জানুয়ারির শুরুতে, যখন কোভিডের তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ছে, ঠিক সেই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের সাইপ্রাসের এক বিজ্ঞানী সংবাদমাধ্যমে জানালেন যে, তিনি কোভিড সৃষ্টিকারী ভাইরাসের নতুন এক ভ্যারিয়ান্ট পেয়েছেন, যার মধ্যে নাকি ডেল্টা (Delta) এবং ওমিক্রন (Omicron) দুয়েরই জিন বিদ্যমান, এবং একে "ডেল্টাক্রন' নামে ডাকা চলে।
এ ধরনের খবর এই বাজারে ছড়াতে দেরি হয় না, কাজেই সারা পৃথিবী তখন থেকে আগতমান ডেল্টাক্রনের নাম জানতে শুরু করল।
সাইপ্রাসের সেই বিজ্ঞানী, কসত্রিকিস (Kostrikis) তাঁর গবেষণায় পাওয়া ‘ডেল্টাক্রন’-এর যাবতীয় সিকোয়েন্স ইন্টারনেটে আপলোড করার সঙ্গে সঙ্গেই হাজারো বিজ্ঞানীর নজরে পড়ল যে, এই সিকোয়েন্সে গন্ডগোল আছে। এটা কোনও নতুন সিকোয়েন্স নয়, বরং সিকোয়েন্সিং করার সময়ে ল্যাবরেটরির মধ্যে দু’রকম ভাইরাসের জিন মিশে গেছে- যেটাকে contamination বলা হয়।
এরকম কনটামিনেশন কি বিরল? না। বরং জিনতত্ত্ববিদ এবং অণুজীববিদদের কাছে এটা খুব সাধারণ ব্যাপার, অর্থাৎ সাবধানে কাজ না করলেই মেশামেশি বা কনটামিনেশন হয়ে যেতে পারে।
কোভিডের সূত্রে RTPCR এবং সিকোয়েন্সিং শব্দ দু’টো লোকের মুখে মুখে ঘুরছে বটে, কিন্তু বেশিরভাগ লোকই বোঝে না সেগুলো কী টেস্ট।
RTPCR হল এমন একটা টেস্ট, যেখানে ঠিকঠাক ডিজাইন করলে ঠিক অমুক প্রাণী বা অমুক জীবাণুর অমুক জিনকে একেবারে ঠিকঠাক ভাবে ধরতে পারা যাওয়া যায়। যেহেতু রোগীর স্যাম্পলে জিনকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করার মতো যথেষ্ট পরিমাণ জিন থাকে না, সেই কারণে টেস্ট টিউবের মধ্যে কৃত্রিম উপায়ে chain reaction-এর মাধ্যমে (polymerase chain reaction, PCR) বহু কপি করে নেওয়া হয়। বহু কপি অর্থাৎ প্রথমে 1 থেকে 2, তারপর 2থেকে 4, 4 থেকে 8, 8 থেকে 16 এই ভাবে 35 বারের পর প্রায় বিলিয়ন খানেক কপি তৈরি হয় এবং তার অস্তিত্ব সহজেই ধরতে পারা যায়। এই পরিবর্ধিত কপিগুলিকেই কখনও কখনও সিকোয়েন্সিং-এ পাঠানো হয়। সিকোয়েন্সিং-এর রাসায়নিক পদ্ধতিটা খানিকটা PCR-এর মতো। কিন্তু গোটা জিনটা এখানে ছোট্ট ছোট্ট ধাপে কপি হয়। এই ধাপগুলি এতই ছোট যে, কোথাও কোনও মিউটেশন থাকলে তা সহজেই নজরে পড়ে। সিকোয়েন্সিং-এর যন্ত্রটা খুব দামি, এবং সঙ্গে যে বিশেষ রাসায়নিক জিনিসপত্র লাগে, তাও খুব দামি। যে কারণে সমস্ত sample-এর RTPCR-এর পরে কোনও দেশেই সিকোয়েন্সিং করা সম্ভব নয়। শতকরা হিসেবে লক্ষ স্যাম্পলে অন্তত একটা করে সিকোয়েন্সিং-এ যায় কিনা সন্দেহ, অন্তত আমাদের দেশে।
কনটামিনেশনের কথায় ফিরে আসি- এই যে RTPCR বা PCR পদ্ধতির মাধ্যমে চেইন রিয়্যাকশনের কপির সংখ্যা বাড়ানো- নিশ্চয়ই তা লক্ষ্য করেছেন, একটা সময়ে যারা কপির ছাঁচ হিসেবে কাজ করছে, তাদের বেশিরভাগই টেস্ট টিউবের মধ্যে কৃত্রিম ভাবে বানানো, এবং তারা যেখানে যাবে, সেখানেই তারা ওই জিনটির কপি বানাবে। এখন ওই কপিগুলি যদি অসাবধানতায় টেস্ট টিউবের বাইরে বেরিয়ে আসে কখনও, তখন হাতে লেগে কিন্তু পরবর্তী অনেক স্যাম্পলের মধ্যেই মিশে গিয়ে ওই নির্দিষ্ট জিনটির ব্যাপারে ‘পজিটিভ’ দেখাবে।
সাবধানে কাজ না করলেই কিন্তু এই কনটামিনেশন, যাকে carry over contamination বলে, হতে পারে। এবং এই কনটামিনেশন কোনও ল্যাবরেটরির মধ্যে একবার ঘটলে সেই আপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া রীতিমতো কষ্টকর। (অর্থাৎ কিনা, কোনও ল্যাবরেটরি ডেল্টা বা ওমিক্রন বা দু’টো নিয়েই যদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, তবে যে কোনও একজন মানুষের অসাবধানতাই যথেষ্ট, সব কিছু মিলে মিশে জগাখিচুড়ি সব ফল দেখানোর জন্য। এরকম জগাখিচুড়ি একটি ফলের নাম ডেল্টাক্রন।
কসত্রিকিস কিন্তু তাঁর পর্যবেক্ষণ ভ্রান্ত এরকম আন্দাজ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর পোস্ট করা সমস্ত সিকোয়েন্স ইন্টারনেট থেকে সরিয়ে নিয়েছেন। মিডিয়া তাতে থামেনি। ঠিক যে ভাবে chain reaction -এ জিনের কপির সংখ্যা বাড়ে, ঠিক সেই ভাবেই বেড়েছে এক সংবাদপত্র থেকে অন্য সংবাদপত্রে ডেল্টাক্রনের জুজু মূর্তি।
21 শে জানুয়ারির নেচার পত্রিকা কিন্তু কসত্রিকিসের ভ্রান্তি এবং বিজ্ঞানী মহলের প্রতিক্রিয়া খুঁটিয়ে প্রকাশ করেছে। সকলের জ্ঞাতার্থে জানাই নেচার পৃথিবীর সব চেয়ে নামী বিজ্ঞান পত্রিকা।
কিন্তু কে শোনে কার কথা। সবচেয়ে অস্বস্তিকর লাগে যখন Scientific American-এর মতো পত্রিকা-ও HIV, delta, omicron-এর খিচুড়ি পাকিয়ে একটা হেডলাইন তৈরি করে আতঙ্ক ছড়ায়। আমাদের দেশের বিখ্যাত সংবাদপত্র গুলোর কথা না হয় ছেড়েই দিলাম।
একটা নতুন উৎপাত শুরু হয়েছে বিজ্ঞানের নামে। Bioarxiv নামে একটি সাইট হয়েছে, যেখানে বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণাপত্র কোনও পত্রিকায় প্রকাশের জন্য পাঠালে, তৎক্ষণাৎ সেই গবেষণাপত্রটি এখানে আপলোড করে দেওয়া হয়। এর পিছনে যুক্তিটি হল, বিজ্ঞানের পত্রিকা গুলির সম্পাদক এবং দুই বা তিনজন বিজ্ঞানীর কাছে রিভিউ করে প্রকাশনার অনুমোদন পেতে অনেকটা সময় চলে যায়। পৃথিবী কেন অত দিন অপেক্ষা করবে নতুন তথ্যের জন্য, তা-ও এই সদাব্যস্ততার বাজারে? মুশকিল হল যে, যে কোনও লোকই যে কোনও পত্রিকায় যে কোনও লেখা পাঠাতে পারে, কাজেই Bioarxiv-এ তা আপলোড-ও করতে পারে। এখানে আপলোড করা তথ্য সত্যি কিনা, কেউ যাচাই করতে আসে না। কিন্তু ইন্টারনেটে সহজলভ্য হওয়ায় সেই তথ্য দুরন্ত গতিতে আলোড়ন তুলতে পারে। অনেক সময়েই দেখা যায়, যখন এই আলোড়ন থেমে গেছে, সেই সময়ে বিজ্ঞান পত্রিকাটি-ও বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের অভাবে ওই গবেষণাটিকে প্রকাশ করতে অস্বীকার করেছে। কোভিডের আমলে এই রকম আকছার ঘটেছে৷ অনেক তথাকথিত "বৈজ্ঞানিক' তথ্যই Bioarxiv-এর দৌলতে মিডিয়াতে আলোড়ন তুলছে, কিন্তু আসলে তার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি প্রায় নেই বললেই চলে। কাজেই অযথা এসব তথ্যের কথা শুনে আতঙ্কিত বা আলোড়িত হওয়া উচিত নয়।
একটা সাবধানবাণী কিন্তু এখনও রইল। ডেল্টাক্রন অবাস্তব, কিন্তু এখনও নতুন কোভিড variant -এর উদ্ভব হওয়ার সম্ভাবনা ঘোরতর বাস্তব। WHO তাই বলছে, এবং বলছেন সারা বিশ্বের জিনতত্ত্ববিদেরা। কাজেই মাস্ক পরতে, দূরত্ব বজায় রাখতে ভুলবেন না।
(ড: সুস্মিতা ঘোষ ডায়াগনোরাইট-এর প্রতিষ্ঠাত্রী এবং জৈব-রসায়নবিদ। হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের প্রাক্তন পোস্ট ডক্টরাল ফেলো। সুস্মিতার ডায়াগনোরাইট একটি সম্পূর্ণ মহিলা পরিচালিত স্টার্ট-আপ সংস্থা, যার লক্ষ্য সকলের জন্য সুলভে বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক ডায়গনস্টিক্স)