মোদ্দা কথা: এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে দেশের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীরা কী কী শর্তে লকডাউন তুলে নেওয়া যাবে সে ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার সেই পরামর্শ উপেক্ষা করে নিজের মতো নিয়মাবলী প্রণয়ন করে, যা রাজ্যগুলির কাছে আজও অস্পষ্ট। যার ফলে লকডাউনের শুরু থেকে 11 মে পর্যন্ত 10,841 শতাংশ সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সরকারকেও বারবার তার নির্দেশিকায় বদল আনতে হচ্ছে।
মহারাষ্ট্রের প্রত্যেকটি জেলায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে করোনার উপসর্গ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। করোনা আক্রান্ত এবং সম্ভাব্য আক্রান্তদের পৃথক করে কোয়ারান্টাইনে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে তাঁদের পরীক্ষার ফলাফল আসা অবধি অপেক্ষা করা যাবে না। 14 দিনের পর যদি এই রকম প্রত্যক্ষ নজরদারি চালিয়ে সম্ভাব্য আক্রান্তদের কোয়ারান্টাইন করা সম্ভব হয় তাহলে সংক্রামিত রোগীর সংখ্যা 40 শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো এই মহামারীর মোকাবিলা করতে অনেকটা সক্ষম হবে। একমাত্র সেক্ষেত্রেই লকডাউন শিথিল করা সম্ভব।
Indian Council of Medical Research (ICMR) সরকারকে উপরোক্ত পরামর্শ দিয়েছিল এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে। ICMR এই ব্যাপারে সরকারের কাছে যে ভবিষ্যৎ রূপরেখা তুলে ধরে Article14 তার পর্যালোচনা করেছে। তাতে বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন লকডাউনকে শিথিল করার কয়েকটি নির্দিষ্ট প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, ‘প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ এবং নজরদারি ছাড়া সংক্রমণ বৃদ্ধি পাবে এবং প্রত্যক্ষ নজরদারির দ্বারাই এর মোকাবিলা সম্ভব। স্থানীয় স্তরে নজরদারি এবং তথ্য সংগ্রহ ছাড়া কোনওভাবেই লকডাউনকে শিথিল করা যাবে না।’
লকডাউনের পর ছ’সপ্তাহ অতিক্রান্ত। দু'বার লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ লকডাউনের বয়স প্রায় 52 দিন হতে চললেও বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরীক্ষা করার কোনও পরিকাঠামো সরকার এখনও গড়ে তুলতে পারেনি। পাশাপাশি লকডাউনকে শিথিল করার উদ্দেশ্যে ICMR যে ‘decision-making tree’-এর পরামর্শ দিয়েছিল সেটাও সরকার মানেনি।
যেভাবে ধাপে ধাপে পরীক্ষা করে লকডাউন শিথিল করার বিধান দিয়েছিল আই সি এম আর
উপরন্তু, সরকার করোনা মোকাবিলায় এমন কিছু মানদণ্ড নির্ণয় করল যার অধিকাংশই অস্বচ্ছ। ফলে রাজ্য সরকারগুলির কাছে কেন্দ্রের এই নির্দেশিকা স্পষ্ট হল না। কিন্তু এক্ষেত্রে দেশের 700টি জেলায় লকডাউনের গুরুত্ব বুঝতে হলে এবং লকডাউন শিথিল করতে হলে এই বিষয়গুলি স্পষ্ট হওয়া উচিত ছিল। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ওয়াকিবহালের পরামর্শ অগ্রাহ্য করার জন্যই দেশে সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
24 মার্চ, দেশে যখন লকডাউন শুরু হয় তখন সারা দেশে 618 জন করোনা আক্রান্তের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। 11 মে-তে এসে দেখা গেল এই সংখ্যাটাই 67,000-এ গিয়ে পৌঁছেছে। অর্থাৎ সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে 100 গুণেরও বেশি। 7 মে দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই, আহমেদাবাদ সহ দেশের 15 টি বৃহৎ শহরে প্রায় 60 শতাংশ করোনা আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এই শহরগুলিতেও কঠোরভাবে লকডাউন পালিত হচ্ছিল। তবুও সংক্রমণের বৃদ্ধিহার কমানো যায়নি। লকডাউন শুরুর সময় মুম্বইয়ে করোনা সংক্রমণের 67 টি ঘটনার কথা জানা গিয়েছিল। 11 মে এই সংখ্যাটাই পৌঁছল 13,000-এ। অর্থাৎ সংক্রমণের বৃদ্ধিহার 19,303 শতাংশ। একইভাবে দিল্লির 35 টি করোনা সংক্রমণের ঘটনা 11 মে-তে 7,233 টি ঘটনায় পরিণত হয়। এক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার 20,565 শতাংশ। 25 মার্চ আহমেদাবাদে সংক্রামিত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল 14। 11 মে তা বেড়ে হল 5,818 টি। বৃদ্ধির হার 41,457 শতাংশ।
মহারাষ্ট্র সরকারের আধিকারিকরা দেরিতে হলেও বুঝলেন রাজ্যের কিছু অংশে গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়েছে। ওড়িশায় মাত্র এক সপ্তাহে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হল। গত 24 এপ্রিল কেন্দ্রীয় সরকার অনুমান করেছিল 16 মে-এর পর দেশে আর একটিও করোনা সংক্রমণের ঘটনা থাকবে না। বাস্তবে তাদের সেই অনুমান ভয়ঙ্করভাবে ভুল প্রমাণিত হতে চলেছে।
গত 30 এপ্রিল কেন্দ্রের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক, তাদের নির্দেশিকায় জানায় লকডাউনকে শিথিল করার জন্য দেশের জেলাগুলিকে লাল, কমলা এবং সবুজ এই তিনটি জোনে বিভক্ত করা হবে। এক্ষেত্রে সেই জেলায় সংক্রমণের সংখ্যা, সংক্রমণের হার দ্বিগুণ হওয়ার সময়পর্ব, পরীক্ষার সংখ্যাবৃদ্ধি এবং নজরদারির তথ্য – এই চারটি মানদণ্ডের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন জোনে বিভক্ত করা হবে। রেড জোনের অন্তর্ভুক্ত জায়গাগুলিতে কঠোরভাবে লকডাউন অনুসৃত হলেও, গ্রিন জোনের অন্তর্গত জায়গাগুলিতে বিধিনিষেধ যথাসম্ভব কমিয়ে আনা হবে।
গত 24 এপ্রিল কেন্দ্রীয় সরকার অনুমান করেছিল 16 মে-এর পর দেশে আর একটিও করোনা সংক্রমণের ঘটনা থাকবে না। বাস্তবে তাদের সেই অনুমান ভয়ঙ্করভাবে ভুল প্রমাণিত হতে চলেছে। |
সরকারের 30 এপ্রিলের নির্দেশিকায় রাজ্যসরকারগুলিকে লকডাউন শিথিল করার জন্য যে চারটি মানদণ্ডের কথা বলা হয় রাজ্যগুলির কাছে তা সুস্পষ্ট হয়নি। স্বাস্থ্যমন্ত্রকের বিজ্ঞপ্তিতে শুধু এইটুকুই বলা হয়েছিল ‘স্থানীয় স্তরের খবর এবং অন্যান্য তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে রাজ্যগুলি প্রয়োজন মত রেড এবং অরেঞ্জ জোনকে তাদের মত করে বিন্যস্ত করতে পারে। যদিও স্বাস্থ্যমন্ত্রক দেশের জেলাগুলিকে যেভাবে কয়েকটি জোনে বিভক্ত করেছে সেই বিন্যাসকে রাজ্য সরকার বদলাতে পারবে না।’
এই বিজ্ঞপ্তি আসার একদিন পর অর্থাৎ পয়লা মে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধি করে। আগের নির্দেশিকায় কিছু পরিবর্তন করে তারা জানায় ‘দেশের রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলি রেড জোন এবং অরেঞ্জ জোন হিসেবে নির্দিষ্ট হলে সেখানে লকডাউন শিথিল করার কিংবা জোন পরিবর্তন করার কোনও সিদ্ধান্ত রাজ্য সরকারগুলি নিতে পারবে না।’ এখানেও সিদ্ধান্তটি কীভাবে গ্রহণ করা হবে সেই বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি।
কে শোনে বিজ্ঞানীদের কথা?
23 এপ্রিল Article14-এর প্রাথমিক অনুসন্ধানে ICMR-এর একটি রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসে। সেই রিপোর্টে ICMR এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সরকারকে সতর্ক করে জানায় বৃহৎ মাত্রায় গোষ্ঠী সংক্রমণ দেশে মাথা চাড়া দিতে পারে। সেক্ষেত্রে করোনার এই বাড়বৃদ্ধিকে রোখার একমাত্র উপায় লকডাউনের পথে গিয়ে দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে এই সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত করা। ICMR বিজ্ঞানসম্মত উপদেশ দেয় যে, বাড়ি বাড়ি ঘুরে নজরদারি এবং প্রত্যেকটি এলাকায় নজরদারি চালিয়ে সম্ভাব্য করোনা আক্রান্তদের চিহ্নিত করে কোয়ারান্টাইনে পাঠানো দরকার। তা না হলে লকডাউনের সুফল হবে সাময়িক। ICMR-এর বিজ্ঞানীদের এই পরামর্শ সরকার অবজ্ঞা করে।
বিজ্ঞানীরা ফেব্রুয়ারী মাসের গোড়াতেই দেশে চিনের মতো লকডাউন করার সিদ্ধান্তে অখুশি হয়েছিলেন এবং এই বিষয়ে সরকারকে সতর্কও করেছিলেন। এই ধরনের লকডাউনে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মানুষের শারীরিক ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। বিজ্ঞানীরা অন্তত তেমন মতই ব্যক্ত করেছিলেন। এইরকম লকডাউনের পরিবর্তে সরকারের কাছে বিজ্ঞানীদের পরামর্শ ছিল, এই মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সরকার যেন স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে প্রস্তুত রাখে। পাশাপাশি বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে নজরদারি এবং কোয়ারান্টাইনের পরিকাঠামো উন্নত করার দিকে যাতে সরকার সতর্ক দৃষ্টি রাখে সেই বিষয়েও পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।
অথচ এই সতর্কবার্তাগুলিকে উপেক্ষা করে একটি অপ্রস্তুত, অবৈজ্ঞানিকভাবে চলা সরকার 24 মার্চ, মাত্র 4 ঘণ্টার নোটিসে সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা করে দিল। সরকারের এই হঠকারী সিদ্ধান্তে দরিদ্র এবং পরিযায়ী মানুষদের মধ্যে খাদ্য এবং জীবনধারণের সঙ্কট তৈরি হল।
বিজ্ঞানীদের উপদেশ অগ্রাহ্য করে লকডাউনের সিদ্ধান্ত কার্যকর করার পরেও ICMR-এর বিজ্ঞানীরা কিছু বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন। গোষ্ঠী সংক্রমণ রোখার জন্য এই ব্যবস্থাগুলি অত্যন্ত দরকারি হলেও একাংশের অভিমত দেশে ইতিমধ্যেই গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়ে গিয়েছে। তাই এই লকডাউন থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তাঁরা একটি ‘decision-making tree’-এর পরামর্শ সরকারকে দিয়েছিলেন। সরকার তাও রূপায়ণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
Public Health Foundation of India-এর সভাপতি এবং COVID-19-এর মোকাবিলায় গঠিত ন্যাশনাল টাস্ক ফোর্সের সদস্য কে শ্রীনাথ রেড্ডির বক্তব্য “যদি কোনও বিশেষ চিকিৎসার ব্যবস্থা নাও করা যায় তবে সম্ভাব্য রোগীদের খুঁজে বের করা এবং তাঁদের আইসোলেট করা করোনা চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। ঠিক এই কারণেই সমগ্র একটি এলাকায় নজরদারি চালানো প্রয়োজন।”
বৈজ্ঞানিক পরামর্শ উপেক্ষা
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ICMR-এর ‘decision making tree’ যখন সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছিল তখন নীতি আয়োগের সদস্য বিনোদ কে পাল বলেছিলেন সমস্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে সরকারের আরও এক সপ্তাহ সময় লাগবে। অর্থাৎ বিজ্ঞানীদের পরামর্শ মতো বাড়ি বাড়ি গিয়ে নজরদারি এবং কোয়ারান্টাইন কেন্দ্র স্থাপনের মত পরিকাঠামো তখনও সরকারের কাছে ছিল না। এই সময়ে সরকার জনসমক্ষে দাবি করে গেছে যে মহামারী নিয়ন্ত্রণে আনা গেছে। কিন্তু সরকারের অভ্যন্তরে অনেকেই বুঝেছিলেন পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে চলেছে।
14 এপ্রিল ICMR অধিকর্তা ভার্গব রাজ্য সরকারগুলিকে একটি নোট পাঠান। সেই নোটে বলা হয়, দেশে COVID আক্রান্তের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওই একই দিনে কেন্দ্রীয় সরকার প্রথমবারের জন্য জেলাগুলিকে রেড, অরেঞ্জ এবং গ্রিন জোনে বিভক্ত করেছিল। তবে এই ক্ষেত্রে পূর্বের চারটি মানদণ্ডের বদলে একটি মানদণ্ডকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। যে সমস্ত জেলাগুলিতে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা চারদিনের কম ব্যবধানে দ্বিগুণ সংখ্যক হয়েছিল, সেই জেলাগুলিকে রেড জোনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। যেসমস্ত এলাকায় একটানা 28 দিন কোনও করোনা আক্রান্তের সন্ধান পাওয়া যায়নি সেই সমস্ত এলাকাগুলিকে গ্রিন জোনে এবং বৃহত্তর এলাকাটিকে অরেঞ্জ জোনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যদি কোনও রেড জোনে পূর্ববর্তী 14 দিনে নতুন করে কোনও সংক্রমণের খবর পাওয়া না যায় সেক্ষেত্রে সেটিকে অরেঞ্জ জোনের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। একইভাবে অরেঞ্জ জোনে তার আগের 14 দিনে যদি কোনও সংক্রামিত ব্যক্তির সন্ধান না পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে সেই এলাকাটিকে গ্রিন জোন বলা হবে।
করোনা মোকাবিলায় সরকারের তৈরি টাস্ক ফোর্সের জনৈক সদস্যের বক্তব্য, ‘এই সময়ে বহু জেলা দাবি করছে তাদের ওখানে সংক্রমণের কোনও খবর নেই। কিন্তু তারা এটা বলতে পারে না কেননা তারা যথেষ্ট পরিমাণে নজরদারি এবং পরীক্ষার ব্যবস্থা করছে না। তাই তাদের দাবি থেকে এটা ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই যে ওইসব জেলাগুলিতে করোনায় আক্রান্ত কোনও ব্যক্তি নেই।’ উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে 23 এপ্রিল ত্রিপুরায় দুজন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির রিপোর্ট নেগেটিভ আসার পর সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব, ত্রিপুরাকে করোনামুক্ত রাজ্য বলে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু ত্রিপুরা প্রশাসন BSF জওয়ানদের করোনা পরীক্ষা শুরু করার পর থেকেই মাত্র দুই সপ্তাহে সংক্রামিত ব্যক্তির সংখ্যা 62-তে পৌঁছায়। 10 মে-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ত্রিপুরায় 100 টি পজিটিভ কেসের খবর মিলেছে।
15 এপ্রিল থেকে 1 মে-এর মধ্যে সরকার যখন প্রথমবারের জন্য লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধি করেছিল, সরকার তখনও বাড়ি বাড়ি গিয়ে নজরদারি এবং করোনার উপসর্গ থাকা ব্যক্তিদের কোয়ারান্টাইনে পাঠানোর পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারেনি। অথচ ICMR ফেব্রুয়ারী মাসে এবং আরও একবার এপ্রিল মাসের গোড়ায় এই ব্যাপারে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিল। 17 এপ্রিলের পর থেকে শুধুমাত্র দেশের সেই সব জায়গাতেই টেস্টের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছিল যেখানে অধিক মাত্রায় সংক্রমণ দেখা দিয়েছিল।
রেড্ডি জানাচ্ছেন, ‘অন্ধ্রপ্রদেশ এবং কেরালার ওয়ার্ড এবং গ্রাম স্বেচ্ছাসেবকরা প্রতি সপ্তাহে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের কোনও উপসর্গ দেখা দিয়েছে কিনা তার খোঁজখবর নিয়েছেন। এমনকী লকডাউনের সময়েও এই কাজে কোনও ছেদ পড়েনি।’ রেড্ডির আরও বক্তব্য, ‘এই কাজের জন্য কোনও ডাক্তারের প্রয়োজন নেই। স্বেচ্ছাসেবক এবং আশা কর্মীরাই এই কাজটি করতে পারেন।’
দ্বিতীয় পর্বের লকডাউন যখন শেষ হওয়ার মুখে তখনও মহামারীর সংক্রমণ আগের থেকে অনেক বেশি মাত্রায় হয়ে চলেছে। 14 এপ্রিল করোনা সংক্রামিত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল 12 হাজার। 30 এপ্রিল হল 33 হাজার। 9 মে এই সংখ্যাটাই 60 হাজার হয়। প্রলম্বিত লকডাউনে অর্থনৈতিক সঙ্কটের বিষয়টিও সরকারকে ভাবিয়ে তোলে। তাই আরও একবার সরকার করোনা মোকাবিলায় তার অভিমুখ বদলায়।
সর্বশেষ নির্দেশাবলী
1 মে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের নির্দেশিকায় বলা হয় স্বাস্থ্য এবং পরিবারকল্যাণ মন্ত্রক, ভারত সরকারের নির্দেশে জেলাগুলিকে রেড জোন বা হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। এক্ষেত্রে যে চারটি মানদণ্ডের উপর নির্ভর এই মূল্যায়ণ করা হবে সেগুলি হল মোট সংক্রামিত ব্যক্তির সংখ্যা, সংক্রমণের হার দ্বিগুণ হওয়ার সময়সীমা, টেস্টের সংখ্যা এবং নজরদারি। কেন্দ্রীয় সরকারের এই নয়া নির্দেশিকায় কিংবা আলাদা কোনও নির্দেশিকায় ব্যখ্যা করা হয়নি, কেন তারা এই চারটি মানদণ্ডের ভিত্তিতে রেড জোনকে চিহ্নিত করছেন। এটাও স্পষ্ট করা হয়নি কীভাবে তারা লকডাউনকে শিথিল করবে এবং ধাপে ধাপে এর বিধি নিষেধ কমিয়ে আনবে।
একটি রাজ্যের, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পদস্থ আধিকারিক জানান, ‘আক্রান্ত ব্যক্তির হাসপাতালে চিকিৎসা এবং উপসর্গ থাকা ব্যক্তিতে কোয়ারান্টাইনে পাঠানোর সুব্যবস্থা করার জন্যই লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনও রকম স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ও ব্যবস্থাপনার বন্দোবস্ত না করে শুধুমাত্র ওই মানদণ্ডে জেলাগুলিকে কয়েকটি জোনে বিভক্ত করলেই মহামারীকে রোখা যাবে না।’ পদস্থ সেই আধিকারিক যে রাজ্যে কর্মরত সেই রাজ্য কেন্দ্রীয় সরকারকে ‘জোনিং পলিসি’-তে পরিবর্তন আনার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিল।
ওই আধিকারিকের বক্তব্য, ‘যদি একটি জেলায় একটি নির্দিষ্ট সময়ে 500 জন ব্যক্তি করোনা পজিটিভ হন এবং উল্টোদিকে মাত্র 50টি শয্যা থাকে সেক্ষেত্রে করণীয় কী হতে পারে।’ বিষয়টি স্পর্শকাতর বলে তিনি পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি আরও জানান, ‘একটি জেলায় যদি এক হাজারটি শয্যার ব্যবস্থা করা যায় তাহলে এই মহামারীর বিরুদ্ধে লড়া যায়। আর আমরা জানি প্রতিদিন সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কেউ বিধিনিষেধ শিথিল করার কথা বলতেই পারেন। কিন্তু কেন্দ্রের নির্দেশিকায় ওই মানদণ্ডগুলিকে কীভাবে কাজে লাগানো হবে সেই সম্পর্কে আমাদের কাছে কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই।’
নজরদারিই মাপকাঠি
30 এপ্রিলের সরকারি নির্দেশিকা দেখার পর বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য যে ICMR-এর পরামর্শ মতো নজরদারি চলছে কিনা তার তথ্যে অনেক বিভ্রান্তি রাখা হয়েছে। ICMR-এর পরামর্শ ছিল বাড়ি বাড়ি গিয়ে পর্যবেক্ষণ করা। কিন্তু সরকারি নির্দেশিকায় এই বিষয়টিকে যদি মহামারী মোকাবিলার অন্যতম এক মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয়েই থাকে তাহলে আংশিকভাবে হলেও কেন ICMR-এর পরামর্শ মানা হল না? সরকারের ভিতরের এবং বাইরের বহু বিশেষজ্ঞ এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
ICMR পরামর্শ দিয়েছিল বাড়ি বাড়ি গিয়ে সার্ভে করতে হবে এবং দেশের 700 টি জেলায় কোনও ব্যক্তির শরীরে COVID-19-এর উপসর্গ আছে কিনা সেটা দেখতে হবে। তারা একইসঙ্গে “sentinel surveillance” বা সামূহিক পরীক্ষার পরামর্শও দিয়েছিল, যার দ্বারা সরকার সম্ভাব্য করোনা সংক্রামিত রোগীদের হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ফিভার ক্যাম্পে নিয়ে এসে পরীক্ষা করবে। এর ফলে বিশেষ কোনও এলাকায় বড় সংক্রমণের সম্ভাবনাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। কথা ছিল, যে সমস্ত এলাকায় কোনও সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়নি সেখানে এই সামূহিক পরীক্ষার দ্বারা হাসপাতালে গেছেন এমন ব্যক্তির অ্যান্টিবডির পরীক্ষা করা হবে। কেননা এই পরীক্ষা না হলে সেই এলাকায় সংক্রমণের হার বাড়তে পারে।
কেন্দ্রীয় সরকার শুধুমাত্র কন্টেনমেন্ট জোনগুলিতেই বাড়ি বাড়ি ঘুরে সার্ভে করার নির্দেশ দিয়েছে। কন্টেনমেন্ট জোন বলা হচ্ছে সেই এলাকাগুলিকেই যেখানে অন্তত একজন করোনা পজিটিভ রোগীর সন্ধান মিলেছে। 17 এপ্রিলের নির্দেশিকা অনুযায়ী সমগ্র জেলা নয়, অ্যাক্টিভ কেস খুঁজতে এলাকাগুলিকে কয়েকটি ছোট জোনে ভাগ করে নেওয়া হয়েছে এবং বাকি এলাকা থেকে সেগুলিকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের পরামর্শ অনুযায়ী রেড জোনের বাইরে যে এলাকায় কোনও পজিটিভ কেস পাওয়া যায়নি সেটিকে ‘বাফার জোন’ এবং শহরের যে অংশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা আছে সেটিকে ‘কন্টেনমেন্ট জোন’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। 30 এপ্রিল কেন্দ্রীয় সরকার কন্টেনমেন্ট জোনের ব্যাখ্যায় একটা পরিবর্তন আনেন। সেখানে বড় আবাসন, প্রতিবেশি, রাস্তা এবং পুলিশ থানাকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ICMR টাস্ক ফোর্সের সেই সদস্য জানালেন, ‘আমার মনে হয় ICMR-এর পরামর্শ মানতে সরকার অনেক দেরি করল।’
অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরালা এবং মহারাষ্ট্রের মতো অল্প সংখ্যক কিছু রাজ্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু কেউই এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করেনি। দিল্লি সরকারের একটি সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে সেখানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নজরদারির ব্যবস্থা শুরু হয়েছে। কিন্তু ICMR-এর যে পরামর্শ, যেখানে বলা হচ্ছে উপসর্গ থাকা সকল ব্যক্তিকে কোয়ারান্টাইনে নিয়ে যেতে হবে সেখানে দিল্লিতে উপসর্গ থাকা ব্যক্তিদের বাড়িতেই করোনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। শুধুমাত্র যাদের উপসর্গ জটিল আকার নিয়েছে এবং রিপোর্টে যাদের করোনা সংক্রামিত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে শুধু তাদেরকেই কোয়ারান্টাইনে পাঠানো হচ্ছে।
এই রিপোর্টের পরবর্তী পর্বে আমরা দেখব যে, দেশের 700টি জেলায় করোনার মোকাবিলা করার মতো কোনও শক্তিশালী তথ্য আদৌ সরকারের কাছে ছিল কিনা।
রিপোর্টটি ইংরেজিতে পড়তে হলে www.Article-14.com