4thPillar


করোনায় উল্টো-বিশ্বায়ন

বিতান ঘোষ | 19-03-2020May 23, 2023
করোনায় উল্টো-বিশ্বায়ন

করোনা ভাইরাস বিশ্বায়নের চাকা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। ক্রমশ ছোট হতে থাকা পৃথিবীটা যেন হঠাৎই আবার বিশাল বড় হয়ে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফিরে যাচ্ছে।

বিশ্বজুড়ে করোনা প্রসূত যে বিচ্ছিন্নতা দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক ভাবে সেটার সূচনা কিন্তু অনেক আগেই হয়েছে। গত এক দশকে বিভিন্ন দেশের নির্বাচনের মূল হাতিয়ার হিসাবে দেখা দিয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদী রেটোরিক। এই আখ্যানে সওয়ার হয়ে অনেকে অভাবিত ভাবে দেশনেতা হয়ে উঠেছেন। মার্কিন মুলুকের বাণিজ্য টাইকুন ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের সুবিশাল রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্য ও ক্যাসিনো ব্যবসা নিয়ে দিব্যি ছিলেন। ২০১৬ সালে ভোটপ্রচারে শরণার্থী এবং নারীদের সম্পর্কে তাঁর বিভিন্ন মন্তব্যে রাজনৈতিক বিচক্ষণতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। কখনও কোনও মার্কিন প্রদেশের সেনেটর হিসাবেও দায়িত্ব পালন না করেও, তিনিই আজ সাদা বাড়ির অধিপতি। ট্রাম্পের অভাবনীয় রাজনৈতিক সাফল্য বোধহয় বিশ্বায়নের স্রোতের উল্টোদিকে সেই বিচ্ছিন্নতাকেই নির্দেশ করে। ট্রাম্পের কাছে পরাজিত হওয়ার পর হতাশ হিলারি ক্লিন্টন বলেছিলেন, "আমার দেশটাকে আমি যতটা বিচ্ছিন্ন ভাবতাম, দেশটা তার চেয়েও বেশি বিচ্ছিন্ন।' প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্পর্শকাতর বিবিধ বিষয়ে লাগাম ছাড়া মন্তব্য করে প্রমাণ করে দিয়েছেন, দেশনেতা হওয়া দূরস্থান, আমাদের দেশের খাপ পঞ্চায়েতের প্রধান হওয়ারও যোগ্য নন। অবশ্য নরেন্দ্র মোদিও যে একদিন লালকেল্লা থেকে ভাষণ দেবেন, তাই বা দশ বছর আগে কে ভেবেছিল?

নভেল করোনা ভাইরাসের বিশ্বব্যাপী মহামারী হয়ে ওঠাটা বিশ্বায়নেরই দান। এত দ্রুত সারা পৃথিবীতে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার কারণই হল এত বেশি মানুষের দেশ দেশান্তরে যাতায়াত। ভাইরাস আটকাতে এখন যাতায়াত বন্ধ করতে হচ্ছে। ভাগ্যের পরিহাস হল, এই যাতায়াত বন্ধ করাটাকেই একটা ভূ-রাজনৈতিক (geo-political) ভাইরাস বলে মনে করে উদারপন্থী আধুনিক দুনিয়া। যেমন ট্রাম্প বলছেন, পাঁচিল দিয়ে আমেরিকা ঘেরো। বরিস জনসন বাকি ইউরোপের থেকে ব্রিটেনকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইছেন। বিশ্বায়নের চাকাকে সময়ের উল্টো দিকে ঘোরাতে চাইছেন এই দেশনেতারা।


করোনায় উল্টো-বিশ্বায়ন

উগ্র জাতীয়তাবাদ সর্বদাই একটা ছোট আইডেন্টিটিকে তুলে ধরে বাকিদের সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়। বৃহত্তর ক্ষেত্রে আত্মপরিচয়ের সংকটে ভোগা মানুষগুলোকে তুলে ধরা হয় দেশ কিংবা জাতির শত্রু হিসাবে। উগ্র জাতীয়তাবাদের মন্ত্র: যারা কাঙ্খিত তারা সমবেত হও, বাকিরা তফাত যাও। হিটলার এই পথেই এগিয়েছেন। ট্রাম্পও আগেভাগেই জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আমেরিকা ফর আমেরিকানস’। করোনা ভয়ে ভীত বিশ্বের সব দেশই তাদের নিজেদের মত করে একটা অদৃশ্য পাঁচিল তুলে দিয়েছে। তার জন্য ট্রাম্পকে মেক্সিকো সীমান্তে পাঁচিল তুলতে হচ্ছে না। ইজরায়েলকে গাজা ভূ-খন্ডে সেনা মোতায়েন করতে হচ্ছে না। বিশ্বায়নের অস্ত্রেই ঘায়েল হতে চলেছে বিশ্বায়ন।

করোনার অর্থনৈতিক অভিঘাতে শ্রমের আন্তর্জাতিক চলাচল বন্ধ। করোনার আগেই ব্রেক্সিটের অর্থনৈতিক প্রভাব ব্রিটেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কারও কাছেই বিশেষ ইতিবাচক নয়। ২০১৫-তে ব্রেক্সিট পূর্ববর্তী সময়ে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি যেখানে ২.৪ শতাংশ ছিল, ২০১৮-তে ব্রেক্সিট খসড়ার সময়েই তা ১.৫ শতাংশে নেমে আসে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত দেশগুলি ও ব্রিটেনের মধ্যে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে যে শুল্ক প্রাচীর উঠতে চলেছে, তাতে চার্চিলের দেশে মুদ্রাস্ফীতি অবশ্যম্ভাবী। কয়েক কোটি অপেশাদার শ্রমিক ইউরোপে কাজ হারাতে চলেছে। নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে সবাই যদি দুয়ার আঁটে বিশ্ব অর্থনীতি বাঁচবে কী? বাজার অর্থনীতির দুর্দিনের সময়ে ট্রাম্প, জনসনরা বাজারে চাহিদা বাড়ানোর সবকটি রাস্তা বন্ধ করছেন৷ তাদের রাজনৈতিক অবিমৃষ্যকারিতায় বিনিয়োগে ভয় পাচ্ছে শিল্পমহল। করোনা মহামারি যে অর্থনৈতিক সংকটের ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে, তাতে কিন্তু দক্ষিণপন্থী শাসকদেরই লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা ষোলো আনা। বাকি বিশ্বের সবাইকে ‘শত্তুর’ ঠাওড়ে নিজেদের মহিমাকীর্তনে তারা বাকিদের ব্যস্ত রাখার ফুসরত পেল এবার। হিটলার যেমন ভাইমার প্রজাতন্ত্রের অর্থনৈতিক নীতিকে দুষে উগ্র জাতীয়তাবাদে মজিয়েছিলেন দেশবাসীকে। বীররসের মহিমাকীর্তনের এই সময়ে ছাতিধারি নেতাদের বুক ঠোকার সুযোগ করে দিল করোনা মহামারি। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বিপন্ন হওয়া মানুষের সামনেই তো স্বপ্নের সওদাগর হওয়া যায়। হোক না সে স্বপ্নটা অলীক।


New
বিদায় পিটি নায়ার: কলকাতার ইতিহাসবেত্তা
এগজিট পোল মিলে গেলেও যে প্রশ্ন উঠবেই
কংগ্রেস সেঞ্চুরি না করলে কে রুখবে বিজেপিকে?


Other Writings by -বিতান ঘোষ | 19-03-2020

// Event for pushed the video