4thPillar


অবরোধের ডায়েরি: কিছু ভাট বকা হা-রাম-জা-দা

রঞ্জন রায় | 11-04-2020May 23, 2023
অবরোধের ডায়েরি: কিছু ভাট বকা হা-রাম-জা-দা

যা তা ব্যাপার! দু’সপ্তাহের কোয়ারান্টাইনে থাকতে থাকতে মেজাজ সবার খিটখিটে। রান্নায় স্বাদ নেই। চ্যানেলে চ্যানেলে আক্রান্তের এবং মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কিছু একটা দেখতে দেখতে মুখ থেকে বেরিয়ে এল - হারামজাদা!

ব্যস, মেয়ে বলল- মুখ খারাপ করছ কেন?

গিন্নি বললেন, এই পরিবারে এটাই চলন।

আমি বললাম- অ্যাই, আমারে যা কওয়ার কও; পরিবার তুল ক্যান?

তারপর নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে আত্মানুসন্ধানে লেগে পড়লাম।

ঘটিদের যেমন শালা, বাঙালদের তেমনই হারামজাদা। অবশ্যি ঘটির তস্য ঘটি বঙ্কিমের বন্ধু দীনবন্ধু মিত্র ‘নীলদর্পণ’ নাটকে নীলকর সায়েবদের মুখে ওই ‘হারামজাদা’ এবং ‘বাঞ্চৎ’ গালি দু’টো বসিয়েছেন। কিন্তু বাঙালদের মুখে ‘শালা-বাঞ্চোৎ’? আমি শুনিনি।

ভুল বললাম; আমার প্রাইমারি স্কুলের বন্ধু স্কুল ফেরত ঘরে না গিয়ে আমাদের বাড়ি খেলতে এসেছিল। খানিকক্ষণ পর ওর পিতৃদেব এসে ওর দিকে তেড়ে গেলেন– ‘হালার পোলা হালা! হালারে কাইট্যা ফালামু হালা’!

আরও পড়ুন 

অবরোধের ডায়েরি: দোজখনামা

উনি পার্কসার্কাস বাজারের কসাইদের ছাগল নিয়ে যাওয়ার ভঙ্গীতে ছেলের কান ধরে বাড়ি নিয়ে গেলেন। আতঙ্ক কেটে গেলে আমি দাদুকে জিজ্ঞেস করলাম - হালা কারে কয়?

দাদু বললেন - এইডা আসলে শালা, ঢাকাইয়ারা এমুন কইর‍্যা কয়।

-তোমরা কও না ক্যারে?

-দূরহ ব্যাডা প্যাট-ব্যাক্কল! কইলাম না অরা ঢাকাইয়া?

দাদুর কথার লব্জ ছিল ‘হারামজাদা’। একবার রেডিওতে শনিবারের অনুরোধের আসরে লতা মঙ্গেশকরের গলায় ‘প্রেম একবার এসেছিল নীরবে’ শুনে ঘোর লেগে গেল। দাদুও চেয়ারে বসে হাঁটুর উপর আরেক হাঁটু তুলে সেলাই মেশিনের মত পা নাচাতে নাচাতে শুনছিলেন।

আমার ক্লাস থ্রি। ঘোর কেটে গেলে আমার প্রশ্নাবলী - প্রেম একবার আইয়া চইল্যা গেল, কিন্তু ‘এসেছিল পারিনি তো জানতে’? ক্যারে টের পাই নাই? পা টিইপ্পা টিইপ্পা আইছিল? খালি পায়ে? তুমি ঘুমাইতেছিলা নাকি?

দাদু মুচকি হেসে বললেন- হা-রাম-জা-দা! যা প্যাট ভইরা আরও এক থালা ভাত খাইয়া আয়! আর পাতে লবণ খাইবি বেশাইয়া।

বাবা বাড়ির ভেতরে বা ছোটদের সামনে কখনও গাল পাড়তেন না। বেশ ভিক্টোরীয় রুচির লোক। কিন্তু ময়মনসিংহবাসী কারও গল্প বলতে গেলে চরিত্রটির জবানে যদি গালিটি থাকে তো নির্দ্বিধায় বলতেন। দিল্লিবাসী কোনও আধিকারিকের ল্যাং খেয়ে ট্রান্সফার হওয়া ভিলাই স্টীলের এক উচ্চপদস্থ বাঙালি আধিকারিক (সবাই তাঁর বিশাল গোঁফ দেখে গুঁফো ভটচায্যি বলত) নাকি দিল্লির ইস্পাত ভবনে ঐ শকুনিকে বাগে পেয়ে জুতোপেটা করে ক্যামেরাম্যান ডেকে ছবি তুলিয়েছিলেন! কিন্তু পেটানোর সময়ে তাঁর মুখে ছিল সেই একটিই সম্বোধন- হা-রাম-জা-দা!

ছোটবেলায় চার সিলেবলে ভাগ করে উচ্চারিত গালিটি আমার কানে মধুবর্ষণ করেছিল।

সেইবার খেলার মাঠ থেকে বাড়ি ফিরে পিঠোপিঠি দুইভাই বাথরুমে হাতাহাতি শুরু করলাম। সেজকা দুজনের কান ধরে রান্নাঘরে মা-কাকিমার সামনে হাজির করে অভিযোগ পেশ করলেন- বৌদি, এই আপনার দুই ছেলে - ক্লাস থ্রি আর ফোর - একজন আরেকজনকে বলছে শালা, অন্যজন হা-রাম-জা-দা!

দাদুর কাছে শুনতাম আমাদের পূর্বপুরুষের গল্প। দাদু সতীশচন্দ্রের বর্ণনায় সেই সব গৌরবগাথা জীবন্ত হয়ে উঠত। যেমন জয়দেব ইন্দ্র নীলকরের নীলভর্তি নাও (নৌকো) মেঘনায় ডুবাইয়া দিছিলেন। তাঁর ভাইপো পরে ইংরাজ আমলের ডাকসাইটে দারোগা হয়েছিল। হাফপ্যান্ট, বুটজুতা, হাঁটু অব্দি মোজা, মাথায় সোলার হ্যাট, হাতে ব্যাটন, কোমরে পিস্তল– তিনি যখন ঘোড়া দাবড়ে এলাকায় টহল দিতেন তখন আচ্ছা আচ্ছা ঘাগু ক্রিমিনালেরা কেঁপে উঠত, নতুনেরা প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলত।

দেশভাগের সময় প্রাণ হাতে করে সপরিবারে মেঘনা নদী পার করে পালিয়ে এসে কলকাতায় তিন কামরার ভাড়াবাড়িতে বাইশজন ঠাসাঠাসি করে থাকা হিন্দু সংযুক্ত পরিবারের কর্তার সান্ত্বনা বলতে এইটুকুই ছিল। এক ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডির শিকার প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি ভিটেমাটি চাটি হওয়ার জন্য কেমন করে যেন নিজেকেই দায়ি করতেন।

ও হ্যাঁ; সেই দারোগার গল্পটি। তিনি নাকি একবার এক কুখ্যাত ডাকাতকে তাড়া করে জনশূন্য মাঠের মধ্যে এক ফকিরের দরগায় পৌঁছে গেছিলেন। চোখ বুঁজে তসবি জপা ফকিরকে দেখে তাঁর কেমন সন্দেহ হল। ব্যাটনের খোঁচা খেয়ে ফকিরসাহেব চোখ খুললে উনি বললেন– ডাকাত কোন দিকে গেছে? তোমার ঠেকে লুকিয়ে নেই তো? ভালোয় ভালোয় বলে দাও নইলে মুশকিলে পড়বে।

বিরক্ত ফকির নাকি ভ্রূ কুঁচকে বলেছিলেন- বাঞ্চৎ বাওরা হ্যায় ক্যা?

ব্যস, ঘোড়া হঠাৎ চিঁ-হিঁ-হিঁ ডাক ছেড়ে দারোগাকে পিঠে নিয়ে জোরকদমে ছুটে চলল। তিনদিন তিনরাত কোনও খবর নেই। চতুর্থ দিন লোকজন হদিশ পেল। বারো মাইল দূরে মধুখালির গড়ের কাছে ঘোড়া নিশ্চিন্ত মনে ঘাস খাচ্ছে, কোন হেলদোল নেই। দারোগার মৃতদেহ রেকাবে এক’পা আটকে লটকে রয়েছে।

সত্যি-মিথ্যে যাই হোক, এই গল্পটি ছোটবেলায় দাদুর মুখে বহুবার শুনেছি। আমাদের বারবার শোনার উদ্দেশ্য হল দাদুর মুখে ‘বাঞ্চৎ’ গালিটি শোনা। সে কী পুলক!

একজন ছোট ভাইকে উস্কে দেওয়া হত। সে গিয়ে জলখাবারের সময় নিরীহ মুখ করে বলত- “আচ্ছা দাদু, আমাদের এক পূর্বপুরুষ ডাকসাইটে দারোগা ছিলেন না? কী যেন নাম? আর তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যুর ব্যাপারটা?”

দাদু চশমার ফাঁক দিয়ে পুঁচকে নাতিকে মন দিয়ে দেখলেন এবং বাচ্চাটার “মর্মান্তিক মৃত্যু” গোছের শুদ্ধ শব্দ প্রয়োগে খুশি হয়ে বলতে শুরু করলেন। তাঁর কথকতা এক্সপ্রেস ট্রেনের মত টাইম টেবিল এবং স্টপেজ মেনে নির্দিষ্ট লয়ে এগিয়ে চলল। ঘরভর্তি লোক, মহিলারাও আছেন। গল্পটি সবারই শোনা। ফলে সবাই আন্দাজ করতে পারছে যে সেই অমোঘ মুহূর্তটি কতদূর? যেন খড়গপুর স্টেশন আসছে।

গল্প এগোয়, আর ঘরের ভিতরে ভিড় পাতলা হতে থাকে। শেষে সেই আর্ষপ্রয়োগের সময় শ্রোতা কূল্যে আমরা চার ভাই; তাতে কী!

‘হারামজাদা’ শব্দটি কি ‘রুঢ়’, ‘রুঢ়ি’ নাকি ‘যোগরুঢ়’?

এসব জেনে কি আপনার চারটে হাত গজাবে? তাহলে সুনীতিকুমার চট্টো বা ভগবদগীতাখ্যাত জগদীশ ঘোষকে জিজ্ঞেস করুন।

যদি এত গ্রামারের কচকচিতে উৎসাহ, তো যান না, বাঙলাবাজারে ‘করোনা ভাইরাস’, ‘লক ডাউন’, ‘কোয়ারান্টাইন’, ‘সোশাল ডিস্ট্যান্সিং’, ‘মাইগ্র্যান্ট লেবার’ বা ‘হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন’ শব্দাবলীর অর্থ-অনর্থ, উৎপত্তি-ব্যুৎপত্তি এবং লেক্সিকন নিয়ে কোমরবেঁধে লাগুন।

আচ্ছা, বড় হতে হতে যা জেনেছি সেই ইনফরমেশনগুলো শেয়ার করছি; করা উচিত। এভাবেই COVID-19-এরও ভ্যাকসিন বেরোবে।

হারামজাদা শব্দের সরল অর্থ- হারামের পুত্র, যেমন শাহজাদা, নবাবজাদা ইত্যাদি। সমাস হবে ষষ্ঠী তৎপুরুষ, ব্যাসবাক্য - হারামের পুত্র; যেমন রাজার পুত্র= রাজপুত্র।

আমার স্বগত ভাষণ বোধহয় গিন্নির কানে গেছল।

-ভুল; এটি বহুব্রীহি সমাস। ব্যাসবাক্য - হারাম হইতে জাত যে সে, অর্থাৎ ‘অবৈধ সন্তান’। হারাম ভারতীয় শব্দ নয়, বিদেশি শব্দ। ওটিকে বিশেষ্য পদ ধরলে ব্যাসবাক্য হবে ‘হারামাৎ জায়তে যঃ স।’

রিটায়ার্ড স্কুলটিচার মহিলাটি আমার ভুল বের করতে মুখিয়ে থাকেন। মেয়ে হোয়াটসঅ্যাপ জোকস স্টাডিতে বাধা পড়ায় বিরক্ত হয়ে বলল– দুটোই ঠিক। ড্যাড, আগামী জন্মে কোনও টিচারকে বিয়ে করো না। সুখে থাকবে।

গিন্নি বিড়বিড় করছিলেন- আলাদা করে হারামজাদা শব্দটি দেখলে তৎপুরুষ, কিন্তু শব্দের উদ্দিষ্ট যদি হারামজাদা ব্যক্তিটি হয় তবে অবশ্যই বহুব্রীহি।

আমি এসবে কান না দিয়ে তাক থেকে কিছু অভিধান নামিয়ে পাতা ওল্টাতে লাগলাম। বিভিন্ন অভিধান বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি হাতড়ে পাওয়া গেল ‘হারাম’ শব্দটি উর্দু এবং এর শাস্ত্রবিহিত অর্থ হল ‘নিষিদ্ধ’। যেমন মুসলমানের জন্য শূকর নিষিদ্ধ। মানে খালি শূকরের মাংস নয়, শূকর পশুটিই অপবিত্র, ছোঁয়া লাগা গুনাহ। তাই হারামজাদার যোগরূঢ় অর্থ হল ‘শুয়োরের বাচ্চা’— বাঙালির প্রিয় গালি। হিন্দি বলয় থেকে বঙ্গদেশে পদার্পণ করলে আমার কান জুড়িয়ে যায় দু’টো বাঙালি-স্পেসিফিক গালি শুনলে। একটা তো বললাম; দ্বিতীয়টি- যা মানুষের স্বভাবজাত মূর্খতার প্রতি ইশারা করে- না বললেও চলে।

কিন্তু হিন্দুদের বরাহ আবার বিষ্ণুর তৃতীয় অবতার!

-“বসতিদশনশিখরে ধরণী তব লগ্না,

    শশিনিকলংকলেবনিমগ্না,

    কেশব ধৃত শূকররূপ জয় জগদীশ হরে”

 

হুঁ হুঁ বাবা, আমার দাদু, আচারনিষ্ঠ বৈষ্ণব ছোটবেলায় দশাবতার স্তোত্র শিখিয়েছিলেন, খালি ‘হারামজাদা’ নয়, বললে হবে! দেখা যাক, হিন্দুদের ক্ষেত্রে কোনটা খাওয়া ‘নিষিদ্ধ'। এর জন্য খুলতে হবে স্মৃতিশাস্ত্রের শ্রেষ্ঠ মনুসংহিতা। পঞ্চম অধ্যায়ে রয়েছে খাদ্যাখাদ্য বিচার। চমকে গেলাম, কী কী খাওয়া যাবে না তার বিরাট লিস্টি, তাও আবার জাতধর্ম অনুযায়ী আলাদা আলাদা। কিন্তু এর পরে থাকছে এক্সেপশন বা ব্যতিক্রমের লিস্ট।

যেমন 5/14 এবং 5/15 বলছে বক, দাঁড়কাক, কুমীরাদি মাংসাশী জন্তু এবং সর্বপ্রকার মৎস্য বর্জনীয়। কারণ সব মৎস্যই মাংসভোজী। মাছ আমাদের হারাম? বাঙালী খাবে কী?

 

কিন্তু পরের শ্লোকটি (5/16) দেখে ধড়ে প্রাণ এল। সেখানে বলছেঃ

“পাঠীনরোহিতাবাদ্যৌ নিযুক্তৌ হব্যকব্যয়োঃ।

   রাজীবান সিংহতুণ্ডাশ্চ সশল্কাংশ্চৈব সর্বশঃ।।1

 

অর্থাৎ, দেবকার্যে এবং পিতৃকার্যে প্রযুক্ত বোয়াল এবং রোহিত (ভক্ষ্য); রাজীব, সিংহতুন্ড (শিঙ্গিমাছ) এবং সকলপ্রকার আঁশযুক্ত মৎস্য ভক্ষণ করবে।

মৎস্য হল আমাদের প্রথম অবতার– কেশবধৃত মীনশরীর জয় জগদীশ হরে! -তবু খেতে মানা নেই । হিন্দুধর্ম বেশ উদার, হে-হে!

কিন্তু “ব্যাঙের ছাতা, গ্রাম্য শূকর, রসুন, পেঁয়াজ, গাজর এবং গ্রাম্য কুক্কুট জেনেশুনে খেলে দ্বিজগণ পতিত হবেন”।2

তাহলে বঙ্গদেশের সমস্ত ব্রাহ্মণ পতিত, গ্যারান্টি দিয়ে বলছি।

আর যজ্ঞ, শ্রাদ্ধ, মধুপর্কে নিবেদিত মাংস, অন্যথায় ব্রাহ্মণের অনুমতি নিয়ে অথবা প্রাণসংশয়ে মাংস খাওয়া যাবে।3

আর এটা দেখুন:

“নিযুক্তস্তু যথান্যায়ং যো মাংসং নাত্তি মানবঃ।

স প্রেত্য পশুতাং যাতি সম্ভবানেকবিংশতিম।। 5/35

অর্থাৎ শ্রাদ্ধে ও মধুপর্কে যথাবিধি নিযুক্ত হয়েও যে মাংসভক্ষণ করে না, সে মরে গিয়ে একুশ জন্ম পশুত্ব প্রাপ্ত হয়।4

ওঁ মধু! মধু! ইউরেকা! ‘সত্যই তুমি মহান উদার বাদশা আলমগীর’ ইত্যাদি!

কিন্তু গোমাংস ভক্ষণ নিয়ে মনু একটি লাইনও খরচ করেননি। হ্যাঁ-না কিচ্ছুই বলেননি। যদিও গোমূত্র, গোময়কে পবিত্র এবং প্রায়শ্চিত্তের সহায়ক বলেছেন কিন্তু কোথাও গরুকে মাতা বলেননি। একাদশ অধ্যায় দেখুন - যাতে সেই সময়ের পিনাল কোড এবং ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড দেওয়া আছে।

আরও লক্ষ্যণীয়, উনি গোবধকে (যে অভিযোগে বর্তমান ভারতে একগাদা প্রাণ গেছে) আদৌ মহাপাতক বলেননি। চারটে অপরাধকে উনি বলেছেন “মহাপাতক”। যেমন ব্রহ্মহত্যা, নিষিদ্ধ সুরাপান, ব্রাহ্মণের সোনা অপহরণ, গুরুদারগমন ও এদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা।5

গোবধ মহাপাতক নয়, উপপাতক বা দ্বিতীয় শ্রেণীর হারাম। এতে গোবধের সঙ্গে রয়েছে প্রায় চল্লিশটি অপরাধের বিশাল লিস্টি, তাতে পরদারগমন, বেতন দিয়ে অধ্যাপন এবং অধ্যয়ন, মৈথুন ছাড়া অঙ্গুলিপ্রক্ষেপাদিদ্বারা কন্যাদূষণ, বৌকে দিয়ে বেশ্যাবৃত্তি করিয়ে জীবিকার্জন, নাচগান করে পেট চালানো, স্ত্রী এবং শূদ্র হত্যা ও নাস্তিকতা। 11/59 থেকে 66পর্যন্ত। 6-এর কোনওটির শাস্তি প্রাণদন্ড নয় ।

আরও পড়ুন

অবরোধের ডায়েরি: হাজার বছরের প্রেমের কবিতা

 

আর গোমাতা’ যে কোন শাস্ত্রে বলেছে তা আজও খুঁজে চলেছি। ‘হিন্দুত্ব' প্রণেতা সাভারকর গরুকে মাতা বলতে অস্বীকার করেছেন।7

উপনিষদে মহাভারতে রামায়ণে দেখছি গাভী মা নয়, সম্পত্তির একক। কেনা বেচা হয়, দান দেওয়া হয়। মাকে নিয়ে কেউ এসব করতে পারে? বৃহদারণ্যক উপনিষদে জনকসভায় যাজ্ঞবল্ক্য তর্কে জিতে সোনা দিয়ে শিঙ মোড়া একহাজার গাভী পুরস্কার পেলেন। একই উপনিষদের শেষের দিকে খিলকাণ্ডের চতুর্থ ব্রাহ্মণে 18 নম্বর শ্লোকে বলছে: যদি কোন দম্পতি বিখ্যাত, বেদজ্ঞ, দীর্ঘায়ু পুত্রসন্তান কামনা করেন তবে কচি বাছুর বা বয়স্ক বৃষের মাংস দিয়ে পলান্ন  রাঁধিয়ে আহার করলে ঐরূপ সন্তানোৎপাদনে সমর্থ হবেন”।8

ধেত্তেরি! ফের ধান-ভানতে-শিবের-গীত! ‘হারাম’ চর্চা থেকে হারামিপনা শুরু। ফিরে আসছি ‘হারামজাদায়’।

যা বুঝলাম হারামজাদার সংস্কৃত, বাঙলা এবং ইংরেজি অর্থ- বর্ণসংকর, প্রতিলোমজাত বা বিবাহ বহির্ভূত সন্তান, জারজ বা উপপত্নীর সন্তান, বেজন্মা, বাস্টার্ড, ইল্লেজিটিমেট চাইল্ড ইত্যাদি।

মনু বলছেন- মা-বাবা একই জাতির হলে উত্তম; নইলে সন্তান হবে বর্ণসংকর। এর মধ্যেও অনুলোম (পিতা উচ্চবর্ণ এবং মা নিম্নবর্ণ) বিবাহ বৈধ; সন্তান পাবে পিতার গুণ এবং তার জাত হবে পিতার থেকে নিম্নে কিন্তু মায়ের থেকে উচ্চে।

(মহাভারতে পরাশর মুনির নৌকোতে নিষাদরাজের কন্যা মৎসগন্ধার সঙ্গে কামবশ উপগত হয়ে তাকে সত্যবতী বানিয়ে দেওয়া এবং গর্ভে মহাভারতকার কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের জন্মের গল্পটি মনে করুন।)

কিন্তু প্রতিলোম বিবাহ (মা উচ্চবর্ণ, পিতা নিম্নবর্ণ) অবৈধ। সন্তান পাবে পিতার হীনগুণ এবং স্থান হবে পিতার জাতের চেয়েও নিম্নে। যেমন ব্রাহ্মণ মাতা ও শূদ্রপিতার সন্তান হবে ‘নরাধম চন্ডাল’।9 এরাই আসল বর্ণসংকর বা বাস্টার্ড, আমাদের সন্দর্ভে বললে ‘হারামজাদা’। আবার চন্ডাল যদি ব্রাহ্মণীতে উপগত হয়, তাদের সন্তান চন্ডালের থেকে আরও নিকৃষ্ট হবে।10 হারামজাদাদের মহর্ষি মনু একদম সহ্য করতে পারতেন না ।

“যে রাজ্যে বর্ণসংকরজাতি উৎপন্ন হয়, সেই রাজ্য ও রাজ্যবাসী অচিরেই বিনষ্ট হয়”। 11

এবার মন খারাপের পালা। আমার চেনাশোনা অনেক পরিবারেই শূদ্র বা যজ্ঞোপবীতহীন পুরুষ বিয়ে করেছেন ব্রাহ্মণ কন্যাকে। কিন্তু তাদের সন্তানেরা দেখছি প্রতিলোম সম্পর্কের সন্তান হয়েও বাপ-মা’র থেকে মেধাবী। তাহলে?

বছরখানেক আগে ইলেকশনের সময় একটি সর্বভারতীয় দলের নেতা প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন- এবার ইলেকশনটা হচ্ছে রামজাদা বনাম হারামজাদা।

আমি বেশ মজা পেয়েছিলাম, নেতাটির উইটের প্রশংসা করেছিলাম। কিন্তু কেন কমিশন কেস দিল বুঝিনি, এখন বুঝতে পারছি। রাম স্বয়ং নিজের এবং পরিবারের ইমেজ নিয়ে বেশ সচেতন ছিলেন। তাই অগ্নিপরীক্ষার পরও সীতাকে নিয়ে সন্দেহ যায়নি। গুপ্তচরের চুকলি শুনে গর্ভবতী সজাতি পত্নীকে বনে পাঠালেন। শেষে লব-কুশকে নিয়ে সীতা ফিরে এলেও রামের সন্দেহ গেল না যে এরা ‘রামজাদা’ না ‘হারামজাদা’। তাই সীতার সপক্ষে বাল্মীকির বিশাল লেকচার ‘অপাপা যদি মৈথিলী' 12 সত্ত্বেও আবার অগ্নিপরীক্ষা দিতে বললেন। সীতার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। ধরিত্রীকে ডেকে বললেন- মাগো, আর পারছি না। এবার কোলে নাও।13

কিন্তু রামের আচরণ মনুসংহিতা অনুযায়ী বিধিসম্মত। তাইতো তিনি ‘মর্য্যাদাপুরুষোত্তম’।

মুড খারাপ হয়ে গেল। হারামজাদাদের কি কোনও উদ্ধার নেই?

বারোতলার ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালাম। এখানেই ক’দিন আগে গিন্নি ও মেয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থালা বাজিয়েছি, শাঁখ ফুঁকেছি, ঘর নিষ্প্রদীপ করে মোমবাতি জ্বালিয়ে সমবেত কন্ঠে ‘গো করোনা, গো!’ বলেছি।

হঠাৎ মাথার ভেতরে টিউবলাইট জ্বলে উঠল।

একবার হাতে এসেছিল শ্রীশ্রী সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ সম্পাদিত “আর্যশাস্ত্র” মাসিক পত্রিকার একটি সংখ্যা। তাতে কভারপেজের ভেতরের দিকে নীল রঙে ছাপা ছিল রামনামের মহিমা। গল্পটা হল এক মুসলমান যবন অরণ্যে পশুশিকার করিতে গিয়া বন্য বরাহের আক্রমণে নিহত হইল । প্রাণত্যাগের পূর্বে সে আফশোস করিয়া বলিল- ‘হারামের দ্বারা হত হইলাম’। অহো, রামনামের কি মহিমা! ‘হারাম’ শব্দের ভিতর রামনাম উপ্ত ছিল। এইভাবে নিদানকালে রাম নাম উচ্চারণ করায় সেই ম্লেচ্ছ যবনের স্বর্গপ্রাপ্তি হইল।

তাহলে আমার দাদু এবং পরিবারের মানিগণ্যিরা যাঁরা এতদিন ‘হারামজাদা’ বলে এসেছেন তাঁরাও তো রামনামের তরণীতে চড়ে বৈতরণী পেরিয়ে গেছেন। আমিই বা কেন বাদ যাই! গোল গোল করে রিং ছেড়ে অনভ্যস্ত জিভে দাঁতের ফাঁক দিয়ে বলি– হা-রাম-জা-দা!

 

 

1. মনুসংহিতাঃ ভূমিকা, অনুবাদ এবং টীকাঃ অধ্যাপক সুরেশ্চন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, পৃঃ ১৪৭।

2. ঐঃ ৫/১৯, পৃঃ ১৪৮।

3. ঐ; ৫/২৭, পৃঃ ১৪৮।

4. ঐ; পৃঃ ১৫০ ।

5. ঐ; ১১/৫৪, পৃঃ  ৩০৬।

6. ঐ; পৃঃ  ৩০৭-৮।

7. বৈভব পুরন্দরে, “সাভারকর, দ্য ট্রু স্টোরি অফ দ্য ফাদার অফ হিন্দুত্ব” পৃঃ ২০০-০১।

8. বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ৬/৪/১৮। উপনিষৎ গ্রন্থাবলী, তৃতীয় ভাগ, স্বামী গম্ভীরানন্দ সম্পাদিত, পঞ্চম সংস্করণ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলিকাতা-৩।

9. মনুসংহিতা, ১০/১২, ১০/১৬। পৃঃ ২৮৭-৮৮।

10. ঐ; ১০/৩০, পৃঃ  ২৮৯।

11. ঐ; ১০/৬১; পৃঃ ২৯২।

12. বাল্মীকি রামায়ণ, উত্তরকান্ড , শেষ দুটো পাতা।

13. বাল্মীকি রামায়ণ, উত্তরকান্ড , “সীতায়াঃ পাতালপ্রবেশঃ “ বলে অন্তিম অংশটুকু।

 


New
মাদক ব্যবসা ও বিভাজনের রাজনীতির আবর্তে আজকের মণিপুর
ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে রাষ্ট্রীয় মদত? বিস্ফোরক রিপোর্ট অসম রাইফেলসের
বিরোধী জোট আছে, রাজনীতি কই?


Other Writings by -রঞ্জন রায় | 11-04-2020

// Event for pushed the video