4thPillar


জীবন থেকে মৃত্যু সর্বত্র কলস

সোহেইল হাশমি | 18-07-2022April 14, 2023
জীবন থেকে মৃত্যু সর্বত্র কলস

মাটির কলসকে সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে দেখতে হবে যখন কুমোরের চাকায় তৈরি মৃৎপাত্র বা পটারি প্রথম দেখা দেয়। চাকা বস্তুটি কিন্তু প্রথমে মৃৎপাত্র তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল, পরে এটি পরিবহনে ব্যবহারের জন্য অভিযোজিত হয়েছিল। পৃথিবীতে পাওয়া প্রাচীনতম চাকাটি মেসোপটেমিয়ার, এবং এটি 3500 খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ বা আমাদের সময়ের 5700 বছর আগেকার একটি কুমোরের চাকা।

এর থেকে আমরা এই উপসংহারে উপনীত হই যে ঘোড়ার গাড়ি বা রথ নিয়ে যুদ্ধ এই সময়ের আগে সম্ভব ছিল না। কিন্তু যুদ্ধ আমাদের এখানে আলোচ্য বিষয় নয়। আমরা এখানে কথা বলব, আমরা খুব সাধারণ একটা জিনিস, মাটির কলস নিয়ে। কুমোরের চাকায় তৈরি, রোদে শুকানো, আগুনে পোড়ানো কলস, যা জল, শস্য এবং অন্যান্য সমস্ত ধরনের জিনিস সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়। ধর্মীয় আচারেও লাগে।

সুমেরীয়, মিশরীয়, চিনা, রোমান, গ্রিক এবং আমাদের নিজস্ব প্রাচীন সভ্যতায় ঘূর্ণায়মান চাকায় তৈরি এই সমস্ত হাঁড়ি, কলসি, কলস, অবং অন্যান্য মৃৎপাত্র নিয়ে অজস্র পৌরাণিক কাহিনি আছে।  জল ধরে রাখার জন্য ব্যবহৃত কলস তৈরি করা ছিল সভ্যতার দিক থেকে একটা যুগান্তকারী ঘটনা। কলস মানবজাতিকে নদীর বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি দিয়েছে। কলস বা অনুরূপ জলের পাত্র আবিষ্কারের আগে মানুষকে তৃষ্ণার্ত হলেই জলাশয়ের সন্ধানে যেতে হত। কলস জলকে তাদের নাগালের মধ্যে এনে দিল। খুব শীঘ্রই কলস এক বিশেষ আইকনিক মর্যাদা অর্জন করল - যা জীবনকে টিকিয়ে রাখে।


জীবন থেকে মৃত্যু সর্বত্র কলস

এই সময়ের মধ্যে মানুষ তার অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছিল যে তারা আগে যে ঘাসের বীজগুলি বন থেকে সংগ্রহ করেছিল এবং এখন চাষ করতে এবং খেতে শিখেছিল ( যেমন বার্লি, বাজরা,  রাগি এবং অন্যান্য) তাদের একটি নির্দিষ্ট জীবন চক্র। তাই পরবর্তী মরসুমের জন্য বীজ বপনের জন্য শস্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। এই কাজেও কলস বা কলসির ব্যবহার শুরু হল।

প্রচুর পরিমাণে শস্য মজুত করার প্রয়োজনের ফলে একদিকে বড় স্টোরেজ বিনের সৃষ্টি হয়েছিল, যা আমরা হরপ্পা এবং অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতায় দেখতে পাই। অন্যদিকে ঢাকনা সহ ছোট কলস বীজ সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হতে থাকে। কলস এখন আর শুধু তৃষ্ণা নিবারণের পাত্রই নয়, সে একই সঙ্গে বেঁচে তাকার জন্য অন্ন জোগানোরও মাধ্যম। ফলে বীজ সঞ্চয় করার জন্য ব্যবহৃত ছোট কলসটি খুব শীঘ্রই অনেক প্রাচীন আচার-অনুষ্ঠানের কেন্দ্রে পরিণত হল, কারণ এটিকে খাদ্যের উৎস হিসেবে দেখা শুরু হল। যেহেতু কলসিতে বীজ থাকত এবং তা থেকেই জীবনের চক্র শুরু হয়, তাই এটিকে মায়ের গর্ভের সমতুল্য বলে গণ্য করা শুরু হয়।  গর্ভ কলস নামে এই কলস পরিচিত হতে শুরু করে।

কলস, যা আগে থেকেই ভরণ-পোষণের প্রতীক ছিল, তা ক্রমশ প্রাচুর্য এবং সচ্ছলতার প্রতীক হয়ে ওঠে। এটা ছিল মানব সভ্যতার ঊষা লগ্ন, সেই সময় যখন মানুষ  শিকারী এবং খাদ্য আহরণকারী ছিল এবং আমরা আমাদের প্রাথমিক অ্যানিমিস্ট বিশ্বাস থেকে ক্রমশ সরে আসতে শুরু করেছিলাম। ক্রমশ এক জায়গায় থেকে চাষাবাদ শুরু হল, মানুষ জনবসতি স্থাপন করল, আর আদি গ্রাম্য জীবনের ব্যাপার স্যাপার সামলাতে গিয়ে জীবন ক্রমশ আরও জটিল হয়ে উঠল। বহু নতুন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হল মানুষকে।

এর আগে পদ্মের বিষয় বলতে গিয়ে আমরা যে সময়ের কথা বলেছি তখন সরল অ্যানিমিজম বা সর্বপ্রাণবাদই আমাদের আধ্যাত্মিক কৌতূহল পূরণের জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে জীবন আরও জটিল হয়েছে, আরও বহু নতুন বিষয়ে মানুষের মনে কৌতূহল জাগ্রত হয়েছে। যার মধ্যে প্রথম দুটে হল জন্ম এবং মৃত্যু।

আধুনিক মানুষ হোমো স্যাপিয়েন্স অন্য সব প্রাণীর মতোই যৌন মিলন করেছে যখন দরকার মনে করেছে। সর্বশেষ ডিএনএ গবেষণা থেকে এটাও জানা যায় যে আমাদের পূর্ব পুরুষরা নিয়ানডারথাল মানবের সঙ্গেও সঙ্গম করেছে, যার জন্য সেই নিয়ানডারথাল মানবের কিছু ডিএনএ আমাদের মধ্যে রয়ে গিয়েছে। আমরা যে সময়ের কথা বলছি তখনও পরিবার বল কোনও কিছুর ধারণা মানুষের মধ্যে আসেনি। মানুষ দলবদ্ধভাবে জীবন যাপন করত, সঙ্গম করত, আবার যে যার মতো চলত। একটি শিশু জন্মালে তাতে সকলে উল্লসিত হত, আনন্দিত হত, আর ভাবত, এই সুন্দর বাচ্চাটা কোথা থেকে এল? এখান থেকেই এল জন্মের দেবতা বা উর্বরতার দেবতার ধারণা। এই ধরনের দেবতার ধারণা সমস্ত সভ্যতাতেই রয়েছে।


জীবন থেকে মৃত্যু সর্বত্র কলস

র্বরতার দেবতাকে প্রসন্ন করে প্রচুর শস্য, গবাদি পশু এবং সন্তান পাওয়ার জন্য সমস্ত প্রাচীন সভ্যতাতেই তার নিজস্ব এবং বিস্তারিত আচার অনুষ্ঠান রয়েছে। আর এর সঙ্গে সমান্তরালভাবে চলে এসেছে আর একটি গভীর এবং মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে মানুষের ভাবনা: মৃত্যু। সমস্থ সভ্যতাতেই জন্মের দেবতার মতো মৃত্যুরও দেবতা আছে।

জীবন ও মৃত্যু উভয় সম্পর্কেই মানুষের আচার বিধি তৈরি হল। জীবনের দেবতার কাছে প্রার্থনা: আরও দাও। মৃত্যুর দেবতার কাছে প্রার্থনা: কেড়ে নিয়ো না। জীবন আর মৃত্যুর মাঝের বিভিন্ন পর্বের জন্যও তৈরি হল আলাদা আলাদা আচার বিধি। এ সমস্ত কিছুর মধ্যেই ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবহার করা হত কলস। কলস এতটাই একেবারে এ সবের কেন্দ্রীয় একটা উপাদান হয়ে উঠেছিল যে মন্দিরের গায়ে তা উৎকীর্ণ করা শুরু হল।

শুরুতে মাদের অধিকাংশ মন্দিরই ছিল জন্মের দেব বা দেবীর। গ্রামের নিজস্ব মাতৃরূপিণী দেবীর যে মন্দির সেটা ছিল বিশেষ অগ্রগণ্য। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ফসল কাটার সময়কার বাৎসরিক উৎসবের সময়ে সেই দেবি অন্য সব দেব-দেবীর উপরে প্রাধান্য পেতেন। তিনি ছিলেন জীবনের রক্ষয়িত্রী, অশুভ শক্তির বিতারণকারিণী।

আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে কলস বা ঘট দেখা যায়। একটার উপরে একটা সাজানো থাকে, সবচেয়ে উপরেরটায় থাকে আম্রপল্লব আর নারকোল। নারকোল নিজেই একটা বীজ, আবার গর্ভের প্রতীকও বটে।

কলস কিন্ত মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত নানা ধরনের আচারেও ব্যবহৃত হতে থাকে। মৃত ব্যক্তিকে আগের মতো এখনও একটা নুষ্ঠানিক স্নান করানোর প্রক্রিয়া থাকে। কোনও কোনও সমাজে এটার জন্য একেবারে নতুন ব্যবহার না করা কলসি লাগে। একটি জলভরা কলসে ফুটো করা থাকে, সেটি নিয়ে মৃত্রি কোনও আত্মীয় (সাধারণত পুত্র) মৃতদেহকে প্রদক্ষিণ করে আর কলস থেকে জল বেরিয়ে যেতে থাকে। সেটি শূন্য হয়ে গেলে মাঠিতে আছড়ে ভেঙে ফেলা হয়। বেরিয়ে যাওয়া জল জীবনের আর শূন্য হয়ে যাওয়া মৃত্যুর প্রতীক। মৃতদেহ সৎকারের পরে আবার কিন্তু ওই ঘট বা কলসে করেই ভস্ম নিয়ে যাওয়া হয় নদীতে বিসর্জনের জন্য।

ঘট বা কলস তাই জীবন থেকে মৃত্যু – সদাই অবিচ্ছেদ্য, এবং সেই কারণেই পবিত্র বা উপাসনার জয়গায় সর্বত্রই তার উপস্থিতি। খাইবার পাস পেরিয়ে পঞ্চনদের দেশে যখন বাইরের থেকে মানুষ এল তখন এখানে কলসের এই কাহিনি সুপ্রতিষ্ঠিত।

পরে অবশ্য কলস আর পদ্মের নতুন অবতারও দেখা দেবে।

 

#Islamic_architecture #Indian_architecture #Kalas


New
বিদায় পিটি নায়ার: কলকাতার ইতিহাসবেত্তা
বিদায় পিটি নায়ার: কলকাতার ইতিহাসবেত্তা
এগজিট পোল মিলে গেলেও যে প্রশ্ন উঠবেই
এগজিট পোল মিলে গেলেও যে প্রশ্ন উঠবেই
কংগ্রেস সেঞ্চুরি না করলে কে রুখবে বিজেপিকে?
কংগ্রেস সেঞ্চুরি না করলে কে রুখবে বিজেপিকে?


Other Writings by -সোহেইল হাশমি | 18-07-2022

// Event for pushed the video