4thPillar


বড় ভাই সব দেখছে!

সোমনাথ গুহ | 03-03-2021May 24, 2023
বড় ভাই সব দেখছে!

চন্দন স্যারের পসার এমনিতে ভালই। ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। পাড়ার নতুন শপিং মলে গিয়ে প্রায়ই এটা সেটা নাড়তে চাড়তে সটান পকেটে চালান করে দেন তিনি। দাম দেওয়ার সময় যেগুলো নিতান্তই বড় জিনিস, খালি সেগুলোর বিল মেটান। বলাই বাহুল্য কেউই বিশ্বাস করতে পারবে না। তিনি নিজে ভাবেন কেউ কিচ্ছু টের পায়নি। আসলে কিন্তু ভিডিও ফুটেজে সব ধরা আছে। মল মালিকের ছেলে স্যরের ছাত্র, তাই বিষয়টি পাঁচ কান হয়নি!

 

চন্দন স্যার ভাবেন, তাঁকে কেউ দেখছে না, নিরাপত্তা কর্মী নেই, অতএব...। কিন্তু আসলে শপিং মলের শ'খানেক নজরদারি ক্যামেরা তাঁর দিকে তাক করা। কোনওটা লক্ষ্য করলে দেখা যায়, কোনওটা সাধারণ লোকের বোঝারই উপায় নেই। সিসিটিভি কন্ট্রোল রুমের লোকগুলো করেটা কী! এতদিনে একবারও ধরতে পারল না চন্দন স্যারকে? তারা কী করে সেটা কিছুদিন পরই জানা গেল। মেয়েদের পোশাকের ট্রায়ালরুমে গোপন ক্যামেরা পাওয়া গিয়েছে সেই শপিং মলেই! সেই নিয়ে হুলুস্থুল পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে!

 

ওই শপিং মলটির নাম ভারত রাষ্ট্র। তার নাগরিকের বেডরুমে, বাথরুমে সিসিটিভি বসানো হয়নি। ক্যামেরাই কী আর একমাত্র নজরদার নাকি! ডিজিটাল যুগের চোর ও চর সকলেই ডিজিটালপন্থী। তাই ফেসবুক,  হোয়াটসঅ্যাপ বা টুইটার যাতেই লিখুন, আপনি নজরদারির মধ্যেই থাকছেন। গোপন চ্যাট বা ভিডিও কল যার সঙ্গে করছেন, শুধু তিনিই জানছেন এমনটা নয়। কীভাবে? খুব সহজ। আপনার অজান্তেই আপনার ব্যবহৃত ডিভাইসে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে অজস্র ডিজিটাল গুপ্তচর, যাদের বলে ম্যালওয়্যার। একের পর এক সফটওয়্যার বা অ্যাপ যখন ইনস্টল করছেন, তখন সেইসব ম্যালওয়্যার পারমিশন পেয়ে আপনার যাবতীয় ব্যক্তিগত তথ্য পৌঁছে দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে। সেখান থেকে ‘পুলিশে’র চোর ধরার খবর পৌঁছে যাবে ‘বাবু’-র কাছে।

 

কীভাবে চলে আপনার উপর নিরন্তর নজরদারি

 

বিশ্ব নজরদারি বিদ্যাকেন্দ্রের পরিচালক, বিশিষ্ট সমাজতত্ত্ববিদ, অধ্যাপক ডেভিড লিওন-এর মতে, নজরদারি বা সার্ভেইল্যান্স এর মূল কথা হল - "focused, systematic and routine attention to personal details for purpose of influence, management, protection, or direction."

 

এই সংজ্ঞার ভিত্তিতে বলা যায় সরকারের উদ্দেশ্য আসলে মহৎ। নিরাপত্তা প্রদান এবং সঠিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে জনতার ব্যক্তিগত খুঁটিনাটি তো পর্যবেক্ষণে রাখতেই হবে। তাতে ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়ে টেস্ট টিউবে পর্যবেক্ষণে রাখা একগাদা রোগ-জীবাণুর মনিটরিং-এর সঙ্গে মিল খুঁজে পেলে, আপনার মনে চোর চোর ভাব বলতে হবে। যুক্তিও তাই, আপনি যদি চুরি না করেন, তবে নজরদারিতে ভয় কিসে!

 

‘ডিজিটাল যুগে গণ নজরদারি: রাষ্ট্র ও মানবাধিকার’ বইয়ে বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্র লিখছেন, “ভারত-সহ সর্বত্র সুপ্রিম কোর্টের রায় বলুন, ইউরোপীয় কনভেনশন বা রাষ্ট্রসংঘ বলুন, এমনকি আর্টিকল 19-সহ অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী মানবাধিকার সংগঠনের 2019 সালের 23 মে জোহানেসবার্গের নীতিগত ঘোষণাই বলুন...সর্বত্র আপনি পাবেন নজরদারি করারই অনুমোদন; অবশ্য শর্তসাপেক্ষে!”

 

আরও পড়ুন: চমৎকার ইঁদুর ধরছে গেরুয়া বিড়াল

 

লেখক এই বইতে বিভিন্ন প্রসঙ্গ টেনে এনে দেখিয়েছেন যে, বড় নজরদারির খেলাটা সরকার ‘জাতীয় নিরাপত্তা’, ‘জন বিশৃঙ্খলা’ ইত্যাদির প্রয়োজনে পরিমাণ বুঝে চালায়। এতে প্রশ্ন করার কিছু নেই। ‘নৈরাজ্যবাদী’ দার্শনিক বার্গস্টাইন যেমন বলেছিলেন রাষ্ট্র যে কোনও কুকর্ম করতে পারে ‘in the name of state’! এদিকে আমরা ছোটবেলা থেকে জেনে আসছি কেবল দুইক্ষেত্রেই সবকিছু সম্ভব, প্রথমটি ভালবাসায় এবং দ্বিতীয়টি যুদ্ধে (Anything is fair in love and war), অতএব এই অভিনব খেলা জনতার প্রতি রাষ্ট্রের ভালবাসা না যুদ্ধ, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

 

ভীমা কোরেগাঁও মিথ্যা মামলায় কিছু মানুষ প্রায় দু’বছর ধরে বন্দি। তাঁদের ‘কম্পিউটারের তথ্য’ নাকি সব ‘দেশবিরোধী’। তাঁরা নাকি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কম্পিউটারের মাধ্যমে, ই-মেলের মাধ্যমে তাঁরা এই ষড়যন্ত্র চালাতেন বলে অভিযোগ!

 

এনআইএ জানায় যে ‘কমিটি ফর রিলিজ অফ পলিটিকাল প্রিজনার্স’-এর সম্পাদক রোনা উইলসনের কম্পিউটারে এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সমস্ত চিঠি ও অন্যান্য তথ্য পাওয়া গেছে। সেই তথ্যপ্রমাণ অনুযায়ী দীর্ঘ আড়াই বছরে ভীমা কোরেগাঁও মামলার সঙ্গে যুক্ত সুধা ভরদ্বাজ, ভারভারা রাও, গৌতম নওলাখা, স্ট্যান স্বামী সহ পনেরো জন আইনজীবী, সমাজকর্মী এবং সাংস্কৃতিক কর্মীরা গ্রেপ্তার হয়েছেন। মজার ব্যাপার হল এতদিনেও প্রমাণস্বরূপ সেইসব চিঠি ও তথ্যের কোনওকিছুই আজ অবধি আদালতে পেশ করা হয়নি।

 

অধ্যাপক ডেভিড লিওন নজরদারি বিদ্যা প্রসঙ্গে তাঁর এক গ্রন্থে বলেছেন : "It is difficult for a human to reproduce speech exactly, but it is very easy to reproduce written words. Like written words, digital information is encoded into discrete and reproducible components." এই বার্তা মাথায় রেখে ডিজিটাল সচেতনামূলক একটি গানের লাইন হতে পারে ‘তোমার মহাবিশ্বে কিছু হারায় নাকো কভু।‘ যা একবার টাইপ করে আপনার ডিভাইস থেকে সেন্ড করে ফেলেছেন, সেটি অবিনশ্বর। প্রয়োজনে কফিন খুঁড়ে তা বার করা যাবে। আপনার ডিলিট করে দেওয়া বেফাঁস মন্তব্য সাইবার সেলের চোখ এড়াবে না। কারণ ডিজিটাল মেমরি আর মনুষ্য মস্তিষ্কের স্মৃতি এক কথা নয়। কম্পিউটার কিছু ভোলে না। অন্যদিকে প্রয়োজনে কাউকে ‘দেশদ্রোহী’ প্রমাণ করতে সেই নাগরিকের যাবতীয় ব্যক্তিগত তথ্যের বিন্যাস বদলে দিতে পারে রাষ্ট্র। ব্যক্তিগত কম্পিউটারে একটি ম্যালওয়্যার ঢুকিয়ে দেওয়া রাষ্ট্রের কাছে বাঁ হাতের খেল মাত্র। রাষ্ট্রের কাছে আমরা কতটা অসহায়- তা ভাবার দিন আগেই পেরিয়ে গিয়েছে। এখন বুঝতে হবে যে, চন্দন স্যারের ভাগ্য সকলের হয় না। আমাদের যাবতীয় কর্মকান্ড ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রের নজরদারিতে বন্দি।

 

সরকারের কানাকড়ি খরচাও নেই, স্বেচ্ছাসেবক হাজির

 

সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সাইবার ক্রাইম সেল সাইবার ভলেন্টিয়ার তৈরি করার একটি প্রকল্প শুরু করেছে (indianexpress.com-february 9, 2021)। প্রকল্পটি পরীক্ষামূলক ভাবে প্রথমে জম্মু কাশ্মীর ও ত্রিপুরায় শুরু হবে। এই ভলেন্টিয়াররা সোশাল মিডিয়ায় পর্নোগ্রাফি, ধর্ষণ, সন্ত্রাসবাদ এবং যে কোনও ধরনের বেয়াদপির পাশাপাশি রাষ্ট্রবিরোধী মন্তব্য বা অন্যান্য ক্ষতিকর বিষয়বস্তু চিহ্নিত করে তা সরকারের কাছে রিপোর্ট করবেন। তাঁরা বিশেষ করে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা যাতে অক্ষুন্ন থাকে সেদিকেই নজর দেবেন। অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কহানি হয় বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে, এমন কোনও পোস্ট সোশাল মিডিয়ায় বরদাস্ত করা হবে না। ব্যক্তি-স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ? একেবারেই না, দেশের ভালর জন্য সব ভাল। যাক সে কথা, ভলেন্টিয়ারদের আইডেন্টিটি গোপনই থাকবে। এঁরা কাজও করবেন চুপিচুপি। অর্থাৎ, কে চোর, তা এই এক্ষেত্রে ধরবেন স্বয়ং চোর। তাঁর হাতে অভূতপূর্ব ক্ষমতা, যা তিনি প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করতে পারেন। নরেন্দ্র মোদী সরকার এই ক্ষেত্রেও দেশপ্রেমের তাসটি বাড়িয়ে দিয়েছে। বলা হচ্ছে দেশের জন্য যাঁরা নিবেদিত এই প্রকল্প তাঁদের জন্যই। যাঁরা স্বেচ্ছায় কাজ করতে ইচ্ছুক এটি তাঁদের একত্রিত করবে।

 

আপনার প্রতিবেশীও এহেন স্বেচ্ছাসেবী চর হতে পারেন। মন খুলে নিজের ব্যক্তিগত কথা যে বন্ধুকে এতকাল জানিয়ে আসছেন, সেই বন্ধুই আপনার সব তথ্য অন্যদিকে চালান করে যাচ্ছেন হয়তো।

 

সরকারি নজরদারির দশ অবতার

 

তবে কি আমরা জর্জ অরওয়েলের ‘1984’ উপন্যাসের ‘বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং’ পর্বে প্রবেশ করে গেলাম? শ্রী ভদ্র এই ব্যাপারে নিশ্চিত। তিনি লিখছেন, “...‘নতুন ডিজিটাল ভারতে’ 2000 সাল থেকে অন্যান্য দেশের মতোই ডিজিটাল নজরদারির লক্ষ্যে আইন, নিয়মকানুন, বিধি 2019 সাল পর্যন্ত রচিত হয়েছে, যা নাগরিক অধিকার তথা ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং করবে।” 2000 সালে  ‘The Information Technology Act’ রচিত হয়, যা 2008 সালে সংশোধিত হয়। 2009 এ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ, তথ্য পড়া, বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা সরকারি সংস্থাগুলোর হাতে দেওয়া হল।

 

ভারতের সংবিধানে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে আলাদা কোনও আইন নেই। কিন্তু 2017 সালে কেএস পুত্তুস্বামী মামলায় সর্বোচ্চ আদালত তথ্য-সংক্রান্ত ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে সাংবিধানিক অধিকার বলে স্বীকার করেছেন। যদিও সেই মামলার ইতিবাচক দিকগুলিকে অস্বীকার করে 2018-র ডিসেম্বরে এক নতুন প্রশাসনিক নির্দেশে ভারতকে পুরোপুরি নজরদারি রাষ্ট্র বানানো হয়। এই নির্দেশ অনুযায়ী, “সরকারি 10টি সংস্থা যে কোনও ‘কম্পিউটার রিসোর্স’-এ সংরক্ষিত, অথবা নেওয়া হয়েছে অথবা পাঠানো হয়েছে, অথবা সেখান থেকে উৎপাদিত হয়েছে- এমন যে কোনও তথ্যের ওপর নজরদারি চালাতে পারবে, হস্তক্ষেপ করতে পারবে ও তার encryption ভেঙে পড়তে, শুনতে, নথিভুক্ত করতে পারবে।”

 

এই দশটি সংস্থা হল: আইবি, নারকোটিকস কন্ট্রোল ব্যুরো, ইডি, কন্ট্রোল বোর্ড অফ ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস, ডিরেক্টরেট অফ রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স, সিবিআই, এনআইএ, র’ (RAW), দিল্লি কমিশনের অফ পুলিশ এবং জম্মু কাশ্মীর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও অসমের জন্য ডিরেক্টর অফ সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স। ‘কম্পিউটার রিসোর্স’ বলতে বোঝায় কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডেটা, কম্পিউটার ডেটাবেস অথবা সফটওয়ার এবং মোবাইল ফোন। অতএব সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই বড়দা আমাদের ওপর কড়া নজর রাখছেন। এখন আমরা আপাদমস্তক সুরক্ষিত। দেশে কোনও অনিয়ম নেই, সন্ত্রাস নেই। গর্বের সঙ্গে চন্দন স্যার আজ ছাত্রদের বলতে পারেন- ‘একদম ওর খাতা দেখে টুকবে না। চুরিবিদ্যা শিখে কী আর বড় হওয়া যায়!’ আমরা এখন পুরোপুরি নজরদারি রাষ্ট্রে অবস্থান করছি।

 

অতএব চন্দন স্যার, সাবধান! ওরা কিন্তু সব জানে! আপনাকে না ধরার একমাত্র কারণ, এখনও ধরার দরকার নেই।

 

(লিখন সহায়তা: তিয়াস বন্দ্যোপাধ্যায়)


New
মাদক ব্যবসা ও বিভাজনের রাজনীতির আবর্তে আজকের মণিপুর
ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে রাষ্ট্রীয় মদত? বিস্ফোরক রিপোর্ট অসম রাইফেলসের
বিরোধী জোট আছে, রাজনীতি কই?


Other Writings by -সোমনাথ গুহ | 03-03-2021

// Event for pushed the video