হুজুগে সমাজসেবী সাজতে চাওয়া কিছুজন প্রচার করেন, দেখতে খারাপ লাগে। কাজের ছবি অবশ্যই ফেসবুকে দেব। ফেসবুক একটা মাধ্যম, সেখান থেকে অনেক মানুষ এগিয়ে আসেন নিজ নিজ পরিসরে। অনেকে শিখতে পারেন কিভাবে কাজটা করা উচিৎ, অনেকে অনুপ্রাণিত হন। কিন্তু ছবিটা যখন একজন কারো হাতে এক প্যাকেট চাল তুলে দিচ্ছেন এমন পোজে তোলা হয় তা সত্যিই খুব লজ্জার। কোথাও একটা এটা প্রকট হয়ে দাঁড়ায় 'আমার আছে তোমার নেই, আমি দিচ্ছি তুমি নাও'। আমারই কাছের পাড়ায় এক বস্তিতে যখন কিছুজন এক বৃদ্ধ রিকশা চালকের হাতে দু কেজি চাল তুলে দিচ্ছেন তা ঘিরে ছবি তুলছেন আরও ৮ জন! আমরা আমাদের আত্মীয়ের পাশে দাঁড়ানোর সময়, বাবার হাতে এ সপ্তাহের বাজার তুলে দেওয়ার সময় কি এরকম করি? এবার সেই ছবি যখন ঘুরে সেই নিম্ন মধ্যবিত্ত খেটে খাওয়া মানুষগুলোর কাছে পৌঁছাচ্ছে তা কতটা খারাপ লাগার বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে ভাবুন তো! তারা তো তথাকথিত 'ভিখারি' নন, রোজগার করতেন। তারা মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ছেন (সম্প্রতি অভিজ্ঞতা থেকে বলছি)। অথচ অনেক পরিচিতদের দেখছি তারা ছবি দিচ্ছেন খাবারের আয়োজনের, কিভাবে তা পৌঁছাচ্ছে তার, কারা কিভাবে দায়িত্ব ভাগ করে কাজ করছেন তার, এই ছবিগুলো আমাদের কাজ শেখায়! কিন্তু 'দান' করার ছবি এই সময়ে বড় দূরে ঠেলে দিচ্ছে, সেই মানুষগুলো পরেরবার আর নিতে চাইছেন না। ঘুরে ফিরে তারা সেই অভুক্তই থেকে যাচ্ছেন আমার আপনার জন্য।
ভালো করতে গিয়ে যেন খারাপই বেশি হচ্ছে। 'দান' না করে পাশে থাকতে পারি না আমরা? অন্যরকম তো ভাবতে পারি।
একটু ভাববনা আমরা, ভাববনা আমরা একটু?