ঠিক এক বছর আগে, 15 ডিসেম্বর, 2019 সন্ধ্যাবেলায় দিল্লির হাড়কাঁপানো শীতে মানুষ যখন জবুথবু, তখন এক বিশাল পুলিশ বাহিনী জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা করে। তার ঠিক চার দিন আগে সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) অনুমোদিত হয়েছে। সংখ্যালঘুদের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক এই আইনের প্রতিবাদে সারা দেশ জুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়ে গেছে। রাজধানীও অশান্ত। সকাল থেকে ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে সমবেত হয়েছে। সেখান থেকে কিছুটা দূরে কে বা কারা বাসে অগ্নিসংযোগ করেছে, হিংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়েছে। দায়টা অবশ্যম্ভাবী ভাবে এসে পড়ে এই তরুণ তরুণীদের ওপর। তারা বারবার অস্বীকার করে, কিন্তু পুলিশের তো একটা বাহানা দরকার। বাস্তবে কে হিংসা ছড়িয়েছে সেটা খুঁজে বার করতে তাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। আজাদি, আজাদি করে স্লোগান দেওয়া ওই বেয়াদপ ছেলেমেয়ে গুলোকে তারা সবক শেখাতে চায়। অন্ধকার ঘনিয়ে আসতেই শুরু হয় নৃশংস আক্রমণ, ছাত্রছাত্রীরা দিশাহারা হয়ে পড়ে, ছত্রভঙ্গ হয়ে পালানোর চেষ্টা করে। পুলিশ বেপরোয়া। কর্তৃপক্ষের অনুমতির পরোয়া না করে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে প্রবেশ করে, পাঠাগারের ভিতরে ঢুকে পড়ুয়াদের ওপর আক্রমণ করে। কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে, পাঠরত পড়ুয়াদের বেধড়ক লাঠিপেটা করে। কয়েকজন একটি পাশের বাড়িতে লুকোনোর চেষ্টা করে, কিন্তু পুলিশ তাদের পিছন নেয় এবং এক ছাত্রকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে আসে। ক্রমাগত লাঠিবর্ষণ হতে থাকে তার ওপর। তাকে বাঁচানোর মরিয়া প্রচেষ্টায় চার পাঁচটি মেয়ে এসে ছেলেটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাকে আড়াল করে তারা একটা বলয় তৈরি করে। ইতিহাসের ছাত্রী, কেরালার মেয়ে আয়েষা রেনা আঙুল তুলে পুলিশকে পাল্টা হুমকি দেন। তরুণীদের এই অগ্নিমূর্তি দেখে পুলিশ পিছু হঠতে বাধ্য হয়। বন্ধুকে বাঁচানোর জন্য ছাত্রীদের এই অসমসাহসী কীর্তি সারা দেশে ভাইরাল হয়ে যায়। আয়েষার রণমূর্তি হয়ে যায় সিএএ-এনআরসি-এনপিআর বিরোধী দেশব্যাপী আন্দোলনের প্রতীক।
সেই শুরু। সিএএ-র যে প্রাথমিক রূপরেখা প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বলা হচ্ছে যে 31 ডিসেম্বর, 2014 অবধি পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পার্সি ও খ্রিষ্টান ধর্মের যে সব মানুষ ভারতে এসেছেন, তাদের অবৈধ অভিবাসী হিসাবে গণ্য করা হবে না। মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষদের এই তালিকাভুক্ত করা হয়নি যা চরম বৈষম্যমূলক। এর আগে অসমের এনআরসি-তে প্রায় 20 লক্ষ মানুষ বাদ পড়েছেন। সিএএ করে কেন্দ্রীয় সরকার বোঝাতে চাইল যে, মুসলিম বাদে যারা তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন তারা এই নয়া আইনের মাধ্যমে নাগরিকত্ব পেতে পারেন, যা একটা চূড়ান্ত ধাপ্পা ছাড়া কিছু নয়। 2014 সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর গো-পাচার এবং গো-ভক্ষণের অজুহাতে সংখ্যালঘুদের ওপর ক্রমাগত আক্রমণ নামিয়ে আনে। 2015 থেকে তথাকথিত গোরক্ষা সংক্রান্ত 115টি ঘটনায় 46 জন মারা গেছেন, আহত হয়েছেন 146 জন। ধারাবাহিক এই ধরনের আক্রমণের ফলে মুসলিমরা মানসিকভাবে দুর্বল ও রক্ষণাত্মক হয়ে পড়েন। দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর সরকার আরও আগ্রাসী হয়। সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তারা পরপর আইন প্রণয়ন করে। তিন তালাক আইনে পুরুষদের শাস্তির বিধান, 370 ধারা বিলোপ এবং সর্বোপরি অযোধ্যায় মন্দির নির্মাণে সুপ্রিম কোর্টের রায় মুসলিমদের আশঙ্কিত করে। সিএএ সমস্ত গরিব ও নিম্নবিত্ত মানুষ, বিশেষ করে মুসলিমদের কাছে হয়ে দাঁড়ায় একটি অশনি সংকেত। আমাদের দেশে নথিপত্র রক্ষা করার রেওয়াজ প্রায় নেই বললেই চলে। জন্ম ও মৃত্যু নথিভুক্ত করার আইন চালু হয়েছে সবে 1969 সালে, সর্বজনীন সচিত্র ভোটার কার্ড সবে 1998 সালে চালু হয়েছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, সরকারি দীর্ঘসূত্রিতা, তথাকথিত উন্নয়নের ফলে বারবার স্থানচ্যূত হওয়ার কারণে বহু মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস নেই। সিএএ-র তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার কারণে মুসলিম মানুষ বিপন্ন বোধ করতে শুরু করেন। পাশের দেশ মায়নমারে তারা দেখেছেন, কী ভাবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব হরণ করা হয়েছে। জামিয়া মিলিয়ায় তরুণীদের রুখে দাঁড়ানো তাদের সাহস জোগায়, এতদিনের তিলতিল করে জমে থাকা ক্ষোভের উদগীরণ হয়। রাষ্ট্রশক্তি সম্পর্কে যে আতঙ্ক দানা বেঁধেছিল, তা ভেঙে যায়। তারা উপলব্ধি করেন যে, এই অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করা সম্ভব। জামিয়া থেকে শাহিনবাগ দুই কিলোমিটারের পথ। অনেকের আত্মীয় পরিজনেরা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ওইদিন রাতেই নিজেদের সন্তান বা ঘনিষ্ঠদের চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে, পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদে বহু মহিলা রাস্তায় নেমে আসেন। এরা অধিকাংশই গৃহবধূ, পর্দানসীন নারী, যারা জীবনে কখনও ঘরের বাইরে পা রাখেননি, যারা সেই অর্থে জীবনে প্রথম পুরুষ, পরিবার, বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মতির অপেক্ষা না করে কোনও সামাজিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করলেন, যারা বাস্তবে ‘ফার্স্ট টাইম প্রোটেস্টার’। অনেকে পুলিশি হামলায় আহত ছাত্রছাত্রীদের শুশ্রুষা করেন, তাদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন। অনেকে সিদ্ধান্ত নেন রাস্তা অবরোধ করতে হবে। তারা রাস্তায় বসে পড়েন এবং কোভিডের কারণে নিষেধাজ্ঞার আগে সেই জায়গা ছেড়ে আর ওঠেন না। ধীরে ধীরে এই জমায়েত বৃদ্ধি পায়। আবালবৃদ্ধবনিতা রাস্তার দখল নেয়। হিমশীতল হাওয়া থেকে বাঁচতে তাঁবু খাটানো হয়, কম্বল-তোষক চলে আসে। যে সমাবেশ শুরু হয়েছিল পুলিশি অত্যাচারের প্রতিক্রিয়ায়, তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আরও প্রসারিত হয়ে একটি জনবিরোধী আইনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রতিবাদের প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে। সাংবাদিক সীমি পাশা তাঁর ‘দ্য নাইট অফ ব্রোকেন গ্লাস: 15 ডিসেম্বর, 2019’ (সীমা মুস্তাফার বই ‘শাহিন বাগ এন্ড দ্য আইডিয়া অফ ইন্ডিয়া’-তে সংকলিত) লিখছেন, “বর্ণাঢ্য কোনও পরিকল্পনা ছিল না, ছিল না কোনও ছক বা কোনও অভিলাষ যে, শাহিনবাগ থেকে একটা আন্দোলন শুরু করতে হবে। কিন্তু ঘটনা আপনা থেকেই গড়াতে শুরু করল এবং কেউ কিছু বুঝে ওঠবার আগেই তারা একটি শক্তিশালী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেলেন।” অরুন্ধতী রায় লিখলেন, “এটা একটা বিরাট ব্যতিক্রম যে মুসলিম নারীর কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে, মুসলিমদের মতামত বলতে আমরা তো মৌলানাদের বক্তব্যই খালি শুনতাম।“ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অশীতিপর দাদিরাও প্রতিবাদে মুখর হলেন। সুপরিচিত এই দাবাং দাদিরা প্রবল ঠান্ডায় সকাল আটটা থেকে রাত বারোটা অবধি মঞ্চে হাজিরা দিলেন। তাঁরা বললেন আমরা যা করছি তা নিজেদের জন্য নয়, ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য। বিলকিস বানো, টাইম পত্রিকা যাঁর পরিচিতি আরও বিস্তৃত করেছে, তাঁর সম্পর্কে ‘গুজরাত ফাইল’ খ্যাত লেখিকা রানা আয়ুব লিখছেন, “তিনি ভারতের প্রান্তিক মানুষদের কন্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন...একটা দৃষ্টান্ত যখন নারী ও সংখ্যালঘুদের স্বর মোদী জমানার সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতির চাপে হারিয়ে যাচ্ছিল।”
শাহিনবাগের সমাবেশটাই ব্যতিক্রমী। স্বাধীন ভারতে এই রকম জমায়েত কমই দেখা গেছে, যেখানে এক হাতে জাতীয় পতাকা এবং অন্য হাতে সংবিধান নিয়ে সকাল সন্ধ্যা সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে পাঠ করা হয়, ‘উই দ্য পিপল অফ ইন্ডিয়া…।’ যেখানে নিয়ম করে গীতাপাঠ হয়, কোরান, গুরু গ্রন্থসাহিব, বাইবেল থেকে বিভিন্ন অংশ উদ্ধৃত করে জনতাকে শোনানো হয়, সারা দিন ধরে শোনা যায় দেশাত্মবোধক গান, কবিতা। পোস্টার লেখা হয়, ছবি, কার্টুন আঁকা হয়। গান্ধী, সর্দার প্যাটেল, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, ভগৎ সিং ইত্যাদি দেশনেতাদের ছবি দিয়ে ধর্নামঞ্চ সজ্জিত করা হয়। প্ল্যাকার্ড, ব্যানার চতুর্দিকে টাঙিয়ে দেওয়া হয়। বহু পরিশ্রম করে যুবক যুবতীরা দু’টি মুর্যাল তৈরি করে- ইন্ডিয়া গেট এবং ভারতবর্ষের মানচিত্র। মায়ের সঙ্গে যে বাচ্চারা আসেন, তাদের জন্য বসে আঁকার অনুষ্ঠান হয়। 17 জানুয়ারি হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র রোহিত ভেমুলার প্রয়াণ দিবসে ফতিমা শেখ এবং সাবিত্রীবাই ফুলের নামে একটি পাঠাগার খোলা হয়। গান্ধী থেকে সাভারকার, রবীন্দ্রনাথ থেকে রানা আয়ুব, অরুন্ধতী রায় থেকে আম্বেদকর সবার বই এখানে রাখা হয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ, বাচ্চাদের বই, পাঠ্যপুস্তকও রাখা হয়, যাতে তাদের পড়াশোনা কোনওভাবে বিঘ্নিত না হয়। সারা দিন ধরে বিভিন্ন সংগঠনের মানুষেরা আসেন। তারা বক্তব্য রাখেন, নাগরিকত্ব আইন ব্যাখ্যা করেন, আসামে এনআরসি-র কুফল সম্পর্কে জনতাকে অবহিত করেন। রাতারাতি গোঁড়া, রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েরা দেশ দুনিয়ার সমস্যা সম্পর্কে অবহিত হন। তারা বক্তাদের প্রশ্ন করেন, বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানতে চান, নিজেদের মধ্যে তর্কবিতর্ক করেন, আলোচনা করেন। ঘর গেরস্থালির কথার চেয়ে সিএএ-এনআরসি তাদের কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আটপৌরে মুসলিম মহিলা আন্দোলনের মুখ হয়ে ওঠেন। দেশের ছাত্র-যুব, নাগরিক সমাজকে এই ধর্না-সমাবেশ চমৎকৃত করে। শুধু দিল্লিতেই আরও অন্তত দশটি স্থানে এই ধরনের সমাবেশ গড়ে ওঠে। শাহিনবাগের মডেল সংক্রামক হয়ে ওঠে। লখনউ, এলাহাবাদ, কোটা, কলকাতা, নাগপুর, দ্বারভাঙা, পাটনা, জয়পুর, পুনা ইত্যাদি নানা শহরে বহু শাহিনবাগ গড়ে ওঠে। লক্ষনীয় এগুলি প্রায় প্রতিটি মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে স্থাপিত হয় এবং মুসলিম মহিলারাই প্রতিবাদে প্রধান ভূমিকা নেন। এটা যেমন এই আন্দোলনের সদর্থক দিক আবার এটা আন্দোলনের দুর্বলতাও বটে। অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষেরা ধর্নামঞ্চে আসেন, নানা কাজকর্মে যুক্ত হন, তারপর চলে যান। মুসলিম মহিলাদের সঙ্গে টানা সমাবেশে অংশগ্রহণ করা প্রায় কোথাও দেখা যায়নি। এর ফলে কেন্দ্রীয় সরকার এবং তাদের চাটুকার মিডিয়া এই সমাবেশ গুলিকে একটি মুসলিম আন্দোলন হিসাবে চিহ্নিত করে দেয়। জনমানসেও ধারণা হয় যে, সিএএ-বিরোধী আন্দোলন একটি মুসলিম আন্দোলন, যাতে নাগরিক সমাজ ও ছাত্র-যুবর একটি অংশের মাত্র যোগদান আছে।
প্রতিবাদকারীদের একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ হিসাবে ছাপ্পা মেরে দেওয়ার প্রচেষ্টা প্রথম থেকেই দেখা যায়, যখন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাদের পোশাক নিয়ে কুখ্যাত মন্তব্যটি করেন। এরপর কুৎসার বন্যা বয়ে যায়। সুপরিচিত তকমাগুলো সাঁটা শুরু হয়ে যায়- পাকিস্তানি, দেশদ্রোহি, সন্ত্রাসবাদী, টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং, এদের একমাত্র স্থান পাকিস্তান ইয়া কবরিস্থান ইত্যাদি! সমাজমাধ্যমে ছবি ভাইরাল হয়ে যায় যে, ইমরান খান নিজে প্রতিবাদীদের হাতে খাবারের প্লেট তুলে দিচ্ছে। সদা তৎপর আইটি সেল রটিয়ে দেয় যে, ধর্নায় উপস্থিত থাকলে 500 টাকা দেওয়া হচ্ছে এবং বিরিয়ানি খাওয়ানো হচ্ছে। ঐতিহ্যশালী বিরিয়ানি একটি রাষ্ট্রদ্রোহী খাবার হয়ে যায়। আন্দোলনকারীরা বলেন, তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই, পেটিএমের মতো কোনও অনলাইন ওয়ালেট নেই, যেখানে টাকা জমা দেওয়া যেতে পারে। ধর্নামঞ্চে ব্যানার টাঙিয়ে দেওয়া হয় যে, কোনও আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করা হবে না। সচ্ছল মহিলারা জানান, তাদের যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতি আছে, মাত্র 500 টাকার জন্য তাদের মঞ্চে বসার কোনও প্রয়োজন নেই। মিডিয়াকে তারা বলেন, সংগঠকরা 5000 টাকা দিতে রাজি যদি কেউ হিমশীতল ঠান্ডায় ধর্নামঞ্চে এসে একটা রাত কাটাতে রাজি হন। এরপর তারা আইটি সেলের বিরুদ্ধে মানহানির নোটিস পাঠান। সেই নোটিসের আজ অবধি কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি।
সরকারের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনা করার কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি। সুপ্রিম কোর্ট দু’জন আইনজীবী, সঞ্জয় হেগড়ে এবং সাধনা রামচন্দ্রনকে দায়িত্ব দেয় মধ্যস্থতা করার জন্য। কয়েকবার চেষ্টার পর আলোচনা ভেস্তে যায়। মধ্যস্থতাকারীরা ধর্নামঞ্চকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করার ওপর জোর দিয়েছিলেন, যেটা স্বাভাবিক ভাবেই নাকচ হয়ে যায়। তারা আলাদা করে কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনা করতে চাইছিলেন, কিন্তু জনতা মঞ্চের মধ্যে সর্বসমক্ষে কথাবার্তার প্রস্তাব দিয়েছিল। দিল্লিতে এখন যে কৃষক আন্দোলন চলছে, সেটার মতো শাহিনবাগে তো কোনও নেতা বা সংগঠন ছিল না, প্রতিবাদ স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে দানা বেঁধেছিল। তাই আলাদা করে নেতৃস্থানীয় কারও সঙ্গে কথা বলার অবকাশ ছিল না।
ইতিমধ্যে দিল্লি নির্বাচন এসে যায় এবং বিরোধী পক্ষের প্রতি কুৎসার রাজনীতি চরমে ওঠে। বলা হয়, নরেন্দ্র মোদী পুলওয়ামার প্রতিশোধ নিয়েছেন, পাকিস্তানে ঢুকে সার্জিকাল স্ট্রাইক করেছেন, এর উল্টো দিকে আছে শাহিনবাগ, আপনি কোনটার পক্ষ নেবেন? ‘দেশপ্রেমিক’ বনাম ‘দেশদ্রোহী’- সরাসরি বিভাজন রেখা টেনে দেওয়া হয়। স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভাষণ দেন, 'ভোটকেন্দ্রে বোতামটা এত জোরে টিপুন যে, সেটার শক যেন শাহিনবাগে যারা বসে আছে তারা টের পায়।' জনৈক বিজেপি সাংসদ সতর্ক করেন, শাহিনবাগের আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে যদি এখনও কোনও ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে তারা তোমাদের ঘরে ঢুকে মা বোনেদের ধর্ষণ করবে। অরুন্ধতী রায় তাঁর সদ্য প্রকাশিত প্রবন্ধ সংকলন ‘আজাদি’-তে লিখছেন, ‘এটা একটা আকর্ষনীয় মন্তব্য কারণ আমরা জানি শাহিনবাগের অবস্থানকারীরা মূলত নারী! নির্বাচনের প্রাক্কালে কুৎসা প্রচার তুঙ্গে ওঠে। বিজেপি নির্বাচনে শাহিনবাগকে মূল বিষয় করে মেরুকরণ ঘটানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়, যার ফলে সমাবেশের ওপর তাদের আক্রোশ আরও তীব্রতা পায়।'
প্রত্যাঘাত প্রত্যাশিত ছিল এবং নির্বাচনের দুই সপ্তাহের মধ্যে জাফরাবাদ অঞ্চলের একটি সমাবেশ থেকে পূর্ব দিল্লিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। মুসলিমদের বেছে বেছে আক্রমণ করা হয়, তাঁদের ঘর, বাড়ি, দোকান, ধর্মস্থান লুটপাট করে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এই হামলায় যে নেতারা উস্কানি দিয়েছিল বা যারা প্রত্যক্ষ ভাবে খুন, লুঠতরাজে অংশগ্রহণ করেছিল, তাদের কারও বিরুদ্ধে আজ অবধি কোনও আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। উল্টে যারা শাহিনবাগ আন্দোলনের সংগঠক ছিলেন বা সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে দাঙ্গার ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ আনা হয় এবং বহু উজ্জ্বল যুবক যুবতীদের গ্রেপ্তার করা হয়। (এই বিষয়ে ইতিপূর্বে এই পোর্টালে চারটি লেখায় বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হয়েছে)। দাঙ্গা করেও কিন্তু শাহিনবাগকে দমানো যায়নি। জনৈক বিজেপি নেতা হুঙ্কার দেন, জাফরাবাদকে আমরা শাহিনবাগ হতে দেব না। আন্দোলনকারীরা প্রত্যুত্তর দেন শাহিনবাগকে আমরা জাফরাবাদ হতে দেব না। খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই সময় অনেকে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তারা জানিয়েছেন মঞ্চে আসার জন্য বাড়ি থেকে যখন বেরোতেন, তারা জানিয়ে আসতেন যে, আদৌ আর ফিরবেন কিনা সেটার কোনও নিশ্চয়তা নেই। রাষ্ট্রের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করে, পুলিশ প্রশাসনের নানা চাপ, হুমকি এমনকি শারীরিক হামলার ভয় উপেক্ষা করে যে প্রতিবাদ অনড় অটল থেকে 100 দিন টিকে ছিল, তা কোভিড-19 এর আগমনে স্তব্ধ হয়ে যায়। 22 মার্চ জনতা কার্ফুর দিন তারা সুরক্ষা বিধি মেনে পালা করে পাঁচ জন ধর্নামঞ্চে বসেছিলেন। মহামারীর ভয়াবহতা উপলব্ধি করে সংগঠকরা নিজেরাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আন্দোলন তুলে নেন; পুলিশ জোর করে তাদের তুলে দিয়েছিল, এই কথাটি বহু অপপ্রচারের মধ্যে আরও একটি মাত্র। শাহিনবাগ পথপ্রদর্শক। বিজেপির ছয় বছরের শাসনে তারাই প্রথম দেখান যে, স্বৈরাচারকে রুখে দেওয়া সম্ভব। তাদের অনমনীয় সাহসী প্রয়াসের জন্যই আজ দিল্লি সীমান্তে কৃষকদের জোয়ার আছড়ে পড়ছে, কৃষি আইন প্রত্যাহার করার লড়াই প্রতিদিন আরও জোরদার হচ্ছে।