বড় বিচিত্র সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি আমরা। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের শাসকদলের দাক্ষিণ্যে সাম্প্রদায়িক শান্তি ও সৌহার্দ্য রক্ষা করার প্রচেষ্টার ক্ষেত্রেও আইন ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন ভাবে প্রয়োগ করা হয়। আইনের চোখে সকলেই সমান, কথাটি আর জোর গলায় বলা যায় না। ব্যক্তির পদবী, তার ধর্মীয় পরিচয়ের উপরে আইন তার সঙ্গে কী ব্যবহার করবে তা নির্ধারিত হচ্ছে অনেক সময়।
পাঠান যুবক খান আবদুল গফর খান যিনি সীমান্তগান্ধি বা ফ্রন্টিয়ার গান্ধি নামে খ্যাত, তিনি স্বাধীনতার পূর্বে খুদা-ই-খিদমতগার সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই সংগঠন ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের পুরোভাগে থেকে প্রবল ভাবে মুসলিম লিগ ও দেশভাগের বিরোধিতা করেছিল। স্বাধীনতার পরও খুদাই খিদমতগার উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক শান্তি ও সৌভ্রাতৃত্ব প্রচারে ব্রতীরয়েছেদীর্ঘদিন। এই সংগঠনের জাতীয় আহ্বায়ক ফয়সল খান গত 24 থেকে 29 অক্টোবর ব্রজভূমিতে 84 ক্রোশ পরিক্রমা করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরও তিন গান্ধীবাদীসমাজকর্মী চাঁদ মহম্মদ, অলোক রতন এবং নীলেশ গুপ্তা। পরিক্রমার অন্তিম দিন মথুরার নন্দবাবা মন্দির দর্শন করতে পৌঁছন ফয়সল খান। মন্দিরে প্রসাদ গ্রহণ করে পূজারিকে রামচরিত মানস পাঠ করে শোনান তিনি। মন্দির প্রাঙ্গণে উপস্থিত ভক্তদের মুগ্ধ করে দিয়ে রামায়ণ ও বিভিন্ন হিন্দু শাস্ত্র থেকে অনায়াসে নানা উদ্ধৃতি তুলে ধরেন ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলিম ফয়সল। ইতিমধ্যে নমাজের সময় হয়ে যাওয়ায় মন্দিরের পূজারি তাঁকে মন্দির প্রাঙ্গণেই নমাজ পড়ার অনুমতি দেন।
হিন্দু মন্দিরে মুসলিম ফয়সলের নমাজ পড়ার বিভিন্ন ছবি সমাজ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ সেই ছবিটিকেই ব্যবহার করে কট্টরপন্থী কিছু সেবায়েত মন্দিরে নমাজ পড়ার জন্য পূজারিকে পুলিশে অভিযোগ করতে চাপ দেয়। 1 নভেম্বর থানায় অভিযোগ করা হয় এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারা অনুযায়ী ফয়সল এবং তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। যাঁরা বহু দিন ধরে হিন্দু ধর্ম ও ইসলামের মধ্যে সেতু গড়ার চেষ্টা করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেই বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি এবং হিংসা ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়। 2 নভেম্বর উত্তরপ্রদেশপুলিশফয়সল খানকে দিল্লিতে গ্রেপ্তার করে মথুরায় নিয়ে আসে এবং আদালত তাঁকে 14 দিনের বিচারবিভাগীয় হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেয়।
এর ঠিক পরের দিন, 3 নভেম্বর চারজন হিন্দু যুবক মথুরার গোবর্ধনে ঈদগাহে হনুমান চালিশা পাঠ করেন, গায়ত্রী মন্ত্র জপ করেন। জানান, তাঁদেরও উদ্দেশ্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি মজবুত করা। এই ঘটনায় তাঁদেরও গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু দুই লাখ টাকায় বন্ডে সঙ্গে সঙ্গে জামিন পান তাঁরা। গত বেশ কয়েক বছর ধরে বজরং দল তাজমহলে প্রার্থনা করার হুমকি দিয়ে আসছে। অভিযোগ, বিজয়া দশমীর দিন হিন্দু জাগরণ মঞ্চের কিছু সমর্থক গেরুয়া পতাকা নিয়ে এই ঐতিহাসিক সৌধে প্রবেশ করে পুজোপাঠ করেন। তাঁদের বক্তব্য, তাজমহল আসলে একটি হিন্দু মন্দির। এ ব্যাপারেও উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকারের পুলিশ প্রশাসন নিশ্চুপ। তাজমহলের নিরাপত্তারক্ষীরা জানান, এই ধরনের কোনও ঘটনা সম্পর্কে তাঁরা অবহিত নন।
এ বড় অদ্ভুত সময়। এক ধর্মপ্রাণ মুসলিম, যিনি মনে করেন তাঁর ধর্ম ঈশ্বরপ্রেম, যিনি ব্রজভূমিতে আসেন সেই প্রেম ব্যক্ত করতে, সনাতন ধর্ম সম্পর্কে যাঁর গভীর অনুধাবন তাঁকে পূজারির অনুমতি নিয়ও মন্দিরে নমাজ পড়ার জন্য কারাবাস করতে হয়। অথচ অন্যরা একই ধরনের ঘটনায় অনায়াসে পার পেয়ে যায়। পুলিশ প্রশাসনের তোয়াক্কা না করে পাঁচশো বছরের পুরনো ইসলামি সমাধিক্ষেত্রকে হিন্দু মন্দিরে রূপান্তরিত করার হুমকি দিলেও তা অপরাধ বলে গণ্য হয় না। যোগী আদিত্যনাথেরউত্তরপ্রদেশে আইন আজ কতটা পক্ষপাতদুষ্ট, তার এর চেয়ে বড় নিদর্শন আর কী হতে পারে।
ফয়সল খান গ্রেপ্তার হওয়ার পর অযোধ্যার রাম জানকী মন্দিরের মোহন্ত আচার্য যুগল কিশোর শারণ শাস্ত্রী এবং ম্যাগসাইসাই পুরস্কারপ্রাপ্ত সমাজকর্মী ডক্টর সন্দীপ পান্ডে একটি বিবৃতিতে অনুতাপ করেন, ‘অবশেষে ফয়সল ভাই নিজের কর্মের শাস্তি পেলেন। ওঁর বোঝা উচিত ছিল যে এই সরকারের উপস্থিতিতে হিন্দু মুসলিম একতা বা সদ্ভাবনার কথা বলাও অপরাধ।’ আজকের এই ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টিকারী আবহে ফয়সল খান একজন উজ্জ্বল ও ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। তিনি দিল্লিতে জামিয়া মিলিয়ার নিকটে সমাজের নানা প্রকার ভেদাভেদের কারণে শহিদ হওয়া মানুষের প্রতি সমর্পিত ‘সবকা ঘর’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। সাম্প্রদায়িক সদ্ভাবনার উজ্জ্বল নিশান ওই ‘ঘরে’ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ একইসঙ্গে হোলি, ঈদ, দীপাবলি, ক্রিসমাস উদযাপন করেন। তাঁরা বলেন, ‘ফয়সল খান যত সহজে কুরআনের আয়াত পড়তে পারেন, ঠিক তত সহজেই রামচরিত মানসের চৌপাইও পড়তে পারেন।’ 2019 সালে অযোধ্যায় সরযূ নদীর আরতিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন ফয়সল। তার আগের বছর সন্ন্যাসী মুরারি বাপু তাঁকে নিজের আশ্রমে আমন্ত্রণ জানিয়ে সদ্ভাবনা পুরস্কার প্রদান করেন।
আচার্য শাস্ত্রী এবং ডক্টর পান্ডে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি 84 ক্রোশ পরিক্রমা করেছে তাঁর উদ্দেশ্য কী করে ধর্মীয় ভাবনাকে বিনষ্ট করার জন্য বা প্ররোচনামূলক হতে পারে? হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষদের তো এই বিষয়ে খুশি হওয়ার কথা, অন্য কোনও ধর্মের মানুষও তাদের ধর্মকে মান্যতা দিয়ে তাদের নিয়ম এবং উপাচার অনুযায়ী পরিক্রমা করে মন্দিরে ভগবানের দর্শন করার পর প্রসাদ গ্রহণ করছেন।’ অতীতেও ফয়সল খান রামজানকী মন্দিরে অনেকবার নামাজ পড়েছেন, কিন্তু কেউ কখনও তা নিয়ে আপত্তি করেনি।
16 নভেম্বর ফয়সল খানের জামিনের আবেদনের শুনানি তদন্তকারী অফিসারের করোনা হওয়ার কারণে বাতিল হয়ে যায়। 20 তারিখ পরবর্তী দিনে তদন্তকারী অফিসার বা তাঁর পরিবর্তে অন্য কেউ আসেননি। ফলে ফের শুনানি মুলতবি হয় এবং 24 তারিখ পরবর্তিশুনানির দিন ঠিক হয়। ইতিমধ্যে মথুরা পুলিশ বিহারের খাগারিয়া জেলায় জলকউরা গ্রামে, চাঁদ মহম্মদের বাড়িতে হানা দেয়। বাড়ির লোকদের বেধড়ক মারধর করে, ঘরের জিনিসপত্র তছনছ করে চাঁদের ভাইকে গ্রেপ্তার করে দিল্লি নিয়ে যায় এবং পরের দিন ছেড়ে দেয়। 24 তারিখ ফয়সলের জামিনের আবেদন ফের খারিজ হয়ে যায়। সরকারি কৌঁসুলি বলেন, ফয়সল যে খুদাই খিদমতগারের সদস্য, সেটার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ তিনি দিতে পারেননি। জামিন না দেওয়ার আরও একটি কারণ অভিনব! ফয়সলের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে 6.5 লাখ টাকা পাওয়া গেছে যা নাকি কোন বিদেশি সংস্থার অনুদান। অর্থাৎ, মথুরা মন্দিরে নমাজ পড়ার পিছনে কোন বিদেশি চক্রান্ত আছে!
উপরোক্ত ঘটনা এবং এই অভিযোগের কী ব্যাখ্যা করা যেতে পারে? এটা স্পষ্ট, সংখ্যালঘু মানুষদের যে কোনও অছিলায় হেনস্থা করা, নিপীড়ন করা, কারারুদ্ধ করা বর্তমান সরকারের উদ্দেশ্য। ডক্টর কাফিল খানকে কী ভাবে দফায় দফায় কয়েদ করা হয়েছে তার উদাহরণ তো টাটকা। কেরালার সাংবাদিক সিদ্দিকি কাপ্পান, যিনি হাথরসের ধর্ষণের ঘটনার খবর সংগ্রহে গেলে, তাঁকে ‘পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া’র সদস্য বলে দেগে দিয়ে ফের বিদেশি চক্রান্তের অজুহাতে গত 5 অক্টোবর থেকে গ্রেপ্তার করে রাখা হয়েছে। যত দিন যাবে, ফয়সল খানের মতোমানুষেরা নিজেদের গুটিয়ে নেবেন, সমাজবিমুখ হয়ে পড়বেন। কারণ তাঁরা উপলব্ধি করছেন, যে সংখ্যালঘু-বিদ্বেষী এই সরকারের আমলে ঐক্য ও সদ্ভাবনার চেষ্টা বিনাশের নামান্তর মাত্র।