4thPillar


করোনা ভ্যাকসিনের রূপকথা আর বাস্তবতা

সুস্মিতা ঘোষ | 02-12-2020May 23, 2023
করোনা ভ্যাকসিনের রূপকথা আর বাস্তবতা

ইদানিং খবরের হেডলাইনে ভ্যাকসিনের একেবারে ছড়াছড়ি Moderna, Pfizer, Astra Zeneca ইত্যাদি নাম এবং 90%, 95% 95.5%, 100% এই সব সংখ্যা ঘোরা ফেরা করছে। অনেকেই আশায় বুক বেঁধে বসে আছেন, ভ্যাকসিনের সোনার কাঠি এল বলে। এরপর সেই দিনটার অপেক্ষা and they lived happily ever after...

 

সেই স্বপ্ন পূরণের দিন আসতে দেরি আছে এটা সবাই বোঝে কিন্তু সত্যিই কি ভ্যাকসিন এসে রাতারাতি দুনিয়া থেকে করোনা নির্মূল করে দেবে? জৈব প্রযুক্তিবিদ হিসেবে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অত সহজ নয়।

 

ভ্যাকসিন প্রসঙ্গে কয়েকটা চটজলদি তথ্য জানিয়ে রাখি এখনও পর্যন্ত দৌড়ে এগিয়ে আছে তিনটি কোম্পানি। এর মধ্যে Pfizer এবং Moderna-র ভ্যাকসিন হল RNA ভ্যাকসিন। ভ্যাকসিন দৌড়ের শুরুতে RNA কার্যকরী হবে কিনা সন্দেহ ছিল, কারণ RNA বড় অস্থায়ী এবং RNA ভ্যাকসিনের সফলতার কোনও নজির ছিল না। অন্যদিকে Astra Zeneca adenovirus নামে এক ধরণের virus এর কাঠামোকে জেনেটিক এঞ্জিনিয়ারিং করার সিদ্ধান্ত নিল - ভ্যাকসিন biotechnology-তে যে পদ্ধতির সফলতার উদাহরণ আছে। সম্ভবতঃ এই কারণেই পুণের সিরাম ইনস্টিটিউট এদের সাথে হাত মিলিয়ে বিশাল স্কেল এ ভ্যাকসিন বানানোর প্রস্তুতি নিয়েছে। প্রথম দুটি ভ্যাকসিন এর সংরক্ষণ ও পরিবহনের জন্যে অতি শীতল তাপমাত্রার প্রয়োজনীয়তা আছে, এবং বলা হচ্ছে ভারতের ভ্যাকসিন জগতে তার যথেষ্ট পরিকাঠামো নেই। এই প্রসঙ্গে একটা কথা দীর্ঘ দিন বিজ্ঞানচর্চা করার সুবাদে না বলে পারছি না: ভারতে আজ আইসক্রিম যদি সর্বত্র পাওয়া যেতে পারে, তার পরিকাঠামো যদি থাকতে পারে, ভ্যাকসিন কেন সেভাবে সর্বত্র বণ্টন করা অসম্ভব হবে? ইচ্ছে থাকলেই উপায় হবে। এখন কার ইচ্ছে, সেটাই প্রশ্ন

 

আরও পড়ুন: মাস্ক পরুন, মাস্ক পরান, নইলে শাসন করুন, না মানলে পরিহার করুন


এবার কতক গুলো  খুব সাধারণ প্রশ্ন করব, যা সাধারণ মানুষের মাথায় আসে


 

1) বলা হচ্ছে কোভিড ইনফেকশন একবার হলে আবারও হতে পারে, কারণ অন্তত গোটা দশেক reinfection-এর কেস রিপোর্টেড হয়েছে। এক্ষেত্রে চিকেন পক্সের উদাহরণটা মাথায় আসে। একবার চিকেন পক্স হয়ে গেলে সারা জীবন যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়, কোনও ভ্যাকসিনই তার ধারে কাছে যেতে পারে না। তাহলে, গোটা SARS-Cov2 virus যে ইমিউনিটি দিতে পারছে না বলে সাবধান করা হচ্ছে, সেই ভাইরাসের জিনের টুকরো মাত্র তার চেয়ে সবল ইমিউনিটি দেবে কি?


2) সারা পৃথিবীর কথা ছেড়েই দিলাম, সারা ভারতে যত পরিমাণ কোভিড ভ্যাকসিন লাগবে, তার হিসেব চলছে দেখছি। এক মাসে কতটা উৎপাদন হবে, দু মাসে কতটা, চার মাসের কতটা...1.3 বিলিয়নের হিসেব তো দেখিনি কেউই। এমনটা হবে না তো, সবার টিকাকরণ শেষ হওয়ার আগেই অনেককে আবার নতুন করে টিকা দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে? ভোটের আগে কল্পতরু হয়ে সবার জন্য টিকা- এই প্রতিশ্রুতি তো অনেক রাজ্যে গিয়ে দেওয়া হয়েছে, এখন যে ICMR বলছে সবাইকে টিকা দেওয়া হবে না, তার কি হবে?


 3) টিকা-সমীক্ষায় যোগদানকারী একজন দাবি করেছেন যে, এই পরীক্ষামূলক টিকা তাঁর প্রভূত শারীরিক ক্ষতি করেছে, অতএব 3 কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চাই। টিকা প্রস্তুতকারী সংস্থা সিরাম ইনস্টিটিউট পাল্টা 100 কোটি টাকার মানহানির মোকদ্দমা করেছে সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে। এই চাপানউতোরের ভবিষ্যৎ কী?


আমি জৈব প্রযুক্তিবিদ হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী শেষ থেকে কিছু উত্তর রাখার চেষ্টা করছি, পাঠকদের কাছে অন্যান্য আরও উত্তর থাকতে পারে

 

আরও পড়ুন: কোভিড-19 টেস্ট: কিছু প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে

 

1) পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিনের ক্ষতির প্রশ্ন যদি কেউ তুলে থাকেন, নীতিগত ভাবে তার অভিযোগ অবশ্যই খতিয়ে দেখা উচিত। এখানে পাল্টা মামলা করলে এ ধরনের প্রয়োজনীয় এবং জরুরি ট্রায়ালে স্বেচ্ছাসেবক পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে। ফলস্বরূপ ক্ষতিগ্রস্ত হবে জনগণই। এই প্রসঙ্গে বলতে পারি যে, 100%  নিরাপদ বলে কিছু হয় না। সামান্য অ্যাসপিরিন, সেও প্রাণঘাতী হতে পারে কারও কারও ক্ষেত্রে। অথচ, এই অ্যাসপিরিনই অসংখ্য মানুষের ব্যথা কমায়, জ্বর ছাড়ায়, এমনকি সময় বিশেষে স্ট্রোক হওয়ার হাত থেকেও বাঁচায়। উপযোগিতাকে পুরোপুরি ভাবে বুঝতে গেলে সম্ভাব্য ক্ষতিকেও যত বেশি সম্ভব বোঝা দরকার, না হলে ‘contra-indication’-এর তথ্য আসবে কী করে? এই ক্ষেত্রে অবশ্যই সিরাম ইনস্টিটিউটের উচিত অসুস্থতার ঘটনাগুলি ভাল করে বিশ্লেষণ করা


2) সবার জন্য ভ্যাকসিন- নির্বাচনী প্রচারে কার্যকরী স্লোগান। সত্যি সত্যি সম্ভব কি? উৎপাদন, নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় পরিবহণ ও সংরক্ষণ এবং ইঞ্জেকশন দেওয়ার ব্যবস্থা এ সমস্তই কিন্তু করতে হবে, কারণ খাওয়া যায় এমন ভ্যাকসিন এখনও প্রথম সারিতে এগিয়ে আসেনি। মানুষ অবশ্যই ক্ষুব্ধ থাকবে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে। গবেষণার সাহায্যে কিন্তু জানা সম্ভব কাকে কাকে ভ্যাকসিন না দিলেও চলবে। ঠিক যেভাবে স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে ভ্যাকসিনের ট্রায়াল হচ্ছে, সেভাবেই যারা একবার করোনা পজিটিভ হয়েছেন, যারা সেরে উঠেছেন, এবং যারা সেরোপজিটিভ, অর্থাৎ যাদের রক্তে কোভিডের অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে, কিন্তু কোভিড হওয়ার কোনও ইতিহাস জানা নেই, তাদেরকে নিয়ে অনেক মাস ধরে অবিচ্ছিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে পারলে কোভিডের ইমিউনিটি সম্বন্ধে হয়তো অনেকটা স্পষ্ট ধারণা হবে। শতাংশের হিসেবে রিইনফেকশন কতজনের ক্ষেত্রে হতে পারে, কী অবস্থায় হতে পারে, সে সম্বন্ধে আরও কিছুটা আলোকপাত করা যেতে পারে। সেই হিসেবে স্থির করা যেতে পারে কাদের ভ্যাকসিন না দিলেও চলবে


3) এটা মনে রাখতে হবে যে, বিদেশে যে ভ্যাকসিন ট্রায়ালগুলো চলছে, সেখানে কিন্তু কোনও স্বেচ্ছাসেবককেই কোভিড দিয়ে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। তাদের একদলকে ভ্যাকসিনের একটা দুটো ডোজ দেওয়া হয়েছে, অন্য দলকে স্রেফ নুন জল। কোনও দলই জানত না, তাদের শরীরে কী ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে। তারপর তারা এই করোনা কালের নিউ নর্মাল রুটিনে চলেছে, অর্থাৎ মাস্ক পরেছে, যত দূর সম্ভব শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করেছে। তবে হ্যাঁ, এরা সবাই হাই রিস্ক গোষ্ঠীর- কর্মসূত্রে এদের হামেশাই জনবহুল স্থানে যেতে হয়


অর্থাৎ কিনা, এখনও পর্যন্ত এটাই প্রমাণিত যে, মাস্ক-দূরত্বের অভ্যেস রাখলে এই ভ্যাকসিন কোভিড থেকে অন্তত কিছু দিনের জন্য প্রতিরক্ষা দিতে সমর্থ হতে পারে। কিছু কিছু ব্যাপারে আশার আলো দেখছি- আমেরিকা নিজের স্বার্থেই হয়তো এই ভ্যাকসিন গুলো বাজারে আসার আগেই কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যবহার করার জন্য অনুমোদন দেবে। শীত এবং বড়দিনের ছুটি আসছে- কোভিড সংক্রমণ অনেক গুণে বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে যদি এই সব ভ্যাকসিন সেই সম্ভাবনা কমাতে সমর্থ হয়, যদি স্কুল খুলে রাখতে সাহায্য করে, তবে ভারতেও স্কুল খোলার চেষ্টা দিয়ে এটা শুরু করা যেতে পারে। আর ভ্যাকসিন প্রাপকদের তালিকা থেকে বাদ? যারা মাস্ক পরা নিয়ে তর্ক করেন, তাদের অবশ্যই বাদ দেওয়া উচিত

 

ড: সুস্মিতা ঘোষ, ডায়াগনোরাইট-এর প্রতিষ্ঠাত্রী এবং জৈব-রসায়নবিদ, বিটস পিলানির পরামর্শদাত্রী। হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের পোস্ট ডক্টরাল ফেলো সুস্মিতার ডায়াগনোরাইট একটি সম্পূর্ণ মহিলা পরিচালিত স্টার্ট-আপ সংস্থা, যার লক্ষ্য সকলের জন্য সুলভে বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক ডায়গনস্টিক্স

 



New
বিদায় পিটি নায়ার: কলকাতার ইতিহাসবেত্তা
এগজিট পোল মিলে গেলেও যে প্রশ্ন উঠবেই
কংগ্রেস সেঞ্চুরি না করলে কে রুখবে বিজেপিকে?


Other Writings by -সুস্মিতা ঘোষ | 02-12-2020

// Event for pushed the video