4thPillar


নিরুপায় হয়েই বিপন্ন কৃষক আজ রাজপথে নেমেছেন

সোমনাথ গুহ | 08-12-2020May 24, 2023
নিরুপায় হয়েই বিপন্ন কৃষক আজ রাজপথে নেমেছেন

অনেকেরই প্রশ্ন কৃষি আইনে তিনটি সংশোধনী আনার পরেও কেন কৃষকরা এখনও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। কী কী সংশোধন আনা হয়েছে? এক, চুক্তি চাষের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর জন্য একটি ট্রাইবুনাল গঠিত হবে। মূল আইনে বলা হয়েছিল কোনও বিবাদের মীমাংসার জন্য জেলাশাসক বা বিডিওর কাছে অভিযোগ জানানো যাবে, সেখানে আদালতে যাওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। এখানে বাদী ও বিবাদীর মধ্যে ক্ষমতার আন্তঃসম্পর্ক বিচার্য। ক্ষুদ্র বা ছোট চাষি তো ছেড়েই দিলাম, একজন সম্পন্ন চাষিরও কি বিগবাস্কেট বা রিলায়েন্স রিটেইল-এর মতো প্রবল প্রতাপশালী সংস্থার সঙ্গে আইনি লড়াইয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রয়েছে? জেলাশাসকের পরিবর্তে আদালতে গেলেই চাষির সমস্যার সুরাহা হয়ে যাবে, এটা ভাবার কোনও যুক্তি নেই। দু’টি ক্ষেত্রেই বেসরকারি সংস্থা বিচার ব্যবস্থাকে প্রভূত ভাবে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে বলেই অনেকের ধারণা। সরকারের রক্ষাকবচ না থাকলে চাষি কোনওদিনই তার ন্যায্য দাবি আদায় করতে পারবেন না।

 

দ্বিতীয় সংশোধনীটি হল, বেসরকারি মান্ডিতেও কর বসানো হবে, যার দ্বারা রাজ্য সরকারের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া যাবে। তৃতীয়টি হল, বাজারে অংশগ্রহণ করার জন্য বেসরকারি সংস্থাগুলিকেও নথিভুক্ত হতে হবে, শুধুমাত্র প্যান কার্ড থাকলেই যে কেউ কৃষিপণ্য ক্রয় করতে পারবে, এটা হবে না। সমস্যাটা এত মামুলি নয়। কৃষিজাত পণ্যের বিপুল ব্যবসা পুরোপুরি বাজারের হাতে ন্যস্ত করা, এক্ষেত্রে সরকারের সম্পূর্ণ হাত গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তেই কৃষকদের মূল আপত্তি। বেসরকারি সংস্থাগুলির কাছে এই বাজার উন্মুক্ত করে দিয়ে সরকার নিজের দায় থেকে মুক্ত হতে চাইছে; এতেই কৃষকরা বিপন্ন বোধ করছেন।

 

এতে কতিপয় বিশেষজ্ঞদের গোঁসা হচ্ছে। এরা বলছেন যে, এই সচ্ছল, সম্পন্ন কৃষকরা সরকারের ছত্রছায়ায় থাকতে চান, তারা কোনও ঝুঁকি নিতে চান না। এখনকার ব্যবস্থাটাই তাদের সুরক্ষিত বলয়, ‘কমফোর্ট জোন’, যেটা নাড়াচাড়া করলেই তারা বিপন্ন বোধ করতে শুরু করেন। এর জন্য তারা যুক্তি দেখান যে, এপিএমসি (এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেট কমিটি) সেকেলে হয়ে গেছে, এটার উৎস ঔপনিবেশিক আমলে, যখন ব্রিটিশ সৈন্যদের সস্তায় খাদ্য জোগান দেওয়ার জন্য এটা প্রবর্তন করা হয়েছিল। ব্রিটিশ আমলের একটি প্রতিষ্ঠান যে আজও স্বাধীন ভারতে বিদ্যমান, এটা বলে তারা আমাদের মধ্যে সুপ্ত জাতীয়তাবাদও খুঁচিয়ে তুলতে চাইছেন। এটা অবশ্য ঠিকই যে, বৃহৎ কৃষক সমাজ সরকারি ছত্রছায়ায় থাকতে নিরাপদ বোধ করেন। সেই নিরাপত্তা পাওয়ার হকও তাদের আছে। তারা দেশের অন্নদাতা, কথাটা যতই ক্লিশে হয়ে যাক এটা তো 100% বাস্তব। তারা কৃষিপণ্যের উৎপাদনকারী, আবার একইসঙ্গে অন্যতম প্রধান উপভোক্তা, কৃষি উপকরণের বিপুল বাজার তাদের কারণেই প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হচ্ছে। আর সরকারি ব্যবস্থার বাইরে দেশের যে ছয়টি রাজ্যে এপিএমসি বাতিল করে দিয়ে বাণিজ্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে, সেখানকার চাষিদের দূরাবস্থা তো কহতব্য নয়। 2006 সালে বিহারে এপিএমসি বাতিল করা হয়। গত 14 বছরে সেখানে কোনও বেসরকারি সংস্থা রাজ্যের কৃষি পরিকাঠামো উন্নয়ন করার জন্য বৃহৎ কোনও বিনিয়োগ করেনি। উল্টে এইসব সংস্থা কৃষকদের থেকে লেনদেন বাবদ মোটা অঙ্কের টাকা ধার্য করে। রাজ্যে শস্যাগার, কোল্ড স্টোরেজের সংখ্যা চাহিদার তুলনায় নগণ্য মাত্র। শস্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা অপ্রতুল এবং তা যথেষ্ট খরচসাপেক্ষ। নীতি আয়োগের রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো, রাস্তাঘাট, যানবাহন ইত্যাদি গড়ে তোলার আগেই সেখানে এপিএমসি তুলে দেওয়া হয়। এর ফলে নতুন কোনও ব্যবস্থা তো গড়ে ওঠেইনি, উল্টে পুরনো সরকারি ব্যবস্থাও ধসে পড়েছে। বিহারের কৃষির এই ছন্নছাড়া অবস্থা দেখে পাঞ্জাব, হরিয়ানার চাষি যথার্থ ভাবেই প্রশ্ন করছেন যে, দশ বছর পরে তাদের অবস্থাও যে অনুরূপ হবে না, তার কী নিশ্চয়তা আছে?

 

আরও পড়ুন: নিজের ভাল পাগলেও বোঝে, চাষিরা বোঝে না?

 

গত জুলাই মাসে মহারাষ্ট্রে দুধ উৎপাদনকারীরা চাহিদার অভাবে কী বিপুল লোকসানের সম্মুখীন হয়েছিলেন, সেটা স্মরণ করা যেতে পারে। গরুর দুধ মুম্বাইয়ে 48-52 টাকায় বিক্রি হয়, চাষি পান 30 টাকা। লকডাউনের সময় চাহিদা তলানিতে নেমে যায়। চাষির প্রাপ্য 30 থেকে 17 টাকায় নেমে যায়। তারা রাস্তায় তাদের অবিক্রিত দুধ ঢেলে নিজেদের বিপন্নতা প্রকাশ করেন। তাদের লোকসান পূরণ করার জন্য তারা সরকারের থেকে অনুদান দাবি করেন। এটা কোনও ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। আখ চাষিরা প্রায়ই লাভজনক মূল্যের দাবিতে রাস্তায় নামেন। তুলো চাষে ক্ষতিপূরণের দাবিতে মুম্বাইয়ে কিষাণ পদযাত্রা হয়। আর এখনও অবধি যাদের নিয়ে আমরা আলোচনা করছি, তারা কৃষক সমাজের 15-20% মাত্র। বাকি 80% ছোট চাষি, যাদের জমির পরিমাণ 2 হেক্টরের নিচে, তারা তো মান্ডি ব্যবস্থার সুবিধাই পান না। এই চাষিরা অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল, অসহায়। এদের জমি অপ্রতুল। চাষের জমির মালিকানায় যে বিপুল বৈষম্য তা ঠিক করার জন্য প্রয়োজন ছিল ভূমি সংস্কারের, যা কোনওদিনই হয়নি। ভূমি সংস্কার কথাটাই এখন তামাদি হয়ে গেছে, তা এখন এতটাই প্রাচীন যে, বামপন্থী দলগুলিও সেটা কদাচিৎ উচ্চারণ করে। জমির যদি সুষম বন্টন হত তাহলে ক্ষুদ্র চাষি অর্থনৈতিক ভাবে দর কষাকষির জায়গায় পৌঁছতে পারত। সেই ক্ষমতা না থাকার কারণে নূন্যতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) যতই হোক, চাষিরা তাদের পণ্য সেটার কমেই বিক্রি করতে বাধ্য হন। এইসব চাষিদের স্বল্প উৎপাদনের কারণে তাদের পক্ষে সরকারি বা বেসরকারি কোনও বিক্রয় কেন্দ্রেই পৌঁছনো সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই মান্ডি, এমএসপি ব্যবস্থা অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া নয়, সেটা আরও প্রসারিত করা প্রয়োজন, যাতে সমস্ত ধরণের কৃষক এর সুযোগ নিতে পারেন।

 

চুক্তিচাষ কথাটার মধ্যেই একটা প্রতারণা রয়েছে। দুই পক্ষই যখন সমান সমান হয় তখন একটা চুক্তি হতে পারে (যুদ্ধে বিজয়ী ও পরাজিত ব্যতিক্রম মাত্র)। প্রবল প্রতাপশালী এক কর্পোরেট, তার সঙ্গে এক কৃষক- তা তিনি যতই সম্পন্ন হোন- দু’জনের মধ্যে পক্ষপাতহীন কোনও চুক্তি হতে পারে কি? কৃষক যেহেতু বাজার, আইন, প্রশাসন ইত্যাদি সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত নন, তাই প্রথম থেকেই কথার নানা ঘোরপ্যাঁচ দিয়ে এটা নিশ্চিত করা হয় যে, চুক্তি কোম্পানির পক্ষে। এর ফলে কৃষক প্রথম থেকেই কোণঠাসা হয়ে পড়েন। নানা অছিলায় পণ্যের মূল্য দিতে দেরি করা হয়, দামের হেরফের করা হয়। পণ্যের গুনমান যথেষ্ট ভাল নয় বলে তা বাতিল করা হয়। কিছু পণ্য নেওয়া হয়, বাকি ফেরত দিয়ে দেওয়া হয়- যা নিয়ে চাষি আতান্তরে পড়েন। চুক্তিতে কোথাও পরিষ্কার বলা নেই যে, কোম্পানি যদি একতরফা ভাবে চুক্তি বাতিল করে, তখন চাষির কী উপায়, তিনি কী ব্যবস্থা নিতে পারেন। কিংবা নানা কারণে, যা চাষির নিয়ন্ত্রণে নেই,  তিনি যদি পণ্য নির্ধারিত সময়ে সরবরাহ না করতে পারেন, এবং দেরি হওয়ার কারণে কোম্পানি সেই মাল নিতে অস্বীকার করেন, তখন চাষি কী করবেন? আইনে এইরকম অনেক ‘যদি-কিন্তু’ আছে, যেগুলো সম্পর্কে আইনে কোনও সদুত্তর নেই। এক বিশেষজ্ঞ চুক্তি চাষের পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন যে, আমাদের দেশে প্রয়োজনের অধিক চাল, গম উৎপন্ন হয়। তিনি বলছেন এফসিআই-এর গুদামে যা খাদ্যশস্য আছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় দেড় গুণ বেশি, সুতরাং চাল-গমের পরিবর্তে আমাদের আরও বেশি করে তুলো, ভুট্টা চাষ করা প্রয়োজন। প্রথমত, যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্যশস্য ছিল বলেই লকডাউনের সময় রেশনে অতিরিক্ত দশ কেজি করে শস্য দেওয়া গেছে। দ্বিতীয়ত, ধান-গম চাষ কমিয়ে দিয়ে আমরা কি আবার ষাটের দশকে ফিরে যেতে চাই, যখন খাদ্যের জন্য মানুষকে আমেরিকা থেকে আসা অত্যন্ত নিম্নমানের PL-480 গমের জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হতে পারে? তৃতীয়ত, যে জমিতে গম হয়, তা তুলোর জন্য উপযোগী নাও হতে পারে। তুলো, ভুট্টার চাষে প্রচুর পরিমাণে জলের প্রয়োজন হয়, যা জলসংকট সৃষ্টি করতে পারে। জল সংকটের কারণে এলাকার পরিবেশেরও প্রভূত ক্ষতি হতে পারে।

 

এই মুহূর্তে দেশের ভোজ্যপণ্য ব্যবসা দখল করা নিয়ে তিনটি কর্পোরেট সংস্থার তুমুল প্রতিযোগিতা চলছে। এই তিনটি সংস্থা হল জিওমার্ট, অ্যামাজন, ওয়ালমার্ট। লকডাউনে প্রভূত ক্ষতি হওয়ার কারণে ফিউচার গোষ্ঠী (বিগবাজার, ব্র্যান্ড ফ্যাক্টরি) তাদের খুচরো ব্যবসা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছে। বৃহৎ সংস্থাগুলি ছোটগুলিকে আত্মসাৎ করছে। এরা এই কৃষি বাজারের কর্তৃত্ব পাওয়ার জন্য উদগ্রীব। এই ধরনের সংস্থার চরিত্র হল, এরা নিজেরা ঝুঁকি নিতে অপারগ, তাই রেডিমেড সংগঠনকে দখল করতে চায়। এইভাবেই বিএসএনএলের পরিকাঠামো ব্যবহার করে বেসরকারি টেলিকম সংস্থাগুলি ফুলেফেঁপে উঠেছে। সরকারি অনুমতি না পাওয়ার কারণে বিএসএনএল বহু দিন তাদের গ্রাহকদের 4G কানেকশন দিতে পারেনি। অন্য সংস্থাগুলি যেখানে 4G থেকে 5G পরিষেবা উত্তরণের চেষ্টা করছে, তখন বিএসএনএল সবেমাত্র কিছু জায়গায় 4G পরিষেবা দেওয়া শুরু করেছে। এইভাবে সরকারি সংস্থাগুলিকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। এয়ার ইন্ডিয়াকে রুগ্ন করে দিয়ে বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলির রমরমা বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। সরকারি ব্যাঙ্কগুলির গোড়া কেটে দেওয়ার প্রচেষ্টা তো বহু দিন ধরেই চলছে। এখন আবার কর্পোরেটদের ব্যাঙ্ক খোলার ছাড়পত্র দেওয়ার প্রস্তাব আনা হয়েছে। গল্পটা সেই একই। কর্পোরেট সংস্থাগুলি সরকারি ব্যাঙ্কের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত পরিকাঠামো, সাধারণ মানুষের বিপুল আমানত করায়ত্ত করে নিজেদের ব্যবসার বৃদ্ধি ঘটাবে। একইভাবে অন্তত পাঁচ-ছয়টি রাজ্যে কৃষিক্ষেত্রে যে সুগঠিত পরিকাঠামো, বন্টন ব্যবস্থা রয়েছে তা কেন্দ্রীয় সরকার এই তিনটি আইনের মাধ্যমে কর্পোরেটদের হাতে সমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

 


New
বিদায় পিটি নায়ার: কলকাতার ইতিহাসবেত্তা
এগজিট পোল মিলে গেলেও যে প্রশ্ন উঠবেই
কংগ্রেস সেঞ্চুরি না করলে কে রুখবে বিজেপিকে?


Other Writings by -সোমনাথ গুহ | 08-12-2020

// Event for pushed the video