4thPillar


লাভ জেহাদ: বিভাজনকে আইনসিদ্ধ করা হচ্ছে এবার

সোমনাথ গুহ | 24-11-2020May 25, 2023
লাভ জেহাদ: বিভাজনকে আইনসিদ্ধ করা হচ্ছে এবার

মানব সভ্যতার ইতিহাসে ধর্ম, অর্থ, শ্রেণি কোনও কিছুর বেড়া দিয়েই প্রেমকে আটকানো যায়নি। বিপুলা ভারতবর্ষের ইতিহাসে যুগে যুগে বহু বর্ণ, ধর্ম, ভাষার মানুষের সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে আজকের এই দেশ। এমন বহুধা বিচিত্র দেশে ‘লাভ জেহাদ’ শব্দবন্ধটি একটি অক্সিমোরন বা বিরোধাভাস। ভালোবাসা মানুষের যাবতীয় অনুভূতির মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। সভ্যতার ইতিহাসে সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, নাটক, সিনেমার মতো সমস্ত সুকুমার প্রবৃত্তি আবর্তিত হয়েছে এই অনুভুতিকে ঘিরে।

 

সভ্যতার ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ চারটি মহাকাব্য, রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড ও ওডিসির ভরকেন্দ্রেও রয়েছে প্রেম। এবং অনেক সময়ই সেই প্রেম সমাজের স্বীকৃতির তোয়াক্কা না করে দু’টি মানুষের একে অপরকে চাওয়ার গল্প। আকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটিকে পাওয়ার জন্য মানুষ যন্ত্রণা পেয়েছে, পৃথিবীর শেষ প্রান্ত অবধি হেঁটেছে, ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছে, যুগ যুগ ধরে কবিতা, সঙ্গীত রচনা করেছে। প্রেমের পথ পিচ্ছিল হতে পারে জেনেও মানুষ সেই পথে পথিক হয়েছে, হোঁচট খেয়েছে, ভালোবাসার নীড় ভেঙে গেছে, কিন্তু তা মানুষকে ভালবাসতে নিরস্ত করতে পারেনি

 

কিন্তু এর সঙ্গে জেহাদের কী সম্পর্ক বোঝা দায়। জেহাদ অর্থে ধর্মযুদ্ধ, ন্যায়যুদ্ধ আবার কেউ বলে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ধর্মপ্রাণের কাছে কথাটি আধ্যাত্মিক, মন্দের বিরুদ্ধে ভালোর, অমঙ্গলের বিরুদ্ধে মঙ্গলের, অশুভের বিরুদ্ধে শুভর লড়াই। সেই যে মধ্যযুগে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে খ্রিস্টানদের ক্রুসেড হয়েছিল, সেই থেকে জনমানসে জেহাদ কথাটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে ধর্ম। আরও স্পষ্ট করে বললে ইসলাম ধর্ম। গত কয়েক দশকে ইসলামি সন্ত্রাসবাদীদের কার্যকলাপে জেহাদের মধ্যযুগীয় ইতিহাস মুছে গিয়ে তার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে ঘটমান বর্তমানের নৃশংসতা

 

আমাদের দেশে শব্দবন্ধটি 2014-15 সালের পর থেকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন দ্বারা ব্যবহৃত হতে শুরু হয়। দু’টি পরস্পরবিরোধী শব্দ জুড়ে এই বিরোধাভাস একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, বিদ্বেষমূলক চাল; এ দেশের সংখ্যালঘু, মূলত মুসলিম সম্প্রদায়কে চাপে রাখা, কোণঠাসা করা এবং দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার সুদূরপ্রসারী হিন্দুত্ববাদী পরিকল্পনার আরও একটি চতুর হাতিয়ার। সম্প্রতি বিভিন্ন রাজ্যের বিজেপি সরকার লাভ জেহাদের বিরুদ্ধে আইন আনার তোড়জোড় শুরু করেছে। 23 সেপ্টেম্বর এলাহাবাদ হাইকোর্ট একটি রায়ে বিধান দেয়, বিবাহের জন্য ধর্মান্তকরণ সমর্থনযোগ্য নয়। এই মামলাটিতে এক মুসলিম মহিলা এক হিন্দু পুরুষের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার এক মাস আগে নিজের ধর্ম পরিবর্তন করেছিলেন। তিনি ধর্মান্তরিত হন এই বছরের 29 জুন এবং বিবাহ হয় 31 জুলাই। এই ঘটনাটির রায় দিতে গিয়ে বিচারক 2014-র একটি অনুরূপ ঘটনার উল্লেখ করেন যেখানে অঞ্জলি মিশ্র নামে এক মহিলা একই ভাবে শুধুমাত্র বিয়ের জন্য নিজের ধর্ম পাল্টেছিলেন এবং সেই ক্ষেত্রেও আদালত উপরোক্ত অভিমত প্রকাশ করেছিল

 

হাইকোর্টের এই রায় কিন্তু সমাজকে পিছিয়ে দিল। 2018 সালে কেরালা হাই কোর্ট হাদিয়া জাহান এবং শাফিন জাহানের বিবাহ অবৈধ ঘোষণা করে। আদালত যুক্তি দিয়েছিল যে হাদিয়া ছিলেন হিন্দু নারী যিনি বিয়ের জন্য ধর্মান্তকরণ করেছিল। সুপ্রিম কোর্ট কিন্তু এই রায় নাকচ করে দিয়ে বলেছিল প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি নিজের ইচ্ছায় পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হলে রাষ্ট্র বা বিচারব্যবস্থা তাতে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। সংবিধানের 21 নম্বর ধারা অনুযায়ী নিজের ইচ্ছায় ও পছন্দে বিয়ে করা একটি ব্যক্তির অধিকার। বেশি দিনের কথা নয় এই গত ফেব্রুয়ারিতে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী জি কিষান রেড্ডি সংসদে ঘোষণা করেন যে আইনে লাভ জেহাদ নামক শব্দবন্ধের কোন সংজ্ঞা নেই। কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থা এই ধরনের কোনও ঘটনা সরকারের নজরে আনেনি

 

তাই প্রশ্ন জাগে আইন বহির্ভূত কোন মনগড়া, কৃত্রিম ভাবে নির্মিত একটি চিন্তাধারার ভিত্তিতে কি কোন আইন প্রস্তুত করা যায়?

 

তবে, এলাহাবাদ হাইকোর্টের আর একটি রায়ে কিছুটা আশার আলো দেখা দিয়েছে। গত 11 নভেম্বর একটি রায়ে এলাহাবাদ হাইকোর্ট স্পষ্ট জানিয়েছে ভিন্ন ধর্মের দু’জন ব্যক্তির মধ্যে বিয়েতে রাষ্ট্র নাক গলাতে পারে না। উত্তরপ্রদেশের কুশীনগরের বাসিন্দা সালামত আনসারিকে বিয়ে করেন প্রিয়াঙ্কা খারওয়ার। বিয়ের কয়েকদিন আগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন প্রিয়াঙ্কা। তাঁর পরিবার সালামতের বিরুদ্ধে নাবালিকা অপহরণের মামলা করে। কিন্তু এলাহাবাদ হাইকোর্টের দুই সদস্যের একটি বেঞ্চ সেই মামলা খারিজ করে দিয়ে বলে, প্রিয়াঙ্কা ও সালামতকে হিন্দু-মুসলিম হিসেবে দেখতে নারাজ আদালত। আইনের চোখে তাঁরা দু’জন ব্যক্তি, যাদের নিজের পছন্দ মতো বিয়ে করার অধিকার সংবিধানের 21 নং ধারা দ্বারা সুরক্ষিত।

 

 

অবশ্য যাঁরা এটা করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিচ্ছেন গত কয়েক বছরে তাঁরা বারবারই প্রমাণ করেছেন যে তাঁরা কোনও আইনের পরোয়া করেন না। ‘লাভ’ কথাটির দুর্বৃত্তায়ন এবং সেটিকে ব্যবহার করে একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে অপরাধী দেগে দেওয়ার অপকর্মে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন। সম্প্রতি একটি উপনির্বাচনের জনসভায় তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, যদি কেউ লুকোছাপা করে, নাম ভাঁড়িয়ে, পরিচয় গোপন করে, হিন্দু বোনদের সম্মানহানি করার চেষ্টা করে সে যেন ‘রাম নাম সত্য হ্যায়’ শোনার জন্য প্রস্তুত থাকে অর্থাৎ সে যেন শ্মশান যাওয়ার জন্য তৈরি হয়। মনে রাখতে হবে, লাভ জেহাদের সঙ্গে মূলত হিন্দু নারীর মুসলিম পুরুষের প্রণয় বা বিবাহকেই নিশানা করা হয়েছে। হিন্দু পুরুষ মুসলিম নারীকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দিলে তাতে বিশেষ আপত্তি নেই দক্ষিণপন্থী হিন্দু নেতাদের।

 

এলাহাবাদ হাই কোর্টের রায় উল্লেখ করে আদিত্যনাথ বলেছেন, তাঁর সরকার কঠোর ভাবে লাভ জেহাদের মোকাবিলা করবে এবং এই ধরনের প্রচেষ্টা রোখার জন্য শক্তিশালী আইন আনবে। এটি সরাসরি সংখ্যালঘু পুরুষদের সতর্কীকরণ এবং শুধু তাই নয় তাঁদের প্রাণনাশের হুমকি। বিভিন্ন নামে যে সব হিন্দুত্ব বাহিনী দাপিয়ে বেড়ায় তারা এতে উৎসাহিত হবে, সরকারের প্রশ্রয়ে যে কোনও ছুতোয় মুসলিমদের আক্রমণ করবে।

 

কিন্তু সত্যিই কি আমাদের সমাজ এতটা মধ্যযুগীয়, বর্বর মানসিকতাকে প্রশ্রয় দিয়েছে কোনওদিন? খুব বেশি পিছিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কয়েক দশক আগে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের কন্যা শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে পতৌদিন নবাব মনসুর আলি খানের বিয়ে সারা দেশকে উত্তাল করে তুলেছিল। গত শতাব্দীর ছয়ের দশকে সেই বিয়ে যত না পাত্রপাত্রী ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে ঢেউ তুলেছিল, তার চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল দুই ভিন্ন পেশার মহাতারকার মেলবন্ধন। বিয়ের পর শর্মিলার নাম পরিবর্তিত হয়ে আয়েষা বেগম হয়েছিল। কিন্তু ধর্মীয় সেই নামের পরিচয়ে নয়, আজও তিনি তাঁর প্রাক-বিবাহ নামেই সারা বিশ্বে পরিচিত। এরই ঠিক উল্টো দিকে আরও কয়েকটি ভিনধর্মের বিয়ে সাড়া ফেলেছিল বলিউডে। সুনীল দত্ত-নার্গিস, কিশোরকুমার-মধুবালার বিয়েতে তাঁদের ধর্ম বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং সারা দেশ দু’হাত বাড়িয়ে আগলে ধরেছিল ভিন ধর্মের এই দম্পতিদের।

 

আমাদের সংস্কৃতির ইতিহাস চিরকাল নানা ধর্মের আদানপ্রদানের কথাই বলে এসেছে। সঙ্গীতসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান সরস্বতীর পূজা করতেন। তাঁর কন্যা অন্নপূর্ণা যখন রবিশঙ্করকে বিয়ে করেন, তখনও তাঁদের ধর্মীয় পরিচয় বাড়তি গুরুত্ব পায়নি। কাশী বিশ্বনাথের মন্দিরে আজও ভোর হয় বিসমিল্লা খাঁয়ের সানাইয়ের ভৈরবী রাগে। কেন্দ্রীয় সরকারের বহু অনুরোধেও কাশী ছেড়ে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অন্য কোথাও যাননি বিসমিল্লা খাঁ। কারণ? অন্য কোথাও গঙ্গা মাইয়া ও বিশ্বনাথ তাঁর সঙ্গে যাবেন না, তাই।

 

কিন্তু, 2020 সালে দাঁড়িয়ে কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যখন এই ধরনের হুঙ্কার দেন তা জনমানসে ভীতির সঞ্চার করে, সমাজে বিভাজন সৃষ্টি হয়। এমনিতেই সামাজিক ও পারিবারিক কারণে এবং সাম্প্রতিক কালের প্রবল বৈরিতার পরিবেশে ভিন্ন ধর্ম, জাতের মধ্যে মেলামেশা অনেক সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। হিন্দু মুসলিম ছেলে মেয়েদের মধ্যে বিবাহ তো অনেক পরের কথা, এখন স্কুল, কলেজ, মহল্লায় তাদের মধ্যে স্বাভাবিক আদানপ্রদানও হ্রাস পাবে, কেউ কারও সঙ্গে কথা বলতেও ভয় পাবে। হিন্দুত্ববাদীরা তো এটাই তো চায়। তাদের উদ্দেশ্য রাজনৈতিক। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে স্থায়ী বিভেদ তৈরি করা তাদের প্রধান কর্মসূচি। হিন্দু ধর্ম আক্রান্ত, হিন্দু নারী আক্রান্ত— এই ধুয়ো তুলে মানুষের সামনে নিজেদের ত্রাতা হিসাবে তুলে ধরা, নির্বাচনে ভোট নিশ্চিত করা এবং একই প্রক্রিয়ায় মুসলিমদের খলনায়ক বানিয়ে তাদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করা।

 

তথাকথিত এই লাভ জেহাদ বন্ধ করার জন্য উত্তরপ্রদেশে সলতে পাকানো শুরু হয়ে গেছে। মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, ওড়িশা, ছত্তিসগড়-সহ আরও কয়েকটি রাজ্যে ধর্মান্তকরণ বিরোধী আইন আছে, উত্তরপ্রদেশে নেই। এই রাজ্যে ‘ফ্রিডম অফ রিলিজিয়ান বিল’ প্রস্তুত করা শুরু হয়েছে, যার মধ্যে বিবাহের জন্য ধর্ম পরিবর্তন নিষিদ্ধ করার ধারাটিও থাকবে। কানপুরে ইতিমধ্যে পুলিশের একটি ‘স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিম’ তথাকথিত লাভ জেহাদের ঘটনার তদন্ত করছে। মধ্যপ্রদেশ সরকার যে আইন আনছে তাতে ভিন্ন ধর্মে বিবাহের ক্ষেত্রে জেলাশাসককে এক মাস আগে জানাতে হবে। লাভ জেহাদে কেউ অভিযুক্ত হলে তাঁর পাঁচ বছর অবধি অজামিনযোগ্য সাজা হতে পারে। হরিয়ানা, কর্নাটকেও অনুরূপ আইন প্রণয়ন হওয়া সময়ের অপেক্ষা মাত্র। বিহারের সাংসদ গিরিরাজ সিংহ বলছেন লাভ জেহাদ আসলে ক্যানসার, তো এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলছেন হিন্দু নারীদের কব্জা করার এটি একটি ফাঁদ। ভাবটা এমন যেন হিন্দু নারীরা নিজেদের রক্ষা করতে পারেন না, তাঁরা অবলা, তাঁদের অস্তিত্ব বিপন্ন, নিজেদের সম্ভ্রম রক্ষা করতে তাঁদের যেন সংঘ পরিবার ও তাদের সরকারের সাহায্য অপরিহার্য। লাভ জেহাদ এই শব্দবন্ধটাই বাতিল করা আবশ্যক। এটা শুধু আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে বিষাক্ত করে তোলে তাই নয়, এটা প্রবল ভাবে পিতৃতান্ত্রিক এবং নারীস্বাধীনতা-বিরোধী।

 

 


New
মাদক ব্যবসা ও বিভাজনের রাজনীতির আবর্তে আজকের মণিপুর
ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে রাষ্ট্রীয় মদত? বিস্ফোরক রিপোর্ট অসম রাইফেলসের
বিরোধী জোট আছে, রাজনীতি কই?


Other Writings by -সোমনাথ গুহ | 24-11-2020

// Event for pushed the video