‘ইয়ে ক্যয়া জ্বল রহা হ্যায়?’
উত্তর প্রদেশের এক গ্রাম, চারিদিকে নিকষ কালো অন্ধকার, ছায়ার মতো দণ্ডায়মান প্রচুর পুলিশ এবং এক অস্বস্তিকর, অনির্বচনীয় নীরবতা। আকাশে লাফিয়ে ওঠা লেলিহান শিখার দিকে তাকিয়ে এক তরুণী সাংবাদিক যখন এই প্রশ্ন করেন তখন তা সারা দেশ জুড়ে প্রতিধ্বনিত হয়। সত্যি তো ‘ক্যয়া জ্বল রহা হ্যায়’!
উত্তরটা জানার পর সবাই মূক হয়ে যায়। এমনটাও হতে পারে? তথ্যপ্রমাণ লোপাট করার জন্য কোনও ধর্মীয় আচারের পরোয়া না করে, তাঁর আত্মীয় স্বজনদের না জানিয়ে বেমালুম একটা মৃতদেহ এই ভাবে জ্বালিয়ে দেওয়া যেতে পারে? হতে পারে, গোবলয়ের এই রাজ্যে কোনও কিছুই অস্বাভাবিক নয়। হাথরসে নারকীয় গণধর্ষণ হঠাৎ কোনও ঘটনা নয়। এর কয়েক দিনের মধ্যেই কানপুর, বলরামপুর, মিরাট, আমেথি, বুলন্দশহরে একই কান্ড ঘটেছে এবং আরও অনেক অজানা, অনথিভুক্ত ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে। ‘ন্যাশানাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো’র (NCRB), তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশে প্রতি 16 মিনিটে একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। NCRBর এই রিপোর্টে বলছে নারীবিরোধী অপরাধ 2018-এর 3.78 লক্ষ থেকে বেড়ে 2019-এ 4.05 লক্ষ হয়েছে এবং সবচেয়ে উদ্বেগজনক হচ্ছে শাস্তির হার হচ্ছে মাত্র 28 শতাংশ। এই ধরণের অপরাধের তালিকায় উত্তর প্রদেশের নাম শীর্ষে (15.3 শতাংশ)।
আসলে একটা ধারাবাহিক দুঃস্বপ্নের মতো এত সব নারকীয় ঘটনা দৈনন্দিন আমাদের চার পাশে ঘটে চলেছে যে আমাদের স্মৃতিতে সেগুলি ধামাচাপা পড়ে যায়। আমরা কি উন্নাও এর সেই নৃশংস ঘটনা ভুলে গেছি? 2017-এর 4 জুলাই স্থানীয় একটি মেয়ে একজনের সুপারিশে কুলদিপ সিং সেঙ্গার নামে এলাকার বিধায়কের সাথে দেখা করতে যান। অভিযোগ, মেয়েটি ধর্ষিত হন। সেঙ্গার মামুলি কোনও লোক নন, চার চারবার ওই অঞ্চল থেকে তিনি বিধানসভার সদস্য হয়েছেন। হেন কোনও দল নেই যেটার সঙ্গে তিনি যুক্ত হননি- বহুজন সমাজ পার্টি, সমাজবাদী পার্টি, বিজেপি। ঘটনা যখন ঘটে তখন তিনি বিজেপির এমএলএ। ঘটনার প্রতিকারের জন্য ধর্ষিতা মেয়েটি এবং তাঁর পিতা সরকার, পুলিশ, প্রশাসনের প্রতিটি বিভাগের দোরগোড়ায় দিনের পর দিন হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। কেউ তাঁদের কথা শোনেনি, কোনও গুরুত্বই দেয়নি। উল্টে মেয়েটির পিতাই এই কান্ড ঘটিয়েছে, এই মারাত্মক অপবাদ দিয়ে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে। নিরুপায় হয়ে মেয়েটি 2018-র 8 এপ্রিল মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে নিজেকে অগ্নিস্পৃষ্ট করে। প্রশাসন নড়ে চড়ে বসে, মূল অভিযুক্ত, এবং তাঁর ভাই গ্রেপ্তার হয়। ওই মাসেই মেয়েটির পিতারও জেল হেফাজতে মৃত্যু হয়। প্রবল জনমতের কারণে বিজেপি সেঙ্গারকে দল থেকে বহিষ্কার করতে বাধ্য হয়।
কিন্তু তাতে কী? কুছ পরোয়া নেহি! অভিযোগ, তিনি জেল থেকেই কলকাঠি নাড়তে থাকেন। সমস্ত তথ্যপ্রমাণ লোপাট করার চেষ্টা করেন। ওই বছরের জুলাই মাসে মেয়েটি তাঁর আইনজীবী এবং কয়েকজন আত্মীয়র সঙ্গে যখন একটি গাড়ি করে যাচ্ছিলেন, একটি ট্রাক পিছন থেকে এসে সেটিকে ধাক্কা মারে। দুজন আত্মীয় মারা যায়, বাকিরা গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। ট্রাকটির নাম্বার প্লেটে কালি মাখানো ছিল; মেয়েটির নিরাপত্তার জন্য যে পুলিশদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাঁরা জানায় যে গাড়িতে যথেষ্ট জায়গা না থাকার কারণে তাঁরা মেয়েটির সফরসঙ্গী হতে পারেননি। দুর্ঘটনাটি যে পরিকল্পিত এটা বুঝতে শার্লক হোমস হওয়ার প্রয়োজন হয় না। মেয়েটি তবুও নাছোড়বান্দা। অবশেষে 2019এর ডিসেম্বরে সেঙ্গারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ঘটনাটির যে এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটল এটা কিন্তু একেবারেই নিশ্চিত ভাবে বলা যাচ্ছে না। উত্তর প্রদেশে উচ্চবর্ণের দাপট এতটাই যে এরপরেও মেয়েটির জীবন সংশয় হতে পারে, সেঙ্গার আইনের কোনও এক ফাঁক দিয়ে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যেতে পারেন। হাথরস কান্ডেই তো আমরা দেখছি যে পুলিশের উপস্থিতি সত্ত্বেও ঠাকুর সম্প্রদায়ের লোকেরা মেয়েটির পরিবারকে প্রকাশ্যে শাসাচ্ছে। তাদের ছেলেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে তাঁরা যে ভাবে উঠে পড়ে লেগেছে তাতে দোষিদের আদৌ কোনও শাস্তি হবে কী না তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ আছে। শাসক দলের বিভিন্ন বিধায়ক তাঁদের মদত দিচ্ছে। ওই পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং অন্যত্র স্থানান্তরিত হতে চাইছে।
গোবলয়ের এই বিশাল রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার অবস্থা কোনও দিনই ভাল ছিল না। জাতপাতের সংঘাত, সাম্প্রদায়িক হানাহানি, গ্যাংস্টারদের দৌরাত্ম্য, সর্বোপরি পুলিশ প্রশাসনের প্রবল পক্ষপাতদুষ্টতার কারণে এখানকার সমাজ পরম্পরাগত ভাবে জটিল এবং তা বহু ভাগে বিভক্ত ও বিদীর্ণ। নিম্নবর্ণ ও সংখ্যালঘু মানুষেরা এই বাতাবরণে রীতিমতো কোণঠাসা, সন্ত্রস্ত ও নিপীড়িত হয়ে যেন জীবন কাটানো তাঁদের নিয়তি। 2017 সালে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর বিজেপি কিছু উদ্যোগ নেয়। যেমন অফিস কাছারিতে পান, সিগারেট, তামাক, গুটখা খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়। রাজ্যে অবৈধ কসাইখানা এবং গো-পাচার বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে কিছু অবৈধ কসাইখানা অবশ্যই বন্ধ হয়, কিন্তু অনেকের বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও তারা ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। যাঁরা বৈধ ভাবে গবাদি পশু কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাঁদেরও ব্যবসা লাটে উঠে যায়। ঘটনা হচ্ছে, এই দুটি পেশাতেই মুসলিম সম্প্রদায়ের বহু মানুষ যুক্ত থাকার কারণে তাঁদের অনেকের ব্যবসা বৈধ হওয়া সত্ত্বেও নানা অছিলায় সেগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাঁদের গুরুতর অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়, এমনকি রুটিরুজি জোগাড় করা সমস্যাজনক হয়ে পড়ে তাঁদের পক্ষে। এই সিদ্ধান্তগুলি যে একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে নিশানা করে নেওয়া হচ্ছে সেটা আরও পরিষ্কার হয়, যখন সরকার প্রতিটি মাদ্রাসাকে নির্দেশ পাঠায় যে তাঁদের ছাত্রছাত্রীরা যে স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছে এটা প্রমাণ করার জন্য ভিডিও তুলে সরকারি দফতরে পাঠাতে।
এরপরে শুরু হয় তথাকথিত লাভ জিহাদের বিরুদ্ধে জিহাদ। নানা তকমা লাগানো হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের মদতে রাজ্য জুড়ে অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াড তৈরি হয়। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হোটেল, কাফে, পার্ক, সর্বত্র প্রেমিক প্রেমিকাদের নানা ভাবে হেনস্থা করা শুরু হয়। এই সরকারের মুসলিম-বিদ্বেষ এতটাই যে কানপুরে নয়টি হিন্দু-মুসলিম বিবাহের তদন্ত করতে এসআইটি গঠিত হয়। জেরায় পাঁচটি হিন্দু মেয়ে জানায় তাঁরা স্বেচ্ছায় মুসলিম ছেলের সঙ্গে বিবাহে সম্মত হয়েছে। সরকারের বক্তব্য প্রেমের অছিলায় হিন্দু মেয়েদের ধর্মান্তকরণ করা হচ্ছে। এটা আটকাতে একটি অধ্যাদেশ আনারও পরিকল্পনা চলছে।
উত্তরপ্রদেশ রাজ্য সরকার বড়াই করে বলছে যে গত তিন বছরে রাজ্যে কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। 2018র মার্চে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক জানায় যে 2017 সালে উত্তর প্রদেশে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে 44 জন মারা গেছেন এবং 540 জন আহত হয়েছেন। মনে রাখতে হবে এই বছরে এপ্রিল মাস থেকে যোগী আদিত্যনাথ সরকার ক্ষমতায় আছে। 2018 এবং 2019এর কোনও পরিসংখ্যান এখনও পাওয়া যায়নি। 2018র শুরুতে জানা যায় যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য পুলিশ 160 জনের ওপর ‘ন্যাশানাল সিকউরিটি অ্যাক্ট’ (NSA) আরোপ করেছে এবং অভিযোগ এঁদের অধিকাংশই মুসলিম। আরও অভিযোগ প্রত্যেকটি সংঘর্ষে সংঘীরা সক্রিয় ভাবে জড়িত ছিল। এছাড়াও প্রচুর ভুয়ো সংঘর্ষ হয় যার কোনও সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সারা রাজ্য জুড়ে একটা ভয়ের আবহ সৃষ্টি হয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ীদের নানা অছিলায় হেনস্থা করা হয়, নথিপত্রে সামান্য খুঁত পেলে ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হয়। যখন তখন তাঁদের ঘরবাড়ি তল্লাশি হয়। তাঁদের সন্তানদের স্কুল কলেজে হয়রান করা হয়, প্রতিদিন নানা ভাবে অপদস্ত হতে হয়।
নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) বিরোধী আন্দোলন শুরু হওয়ার পর দমনপীড়নের মাত্রা কয়েক গুণ বেড়ে যায় এবং পরবর্তী দু মাসে আন্দোলনকারীদের ওপর যে ধরণের সন্ত্রাস হয়েছে তার কিঞ্চিৎ মাত্র মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। ‘ন্যাশানাল অ্যালায়েন্স অফ পিপলস মুভমেন্ট’ (NAPM) উত্তর প্রদেশে পুলিশি নির্যাতনের ওপর একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেটি থেকে এই সময়ের বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। ডিসেম্বরের 15 তারিখে আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসের ভিতরে এবং বাইরে পুলিশ ছাত্রছাত্রী এবং বিশিষ্টজনদের নৃশংস ভাবে আক্রমণ করে। 60 জন আহত হয় এবং অনেকের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়। এর চারদিন বাদে সারা রাজ্য জুড়ে 144 ধারা জারি হয়। সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে কোনভাবেই অংশগ্রহণ না করার জন্য সতর্ক করে রাজ্যের 3000 মানুষকে চিঠি পাঠানো হয়। কয়েকজনকে গৃহবন্দি করা হয়। সরকারি হিসেব অনুযায়ী আন্দোলনে 18 জন পুলিশের গুলিতে মারা যায় এবং প্রত্যেকেই মুসলিম। NAPM এর রিপোর্ট অনুযায়ী সংখ্যাটা 20 কিংবা তার বেশি। এবং বেসরকারি মতে মৃত্যুর সংখ্যা 30 এর বেশি। অন্যান্য জায়গার মতো উত্তর প্রদেশেও সিএএ-বিরোধী আন্দোলন মূলত শান্তিপূর্ণ ছিল। কিন্তু রহস্যজনক ভাবে বিভিন্ন জায়গায় ভাড়া করা দাঙ্গাবাজদের দিয়ে হিংসা ছড়ানো হয়, যানবাহন এবং সরকারি সম্পত্তিতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সিসিটিভি ফুটেজ দ্বারা চিহ্নিত হয়েছে, এই অভিযোগ করে প্রশাসন অনেকের সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে এবং বিপুল অর্থ জরিমানা করে। লাগাতার পুলিশি হেনস্থায় বিপর্যস্ত হয়ে গিয়ে প্রায় সবাই এই জরিমানা দিয়ে কোনও মতে রেহাই পায়। অনেক পরিবার এতে নিঃস্ব হয়ে যায়। রাজ্যে আন্দোলনের ওপর আক্রমণ এতই তীব্র ছিল যে কংগ্রেসের আবেদনে সাড়া দিয়ে ‘ন্যাশানাল হিউম্যান রাইটস কমিশন’ (NHRC) এর তদন্ত করে। এছাড়াও নাগরিক সমাজের উদ্যোগে একটি ‘পিপলস ট্রাইবুনাল’ গঠিত হয়, এবং দিল্লি হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি জাস্টিস এ পি শাহ, ইরফান হাবিব সহ আরও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা তার সদস্য ছিলেন। এই ট্রাইবুনাল পুলিশি অত্যাচারের প্রবল বিরোধিতা করে এবং দোষীদের শাস্তির দাবি করে।
হাথরসে নির্যাতিতার পরিবারে যে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে তা চট করে অপসৃত হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। উচ্চবর্ণের একটি সংগঠন সেখানে জাঁকিয়ে বসেছে। পুলিশি বলয়ের নিশ্ছিদ্র সুরক্ষার মধ্যে থেকে তাঁরা নির্যাতিতার পরিবার এবং ভীম আর্মির লোকজনদের ক্রমাগত হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী এই পরিবারের নিরাপত্তা কিংবা দোষীদের শাস্তি হবে নিয়ে চিন্তিত কিনা সেটা জানা নেই। কিন্তু এটুকু জানা যাচ্ছে যে তিনি এই ঘটনাকে একটি বিদেশী ষড়যন্ত্র বলছেন, যাঁরা মনীষার ওপর অত্যাচারের প্রতিকার চাইছেন তাঁদের রাষ্ট্রদ্রোহী বলছেন। আর দুদিন বাদেই বলা হবে এর মধ্যে আইএসআই আছে, হাওলার মাধ্যমে বিদেশ থেকে টাকা আসছে। ইতিমধ্যে কিন্তু ধর্ষণ জারি আছে। এই লেখাটি শেষ করার মধ্যেই কৌশাম্বী, জ্ঞানপুর এবং ফৈজাবাদে আরও তিনটি ঘটনা ঘটে গিয়েছে।