এই করোনা-কালে দেশকে স্বনির্ভর করার এক মহাযজ্ঞ শুরু হয়েছে। গত 18 জুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘আত্মনির্ভর ভারত যোজনা’ নামক এক বিপুল উদ্যোগের অধীনে 41টি কয়লা ব্লক বাণিজ্যিক খননের জন্য নিলামে চড়ালেন। এর তিন দিন আগে গালওয়ানে চিনা সৈন্যদের সঙ্গে রক্তাক্ত সংঘর্ষ হয়ে গেছে, COVID-19-এর প্রকোপ হু হু করে বাড়ছে, অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমশ নিম্নগামী; প্রধানমন্ত্রী মনে করলেন জ্বালানির ক্ষেত্রে দেশকে স্বনির্ভর করার এটাই সেরা সুযোগ। তিনি জানালেন কয়লা উত্তোলন এবং বণ্টনের জন্য 50,000 কোটি টাকা বরাদ্দ করা হবে। এর ফলে পাঁচ থেকে সাত বছর 33,000 কোটি টাকা কয়লা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হবে এবং 16,98 কোটি টন কয়লা প্রাপ্তি হবে। তিনি আশ্বস্ত করলেন যে, পরিবেশ রক্ষার্থে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এমন কিছু করা হবে না, যাতে পরিবেশের ক্ষতি হয়। আরও জানানো হল যে, 2 লক্ষ 80 হাজার কর্মসংস্থান হবে এবং এলাকার যুবকদের আর বাইরে কাজের খোঁজে যেতে হবে না। স্থানীয় আদিবাসী মানুষদের জন্য বিভিন্ন কল্যাণমূলক প্রকল্প চালু করা হবে।
এই 41টি ব্লক পাঁচটি রাজ্যে অবস্থিত: মধ্যপ্রদেশে 11টি, মহারাষ্ট্রে 3টি, ঝাড়খন্ডে 9টি, ছত্তিসগড়ে 9টি, ওড়িশায় 9টি। এর মধ্যে 14টি ব্লক গভীর অরণ্য এবং সমৃদ্ধ জীববৈচিত্রের কারণে ‘নো-গো’ অঞ্চল, অর্থাৎ যে এলাকাগুলিতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয় এমন কিছু করা যাবে না। দুটি অঞ্চল inviolate অর্থাৎ শুদ্ধভূমি হিসাবে গণ্য হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার, ‘নো-গো জ়োন’-এ মাইনিং করা যাবে কিনা, তা নিয়ে 2010 সাল থেকে চাপানউতোর চলছে। কয়েকবার এই জ়োনগুলিতে খননের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেও তা বাতিল হয়ে গেছে। এই প্রকল্প রূপায়িত হলে ছত্তিসগড়, ওড়িশা, ঝাড়খন্ড, প্রতিটি রাজ্যে 8,000-10,000 পরিবার উৎখাত হবে। ঝাড়খন্ডে ব্লকগুলি দশটি জেলায় ছড়িয়ে। এই রাজ্যে 30-32টি গ্রামের মানুষকে ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র সরে যেতে হবে। ওড়িশায় নয়টির মধ্যে আটটি ব্লক আঙ্গুল জেলায়, যেখানে 32,000 হেক্টর জমি অধিগৃহীত হবে এবং অন্তত 10,000 পরিবার উৎখাত হবে। আঙ্গুলের তালচের খনি দূষণ ছড়ানোর কারণে বহু দিন ধরেই বিতর্কিত। এই খনির আশেপাশে ছয়টি গ্রাম অতিরিক্ত দূষণে আক্রান্ত। এখান থেকে নির্গত পদার্থ জলাশয়গুলিকে বিষাক্ত করে দিয়েছে। খনির ধোঁয়ার কারণে গ্রামের মানুষ শ্বাসকষ্ট এবং অন্যান্য কঠিন রোগে ভোগেন। খননে উদ্গীরিত ছাই শস্যক্ষেত্র ও পানীয় জল দূষিত করে। এই জেলায় পুনরায় খনন শুরু হলে পরিবেশ দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। এছাড়া আঙ্গুলের 80 শতাংশ মানুষ, যারা বহু প্রজন্ম ধরে কৃষিজীবী, তারা নিজেদের জীবিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ছত্তিসড়ের নয়টি ব্লক ইতিমধ্যেই বিভিন্ন কোম্পানিকে বণ্টন করা হয়ে গেছে এবং সমস্ত সরকারি অনুমতি নেওয়া হয়ে গেছে। এর থেকে বোঝা যায় যে, এই সব এলাকায় কয়লা খননের প্রস্তুতি বহু আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। এই রাজ্যে নয়টির মধ্যে পাঁচটি ব্লক হাসদেও আরান্ড জঙ্গলে অবস্থিত। রাজ্য সরকার এখন এই গভীর জঙ্গলে খননের বিরোধিতা করেছে কারণ লেমুর এলিফ্যান্ট রিজার্ভ এই বিশুদ্ধ অঞ্চলেই অবস্থিত। এই রাজ্যের প্রকল্পগুলি রূপায়িত হলে অন্তত 8,000 মানুষ উৎখাত হবে এবং 25-30 লাখ গাছ ধ্বংস হবে। মধ্যপ্রদেশের 11টি জোনের মধ্যে তিনটি ‘নো-গো’, যার একটির মধ্যে মার্সাটোলা ব্যাঘ্র প্রকল্প অবস্থিত। মহারাষ্ট্রের দু’টি জোনের মধ্যে একটিতে তাড়োবা আন্ধারি জাতীয় উদ্যান অবস্থিত। বোঝাই যাচ্ছে যে, এই সব অঞ্চলে উন্মুক্ত কয়লা খননের কারণে পরিবেশের সমূহ ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আজকে এই প্রাণঘাতী মহামারীর সময়ে যখন বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, নির্বিচারে অরণ্য হনন এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের কারণেই নানা ধরনের ব্যাধির প্রকোপ বাড়ছে, তখন পরিবেশের প্রতি এই অবহেলা বিস্ময়কর। ঝাড়খন্ড, ছত্তিসগড়, মহারাষ্ট্রের সরকার তাদের রাজ্যের প্রকল্পগুলি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে কিন্তু সংসদে শাসক দলের সংখ্যাধিক্য এবং দাপট এতটাই যে, কোনও ধরনের বিরোধিতা আদৌ ধোপে টিকবে কিনা সন্দেহ আছে।
আরও পড়ুন: একটি দাঙ্গা, চারটি রিপোর্ট, অজস্র প্রশ্ন
যদিও প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, কিন্তু এই প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের দেউচা পাঁচামিতে প্রস্তাবিত কয়লা খনি প্রকল্পের উল্লেখ করা প্রয়োজন। এখানে 11টি মৌজায় 1,100 একরের বেশি জমি চিহ্নিত হয়েছে, যেখানে 210 কোটি টন কয়লা সঞ্চিত আছে। কলকাতায় শোনা গেল 4,000 মানুষ উৎখাত হবে কিন্তু বীরভূমে গিয়ে সেই সংখ্যাটা হয়ে গেল 1,500-2,000। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে 100 শতাংশ পুনর্বাসনের আগে প্রকল্প শুরু হবে না। তবে চাকরি-বাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়নি। বাস্তবে যেটা শোনা যাচ্ছে, 34টি গ্রাম উচ্ছেদ হবে এবং প্রায় 10,000 মানুষ ঘরছাড়া হবে, যাদের মধ্যে অধিকাংশই আদিবাসী। ইতিমধ্যেই এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে এলাকায় বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু হয়ে গেছে। নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, অদূর ভবিষ্যতে এই প্রকল্প পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে।
2013 সালের ডিসেম্বর মাসে লোকসভা সেক্রেটারিয়েট একটি রেফারেন্স নোট তৈরি করে, ‘ডিসপ্লেসমেন্ট অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন অফ পিপল ডিউ টু ডেভেলপমেন্টাল প্রোজেক্টস’। এই নোট উল্লেখ করছে যে, 1960-এর দশকে যখন কয়লা খনি ভূগর্ভস্ত ছিল তখন একটি খনির জন্য 150 একর জমি যথেষ্ট ছিল। 1980-র দশকে জমির পরিমাণ দাঁড়াল 800 একর, ওপেন কাস্ট মাইন বা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনন চালু হওয়ার ফলে যা এখন 1,500 একর। এই কারণে এখন আরও বেশিসংখ্যক মানুষ উৎখাত হয় এবং এই নোট পরিষ্কার স্বীকার করছে, যে প্রায় কোনও কর্মসংস্থানই হয় না। যান্ত্রিকীকরণের এই যুগে এখন চাকরির সুযোগ প্রায় শূন্যে এসে ঠেকেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপরোক্ত 41টি কয়লা ব্লকের ক্ষেত্রে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কোনও আলোচনা হয়নি, প্রকল্পের জন্য তাঁদের সম্মতি নেওয়া হয়নি এবং এর ফলে পরিবেশের উপর কী ধরণের প্রভাব পড়তে পারে, সেটার কোনও সমীক্ষা হয়নি। ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসন তো অনেক পরের কথা, আগে তো জমিদাতাদের সম্মতি প্রয়োজন! যদি হয়েও থাকে, সেগুলি প্রকাশিত নয় এবং গ্রামবাসীরা অবগত নয়। এখানে উল্লেখ করা দরকার, সম্মতি নেওয়ার জন্য গ্রামসভা ডাকা হলে সেখানে মালিকপক্ষ নিজেদের লোক ঢুকিয়ে, উৎকোচ দিয়ে বা সামাজিক-রাজনৈতিক চাপ তৈরি করে রায় নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসে। দেউচা পাঁচামির ক্ষেত্রেও সবেমাত্র একটি সভা হয়েছে এবং সেখানে চিহ্নিত গ্রামগুলির প্রতিনিধিত্ব কতটা ছিল সেটা পরিষ্কার নয়।
লোকসভা সেক্রেটারিয়েটের ওই রেফারেন্স নোট এতদিন যাবৎ যে তথাকথিত উন্নয়ন যজ্ঞ চলেছে সেটার একটা নির্মম সত্য উদঘাটন করেছে। নোটটি বলছে স্বাধীনতার পরে “উন্নয়নের মন্দিরগুলি বিভিন্ন প্রকল্প দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কবরখানায় পরিণত হয়েছে।” 1947 থেকে 2000 সালের মধ্যে 6-6.5 কোটি মানুষ (যার 40 শতাংশ আদিবাসী) 25 মিলিয়ন হেক্টর জমি থেকে উৎখাত হয়েছে, যার মধ্যে 7 মিলিয়ন হেক্টর গভীর বনাঞ্চল। এটা নিশ্চিত যে, 41টা কয়লা ব্লক এবং দেউচা পাঁচামি প্রকল্প যা দেশি-বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে, তা এই কবরখানাকে আরও বিস্তৃত করবে।