আজ ভারত-পাক উপমহাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ গল্পবলিয়ে সাদাত হোসেন মান্টোর জন্মদিন। দশ বছর ধরে শতবর্ষ পালনের উপলক্ষ্যে কলকাতায় ওঁর নির্বাচিত গল্পের অনেকগুলো সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। বহু লিটল ম্যাগ ওঁকে নিয়ে অনেক ভারি ভারি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ ছেপেছে। চুলচেরা বিচার হয়েছে ওঁর লেখাকে কোন খোপে ফেলা যায়- ম্যাজিক রিয়ালিজম নাকি পোস্ট-মডার্ন ইত্যাদি?
এইসবের মধ্যে কোথায় হারিয়ে গেছেন ভালবাসার কাঙাল সেই মানুষটি যিনি জাতপাত-ভাষা-ধর্মের বা দেশকালের বিভেদ মানতেন না। তাঁর আত্মার সঙ্গী ‘টোবা টেক সিং’ নামের পাগল চরিত্রটি ধর্মের ভিত্তিতে বুড়োখোকাদের ভারত-পাকিস্তান ভাগ করা মেনে নিতে না পেরে এক কাল্পনিক সীমান্তরেখার দু’পাশে হাত-পা ছড়িয়ে মরে যায়। দাঙ্গায় খুন ও লুটপাটে মেতে ওঠা ইশর সিং নিজের অজান্তে মৃতের সঙ্গে সঙ্গম করে নিজেও ‘ঠান্ডা গোস্ত’ হয়ে যায়। আর হাড় হিম করা ‘খোল দো’ গল্পে লাগাতার গণধর্ষণের শিকার অর্ধচেতন কিশোরী কোনও পুরুষ এমনকী ডাক্তার সামনে এলেও দম দেওয়া পুতুলের মতো হাতড়ে হাতড়ে সালোয়ারের গিঁট খুলতে চেষ্টা করে।
মেলোড্রামা? অবাস্তব? ফেক?
আজকে চারদিকে যা ঘটছে, যেভাবে ফেক নিউজ এবং ঘৃণার আঠায় জুড়ে বানানো ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় নিও-নরমাল বা পোস্ট-ট্রুথ হিসেবে লুফে নেওয়া হচ্ছে, বাস্তব-অবাস্তব-পরাবাস্তবের সীমারেখা মুছে যাচ্ছে– তাতে মন্টোর দুনিয়া খুব অবাস্তব মনে হয় কি?
আজকে বড় দরকার সেই টোবা টেক সিং নামের পাগলকে। বিশ্বাস করুন, ওই টোবা টেক সিং আমাদের সবার মধ্যেই আছে, ঘাপটি মেরে আছে, ঘুমিয়ে আছে। দরকার সেই পাগলকে জাগিয়ে তোলার। না হলে আমাদের চারদিকে অভিনীত হবে অসংখ্য ‘ঠান্ডা গোস্ত’ আর "খোল দো’, তার পদচাপ শুনতে পাচ্ছেন কি?
কিন্তু মান্টোর দুনিয়ায় কি শুধুই অন্ধকার? মানুষের অন্তর্নিহিত শুভবুদ্ধিতে তাঁর আস্থা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল? এর উত্তরে আমি দুটো সাক্ষ্য পেশ করব। একটি তাঁর হমসফর লেখিকা ইসমৎ চুঘতাইয়ের স্মৃতিচারণের টুকরো, অন্যটি মান্টোর লেখা ভিন্ন স্বাদের গল্প “ফৌজি হারামজাদা”-এর সংক্ষিপ্ত অনুবাদ।
ইসমতের স্মৃতিচারণ থেকেঃ
ইসমৎ একবার আবদার ধরলেন মান্টোকে তাঁর নিজের জীবনের একটি বেশ জমজমাট মুচমুচে প্রেমের গল্প শোনাতে হবে। মান্টোর তখন কিশোর বয়েস, সবে গোঁফের রেখা দেখা দিচ্ছে। কাশ্মীরের উপত্যকায় গেছেন শরীর সারাতে। রোজ জ্বর আসে, তখন একটি গরম কাপড় গায়ে জড়িয়ে পাহাড়ের ঢালে বসে সারাদিন রোদ পোহান। দূরে একটি কিশোরী ভেড়া চড়ায়, দুজনেই দুজনকে দেখে, কোনও কথা হয় না। মেয়েটি রোজ একটু করে এগিয়ে আসে কিন্তু ডাকলেই পালিয়ে যায়। মুখ দেখা যায় না, কিন্তু মান্টো দেখেন জামার আস্তিনের ফাঁকে উন্মুক্ত শুভ্র কনুই। একদিন মেয়েটি কাছে এল, একটি হাত পেছনে লুকনো, মন্টো শত অনুরোধ করলেও ও দেখাবে না। শেষে মান্টোর কোলে একটি মিছরির ডেলা ফেলে পালিয়ে যাচ্ছিল, মান্টো গিয়ে ওর হাত ধরতেই কেঁদে উঠে হাত ছাড়িয়ে পালিয়ে গেল।
তারপর?
তার আর পর নেই, আমিও কাশ্মীর থেকে চলে এলাম; গল্প শেষ।
মেয়েটাকে কেমন দেখতে?
মান্টো যেন ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। কোন মেয়েটা? ওঃ, আমি তো ওর মুখ দেখিনি, শুধু শুভ্র কনুই দেখেছি।
আর মিছরির টুকরো?
ড্রয়ারে রাখা ছিল, একদিন খুলে দেখি পিঁপড়ে সবটা খেয়ে ফেলেছে।
ধ্যাৎ, এটা কোনও প্রেমের গল্প হল? একেবারে ভিজে ন্যাতা, হতাশ হলাম মন্টোসায়েব!।
মান্টো রেগে কাঁই।
কী হলে আপনার মুচমুচে প্রেমের গল্প হত? যদি মেয়েটার কোলে একটা বেজন্মা বাচ্চা ছেড়ে আসতাম?
ইসমৎ বলছেন: এই হল মান্টো, যাঁকে দুনিয়া মনে করে অশ্লীল গল্প লেখক, কিন্তু যে একটি শুভ্র কনুই দেখবে বলে সারাজীবন অপেক্ষায় থাকতে পারে।
এবারে দেখুন মান্টোর একটি অন্য স্বাদের অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত গল্পের সংক্ষিপ্ত অনুবাদ।
হারামজাদা ফৌজিব্যাটা
মূল রচনা: সাদাত হোসেন মন্টো
(সংক্ষিপ্ত)
অমৃতসরে এমন কেউ ছিল না যে ফৌজি হারামিকে চেনে না। যদিও ওই শহরে আরও অনেক হারামজাদা ছিল তবু ওর কাছে কেউ লাগে না। ও ছিল এক নম্বর পাজির পাঝাড়া। স্কুলে সমস্ত মাস্টারমশাইদের ও প্রায় নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাত। হেডমাস্টারমশাই, যাঁকে দেখলেই হাড়বজ্জাত ছেলেপুলেরও পেচ্ছাপ বন্ধ হয়ে যেত, তিনিও ফৌজিব্যাটাকে ভয় পেতেন। ওনার প্রসিদ্ধ বেতের বাড়িও ব্যাটাকে বাগে আনতে পারেনি। তাই উনি ফৌজিকে বেত মারা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
ক্লাস টেনের কথা। একদিন বন্ধুর দল ধরে বসল: "দেখ ফৌজি, যদি তুই কাপড় খুলে ফেলে একদম ন্যাংটো হয়ে গোটা স্কুল একপাক ঘুরে আসতে পারিস তো তোকে এক টাকা দেওয়া হবে।' ব্যস্, ফৌজি টাকা নিয়ে এককানে গুঁজল, তারপর কাপড়চোপড় খুলে ফেলে ব্যাগে পুরে সবার সামনে ন্যাংটো হয়ে হাঁটতে শুরু করল।ও যে ক্লাসের পাশ দিয়ে যায় তারাই হাসতে হাসতে লুটোপুটি খায়। এইভাবে চলতে চলতে ও হেডমাস্টারমশাইয়ের রুমের কাছে পৌঁছে গেল। তারপর পর্দা সরিয়ে ফট্ করে ভেতরে ঢুকে গেল। ভেতরে কী হয়েছিল জানা যায় নি। তবে হেডমাস্টারমশাই হন্তদন্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে চাপরাশিকে ডেকে বললেন: "যাও, দৌড়ে ফৌজির বাড়ি গিয়ে ওর জামাকাপড় নিয়ে এস। ব্যাটা বলে কী, মসজিদের চৌবাচ্চার পাশে চান করছিল। তখন কোন চোর ওর কাপড় চুরি করে পালিয়েছে।'
ধর্মক্লাস নিতেন পোট্যাটো মৌলবী। ওনাকে কেন পোট্যাটো বলা হত বুঝিনি। আলুর তো দাড়ি হয় না। তা ফৌজি ওনাকে একটু সমঝে চলত। একদিন হল কী, অঞ্জুমন কমিটির মেম্বারদের সামনে, মানে যাঁরা স্কুলটা চালাতেন, মৌলবী সাহেব ভুল করে ফৌজিকে কোরানের একটি আয়াতের মানে জিজ্ঞেস করে বসলেন। ফৌজির উচিত ছিল চুপ করে থাকা, কিন্তু তাহলে আর ওকে লোকে ফৌজি হারামি বলবে কেন? ও ব্যাটা মুখে যা এল, আবোল তাবোল, সব বলে গেল। পোট্যাটো মৌলবীর ঘাম ছুটে গেল। মেম্বাররা যেতেই উনি হাতের লাঠিটা তুলে ওকে চারটে চোরের মার মারলেন। মারের চোটে ছটফটিয়ে উঠে ব্যাটা খুব বিনয়ের সঙ্গে বলতে লাগল: "আমার কোন কসুর নেই মৌলবী সাহেব! আমি তো ঠিকমত কলমা পড়তেই পারি নে, আর আপনি আমায় গোটা একটা আয়াতের মানে জিজ্ঞেস করে বসলেন।'
এত মেরেও পোট্যাটো মৌলবীর রাগ পড়েনি। উনি ফৌজির বাপের কাছে নালিশ করতে গেলেন। ফৌজির বাবা সব কথা শুনে বড় উদাস স্বরে বললেন: "মৌলবী সাহেব, আমি নিজেই ওকে নিয়ে হতাশ হয়ে গেছি। জানি না কবে শোধরাবে। এই তো সেদিনের কথা। আমি পায়খানায় গিয়েছি আর ও বাইরে থেকে শেকল তুলে দিল। ভেতর থেকে খুব চেঁচালাম, প্রাণভরে গাল দিলাম। কিন্তু ওর এক কথা। যদি আমি কথা দিই যে আট আনা দেব তাহলে শেকল খুলে দেবে। আর খোলার পর যদি কথা না রাখি তো পরের বার তালা লাগিয়ে দেবে। নিরুপায় হয়ে কথা দিলাম, পরে আট আনা দিতেও হল। বলুন, এমন অকম্মার ঢেঁকি ছেলেকে নিয়ে কী করি?'
ওকে নিয়ে কী করা যায় তা বোধহয় আল্লাতালাই ভাল জানেন। লেখাপড়া তো কিছুই করে না। এন্ট্রান্স পরীক্ষায় সবাই ধরে নিয়েছিল যে ব্যাটা ফেল হবে। কিন্তু ফল বেরোলে দেখা গেল ওই সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে। ও চাইল কলেজে পড়তে, বাপের ইচ্ছা ও কোনও হাতের কাজ শিখুক। ফলে ও দুটি বছর এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াল। আর এই সময়টায় ও যা সব হারামিপনা করল তার লিস্টিটা বেশ লম্বা।
শেষে হা–ক্লান্ত বাপ ওকে কলেজে ভর্তি করালেন। প্রথম দিনেই ব্যাটা ম্যাথস্ এর প্রফেসরের সাইকেলটাকে একটা গাছের মগডালে চড়িয়ে দিল। কেউ ভেবে পায় না যে সাইকেল ওখানে গেল কী করে? তবে যারা আগে ফৌজির সঙ্গে স্কুল থেকে পড়েছে তারা বুঝে গেল যে এটা ফৌজি ছাড়া আর কারও কম্ম নয়। ওই একটা বদমাইশিতে ও গোটা কলেজে কুখ্যাত হয়ে গেল।
স্কুলে ওর কীর্তিকলাপের ক্ষেত্র সীমিত ছিল। কলেজে সেটা অনেক বিস্তৃত হল, পড়াশুনা, খেলাধূলা, জলসা, মুশায়েরা, উদ্ভট সব বদমাইশি, সবেতেই ফৌজির জয়জযকার! আর কিছুদিনের মধ্যে এমন হল যে গোটা শহর ওর গুন্ডামিতে ত্রস্ত, নামকরা সব বদমাইশের দল ওর সামনে হেঁটমুন্ড।
ও ছিল বেঁটে কিন্তু শরীর ব্যায়াম করা, সুগঠিত। মারামারির সময় ওর ভেড়ার ঢুঁ–মারা কায়দা লোকের মুখে মুখে। ও এমন জোরসে প্রতিদ্বন্দ্বীর বুকে বা তলপেটে ঢুঁ মারত যে সে ব্যাটা চোখে সরষে ফুল দেখত।
এফ এ কোর্সের দ্বিতীয় বছর ও নেহাত ফাজলামি করে প্রিন্সিপালের নতুন মোটরগাড়ির পেট্রল–ট্যাঙ্কে চার আনার চিনি ঢেলে দিল, তার ফলে পুরো ইঞ্জিনটাই বসে গেল। প্রিন্সিপাল কী করে যেন জেনে গিয়েছিলেন যে এই ভয়ঙ্কর পেজোমিটা ফৌজিরই কাজ। কিন্তু কী আশ্চর্য! উনি বদমাইশটাকে মাপ করে দিলেন। পরে জানা গেল যে আসলে ফৌজি ওনার অনেক গোপন খবর জানত।
এটা ছিল এমন সময় যখন কংগ্রেস খুব শক্তিশালী ছিল আর ইংরেজদের বিরুদ্ধে খোলাখুলি সভাসমিতি শুরু হয়েছিল। শুধু তাই নয়, সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার বেশকিছু ব্যর্থ চক্রান্তও হয়েছিল। চারদিকে সমানে গ্রেফতারি চলছে। জেলগুলো বন্দিদের দিয়ে ভরা, প্রায় প্রতিদিন রেলের পাত উপড়ে ফেলার খবর আসছে। বোম তৈরি হচ্ছে। পিস্তল ধরা পড়ছে। ব্যাপারটা হল আন্দোলনটা ক্রমশ: স্কুল–কলেজের শিক্ষিত লোকজনের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে।
ফৌজিব্যাটা কোনওভাবেই কোনও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল না। আমার ধারণা, ও মহাত্মা গান্ধী কে তাও জানত না। তাই যখন হঠাৎ একদিন ওকে পুলিশ গ্রেফতার করল, তাও এক ষড়যন্ত্রের মামলায়, সবাই অবাক হয়ে গেল।
এর আগেও বেশ কিছু ষড়যন্ত্র ধরা পড়েছে। স্যান্ডার্স হত্যা মামলায় ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্তের ফাঁসি হয়ে গেছে। তাই এই নতুন মামলাটাও বেশ গুরুতর মনে হচ্ছিল। অভিযোগ হল অনেকগুলো কলেজের ছেলেপুলে মিলে একটি গুপ্ত সংগঠন বানিয়েছে যার উদ্দেশ্য হল দেশের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা।
হল কী, কিছু ছেলে কলেজের ল্যাবরেটরি থেকে পিকরিক অ্যাসিড চুরি করেছিল। এসব বোম বানাতে কাজে লাগে। ফৌজিকে নিয়ে সন্দেহ ছিল যে ও ওই চুরিতে যুক্ত আর ও গুপ্ত সংগঠনের সবাইকে জানে।
ওর সঙ্গে কলেজের আরও দুই ছাত্র ধরা পড়েছিল। ওদের মধ্যে একজন নামকরা ব্যারিস্টারের ছেলে, অন্যজন খুব ধনী পরিবারের। দুজনেই ডাক্তারি রিপোর্টের হিসেবে অসুস্থ, তাই মারের হাত থেকে রেহাই পেল। দিন খারাপ ছিল গরিব বেচারা ফৌজি হারামজাদার। ওকে থানায় উল্টো করে ঝুলিয়ে বেধড়ক ঠ্যাঙালো। বরফের উপর দাঁড় করিয়ে রাখল। সবরকম শারীরিক যাতনা দেওয়া হল যাতে গোপন খবরগুলো বলে দেয়। কিন্তু ব্যাটা একেবারে কুকুরের লেজ, একটুও সোজা হল না; বরং থানাতেও বদমাইশি করতে ছাড়ল না।
একবার যখন আর মার সহ্য করতে পারছিল না, তখন থানার বড়কর্তাকে অনুরোধ করল আর না মারতে, ও সবকিছু উগরে দেবে। ও তখন একদম অশক্ত অচল। তাই গরম দুধ আর জিলিপি খেতে চাইল। যখন একটু সুস্থ হয়ে উঠেছে তখন থানার বড়কর্তা কাগজ কলম নিয়ে তৈরি হয়ে বসে বললেন– নাও, এবার বলো।
ফৌজিব্যাটা আড়মোড়া ভেঙে মারখাওয়া শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভাল করে দেখে নিয়ে বলল: এখন আর কী বলব? শরীরে শক্তি ফিরে পেয়েছি, ফের খুঁটি থেকে ঝুলিয়ে দাও।
এমনি আরও অনেক গল্প আছে যেগুলো আমার মনে নেই। কিন্তু সবকটাই দারুণ। মালিক হাফিজ, আমার জাতভাই। ওঁর মুখে শুনলে আপনাদের আরও ভাল লাগত।
একদিন পুলিশের দুটো সেপাই ফৌজিকে কোর্টে পেশির জন্য নিয়ে যাচ্ছে, কাছারিতে ওর চোখে পড়ল মালিক হাফিজ, কোনও কাজে ওদিকে এসেছিলেন। ওঁকে দেখতেই ফৌজি চেঁচাতে লাগল: আসসালামুআলৈকুম হাফিজ সাহেব!
হাফিজ চমকে উঠল। ফৌজিব্যাটা হাতকড়ি পরে ওঁর সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে: মালিক সাহেব! বড্ড মন খারাপ। একা একা ভাল লাগছে না– মন চাইছে যদি আপনাকেও এখানে পেতাম। –ব্যস্, শুধু আমার নাম নেবেন, তাহলেই কাজ হবে।
এসব শুনে মালিক হাফিজের তো হয়ে গেছে। ফৌজি ওকে সাহস দিল: ঘাবড়িও না মালিক, আমি একটু ঠাট্টা করছিলাম। তবে আমাকে দিয়ে যদি কোনও কাজ হয়, যদি তোমার কোনও কাজে লাগতে পারি তো বলো।
বলুন তো? এই অবস্থায় ফৌজি হারামি মালিকের কোন কাজে আসবে? হাফিজ তখন ওখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে! ফৌজি ওকে বলল: ভাই, আর কিছু তো করতে পারব না। বলো তো তোমাদের দুর্গন্ধভরা কুয়োটাই পরিষ্কার করিয়ে দিই?
এখন মালিক হাফিজই আপনাদের বলতে পারবেন যে ওই কুয়োটাকে ফৌজি কত ঘেন্না করত। কুয়োটার জল থেকে একেবারে ইঁদুরপচা গন্ধ ছড়াত। কেন যে ওটাকে কেউ সাফ করাত না?
এক সপ্তাহ বাদে, মানে মালিক হাফিজ যেমন বলেছে আর কী, ও স্নান করতে বাইরে বেরিয়ে দেখে যে দু–তিনটে লোক কুয়োর থেকে নোংরা বের করতে নাগাড়ে খেটে চলেছে। গল্পটা কী? মালিক হাফিজ ধন্দে পড়ে গেল। ওই ময়লা সাফ করার লোকগুলোকে কে ডেকেছে? পাড়াপড়শির দল ভেবে নিল যে বড় মালিক বসে বসে ভাবলেন- চলো, কুয়ো সাফ করিয়ে দিই, পাড়াপ্রতিবেশিদের মনে দাগ কাটবে।
কিন্তু ওরা যখন জানতে পারল যে বড় মালিক শিকারে গেছেন এবং ছোটমালিক এর বিন্দুবিসর্গ জানেন না তখন ওরা খুব অবাক হল। সাদা পোষাকের পুলিশগুলোকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল যে ওরা ফৌজি হারামজাদার দেওয়া খবরের হিসেবে লুকোনো বোম খুঁজে বের করছে।
অনেকক্ষণ ধরে কুয়োর নোংরা তোলা চললো। জল পরিষ্কার হয়ে গেল। কিন্তু বোম কোথায়, একটা ধানিপটকাও পাওয়া গেল না। পুলিশ খুব চটে গেল। তক্ষুণি ফৌজিকে চেপে ধরা হল। ব্যাটা দাঁত বের করে পুলিশ অফিসারকে বলল, –ক্যাবলাসম্রাট! আমার ইচ্ছে ছিল ইয়ারদোস্তের কুয়ো সাফ করার, তো সেটা করিয়ে নিলাম!
এই শয়তানিটা বেশ চমৎকার হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ ওকে খুব পেটাল, মারতে মারতে আধমরা করে দিল। তারপর একদিন খবর এল যে ফৌজিব্যাটা রাজসাক্ষী হয়ে গেছে। ও কথা দিয়েছে যে সবকিছু উগরে দেবে।
শোনা যায়, এ নিয়ে ওর ব্যাপারে খুব নিন্দেমন্দ হল। ওর বন্ধু মালিক হাফিজও, যে সরকারকে ভয় পেত, ওকে খুব গালাগাল দিল: হারামজাদা ভয়ের চোটে বেইমানি করল? কি জানি, এখন কাকে কাকে ফাঁসাবে!
আসলে ও মার খেয়ে খেয়ে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। জেলখানায় কাউকেই ওর সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হত না। খেতে দিত ভাল করে, কিন্তু ঘুমোতে দিত না। ব্যাটা বড্ড ঘুমোতে ভালবাসত। সেই ঘুমোতে না পেরে গচ্চা খেয়ে কথা দিল যে বোম বানানোর গোটা ষড়যন্ত্র ও ফাঁস করে দেবে।
ওকে জেলের ভেতরই রাখা হল। কিন্তু এখন কোনও কড়াকড়ির বালাই রইল না। কিছুদিন খুব আরাম করল কারণ ওর শরীরের সব জোড় নাকি ঢিলে হয়ে গেছে। কিছুদিন ভাল খাবারদাবার খেয়ে আর শরীর মালিশ করিয়ে ও নিজের জবানবন্দি দেওয়ার ক্ষমতা ফিরে পেল।
সক্কালে দুটো বড় গেলাস ভরে লস্যি খেয়ে ও বলতে শুরু করত। একটু পরে জলখাবার–পর্ব শেষ করে পনের–বিশ মিনিট বিশ্রাম। তারপর যেখান থেকে শুরু করেছিল ঠিক সেইখান থেকে সুতোয় সুতো মিলিয়ে ফের শুরু হত ওর আখ্যানমঞ্জরী।
[ফৌজি হারামজাদা কি সত্যিই বিভীষণ? রাজসাক্ষী হয়েছিল? আন্দাজ করুন অথবা মূল গল্পটি পড়ে ফেলুন।]