দিল্লি দাঙ্গা নিয়ে আগের একটি লেখায় আমরা ‘গ্রুপ অফ ইন্টেলেকচুয়ালস অ্যান্ড অ্যাকাডেমিসিয়ান্স’-এর একটি রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা করেছি। ওই রিপোর্টের লেখিকারা তাঁদের প্রতিবেদনটিকে আরও বিস্তৃত করে সেটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ বইয়ের রূপ দেন। বইটির নাম ‘দিল্লি রায়টস 2020: দ্য আনটোল্ড স্টোরি’। লেখিকা- মনিকা অরোরা (আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট), সোনালি চিতলকার (অধ্যাপিকা, মিরান্ডা হাউস, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়), প্রেরণা মালহোত্রা (অধ্যাপিকা, রামলাল আনন্দ কলেজ, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়)। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রকাশক ‘ব্লুমসবেরি’ বইটি ছাপে, কিন্তু অন্তিম লগ্নে তারা বইটি প্রকাশ করতে অস্বীকার করে। একটি বিজ্ঞপ্তিতে সংস্থাটি জানায় যে, তারা বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, কিন্তু একই সঙ্গে তারা সমাজের প্রতি নিজেদের দায়বদ্ধতাও অস্বীকার করতে পারে না। ইতিমধ্যে দিল্লিতে একটি ভার্চুয়াল সভায় বইটির উন্মোচন হয়ে যায়। আনুষ্ঠানিক উন্মোচন করেন বিজেপি নেতা ভূপেন্দ্র যাদব এবং অনুষ্ঠানে ‘গেস্ট অফ অনার’ ছিলেন বিজেপির কপিল মিশ্র, যাঁর প্ররোচনামূলক বক্তব্যই দিল্লিতে দাঙ্গার সূচনা করে বলে অনেকের অভিযোগ। বইটির প্রকাশনা থেকে ব্লুমসবেরির সরে যাওয়া তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করে। জিআই-এর আহ্বায়ক মনিকা অরোরা এই ঘটনাকে ‘ইন্টেলেকচুয়াল ফ্যাসিবাদ’ বলে অভিহিত করেন। প্রকাশনা সংস্থার বিরুদ্ধে সরব প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বামপন্থীরা ডিজিটাল ফতোয়া জারি করে কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করছে, হুমকি দিয়ে বাকস্বাধীনতা হরণ করছে। আমাদের কথা বলার, লেখার অধিকার আছে। প্রসঙ্গত আমেরিকান লেখিকা ওয়েন্ডি ডোনিগারের ‘দ্য হিন্দুস: অ্যান অল্টারনেটিভ হিস্ট্রি’ বইটির বিরুদ্ধে যারা আদালতে পিটিশন দাখিল করেছিলেন, তাঁদের আইনজীবী ছিলেন শ্রীমতি বাটরা এবং বইটির বিরুদ্ধে তিনি এতই সরব ছিলেন যে প্রকাশক সংস্থা পেঙ্গুইন বইটি ভারতীয় বাজার থেকে তুলে নিতে বাধ্য হয়। সুতরাং, বাকস্বাধীনতা সম্পর্কে তাঁর অবস্থান সুবিধামতো পাল্টে যায়, বোঝাই যাচ্ছে।
বইটিতে একটি সূচনা আছে, ভূমিকা আছে এবং উপস্থাপনা ও উপসংহার সহ আটটি অধ্যায় ও পাঁচটি সংযোজনী (অ্যানেক্সার) আছে। সূচনায় প্রাক্তন আইপিএস পি.সি.ডোগরা লিখছেন, আমাদের প্রিয় দেশকে ভেঙে ফেলার পরিকল্পনা হচ্ছে। উনি লিখছেন, যাঁরা নেহরু মডেলে বিশ্বাস করতেন, 2014 এবং 2019-এর নির্বাচনী ব্যর্থতার কারণে তাঁরা হতাশ এবং 2024 সম্পর্কেও তাঁরা বিশেষ আশাবাদী নন। স্বাধীনতার পর থেকে হিন্দুরা আমাদের দেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক ছিলেন, 2014-র পর থেকে তাঁরা হৃত মর্যাদা ফিরে পাচ্ছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেশকে সমৃদ্ধ করার জন্য দায়বদ্ধ। তিনি দেশের গর্ব এবং সবার শ্রদ্ধেয় নেতা। এই অবধি কোনও সমস্যা নেই। হিন্দু ধর্মের ‘উত্থান’ এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে কেউ গর্ব বোধ করতেই পারেন। মুশকিল হল কাউকে সম্মানের স্থানে অধিষ্ঠিত করতে গেলে অন্য কারও তো পতন ঘটাতে হয়। আর এখন তো যত দোষ নন্দ ঘোষ এবং ঘুরেফিরে সমস্ত আক্রমণ শাণিত হয় দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুর দিকে। প্রাক্তন পুলিশ কর্তা লিখছেন, হিন্দু ধর্ম এবং হিন্দুদের প্রতি নেহরুর কোনও আবেগ বা অন্তরঙ্গতা ছিল না এবং মুসলিমদের প্রতি কোনও অন্যায় হলে তিনি ভীষণ বিচলিত বোধ করতেন। নেহরু কতটা হিন্দু-বিরোধী, এটা প্রতিষ্ঠিত করতে এইখানে তিনি একটি উক্তি, যেটি নেহরু কথিত বলে গত কয়েক বছরে সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে, সেটি ব্যবহার করেছেন। নেহরু নাকি একদা বলেছিলেন, “আমি শিক্ষার দিক দিয়ে ইংরেজ, সংস্কৃতিগত ভাবে মুসলিম, এবং কাকতালীয় ভাবে হিন্দু।” ভুয়ো খবর যাচাই করার ওয়েবসাইট ‘অল্ট নিউজ’ কিন্তু বহু আগেই এটা যে আদৌ প্রথম প্রধানমন্ত্রীর উক্তি নয় তা প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছে। ঘটনা হচ্ছে বি.আর.নন্দা তাঁর বই ‘দ্য নেহরুজ: মতিলাল এবং জওহরলাল’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, হিন্দু মহাসভার নেতা এন.বি.খারে নেহরুকে বর্ণনা করতে গিয়ে এই উক্তিটি করেছিলেন। পরবর্তীকালে শশী থারুরও নেহরু সংক্রান্ত তাঁর বইয়ে খারেকেই এই উক্তির জনক বলে উল্লেখ করেন।
এম.জে.আকবর ‘কুইন্ট’ পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, হিন্দু মহাসভার সভাপতি এন বি খারে 1950 সালে নেহরু সম্পর্কে এই প্রচলিত উক্তিটি পুনরুল্লেখ করেন। এর অর্থ বহু দিন ধরেই এই কয়েকটি কথা নেহরুর মুখে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং অত্যাধিক ব্যবহারের ফলে সেটা যেমন জীর্ণ হয়ে গেছে, আবার সেটি প্রায় ‘সত্য’ হিসাবেও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।
ডোগরা আরও লিখছেন যে, হিন্দুদের উত্থানের ফলে বাম-লিবারাল জোট, আর্বান নক্সাল এবং জিহাদিরা মরিয়া হয়ে উঠেছে। এঁদের পরিকল্পনা হচ্ছে জাতিগত ভিত্তিতে দেশকে টুকরো করে দেওয়া। তিনি এখানে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা নন্দিনী সুন্দরের কথা উল্লেখ করেন, যিনি নাকি এই টুকরো করে দেওয়ার তত্ত্বের অন্যতম মূল প্রবক্তা। শুধু তাই নয়, ‘তিরঙ্গা টিভি’তে করন থাপারের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি নাকি খোলাখুলি ভারতকে জাতি ও ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করার প্রস্তাব ব্যক্ত করেছেন। এর প্রতিবাদে অধ্যাপক সুন্দর 24 আগস্ট টুইট করেছেন- “দিল্লি দাঙ্গার উপর বইটা ছাপানোর আগে ব্লুমসবেরি কি কোনও তথ্য যাচাই করেনি? কোনও একজন পি সি ডোগরা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও মানহানিকর উক্তি করেছেন যে, আমি নাকি ‘তিরঙ্গা টিভি’তে করন থাপারকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে ভারতকে টুকরো করে দেওয়ার কথা বলেছি। আমি ‘তিরঙ্গা টিভি’তে করন থাপারকে কোনও সাক্ষাৎকার দিইনি এবং এই ধরনের কোনও কথা বলিনি।” 26 আগস্ট আবার তিনি টুইট করে জানান যে, তাঁর আইনজীবীরা এই উক্তি সম্পর্কে আইনি নোটিস পাঠিয়েছেন। বইটির সূচনাতেই যখন দু’-দু’টি ডাহা মিথ্যা চিহ্নিত করা যায়, তখন বইটির বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে প্রথমেই সন্দেহ জাগে।
ভূমিকায় জিআই-এর আহ্বায়ক মনিকা অরোরা লিখছেন, ডিসেম্বরের শুরুতে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (CAA) সংসদে পাস হওয়ার পরেই চারদিকে ঝামেলা শুরু হয়ে যায়। তিনি দাবি করেছেন যে, তাঁর দল শাহিনবাগে গিয়েছিল এবং সেখানে তাঁরা দেখেছেন তেরঙ্গা এবং সংবিধানের আড়ালে হিন্দু দেবদেবী এবং পবিত্র ধর্মীয় প্রতীকের কীভাবে অবমাননা করা হয়েছে। বাজার এবং মন্দিরের সামনে নাকি আজাদি শ্লোগান দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় অবস্থানের ফলে ট্র্যাফিক জ্যাম বেড়ে গেছে, সাধারণ মানুষ চরম হেনস্থার সম্মুখীন হয়েছেন। তাঁর মতে এই সবই হয়েছে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের ফলে, যেটি আদতে আর্বান নক্সাল এবং জিহাদিদের একটি জোট। অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ভাবে তাঁরা নাকি একটা ধরনা থেকে দাঙ্গা মডেল সৃষ্টি করেছে, যেটা দু-মাস ধরে তারা কার্যকরী করেছে।
উপস্থাপনাটি কার লেখা সেটার কোনও উল্লেখ বইটিতে নেই, ধরে নেওয়া যায় এটা লেখিকাদের যৌথ প্রয়াস। প্রথমে দিল্লি শহরের একটা ইতিহাস দেওয়া হয়েছে, যার অনেকটাই উইকিপিডিয়া থেকে কপি-পেস্ট করা। এরপরে তাঁরা বলছেন দিল্লি দাঙ্গা কোনও দাঙ্গা নয়। এটা এক অভূতপূর্ব শহুরে অভ্যুত্থান যা আগে কোনওদিন আমাদের দেশে দেখা যায়নি। এর নেতৃত্বে ওই আর্বান নক্সাল এবং জিহাদিরা- পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া এবং বিভিন্ন অতিবাম সংগঠন। বামেরা (আর্বান নক্সাল) তাত্ত্বিক, মুসলিমরা তাদের বাহিনী (STRIKING ARM); বামেরা মুসলিমদের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছে। 370 ধারা, তিন তালাক, রাম জন্মভূমি, সিএএ ইত্যাদি নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, যেটা বামেরা উস্কে দিয়েছে এবং তাদের সরকারবিরোধী হিংসাত্মক কার্যকলাপ করতে প্ররোচিত করেছে। পিএফআই আইসিস (ISIS)-এর একটি ছায়া সংগঠন; কেরালায় বহু দিন ধরেই নাকি বাম এবং পিএফআই-এর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সিরিয়া, ইরাকে আমেরিকানদের বিরুদ্ধে যে কৌশল, ফন্দিফিকির ব্যবহার করা হয়েছিল, তা নাকি এই প্রথম ভারতবর্ষে ব্যবহৃত হল। এর সঙ্গে আবার জুড়েছে মাওবাদী সন্ত্রাস, অর্থাৎ ধ্বংস এবং বিনাশের এক অনির্বচনীয় বিস্ফোরক ককটেল! কিছু বহুতল দখল করা হয়েছিল এবং সেগুলির বিভিন্ন ফ্লোরে স্নাইপাররা সদা প্রস্তুত ছিল। পেশাদার শুটারদের কাজে লাগানো হয়েছিল। প্রচুর গোলাবারুদ, আগ্নেয়াস্ত্র, দাহ্য পদার্থ একত্রিত করা হয়েছিল। বিভিন্ন সমাবেশে মেয়েদের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। বামেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যে রকমটা করে থাকে, সুতরাং দুইয়ে দুইয়ে চার!
দ্বিতীয় অধ্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী), জামাত-ই-ইসলামি, পিএফআই এবং অন্যান্য জিহাদি সংগঠনের বিভিন্ন ডকুমেন্টের ভিত্তিতে আর্বান নক্সাল এবং জিহাদিদের তত্ত্ব আবিষ্কার করার চেষ্টা হয়েছে। দিল্লি দাঙ্গায় এই দুই মতবাদের তত্ত্বের মেলবন্ধন ঘটেছে। এখানে বলা হচ্ছে 2015-16 থেকেই এর সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল, যখন ‘ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়া’, ‘হায়দ্রাবাদ সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’, আইআইটি, মাদ্রাজ, দিল্লি এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, জেএনইউতে বিভিন্ন সময়ে ছাত্র আন্দোলন হয় এবং লেখিকাদের মতে সমগ্রটাই ছিল মাওবাদী পরিকল্পনার অঙ্গীভূত। এইভাবে রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যা, জেএনইউ-তে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে কানহাইয়া কুমার, উমর খালিদের গ্রেপ্তার, নাজিব আহমেদের নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি ঘটনগুলিকে কেন্দ্র করে যে সব ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সবগুলোকেই মাওবাদী ছাপ্পা মেরে দিয়ে বেআইনি এবং রাষ্ট্রদ্রোহী বলে দেগে দেওয়া হয়েছে। একটা ধারণা সৃষ্টি করা হচ্ছে যে ছাত্ররা আন্দোলন করলেই তাতে নিশ্চয়ই মাওবাদী যোগ আছে। এর ফলে তথাকথিত নতুন ভারতে ছাত্রদের গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলে কিছু থাকবে না। এর পাশাপাশি কেরালায় ‘লাভ জিহাদ’, হিন্দু ও খ্রিস্টান মেয়েদের ধর্মান্তকরণ এবং কয়েকজনের আইসিসে যোগদান, ইত্যাদির উল্লেখ করে আইনি বেআইনি আন্দোলনের মধ্যে ভেদরেখা মুছে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। এমন ভাব করা হচ্ছে যেন ছাত্র সংগঠন ও আইসিস সব একই গোত্রের।
বইটির তৃতীয় অধ্যায় সিএএ সংক্রান্ত। আশ্চর্যজনক ভাবে এখানে ‘হিন্দু-বিরোধী’ নেহরুর একটি উক্তি দিয়ে শুরু হয়েছে। সুযোগ পেলেই যে তাঁরা নেহরুর কুৎসা করতে পিছপা হন না, সেই নেহরুরই উক্তির সাহায্যে সিএএর যথার্থতা প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছে। নেহরু আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী গোপিনাথ বরদলৈকে লিখছেন, আমাদের হিন্দু উদ্বাস্তু এবং মুসলিম অভিবাসীদের মধ্যে ফারাক করতে হবে এবং দেশকে অবশ্যই উদ্বাস্তুদের দায়িত্ব নিতে হবে। লেখিকারা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন যে, সিএএ-বিরোধী আন্দোলন সম্পূর্ণভাবে একটি মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের আন্দোলন, যদিও দেখানোর চেষ্টা হয়েছে যে তাতে সমস্ত ধর্মের মানুষই সন্নিবিষ্ট ছিল। লেখিকারা প্রতিবাদ, আন্দোলন ইত্যাদি সম্পর্কে সহনশীল! তাঁরা এমনও বলছেন যে, ভিন্ন মত পোষণ করা, প্রতিবাদ করা সবই ঠিক আছে! কিন্তু সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের আড়ালে হিন্দু ধর্মের প্রতীকগুলিকে তো অবমাননা করা যায় না।
চতুর্থ অধ্যায় হচ্ছে 12/12/2019 থেকে 10/01/2020 জামিয়া, দিল্লি ও আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জেএনইউতে ‘হিংসাত্মক কার্যকলাপ’-এর বর্ণনা যা আদতে ধরনা থেকে দাঙ্গা এই মডেলের ভূমিকা (PRELUDE) স্বরূপ। জামিয়াতে পাঠাগারে ঢুকে পড়ুয়াদের উপর পুলিশের বেধড়ক লাঠিচার্জ কিংবা জেএনইউ-তে আলো নিভিয়ে পুলিশের উপস্থিতিতে ছাত্রছাত্রীদের উপর মুখঢাকা গুণ্ডাদের নৃশংস আক্রমণ, এসবের কোনও উল্লেখই নেই বইতে। পঞ্চম অধ্যায় হচ্ছে মধ্যবর্তী পর্যায় (INTERLUDE), যখন লেখিকাদের মতে মানুষের দৃষ্টি শাহিনবাগ এবং অন্যান্য সমাবেশের উপর আবদ্ধ থেকেছে এবং এর আড়ালে দাঙ্গার প্রস্তুতি পুরো দমে শুরু হয়ে গেছে। ধরনাস্থলের ছবি, পোস্টার এই অধ্যায়ে আছে। ছবি ফটোশপ করে শাহিনবাগ আন্দোলনের হিন্দু-বিরোধী ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হয়েছে। একটা দেওয়ালে ‘লং লিভ রিভোলিউশন’ লেখা, যেটা এই আন্দোলনে বামেদের সার্বিক প্রভাব প্রমাণ করার চেষ্টা। আরও গুরুত্বপূর্ণ এটা দেখানোর চেষ্টা যে, এটা নিছক কোনও আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন নয়, আসলে এটা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য একটা বিপ্লবের প্রচেষ্টা! প্রশ্নটা হচ্ছে দেওয়াল লিখনটা কি আদৌ শাহিনবাগ অঞ্চলের, না কলকাতার কোনও এঁদো গলির, এটা বোঝার কোনও উপায় নেই। ষষ্ঠ অধ্যায়ে দাঙ্গার বর্ণনা। এখানে ঘটনার টাইমলাইনে উল্লেখ করা হয়েছে যে 23 ফেব্রুয়ারি, রবিবার, বিকেল সাড়ে তিনটের সময় কপিল মিশ্র মৌজপুরে গিয়েছিলেন এবং তখন সেখানকার বাসিন্দারা ভজন গাইছিলেন। তা এই ভজন গাওয়ার মধ্যে বিজেপি নেতা কী বক্তব্য রেখেছিলেন সেটার কোনও উল্লেখ নেই। কিংবা পুলিশ, প্রশাসনের কী ভূমিকা ছিল, সেটাও অনুল্লিখিত। বরং উল্টে প্রশ্ন করা হয়েছে কেন পুলিশের দিকে পাথর ছোঁড়া হয়েছে? কেন তাদেরকে গুলি করা হয়েছে? কেন তাদের নিগ্রহ করা হয়েছে? বেচারা পুলিশ তো সিএএ-এর জন্য কোনওভাবে দায়ী নয়!
উপসংহারে বলা হচ্ছে, প্রথমত সিএএ-বিরোধী আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ছিল এটা সম্পূর্ণ ভুল। দ্বিতীয়ত, দিল্লি পুলিশ মুসলিম-বিরোধী এটাও সম্পূর্ণ ভুল। মূল পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, এই আন্দোলন ভারত-বিরোধী, হিন্দু-বিরোধী, সরকার-বিরোধী এবং পুলিশ-বিরোধী। মুসলিমদের মৌলবাদী করার চেষ্টা হয়েছে, তাঁদের চরমপন্থার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। মহিলাদের হেনস্থা করা হয়েছে, বহিরাগতরা প্রচুর সংখ্যায় উপস্থিত থেকেছে। এই বিপদকে নির্মূল করার জন্য কী কী করা প্রয়োজন তার সুপারিশ করা হয়েছে।
বইটির বিষয়বস্তু একটি পূর্ব নির্ধারিত (Pre-Determined) মানসিকতা থেকে করা হয়েছে। লেখিকারা দাঙ্গা কবলিত এলাকায় অনুসন্ধান করতে গেছেন এটা একটা কথার কথা মাত্র। তাঁরা এই নির্দিষ্ট ধারণা নিয়েই গেছেন যে, আমরা প্রমাণ করব এই দাঙ্গা সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের স্বাভাবিক পরিণতি। এবং আমরা প্রমাণ করব যে ওই আন্দোলন সম্পূর্ণ দেশদ্রোহী, সন্ত্রাসবাদী, আর্বান নক্সাল এবং জিহাদিদের দ্বারা পরিচালিত। এইভাবে স্বাধীন ভারতের একটি বৃহত্তম গণ আন্দোলনকে নস্যাৎ করার প্রচেষ্টা এই বইয়ের ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে। সুচতুর ভাবে লেখিকারা কিন্তু সম্প্রদায়গত ভাবে মুসলিমদের আক্রমণ করেননি। উল্টে অকুস্থলে থাকা মৌলবিদের সঙ্গে তাঁরা কথা বলেছেন, আক্রান্ত সংখ্যালঘু মানুষদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছেন। মুসলিমদের রাষ্ট্রবিরোধী করে তোলার জন্য আর্বান নক্সালদের দায়ী করেছেন। এমনকী শাহিনবাগের সমাবেশকে ICONIC বলে উল্লেখ করেছেন এবং শাহিনবাগের জন্য কুম্ভীরাশ্রু ফেলেছেন কারণ দূর্ভাগ্যজনক ভাবে সেটা হিংসায় পর্যবসিত হয়েছে। যে মুসলিমরা আন্দোলনে ছিলেন না তারা নিরীহ, যাঁরা ছিলেন তারা জিহাদি, দেশদ্রোহী।
একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় শতকে দক্ষিণপন্থীরা অনেক চটপটে, ঝকঝকে, স্মার্ট, আধুনিক জীবনের সঙ্গে মানানসই। মধ্যযুগীয় গোঁড়ামি, গোবর, গোমূত্র ইত্যাদির গল্প তো আছেই, কিন্তু বহিরঙ্গটা যেন ভবিষ্যৎমুখী। তাঁরা এখন বামপন্থীদের ভাষায় কথা বলে, ‘ইন্টেলেকচুয়াল ফ্যাসিবাদ’, ‘ডিজিটাল ফতোয়া’ ইত্যাদি, তাঁদের মতো কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করে। অতীতে কোনও দাঙ্গায় মানবধিকার সংগঠনগুলি, যেমন PUDR, PUCL, APDR এরা ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট করত। জনমত তৈরি হত, সরকার তদন্ত কমিশন তৈরি করত। শিখ দাঙ্গা, এমনকী গুজরাট দাঙ্গায়ও তাই হয়েছে। এখন শাসক দল তাদের নিজেদের বুদ্ধিজীবীদের দিয়েই একটা আপাত নিরপেক্ষ দল তৈরি করে অনুসন্ধান করতে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এই বুদ্ধিজীবীরা একেবারে হেলাফেলা করার মতো নন, প্রত্যেকেই নিজস্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। নিন্দুকেরা অবশ্য বলছে যে এঁদের সবকিছুই সরকারি আনুকূল্যে। এই দলটা পুলিশ প্রশাসনের সম্পূর্ণ সহযোগিতা পাচ্ছে। অথচ মানবধিকার সংগঠনগুলিকে একটা এফআইআরের কপি পেতে বারবার থানায় মাথা ঠুকতে হচ্ছে। এই নব্য দক্ষিণপন্থীদের মোকাবিলা করতে নতুন পথ খোঁজার প্রয়োজন। পুরনো পদ্ধতি তামাদি হয়ে গেছে।