4thPillar


ফ্যাসিবাদ: শতাব্দী প্রাচীন পরিক্রমা

সোমনাথ গুহ | 11-01-2021May 24, 2023
ফ্যাসিবাদ: শতাব্দী প্রাচীন পরিক্রমা

হলিউডের একটা ছবি, নাম ‘দ্য রিডার’। মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন টাইটানিক খ্যাত অভিনেত্রী কেট উইন্সলেট। সিনেমায় তার নাম হ্যানা। বিশ্বযুদ্ধের প্রায় দেড় দশক পর সে জার্মানির এক ছোট শহরে ট্রাম কন্ডাক্টারের কাজ করে। এক কিশোরের সঙ্গে তার সখ্য হয়, অবসর সময়ে যে তাকে আন্তন চেকভের গল্প পড়ে শোনায়। অসমবয়সী এই বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে এক নিবিড় ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়। যুদ্ধের ক্ষত তখনও দগদগে, হলোকাস্টের বিষাদঘন স্মৃতি তখনও সমাজজীবনে পুরোপুরি বিদ্যমান। হ্যানার একটা অন্ধকার অতীত আছে। যুদ্ধের সময় সে এক ইহুদি বন্দি শিবিরের প্রহরী ছিল। হ্যানা নিরক্ষর, কিন্তু সে গল্প শুনতে ভালবাসত। সে তার পছন্দসই বন্দিদের নিজের ঘরে নিয়ে যেত এবং তারা তাকে বিখ্যাত লেখকদের গল্প পড়ে শোনাত। কিছু দিন অন্তর এদের মধ্যে থেকে কয়েকজনকে বেছে সে গ্যাস চেম্বারে পাঠিয়ে দিত। এই সময়ে একটা গির্জার দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে 30 জন ইহুদিকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। ষাটের দশকে এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর তদন্ত শুরু হয় ও হ্যানাকে মূল অভিযুক্ত করা হয়। অন্য প্রহরীরা ঘটনার দায় পুরো অস্বীকার করে এবং হ্যানাকে দোষী সাব্যস্ত করে। হ্যানা কিন্তু দোষ স্বীকার করে। বিচারকের জেরার উত্তরে সে বলে যে, সে দায়িত্ব পালন করছিল মাত্র। ‘ওপরওয়ালার নির্দেশ’, সে নির্বিকার ভঙ্গিতে জানায়। ‘আমি তো জানতাম না, কী ঘটে চলেছে, আর আমার সেটা জানারও কথা নয়।‘ যেটা উহ্য থেকে যায়, যেটা তার মাথাতে আসে না এবং আরও তাৎপর্যপূর্ণ যেটা, সে আদৌ উপলব্ধি করতে পারে না এবং যে প্রশ্নটা আদালতের বিহ্বল, স্তম্ভিত বাতাবরণে ঘুরপাক খায়, সেটা হচ্ছে ওপরওয়ালার ওই নির্দেশের কী বিয়োগান্তক পরিণতি হতে পারে, সেটা ভাবার কোনও প্রয়োজনই কি সে বোধ করেনি? হ্যানা গল্প শুনতে ভালবাসে, সে তো একজন সংবেদনশীল মানুষ! সে কি এতটাই অনুভূতিহীন, বোধশক্তিরহিত হতে পারে? কিন্তু হ্যানা বিন্দুমাত্র বিচলিত নয়। উল্টে সে বিচারককে জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনি আমার জায়গায় হলে কী করতেন’?

 

নাৎসি জার্মানিতে এইরকম অনুভূতিহীনতার অসংখ্য উদাহরণ দেখা গেছে। একটি তথ্যচিত্র ‘অর্ডিনারি ফ্যাসিজম’-এ দেখি গাছের ডাল থেকে একটা লাশ ঝুলছে এবং সেটির পাশে রাইফেল হাতে, হাস্যময় এক সৈন্য গর্বিত ভঙ্গিতে একটা ছবি তুলছে। সেই ছবি তার পকেটে পাওয়া গেছে, এরই সঙ্গে পাওয়া গেছে স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে তার পারিবারিক ছবি। ‘শত্রু’কে গুলি করে মারছে, সেই ফটোর সঙ্গে সেঁটে আছে সুখী পরিবারের ছবি। কী অদ্ভুত সহাবস্থান! প্রেম, ভালবাসার পাশাপাশি নরহত্যা! একজন গৃহস্থ ছাপোষা মানুষ, যে শান্ত নিরীহ জীবনযাপন করে, সে কোন মন্ত্রবলে হিংস্র হয়ে ওঠে, যাতে খুন, হত্যা, লুঠতরাজও তাকে বিচলিত করে না, উল্টে সে গর্ববোধ করে? একজন আপাত নিরীহ মানুষ কীভাবে নিজের সত্তাকে উন্মত্ত ভিড়ে বিলীন করে দেয়? দলিতদের নগ্ন করে প্রহার এবং তাদের ঘিরে ধর্মান্ধদের উল্লাসে সে সামিল হয়ে যায়, সেই ভিডিও সে বাড়ি গিয়ে তার পরিবারকে দেখায়। অসহায় মুসলিমদের ‘জয় শ্রী রাম’ বলতে বাধ্য করার জন্য রাস্তায় ফেলে পেটানোর ছবি সে সমাজমাধ্যমে সবার সঙ্গে শেয়ার করে! ধীরে ধীরে ন্যায়-অন্যায়, শুভ-অশুভ, মঙ্গল-অমঙ্গলের ভেদাভেদ তার কাছে ধূসর হয়ে যায়। সব কিছু গা সওয়া হয়ে, সে হয়ে ওঠে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া একটি মাংসপিন্ড মাত্র।

 

আর এমনটা তো নয় যে এটা অল্প কিছু মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। আপাদমস্তক একটা জাতি কীভাবে এইরকম হৃদয়হীন, চেতনালুপ্ত জড়ভরতে পরিণত হয়? কর্তৃত্বের কাছে এই প্রশ্নহীন আনুগত্য, অসহায় বশ্যতার কী ব্যাখ্যা আছে? একনায়কতন্ত্রী শাসনের কাছে এই আত্মসমর্পণ সম্পর্কে তৎকালীন সময়ে ভিয়েনার মনোরোগ চিকিৎসক ডক্টর উইলহেলম স্তেকেলের একটা তত্ত্ব আছে। তিনি বলছেন প্রত্যেক শিশুর মধ্যে তার সহজাত প্রবৃত্তি এবং তার অভিভাবকরা সমাজের সঙ্গে তাকে মানানসই করে তুলতে প্রতিনিয়ত তাকে যা শেখাচ্ছে, এই দু’টোর মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব চলে। ধরা যাক সে খুব দুষ্টু, এটা ভাঙছে ওটা ভাঙছে। তাকে শান্ত করার চেষ্টা চলে, মাঝে মাঝে বেচারি চড় চাপাটিও খায়। সে স্বাভাবিক ভাবে যে রকম থাকতে চায়, সে রকম থাকতে দেওয়া হয় না। এর ফলে ছোট থেকেই সমাজ সম্পর্কে সে বিরূপ হয়। যদি সে খুব ডানপিটে হয়, তাহলে ছোট থেকেই বিদ্রোহ করে। কিন্তু প্রায় সবাই এই কর্তৃত্বের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়, নিজেকে পাল্টায়। ধাপে ধাপে তাকে নানা কর্তৃত্বের মোকাবিলা করতে হয়- বাবা, মা, পাড়ার দাদা, শিক্ষক, সমাজ এবং অবশ্যই ধর্ম। কোনও কর্তৃত্ব দিয়েই যখন তাকে বাগ মানানো যায় না, তখন বলা হয় ‘ঈশ্বর তোমাকে সাজা দেবেন’। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ জুড়ে একটা টালমাটাল অবস্থা, সমস্ত কর্তৃত্ব ভেঙে পড়তে থাকে। এমনকি মানুষ ধর্মের প্রতিও আস্থা হারিয়ে ফেলে, কারণ ঈশ্বরের উপস্থিতি সত্ত্বেও একটা সর্বনেশে যুদ্ধ হতে পারে, যাতে প্রায় এক কোটি মানুষ মারা যায়। সবরকম কর্তৃত্বই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। সমাজে একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়। আবার অন্যভাবেও শূন্যতা তৈরি হয়, যখন সমস্ত রাজনৈতিক দল চূড়ান্ত ব্যর্থ, অকর্মণ্য, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রমাণিত হয়। সরকার হয়ে পড়ে জড়ভরত, দিশাহীন। তখন মানুষ এক রক্ষাকর্তা খোঁজে, যে তাকে এই অবস্থা থেকে মুক্তি দেবে। এই ধরনের সন্ধিক্ষণে বিভিন্ন দেশে একনায়কদের উত্থান ঘটে। মানুষ কর্তৃত্বের চাপে যেমন অস্বস্তি বোধ করে, আবার কোনওরকম কর্তৃত্ব ছাড়া সে বাঁচতেও পারে না, দিশাহীন হয়ে পড়ে। এই একনায়করা তাদের বিকল্প পিতা, অভিভাবক হয়ে দাঁড়ায়, হয়ে দাঁড়ায় তাদের উদ্ধারকর্তা।

 

নরেন্দ্র দাভোলকার ‘মহারাষ্ট্র অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি’র প্রতিষ্ঠাতা এবং জাতপাত, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে অক্লান্ত এক সৈনিক ছিলেন। ওঁর কাজের কারণে উনি ধর্মান্ধদের চক্ষুশূল হয়ে পড়েন এবং 2013 সালে কতিপয় আততায়ীর গুলিতে তিনি নিহত হন। ‘বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সমাজে অনুপস্থিত কেন’ এই শিরোনামে ওঁর একটা প্রবন্ধ আছে। ভারতীয় সমাজে স্বৈরাচার যে কেন মাঝেমধ্যেই মাথাচাড়া দেয়, সেটা সম্পর্কে এই প্রবন্ধে কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনি মনে করেন আমাদের সমাজে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুপস্থিত হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে- (1) পরিবারে কর্তৃত্ববাদ, (2) মহান ব্যক্তিকে দেবত্ব প্রদান, (3) ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা প্রশ্নাতীত ভাবে মেনে নেওয়া এবং (4) প্রশ্ন না করার অভ্যাস। আমরা পরিবারে সমস্ত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে পিতৃদেবের মুখাপেক্ষী। ছোট বড় যাবতীয় সমস্যার সমাধান একমাত্র তাঁর কাছেই আছে। পরিবারে পিতার এই সার্বিক আধিপত্যের কারণে আমরা স্বাধীনভাবে নিজেরা চিন্তা করার, ভিন্নভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারি না। আমরা ভাবতেই পারি না যে, 20 বছরের পুত্র বা কন্যা 50 বছরের বাবার চেয়ে আরও উৎকৃষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এইভাবে অঙ্কুরেই আমাদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ইচ্ছা অবদমিত হয়ে যায়। যে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকি। দ্বিতীয়ত, মহান ব্যক্তিদের ওপর দেবত্ব প্রদান করা আমাদের স্বাভাবিক প্রবণতা। তাঁদের কোনও সমালোচনা আমরা সহ্য করতে পারি না। তাঁদেরও যে সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, এটা আমরা মানতেই চাই না। এই ধরনের মানসিকতা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। একইভাবে বিভিন্ন ধর্মীয় রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান যেগুলো পরম্পরাগত ভাবে চলে আসছে, সেগুলোকে আমরা সমালোচনার ঊর্ধ্বে মনে করি। বিভিন্ন কুসংস্কার সমাজের পক্ষে ক্ষতিকারক হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র ঐতিহ্যের খাতিরে এখনও অনুসরণ করা হয়। সেগুলো উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমাদের নেই। উনি একটা উদাহরণ দিচ্ছেন। বিবাহের সময় দম্পতিকে আশীর্বাদ করার জন্য তাদের মাথায়, শরীরে আমরা ধান ঢালি। চারদিকে ধান ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিটি বিয়েতে এইভাবে 5 থেকে 10 কেজি ধান নষ্ট হয়। মহারাষ্ট্রে প্রতি বছর 3 লক্ষ বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়, যার অর্থ প্রায় 20 থেকে 30 লক্ষ চাল প্রতি বছর পদদলিত হয়। ক্ষুধা যে দেশে সর্বব্যাপী, সেখানে এইভাবে শস্য নষ্ট করার কি যুক্তি আছে? দাভোলকার বলছেন, আমাদের সামাজিক কাঠামো এবং শিক্ষাব্যবস্থা প্রশ্ন করার অভ্যাসকে উৎসাহ দেয় না। এই কারণে কর্তৃত্ব বা ক্ষমতার কাছে আনুগত্য স্বীকার করা অল্প বয়স থেকেই সমাজের একটা বড় অংশের মানুষের মধ্যে মজ্জাগত হয়ে যায়। বাকিটা এরপর সহজ। যে প্রশ্ন করে না এবং সহজে বশ্যতা মেনে নেয়, সে কোনও দল, ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের প্রতি সহজেই দ্বিধাহীন ভাবে অনুগত হয়ে যায়। কিছু কল্পিত কারণ খাড়া করে সহজেই তার মধ্যে ঘৃণা, বিদ্বেষ জাগিয়ে তোলা যায়। যেমন- অন্য সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে, তাদের অতিরিক্ত তোষণ করা হচ্ছে, নীচু জাত মাথায় চড়ে বসছে, বহির্শক্তির কারণে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে, প্রেম করার অজুহাতে ধর্মান্তকরণ হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই কল্পিত অভিযোগগুলো ভাঙা রেকর্ডের মতো বারবার বাজিয়ে যেতে হবে এবং এমন একজন নেতাকে তুলে ধরতে হবে, যার কাছে সব সমস্যার সমাধান আছে। তিনি শুধু মহামানবই নন, তিনি দেবতুল্য, অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী।

 

আরও পড়ুন: ফ্যাসিবাদের শেষ পর্যায় চলছে কি?

 

হিটলারের বশংবদ এক কুখ্যাত ট্রেড ইউনিয়ন নেতা রবার্ট লে একটা মানুষের বশীকরণ বাস্তবে কী প্রক্রিয়ায় ঘটে সেটা বর্ণনা করেছেন। “আমরা শিশুর তিন বছর বয়স থেকে কাজ শুরু করি। যখনই তার চিন্তার ক্ষমতা গড়ে ওঠে, তার হাতে একটা পতাকা ধরিয়ে দেওয়া হয়; তারপর স্কুল, হিটলার জুগেন্ট (যুব বাহিনী), এস.এ (স্ট্রমট্রুপার্স বা ঝটিকা বাহিনী) এবং সামরিক প্রশিক্ষণ। ...এছাড়া শ্রমিক সংগঠন আছে এবং ভাল লাগুক বা না লাগুক মৃত্যুর আগে তার আর ছাড় নেই।“ বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই আমাদের দেশে সংকীর্ণ হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রবক্তারা নানা সংগঠনের একটি বিস্তৃত জাল তৈরি করার প্রস্তুতি শুরু করে, যাতে অল্প বয়স থেকেই মগজ ধোলাই শুরু হয়ে যায়। ‘ইনসাইড ইউরোপ’ বইয়ে জার্মানিতে ফ্যাসিবাদের উত্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিখ্যাত আমেরিকান সাংবাদিক জন গান্থার বলছেন, ‘বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে একটা বাইপোলার আজ্ঞানুবর্তিতা নিহিত থাকে, শাসন করা এবং শাসিত হওয়া।‘ এই কারণে হিটলার গ্রামেগঞ্জে, শহরে, মফঃস্বলে অনেক ছোট ছোট ফুয়েরার সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোনও আদেশ এদের কাছে ছিল দৈব কর্তব্যের মতো। হ্যানা এদেরই একজন। যে কারণে পরিণতির কথা না ভেবে দিনের পর দিন বাচ্চা এবং মহিলাদের সে গ্যাস চেম্বারে ঠেলে দিয়েছিল।

 

মানুষের ওপর কর্তৃত্ব ফলানো যায় শক্তি প্রয়োগ করে, ক্ষমতা জাহির করে, ভয় দেখিয়ে। অত্যন্ত স্থূল ভাষায় হিটলার এই ক্ষমতার বর্ণনা করেন। তাঁর মতে, জনতা হচ্ছে নারীর মতো, যত ক্ষমতা প্রয়োগ করবে, তত তারা বশীভূত হবে। তা সত্ত্বেও হিটলার নারীদের মধ্যে প্রবলভাবে জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর যে কোনও সমাবেশে নারীদের উপস্থিতি ছিল লক্ষনীয়। সেই সময়কার নিউজরিল, তথ্যচিত্রে দেখা যায় ফুয়েরারকে ছোঁয়ার জন্য তাদের মধ্যে কী অভূতপূর্ব উন্মাদনা। তাঁর ভাষণ শুনে মহিলারা আপ্লুত হয়ে যেত। তাদের দিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলতেন, ‘যতদিন বাঁচব আপনারা আমার, আমি আপনাদের’। তাদের প্রিয় নেতাকে উপহার হিসেবে পাঠানো পাহাড়প্রমাণ মোজা, দস্তানা পাওয়া গেছে যুদ্ধের পর। বাহুবলের ওপর এই নেতার ছিল অপরিসীম আস্থা। পরিষ্কার বলতেন, ‘আমার এমন যুবক দরকার, খুন করতে যার হাত কাঁপবে না; তাতে সে দুর্নীতি করলেও কিছু যায় আসে না’। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি তো এখনও হয়ে চলেছে। তবে এখন ক্রুরতার কোনও স্থান নেই, সবকিছুই করা হয় হাসি মুখে। হাসি মুখে মহামারীর অজুহাতে অধিবেশন মুলতুবি রাখা হয়, প্রশ্নোত্তর পর্ব বাতিল করে দেওয়া হয়, মানুষের রুটিরুজি সংক্রান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সব বিল বিনা আলোচনায় পাস করিয়ে নেওয়া হয়। এটা হল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার দাপট, সংসদীয় ফ্যাসিবাদ। আক্রমণকারীদের বানিয়ে দেওয়া হয় ‘আক্রান্ত’, প্রতিবাদীরা হয়ে যান ‘সন্ত্রাসী’, সমাজকর্মীরা হয়ে যান ষড়যন্ত্রের ‘চক্রী’। সরকার বিরোধী সমস্ত কন্ঠস্বর হয়ে যায় ‘দেশদ্রোহী’। সন্ত্রাসের এক দমবন্ধ বাতাবরণ তৈরি করার জন্য সদা প্রস্তুত শাসকদলের সরাসরি মদতপুষ্ট হাড়হিম করা নানা কিসিমের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী। প্রতিবাদকারীদের ওপর ধর্মের ভেকধারী এইসব বাহিনী নৃশংস আক্রমণ চালায়, নির্বিচারে হত্যা করে। উদাহরণ- জেএনইউ, জামিয়াতে হামলা, দিল্লি হত্যাকান্ড, সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের ওপর উত্তরপ্রদেশে নৃশংস দমনপীড়ন।

 

কিন্তু ভয়ের একটা সীমাবদ্ধতা আছে। ভয়ের ওপর ভিত্তি করা কাঠামোতে একবার চিড় ধরলে সেটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। এই ‘মহান’ নেতা চান তার দল এবং বশংবদ অনুগামীরা যে কর্মসূচি ঠিক করেছে, তাতে মানুষ যেন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সামিল হয়। নেতা চান প্রত্যেক ব্যক্তি স্বেচ্ছায় তাঁকে সমর্থন করবে, প্রত্যেকে উপলব্ধি করবে যে, নেতা যা করছে তা দেশের ভালর জন্যই করছে, তাদের উন্নতির জন্য, নিরাপত্তার জন্য করছে। তিনি থাকলে আর কোনও ভয় নেই, এইভাবেই তাঁর ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে হবে। এটা করার জন্য তখনও মূল অস্ত্র ছিল প্রচার, এখনও তাই। বলার অপেক্ষা রাখে না নাৎসি জার্মানিতে এই প্রচারের প্রাণপুরুষ ছিলেন হিটলার স্বয়ং, যার বাগাড়ম্বর, মিথ্যাভাষণ, বিষবাক্য ফ্যাসিবাদকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছিল। ভবিষ্যতের নিরিখে আরও যেটা গুরুত্বপূর্ণ, হিটলারি বিষবাক্যপটুতা সর্বকালের জন্য মানুষ খেপানো ভাষণের একটা সংজ্ঞা তৈরি করে দিল। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রনেতারা এই নমুনা অনুসরণ করে ছলচাতুরি, প্ররোচনা, মিথ্যা ভাষণের মাধ্যমে, ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিভাজনের বিষ ছড়িয়ে সমাজে ভয়ঙ্কর সর্বনাশের বীজ বপন করতে কোনও দ্বিধা করেনি।

 

ফুয়েরারের ভাষণ সে দিক থেকে একটা বিস্ময়। শুধু বাকচাতুর্যের দ্বারা মানুষকে এইভাবে সম্মোহিত করা যায়, খেপিয়ে তোলা যায়- তা আগে কেউ কোনদিন ভাবতেও পারেনি। বিদ্বেষপূর্ণ ভাষণের মাধ্যমে মানুষের মধ্যেকার আদিমতম পাশবিক প্রবৃত্তি এইভাবে খুঁচিয়ে তুলতে পেরেছে কি কেউ কখনও? ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিভাজন, নির্বিকার মিথ্যাচার, ‘অপর’কে নিশানা করা এবং পুরোটাই আদ্যোপান্ত হিংসার মোড়কে আদিম ক্রোধ উদ্রেক করার একটা প্যাকেজ করে, শ্রোতাকে যুক্তি-বিবর্জিত আবেগে ভাসিয়ে দিতে তাঁর জুড়ি মেলা ছিল ভার। তাঁর প্রতিটি ভাষণে অবধারিত ভাবে দু’টি প্রধান বিষয় থাকতই। এক, জার্মানির সমস্ত দুর্দশার জন্য বিশেষ কিছু গোষ্ঠী, যেমন- ইহুদি, কমিউনিস্ট প্রমুখদেরই দায়ী করা। আর একটা দিক হচ্ছে জার্মান জাত্যাভিমান খুঁচিয়ে তোলা। এখানেও তাই। মহামারী হলে ‘করোনা জিহাদ’, ভিন্নধর্মে প্রেম করলে ‘লাভ জিহাদ’, মুসলিমের ঘরে যে কোনও মাংস আসলে গোমাংস, নাগরিকত্ব আইন নিয়ে প্রতিবাদ করলে সেটা হয়ে দাঁড়ায় সুগভীর আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সব ‘টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং’-এর আখড়া। এসবই সত্য প্রতিপন্ন করার জন্য নিয়মিত রেডিওতে প্রচারিত হয় মনগড়া সব ‘বাত’, টিভিতে দেখানো হয় সাজানো সাক্ষাৎকার, যেখানে নেতা বিব্রত হন, এমন সব প্রশ্ন সযত্নে পরিহার করা হয়; তিনি তো আমাদের ঘরের মানুষ, তাই তিনি আম খান কিনা জিজ্ঞাসা করা হয়!

 

এখনও ভাবলে অবাক লাগে যে জার্মানদের মতো একটা সভ্য, সুশৃঙ্খল জাতিকে দীর্ঘ প্রায় 15 বছর ধরে কীভাবে মিথ্যার মায়াজালে আবদ্ধ রাখা যায়? আরও আশ্চর্য লাগে যখন দেখি যে, মানুষ ইতিহাস বিস্মৃত হয়েছে এবং একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি এখনও এই দেশে ঘটে চলেছে। মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে, জাতীয় গর্ব, দেশের সম্মান ইত্যাদির ধুয়ো তুলে রকস্টারের মতো একনায়কের বিজয়রথ এখনও গড়গড়িয়ে চলছে। আর নিরন্ন, বিপন্ন মানুষ, অর্থনৈতিক কষ্টে জর্জরিত, পদে পদে বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, নিপীড়িত এদের পিছনেই পিলপিল করে দৌড়চ্ছে। তারা নিশ্চিত যে এই মানুষটা অভ্যন্তরীণ সব শত্রুকে কোণঠাসা করে দেবে, বহির্শক্তিকে টাইট দেবে এবং তাদের যাবতীয় সমস্যার সমাধান করে দেবে। এটা কি মনোবিজ্ঞানের ভাষায় যেটাকে বলে ‘সংঘবদ্ধ মানসিকতা’ বা ‘যূথ মানসিকতা’র (Herd Mentality) পরিণতি? সম্প্রতি এই ধরনের মানসিকতার একটা নমুনা দেখলাম। একটা হাইওয়ের মাঝখান দিয়ে লম্বালম্বি একটা সাদা লাইন টানা রয়েছে। দু’পাশে জঙ্গল। এক দল মহিষ জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে। প্রথম মহিষটা সাদা লাইনটা উঁচুতে বাধা আছে ভেবে একটা ছোট লাফ দিয়ে সেটা ডিঙিয়ে যায়। সেটা দেখে বাকি মহিষগুলোও লাফ দিয়ে লাইনটা ডিঙোয়। লাইনটা কিন্তু রাস্তার ওপর টানা আছে। কিন্তু কোনও মহিষ পরখ করে দেখে না, আদৌ লাফ দেওয়ার কোনও প্রয়োজন আছে কি না। মানুষের ক্ষেত্রে এটা কি একইভাবে ঘটে? লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন অধ্যাপক 2008 সালে এই ধরনের মানসিকতা যাচাই করার লক্ষ্যে একটা পরীক্ষা করেন। তাঁরা একটা বড় হলঘরে কিছু মানুষকে এলোমেলো হাঁটতে বলেন। এদের মধ্যে কয়েকজনকে আলাদা করে তাঁরা একটা নির্দিষ্ট পথ ধরে হাঁটতে বলেন। অবাক কান্ড হচ্ছে দেখা গেল যে, যাদের এলোমেলো হাঁটতে বলা হয়েছিল, তারা নির্দিষ্ট পথ ধরে যারা হাঁটছিল তাদের অনুসরণ করা শুরু করল। গবেষকরা বলছেন আমরা প্রত্যেকেই ভিড় কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বারা প্রভাবিত হই। এই ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে নিজেদের মধ্যে কোনও যোগাযোগ ছাড়াই তারা একটা সম্মিলিত সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাচ্ছে এবং অল্প কিছু সংখ্যকের দেখানো পথ অনুসরণ করছে। অনেকে হয়তো বুঝতেও পারছে না যে, তারা কিছু মানুষের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। দেখা গেছে 5% লোক আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে একটা নির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করলে, তারা বাকি 95% কে তাদের অনুসরণ করার জন্য প্রভাবিত করতে পারে। গণ উন্মাদনার উৎস হচ্ছে এই সংঘবদ্ধ মানসিকতা। এর জন্যই গণেশের দুধ খাওয়ার খবর রটে গেলে মানুষ পিলপিল করে সেটা দেখতে ছোটে, মিডিয়ার প্রবল প্রচারের সৌজন্যে বিশেষ নেতার সভায় মানুষের ঢল দেখা যায়, আই-ফোন কেনার জন্য যুবক-যুবতীরা রাত জেগে লাইন দেয়।

 

হিটলারের মৃত্যু এবং বার্লিনের পতনের পর বহু জার্মান আত্মহত্যা করেছিলেন। তারা একটা স্বপ্ন দেখেছিল, কিন্তু সেটার যে এই করুণ পরিণতি হবে, তা তারা ভাবতে পারেনি। কিন্তু এইসব মৃত্যুকে ছাপিয়ে সারা দেশ জুড়ে এক অস্বাভাবিক স্তব্ধতা বিরাজ করছিল, যেন ঘোর কেটে যাওয়ার পর একটা নিবিড় নিঝুম অবস্থা; একটা আবদ্ধ অবস্থা থেকে ছিন্ন হয়ে বেরিয়ে আসা, যূথবদ্ধ মানসিকতা থেকে অবশেষে মুক্তি পাওয়ার চাপা স্বস্তির নিশ্বাস। ইতিহাসের এই ভয়ঙ্করতম ঘটনা থেকে মানুষ কি আদৌ কোনও শিক্ষা নিয়েছে? বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে, যেখানে বহু বছর ধরে অন্যায়, অবিচার, অপশাসনজনিত ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে, যেগুলো যে কোনও সুসংগঠিত স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের অ্যাজেন্ডা পূরণের লক্ষ্যে ব্যবহার করতে পারে? তারা একটা কাল্পনিক বিপর্যয়ের আখ্যান, নানা অর্ধসত্য প্রচার করে মানুষের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করতে পারে। তারা বলতে পারে এক বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্য দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত, অনুপ্রবেশকারীদের জন্য ভূমিপুত্রদের রুটিরুজি বিপন্ন, ছাত্রছাত্রীদের জন্য দেশের ঐক্য সংকটে, দেশদ্রোহীদের জন্য দেশের উন্নতি ব্যাহত, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেশের সম্মান ক্ষুণ্ণ ইত্যাদি। প্রথমে অল্প কিছু মানুষ সমর্থন করে, কিছু সাফল্য আসে। এই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে সমর্থন বাড়ে, যূথবদ্ধ মানসিকতার প্রভাব বাড়তে শুরু করে, সমর্থনের ঢল নামে। আরও একটা একনায়কতন্ত্রের জন্ম হয় এবং আবারও দীর্ঘ যন্ত্রণার পর বহু মানুষের প্রাণের বিনিময়ে মুক্তি আসে। আমরা কি সেইরকম একটি পর্বের মধ্য দিয়ে পরিব্রাজন করছি?

 

সূত্র- ডক্টর নরেন্দ্র দাভোলকারের প্রবন্ধের অংশটি ‘দ্য রিপাব্লিক অফ রিজন’ বই থেকে অনুবাদ করা হয়েছে।


New
মাদক ব্যবসা ও বিভাজনের রাজনীতির আবর্তে আজকের মণিপুর
ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে রাষ্ট্রীয় মদত? বিস্ফোরক রিপোর্ট অসম রাইফেলসের
বিরোধী জোট আছে, রাজনীতি কই?


Other Writings by -সোমনাথ গুহ | 11-01-2021

// Event for pushed the video