4thPillar


সিঙ্ঘু-টিকরিতে আজকের গোয়েবলস

সৌম্যদীপ্ত রায়চৌধুরী | 04-03-2021May 27, 2023
সিঙ্ঘু-টিকরিতে আজকের গোয়েবলস

বছরখানেক আগে প্রখ্যাত দাবাড়ু গ্যারি কাসপারভ একটি টুইট করেন: "The point of modern propaganda isn't only to misinform or push an agenda. It is to exhaust your critical thinking, to annihilate truth."

 

 

শুধু ভুয়ো তথ্য প্রচারই নয়, প্রোপাগান্ডার অন্যতম উদ্দেশ্য আসলে মস্তিষ্কের দখল নেওয়া। হীরক রাজার দেশে সিনেমার মগজ ধোলাই-এর কথা আমাদের মনে পড়ে। প্রোপাগান্ডা শুধু যে মগজ ধোলাই করে এমনটা কিন্তু নয়, এর পাশাপাশি প্রোপাগান্ডার  মূল উদ্দেশ্য হল, সত্যের সম্পূর্ণ বিনাশ ঘটিয়ে এক নতুন ন্যারেটিভ তৈরি করা, যে ন্যারেটিভের উদ্দেশ্য শাসকের হয়ে কথা বলা।

 

 

নাৎসি জার্মানির প্রচারমন্ত্রী জোসেফ গোয়েবলসের তত্ত্বটিই ছিল, একটা মিথ্যাকে বেশ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে বলতে থাকুন, দেখবেন লোকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, একটা সময়ের পর।

 

 

এই গোয়েবলসীয় তত্ত্ব, যা একসময় গোটা জার্মান জাতিকে বশীভূত করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির শোচনীয় পরাজয় এবং ভার্সাই সন্ধির অপমানজনক চুক্তি জার্মান জাতীয়তাবাদের অহংকারে আঘাত এনেছিল। এমতাবস্থায় জার্মানির ক্ষমতার অলিন্দে ধীরে ধীরে উঠে আসেন হিটলার। হিটলার বলতেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এই প্রোপাগান্ডাই ছিল ব্রিটিশদের জয়ের কারণ। অতএব, ‘মেইন ক্যাম্ফ-এর লেখক যে ক্ষমতায় এসেই তৈরি করবেন এমন এক দফতর, যার নাম হবে ‘মিনিস্ট্রি অব পাবলিক এনলাইটেনমেন্ট অ্যান্ড প্রোপাগান্ডা’, তাতে আর বিস্ময়ের কী আছে? খুব স্বাভাবিকভাবেই এরপর হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ডিগ্রিধারী জোসেফ গোয়েবলসকে প্রচার মন্ত্রী হিসেবে তিনি নিয়োগ করেন।

 

 

এক জার্মান ‘লিটল ডক্টর’-কে নিয়ে আজ কথা বলতে হচ্ছে কারণ, আজকের ভারত গোয়েবলসকে না দেখলেও অমিত মালব্যকে দেখেছে। 

 

2014 সালে জনাদেশ নিয়ে ক্ষমতায় আসেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার। উন্নয়নের যে সকল গালভরা প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই দেশের মগজধোলাই করেছিলেন মোদীজি, তাঁর সবকটিই পালনে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। কিন্তু ক্ষমতালোভীর ছলের অভাব হয় না। বিজেপির প্রোপাগান্ডার ন্যারেটিভ দ্বিমুখী- একদিকে নিরন্তর ঢাক পেটানো এবং অনর্থক কৃতিত্ব নেওয়ার চেষ্টা, অপরদিকে যে কোনও বিরোধী স্বরকে স্তব্ধ করতে নখদন্ত বের করে নির্লজ্জ আক্রমণ।

 

ফ্যাসিস্ট শক্তির লক্ষণ হল বিরোধী স্বরের কণ্ঠরোধ করা। প্রয়োজনে কুৎসা ও অপপ্রচার করে, জনমত ঘুরিয়ে দিতে পিছপা হয় না।

 

 

বিজেপি একদিকে যেমন দেশভক্ত বনাম দেশদ্রোহী এই ন্যারেটিভটা ভারতবর্ষের আমজনতার মধ্যে সফলভাবে কাজ করিয়েছে, অপরদিকে এই ন্যারেটিভের উপর ভর করেই যে কোনও বিরোধী স্বরকে দেশদ্রোহী বলে দেগে দেওয়ার ঘুঁটি সাজিয়েছে। ‘রাষ্ট্র’ এবং ‘দেশ’-এর ফারাক বুঝে উঠতে ভারতবর্ষের আমজনতার ঢের দেরি, এবং তারই সুযোগ নিয়ে ফায়দা লোটে এই ধরনের ফ্যাসিস্ট শক্তি। সরকারের বিরোধিতা অর্থে কিন্তু ‘রাষ্ট্র’ নামক একটা রাজনৈতিক ধারণার বিরোধিতা, তার সঙ্গে ‘দেশ’ নামক একটা ভৌগলিক অবস্থানের খুব সুদৃঢ় কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমাদের দেশে বিশেষত বিজেপি পরিচালিত একনায়কতন্ত্রের জমানায় দেশ এবং রাষ্ট্র এই দুইকে ছাপিয়ে উঠে এসেছে একটি মুখ যার নাম– নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। ফলত মোদী বিরোধিতা অর্থেই রাষ্ট্রবিরোধী এবং তার মানেই দেশবিরোধী, এই অতিসরলীকরণের দিকে আমাদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। যে কারণে মোদী সরকার বিরোধী যে কোনও আন্দোলন, যে কোনও ব্যক্তিকে আমরা সরাসরি দেশের শত্রু ভেবে বসছি।

 

 

আমরা বিশেষ করে কথা বলব কেন্দ্রীয় সরকারের অগণতান্ত্রিক কৃষি বিলের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা কৃষক আন্দোলন এবং তাকে অপদস্থ করতে বিজেপির ভুয়ো প্রোপাগান্ডা কীভাবে উঠে পড়ে লেগেছে।

 

 

 

2020 সালের 7 ডিসেম্বর অল্ট নিউজ একটি টুইট করে জানায় যে, 2013 সালে লন্ডনে ঘটে যাওয়া একটি প্রতিবাদের ছবি ও ভিডিও দিল্লির বুকে চলতে থাকা আন্দোলনের ছবি বলে চালানো হচ্ছে। ছবিতে দেখা যায় জাতীয় পতাকার উপর জুতো পরে দাঁড়িয়ে এক ব্যক্তি। স্বভাবতই প্রতিবাদের এহেন ধরনে ক্ষুব্ধ হন দেশবাসী। কিন্তু পরবর্তীতে অল্ট নিউজের করা খবরে জানা যায়, অত্যন্ত সুচারুভাবে এই সাত বছরের পুরনো ছবিকে কাজে লাগানো হয়েছে কৃষক আন্দোলনের বিরুদ্ধে।

 

 

(https://twitter.com/RashmiBhadoriy2/status/1335272323713122304?ref_src=twsrc%5Etfw%7Ctwcamp%5Etweetembed%7Ctwterm%5E1335272323713122304%7Ctwgr%5E%7Ctwcon%5Es1_c10&ref_url=https%3A%2F%2Fwww.altnews.in%2F2013-image-from-londan-shared-as-khalistani-supporters-disrespect-indian-flag-during-farmer-protest%2F)

 

 

28 নভেম্বর 2020- দিল্লি বিজেপি যুব মোর্চার সভাপতি অভিমন্যু ত্যাগী একটি ছবি শেয়ার করেন। ছবিতে দেখা যায় একদিকে এক মুসলমান ব্যক্তি নাজ মুহম্মদ, অপরদিকে তারই পাগড়ি পরিহিত আর একটি ছবি। অভিমন্যু লেখেন-

 

"This is how sponsored protest works. Nazeer Muhammad turns into Navdeep Mohanpuria."

 

 

(https://twitter.com/Abhiemanyu/status/1332393864271777793?ref_src=twsrc%5Etfw%7Ctwcamp%5Etweetembed%7Ctwterm%5E1332393864271777793%7Ctwgr%5E%7Ctwcon%5Es1_c10&ref_url=https%3A%2F%2Fwww.altnews.in%2Fphoto-predating-farmer-protests-viral-as-muslim-man-disguised-as-sikh-farmer-during-protests%2F)

 

 

 

একইভাবে ঘটনার সত্যানুসন্ধানে নেমে অল্ট নিউজ জানতে পারে এই ছবিটি নাজ মুহম্মদ ফেসবুকে দেন 2020 সালের 8 এপ্রিল। কেন্দ্রীয় সরকার কৃষি বিল নিয়ে আসে জুন মাসে এবং সেপ্টেম্বর মাসে এই বিল আইনে পরিণত হয়। কৃষক আন্দোলন শুরু হয়েছে সেপ্টেম্বর থেকেই। কাজেই এ কথা স্পষ্ট যে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে নাজ মুহাম্মদের একটি পুরনো ছবি ছড়িয়ে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে বিজেপি।

 

 

26 জানুয়ারি 2021, প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন বিজেপির তরফ থেকে দাবি করা হয় কৃষক আন্দোলনের নামে লালকেল্লায় তাণ্ডব চালিয়েছে উন্মত্ত জনতা, এমনকি টেনে হিঁচড়ে নাকি নামিয়ে দেওয়া হয় জাতীয় পতাকা আর তার জায়গায় তোলা হয় খলিস্তানি পতাকা।

 

 

(https://twitter.com/ANI/status/1353984535084470272?ref_src=twsrc%5Etfw%7Ctwcamp%5Etweetembed%7Ctwterm%5E1353984535084470272%7Ctwgr%5E%7Ctwcon%5Es1_c10&ref_url=https%3A%2F%2Fwww.altnews.in%2Ffarmers-protest-no-protestors-did-not-replace-tricolour-with-khalistan-flag-at-red-fort%2F)

 

 

এএনআই এবং দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সহ একাধিক সংবাদমাধ্যমের ভিডিওতে দেখা যায়, লালকেল্লায় স্বমহিমায় উড়ছে জাতীয় পতাকা। লালকেল্লায় লাহোর গেটে একটি খালি স্তম্ভে উত্তোলিত হয় একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পতাকা। বিজেপির দাবি পতাকাটি খলিস্তানি সংগঠনের পতাকা। কিন্তু পরবর্তীতে জানা যায়, দুইটি তলোয়ার চিত্রিত ত্রিভুজাকৃতি পতাকা আদতেই খলিস্তানি পতাকা নয়, বরং তা পবিত্র শিখ ধর্মীয় প্রতীক ‘নিশান সাহিব’।

 

 

(https://twitter.com/IndianExpress/status/1353990450432987136?ref_src=twsrc%5Etfw%7Ctwcamp%5Etweetembed%7Ctwterm%5E1353990450432987136%7Ctwgr%5E%7Ctwcon%5Es1_c10&ref_url=https%3A%2F%2Fwww.altnews.in%2Ffarmers-protest-no-protestors-did-not-replace-tricolour-with-khalistan-flag-at-red-fort%2F)

 

 

 

সত্যের অপলাপ এবং তাকে বিকৃত করে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার যে শৈলী, তাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে বিজেপি। নিজেদের ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে যে কোনও ধরনের মিথ্যাকে সত্যি বলে চালিয়ে দিতে পারদর্শী বিজেপির এই আইটি সেল। কিন্তু, যে অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন তারা দেখছেন, তার ভিত্তিই যদি হয় মিথ্যা, তাহলে সে স্বপ্ন কতদিন টিকবে সেটাই দেখার এখন।



New
মাদক ব্যবসা ও বিভাজনের রাজনীতির আবর্তে আজকের মণিপুর
ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে রাষ্ট্রীয় মদত? বিস্ফোরক রিপোর্ট অসম রাইফেলসের
বিরোধী জোট আছে, রাজনীতি কই?


Other Writings by -সৌম্যদীপ্ত রায়চৌধুরী | 04-03-2021
চাকরি গেলেও লড়াই জারি সৃষ্টির
চাকরি গেলেও লড়াই জারি সৃষ্টির

ইদানিং সোশ্যাল মিডিয়ার নয়া ট্রেন্ড "অনলাইন খাপ পঞ্চায়েত'। বিরুদ্ধ স্বরে কথা বললেই আপনা…


4thPillar

Support 4thPillarWeThePeople

Admin Login Donate
আমাদের কথা

আমরা প্রশ্ন করি সকলকে। আমরা বহুত্ববাদী, স্বাধীন, যুক্তিবাদী। আমরা সংশয়বাদী; তর্কশীল; আবার সহিষ্ণুও বটে। আসুন কথা হোক; পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান, বিশ্বাস রেখে আলোচনা হোক। মননের ইতিহাসে শেষ কথা বলার স্পর্ধা কারও যেন না হয়; আবার কোনও স্বরই যেন অকিঞ্চিৎকর বলে উপেক্ষিতও না হয়। এই রকম ভাবনার একটা ইন্টারনেট-ভিত্তিক বিশ্বব্যাপী কমিউনিটি গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য।

© 2023 4thPillarWeThepeople. All rights reserved & Developed By - 4thPillar LeadsToCompany
// Event for pushed the video