4thPillar


ভোট দিয়ে চাঁদে যান, হেলিকপ্টার জিতুন!

সোমনাথ গুহ | 29-03-2021May 24, 2023
ভোট দিয়ে চাঁদে যান, হেলিকপ্টার জিতুন!

তামিলনাড়ুর বিধানসভা নির্বাচনে মাদুরাইয়ের জনৈক নির্দল প্রার্থী সাক্ষাৎ কল্পতরু হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি শুনলে ভিরমি খাওয়ার জোগাড় হতে হবে। তিনি ভোটারদের হাতে চাঁদ তুলে দিতে মনস্থ করেছেন। ঠিকই শুনেছেন, একদমই তাই! নির্বাচিত হলে সেই নির্দল প্রার্থী ভোটদাতাদের নিখরচায় চাঁদে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সিএনবিসি 18 নামক সংবাদ সংস্থা লিখেছে যে, ইসরোর চন্দ্রায়ন মিশনে যদি ভবিষ্যতে চাঁদে বানিজ্যিক সফরের ব্যবস্থা হয়, তাহলে তাদের যাত্রীর অভাব হবে না। এছাড়া এই নির্দল প্রার্থী ভোটারদের আরও কিছু সামান্য জিনিস পাইয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। যেমন পরিবার পিছু একটি হেলিকপ্টার, গাড়ি এবং একটি তিনতলা বাড়ি। ইনি নির্বাচনে জেতার আশা করেন না। কিন্তু স্পষ্টতই তিনি একটি বার্তা দিতে চাইছেন। তিনি বিদ্রুপ করছেন এই ব্যবস্থাকে যেখানে অঢেল এবং অবাস্তব প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে ভোটারদের উৎকোচ দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার করার চেষ্টা করা হয়।

 

 

দান খয়রাতির এই নির্বাচনী রাজনীতির সূত্রপাত এই তামিলনাড়ুতেই। বলা হয়ে থাকে ডিএমকের (DMK) প্রবল প্রতিপত্তিশালী প্রতিষ্ঠাতা সিএন আন্নাদুরাই 1967 সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রথম এই ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া শুরু করেছিলেন। তিনি দুঃস্থ মানুষদের এক টাকায় সাড়ে চার কিলো চাল দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে ভোটে বাজিমাত করেছিলেন। 1982 সালে কংগ্রেসের অপশাসনের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে এনটি রামা রাও অন্ধ্রপ্রদেশে তেলেগু দেশম দল (TDP) গড়ে তোলেন। কয়েক মাস বাদে তাঁর দল সাড়া জাগিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। তাঁর জয়ের অন্যতম কারণ দু’টাকা কেজি দরে চাল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। কালে কালে এই দান খয়রাতির ইংরেজি নামকরণ হয়েছে ফ্রিবিস (freebies), অর্থাৎ যা ফোকটে পাওয়া যায়। 2006 সালে ডিএমকে দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী মানুষদের বিনামূল্যে রঙিন টিভি এবং গ্যাসের কানেকশন দেওয়ার অঙ্গীকার করে। এছাড়া দু’টাকা কেজি দরে চাল তো আছেই। 2011-তে তাদের ইস্তেহার দান খয়রাতিতে ভরা- সরকারি এবং সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত কলেজগুলিতে বিনামূল্যে ল্যাপটপ, এছাড়া প্রতি পরিবারে মিক্সার গ্রাইন্ডার ও 35 কেজি চাল। সেই বছর দান খয়রাতিতে এআইএডিএমকে-ও (AIADMK) সমান তালে পাল্লা দেয়। উপরোক্ত জিনিসগুলি ছাড়াও তারা ভোটদাতাদের ইলেকট্রিক পাখা দেয়। 2016-র নির্বাচনে এআইএডিএমকে নেত্রী জয়ললিতা যাদের রেশন কার্ড আছে, তাদের মোবাইল ও 100 ইউনিট অবধি বিদ্যুৎ বিনামূল্যে দেন। এছাড়া গরিবদের আর্থিক মানোন্নয়নের জন্য গবাদি পশুও দেন। সেবারে ডিএমকে দানধ্যানে তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেনি এবং তারা নির্বাচনে পরাজিত হয়। এবারে এআইএডিএমকে ওয়াশিং মেশিন এবং সোলার স্টোভ দিচ্ছে, গৃহহীনদের জন্য বাড়ি, এবং প্রতি পরিবারে একজনের সরকারি চাকরি। ডিএমকের দাক্ষিণ্য সেই তুলনায় মামুলি- নবম শ্রেনির ওপরে সকল ছাত্রছাত্রীর জন্য বিনামূল্যে ট্যাব। কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, এবার তামিল-ভূমে ডিএমকে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করবে। এর অর্থ, বেশি দানধ্যান করলেই যে ভোটে জেতা যায় এমনটা নয়।

 

 

সব প্রতিশ্রুতিই যে ফাঁকা আওয়াজ এমনটাও নয়। যেমন 35 কেজি চালের জায়গায় হয়তো 20 কেজি দেওয়া হল বা যত লোককে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল তার থেকে কম লোককে দেওয়া হল। আর শুধু যে তামিলনাড়ুই এই ধরনের ঢালাও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে এমনটাও নয়। দিল্লি সরকার তো মহিলাদের বাসে যাতায়াত ফ্রি করে দিয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যে বহুবার নির্বাচনের প্রাক্কালে কৃষকদের ঋণ মকুব করা হয়েছে। তবে বিজেপি এই ফাঁকা প্রতিশ্রুতি দেওয়ার রেওয়াজটাকে একটা অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে, যেখানে এখন তাঁদের তথাকথিত ‘সংকল্পপত্র’ জুমলাপত্র হিসাবে অভিহিত হচ্ছে। পাতি বাংলায় ‘জুমলা’ অর্থে ঢপ! 2014 সালে যে মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী অঙ্গীকার করেন যে কালো টাকা উদ্ধার করে ভোটারদের ব্যাঙ্কের খাতায় 15 লাখ টাকা জমা হবে, ঠিক তখনই ‘জুমলা’ কথাটি রাজনীতির অভিধানে ঢুকে যায়। তাঁদের আরও দু’টি বিখ্যাত জুমলা হল 2022-এর মধ্যে কৃষি থেকে আয় দ্বিগুণ হয়ে যাবে; উল্টে তিনটি কালা কৃষি আইন বাতিল করার দাবিতে লাখো কৃষক গত চার মাস ধরে দিল্লির সীমান্তে সমবেত হয়ে আছেন। আর একটি হল 2024-25 অর্থবর্ষের মধ্যে ভারতের অর্থনীতি এক লক্ষ কোটি টাকা মূল্যের হয়ে যাবে। আসামে গত নির্বাচনে তাঁরা সংকল্প করেছিলেন যে, চা শ্রমিকদের মজুরি 351 টাকা করবেন, সেটা পাঁচ বছরে বেড়ে হয়েছে মাত্র 193 টাকা। এবারের ইস্তেহারে তাঁরা আবার নতুন করে মজুরি 350 টাকা করার অঙ্গীকার করেছেন। গতবার 25 লক্ষ চাকরি দেবেন বলে নামমাত্র কাজ দেওয়ার পর এবার 2 লক্ষ সরকারি ও 8 লক্ষ বেসরকারি চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বাংলায় তাঁদের সংকল্পপত্রে নারীদের জন্য একগুচ্ছ ঘোষণা আছে। মেয়েদের 18 বছর হলেই 2 লক্ষ টাকা, বিধবাদের জন্য মাসিক 3,000 টাকা। এছাড়া সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ, বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা, মেয়েদের (প্রাথমিক স্তর থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত) নিখরচায় শিক্ষা ও পরিবহণের কথা উল্লিখিত হয়েছে। এটা বিশ্বাসযোগ্য? সরকারি চাকরিই যারা তুলে দিচ্ছেন, তাঁরাই আবার সংরক্ষণের কথা বলছেন! যে দলের রাজত্বে উত্তরপ্রদেশে হাথরস, উন্নাও ঘটে, যে দল ধর্ষকদের মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দেয়, তারা নারীদের উন্নতি, নিরাপত্তার জন্য কিছু করবে এটা কি বিশ্বাস করা যায়?

 

 

এই ধরনের দান খয়রাতিকে অনেকে কল্যাণমূলক প্রকল্প (ওয়েলফেয়ার) হিসাবে অভিহিত করে থাকে, যা দিয়ে একটা ওয়েলফেয়ার স্টেটকে চিহ্নিত করা হয়। দান এবং ওয়েলফেয়ার বিষয় দু’টোকে পৃথক করার দরকার আছে। ধরা যাক তফশিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য সংরক্ষণ। এটা নিশ্চিত ভাবে একটা কল্যাণমূলক প্রকল্প, যার দ্বারা অনগ্রসর মানুষদের উন্নয়ন করার একটা ধারাবাহিক প্রচেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু ফ্রিজ, টিভি দেওয়া বা মাসে কিছু টাকা ধরিয়ে দেওয়া তো উৎকোচ দেওয়ার সামিল। প্রশ্নটা হচ্ছে সরকার ও মানুষের মধ্যে সম্পর্কটা কি দাতা আর গ্রহীতার? সরকার দান করে যাবে আর তার পরিবর্তে মানুষের প্রশ্নাতীত আনুগত্য দাবি করবে? দান খয়রাতির মাধ্যমে একটা সরকার-অনুগত বশংবদ সমাজ তৈরি হবে? পরিবারের গৃহকর্ত্রীর হাতে মাসে 6,000 টাকা তুলে দিলে তাঁর ভোটটা হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু তাঁকে স্বনির্ভর হতে সাহায্য করা যাবে কি? বন্ধ কলকারখানার শ্রমিকদের জন্য মাসে 2,500 টাকা আপাতত ঠিক আছে। কিন্তু সেই কারখানাগুলো পুনরায় খোলা কিংবা সেটার পরিবর্তে এই সময়ের উপযোগী নতুন কোনও উদ্যোগ শুরু করা আরও জরুরি নয় কি? খাদ্যশস্য বন্টনের যে উদ্যোগগুলি নেওয়া হয় সেগুলি অত্যন্ত জরুরি। কারণ যতই আমরা গলা ফাটিয়ে বলি আমরা খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভর, বাস্তবে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ এখনও অর্ধাহারে এবং অনাহারে থাকে। তাই ‘দু’টাকা কেজি চাল’ ধরনের প্রকল্পগুলি আরও বহুদিন এই দেশে চলবে। লকডাউনের পর থেকে বোঝাই যাচ্ছে ক্ষুধা এখন সমাজ জীবনের বড় একটা সমস্যা। যে কারণে বাংলায় প্রতিটি দলের ইস্তেহারে স্বল্পমূল্যে পেটভরা খাবারের কথা আছে।

 

 

প্রয়োজন হচ্ছে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা। 100 দিনের কাজ আরও বাড়ানো হোক, 150 দিন করা হোক; বিজেপি তো লাফিয়ে সেটাকে আবার 200 দিন করতে বলছে। ছোট বড় নানা ধরনের কাজ সৃষ্টি করা হোক। কাজের বিনিময়ে মানুষকে টাকা দেওয়া হোক, সরকার মানুষকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করুক। সেটাই তো সরকারের কর্তব্য। কথায় বলে জীবনে ফ্রি লাঞ্চ বলে কিছু হয় না। যখনই কোনও দল ভোটারদের বিনামূল্যে কিছু দেওয়ার কথা বলছে, তারা তাদের কাছ থেকে আনুগত্য দাবি করছে। আজ যখন সব দলই এই দোষে দুষ্ট এবং সমাজে দারিদ্র ও বৈষম্য প্রবল, তখন প্রতিটি নির্বাচনের আগে অবধারিত ভাবে প্রতিশ্রুতির বন্যা বইবে। কিন্তু জনগণকে জুমলাবাজি থেকে সতর্ক থাকতে হবে।



New
মাদক ব্যবসা ও বিভাজনের রাজনীতির আবর্তে আজকের মণিপুর
ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে রাষ্ট্রীয় মদত? বিস্ফোরক রিপোর্ট অসম রাইফেলসের
বিরোধী জোট আছে, রাজনীতি কই?


Other Writings by -সোমনাথ গুহ | 29-03-2021

// Event for pushed the video