4thPillar


রাষ্ট্রের কাঁটাতার জানে, ‘ওরা' উড়তে চেয়েছিল

বিতান ঘোষ | 08-12-2021May 22, 2023
রাষ্ট্রের কাঁটাতার জানে, ‘ওরা' উড়তে চেয়েছিল

কবি মানস যতই আপন হতে বাহির হওয়ার আহ্বান জানাক, আপন-পরের ভেদাভেদ আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে আজকের দুনিয়ায়। ভুবনায়নের (Globalisation) দুর্বার স্রোতও সেই ভেদাভেদের গন্ডিকে অতিক্রম করতে পারে না। আধুনিক কল্যাণকামী রাষ্ট্র (Modern Welfare State) তার জনমোহিনী সত্তার ধড়াচূড়া পরে থাকলেও, ‘আপন'  ‘পর'-কে বিচ্ছিন্ন করার দায়ভাগে সমান অংশীদারিত্ব যে তারও! তাই দেশ দেশান্তরে, কাল কালান্তরে পরিযায়ী মানুষদের (Migrants People) স্রোত বসত খুঁজে মরে, আর হিরণ্ময় নীরবতা নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকে রাষ্ট্র।

 

এই দেশেই যেমন সহসা ঘোষিত লকডাউনে কর্মসূত্রে আটকে পড়া রামপুকুর পণ্ডিত পুত্রসন্তানের মৃত্যুসংবাদ শুনেও ঘরে ফিরতে পারেন না। রাজপথের কিনারে তাঁকে হাপুস নয়নে কাঁদতে দেখে সারা দেশ। রামপুকুর পণ্ডিতরা তবু হেঁটে চলেন, অন্নহীন, ছায়াহীন পথে। ঘরে ফেরেন, ফিরে যান পুরনো কর্মস্থলে, কেউ কেউ পথেই লুটিয়ে পড়েন। পূতিগন্ধময় ‘লাশ' হয়ে থেকে যান কিছু সময়ের জন্য। রাষ্ট্র এঁদের কারও হিসাব রাখে না, রাখার প্রয়োজনও বোধ করে না। কারণ এঁরা রাষ্ট্রের ভোটব্যাঙ্ক নয়। এঁরা কালেভদ্রে ঘরে ফেরেন, তার পর ছড়িয়ে পড়েন দেশের নানা প্রান্তে। এমন ছন্নছাড়া মানবস্রোত কি আর ভোটবাক্সে কোনও সুবিধা করে দিতে পারে? তাই রাষ্ট্র প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরে অক্লেশে জানিয়ে দেয়, তার কাছে এই ‘অপর'দের সম্পর্কে কোনও তথ্য নেই।

 এই আপন-পরের খেলা নিরন্তর। হিটলারের হেরেনভক তত্ত্ব-প্রসূত তীব্র ইহুদি-বিদ্বেষ কিংবা পড়শি মায়ানমারের জুন্টা সরকার কর্তৃক রাখাইন প্রদেশবাসী রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত অত্যাচার, দেশের মূলস্রোত থেকে ‘অপর'কে বিচ্ছিন্ন করার, পীড়ন করার ইতিহাস বদলায় না। গাজা, মেক্সিকো কিংবা আফগান সীমান্তের কাঁটাতারগুলো জানে, কত মানুষ রাষ্ট্রের অভয়ারণ্য থেকে মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে উড়ে যেতে চেয়েছিল। ঠিক যেমন দাঙ্গাবিধ্বস্ত উত্তর-পূর্ব দিল্লি জানে, সংখ্যাগুরুবাদের আস্ফালন কী ভাবে স্থানান্তরী করে দেয় একটা গোটা মহল্লাকে।

 


রাষ্ট্রের কাঁটাতার জানে, ‘ওরা' উড়তে চেয়েছিল

সম্প্রতি মহানির্বাণ ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপের উদ্যোগে Media & the Politics of Migration শীর্ষক একটি আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়েছিল। কলকাতার একটি পাঁচতারা হোটেলে অনুষ্ঠিত, দু'দিন ব্যাপী এই আলোচনা সভায় পরিযায়ী সংকটের মূলে থাকা কারণগুলো নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হল। দেশ বিদেশের কৃতি গবেষক, সাংবাদিকরা তাঁদের গবেষণালব্ধ তথ্য উপস্থাপিত করে দেখালেন, কী ভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে রাজনৈতিক ব্যবস্থার শিকার হয়ে পরিযায়ী হতে বাধ্য হচ্ছেন শতসহস্র মানুষ। অথচ রাষ্ট্রের দলিল দস্তাবেজে তাঁদের কোনও উল্লেখই থাকছে না। জীবন ও জীবিকা বাঁচাতে স্রেফ কয়েকটা সংখ্যা হয়েই এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে চলেছে এই জনস্রোত।

 

ভারতীয় উপমহাদেশ গত এক শতক জুড়ে শরণার্থী সমস্যার এক অসম পরীক্ষাগার হিসাবে উঠে এসেছে। দেশভাগের হাত ধরে দেশের পুব ও পশ্চিম, উভয়প্রান্তের বহু মানুষকেই ছিন্নমূল হতে হয়েছে। তবু রাষ্ট্র স্থিতাবস্থা চায় না। NRC, CAA-র হাত ধরে এই আপন ও পরের দ্বন্দ্ব আবার সামনে চলে এসেছে। অনুপ্রবেশকারী তকমা নিয়ে কত নিরীহ প্রাণ যে অকালে ঝরে গিয়েছে, তার খবর রাষ্ট্রের নেওয়া হয়নি। এখনও এই দেশের সংখ্যাগুরু সমাজের দুর্বলতর অংশ কিংবা প্রতিস্পর্ধী চরিত্রের অস্তিত্বকে ‘বাংলাদেশি' কিংবা 'খলিস্তানি' বলে দেগে দেওয়াতেই অভ্যস্ত। তাই এখনও ‘পদ্মা নদীর মাঝি' উপন্যাসের সেই অলীক ময়নাদ্বীপের উদ্দেশে ছুটে চলেছে মরিয়া মানবস্রোত, আর কল্যাণকামী পপুলিস্ট রাষ্ট্র যেন হোসেন মিঞার মতো আয়েস করে এই বিয়োগান্তক দৃশ্যপট রচনা করে যাচ্ছে।


New
মাদক ব্যবসা ও বিভাজনের রাজনীতির আবর্তে আজকের মণিপুর
ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে রাষ্ট্রীয় মদত? বিস্ফোরক রিপোর্ট অসম রাইফেলসের
বিরোধী জোট আছে, রাজনীতি কই?


Other Writings by -বিতান ঘোষ | 08-12-2021

// Event for pushed the video