৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষ নতুন একটা কথার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল - ব্ল্যাক আউট। এবার করোনা মহামারীর সুবাদে ভারতের শহর ও গ্রামের মানুষ নতুন আর একটা কথার সঙ্গে পরিচিত হল - লক ডাউন। টিভিতে, সংবাদপত্রে এবং সোশাল মিডিয়ায় এই লক ডাউনকে এমনভাবে তুলে ধরা হচ্ছে যেন করোনা মহামারী ঠেকাতে এটি একটি সর্বরোগহর বটিকা। যেটা বলা হচ্ছে না, লক ডাউনের মাধ্যমে সংক্রমণের ছোঁয়া থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখতে হলে রাষ্ট্রকে একই সঙ্গে আরও কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস যেমন, চাল ডাল আটা তেল নুন চিনি দুধ সবজি ডিম ইত্যাদির জোগান নিশ্চিত করলেই হবে না, একই সঙ্গে মানুষ যাতে ওই সব জিনিস কিনতে পারে সে জন্য তার হাতে টাকার জোগানও দিতে হবে।
করোনা মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইকে যদি একটা বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তা হলে মনে রাখতে হবে যে যুদ্ধের সময় আর যে নিয়মই খাটুক, বাজার অর্থনীতির নিয়ম খাটে না। যুদ্ধের সময় যেমন রাষ্ট্রকে তার দেশের সেনাবাহিনীকে শুধু শত্রুর বিরুদ্ধে প্রয়োগের জন্য সমরাস্ত্র দিলেই চলে না, একই সঙ্গে সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম, রসদ জোগাতে হয়, তেমনই রণাঙ্গনের লড়াই অব্যাহত রাখতে সমরাস্ত্র, খাদ্য, ওষুধ ইত্যাদির উৎপাদন এবং সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়। এ সবের জন্য বাজার অর্থনীতি কাজ করে না। তেমনই করোনা মহামারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে নামতে হলে শুধু রাজ্যে রাজ্যে লক ডাউন ঘোষণা করে রাস্তায় পুলিশ নামিয়ে তা নিশ্ছিদ্র করা অসম্ভব। এটা তখনই সম্ভবপর যখন দেশের নাগরিকরা রাষ্ট্রের সঙ্গে এ ব্যাপারে স্বেচ্ছায় সহযোগিতা করবেন। আর নাগরিকদের কাছ থেকে সহযোগিতা পেতে হলে রাষ্ট্রকে আগে দেখতে হবে দেশের মানুষের পক্ষে দিনের পর দিন ঘরে বন্দী হয়ে থাকার প্রয়োজনীয় শর্তাদি রাষ্ট্র পূরণ করতে পারছে কি না। এটা অবশ্য সমাজের সেই অংশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, যাদের বাড়িতে খাদ্য ও পানীয়ের ভান্ডার মজুত, হাতের মুঠোফোনের সাহায্যে মুহূর্তে ঘরে বসে আরও অত্যাবশকীয় জিনিস আনিয়ে নিতে সক্ষম, একাধিক ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডে পার্স বোঝাই। এমনিতেই দেশের ২০-৩০ শতাংশের বেশি মানুষ এই গোত্রে পড়েন না। বাকিদের মধ্যে সমাজের একেবারে নিচের দিকের ৩০ শতাংশ মানুষকে নিয়েই চিন্তা। কারণ, এঁদের বেশিরভাগই দিন আনি দিন খাই করে চালান। ফলে, হাতে সঞ্চিত অর্থ সামান্যই থাকে। অনির্দিষ্ট লক ডাউনে এদের রোজগার বন্ধ হয়ে গেলে এক ঝটকায় এঁরা সপরিবারে অনাহারের সামনে এসে দাঁড়াতে বাধ্য হন।
বিশেষ করে এঁদের জন্যই রাষ্ট্রকে তার নাগরিকদের জনকল্যাণকামী (welfare state) ভূমিকা নিতে হয়। অর্থাৎ, লক ডাউনের জন্য সব কাজ বন্ধ, এই অবস্থায় রাষ্ট্রকেই সেই কাজ হারানো মানুষদের পকেটে টাকা গুঁজে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে। না হলে, বাধ্য হয়েই তারা জীবিকার সন্ধানে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে বেড়াবে। রোগ সংক্রমণে নিজেদের প্রাণ বিপন্ন হতে পারে জেনেও। যেমন স্পেশাল ট্রেনে চড়ে বেরিয়ে পড়েছিল মুম্বই ও পুনে থেকে হাজার হাজার অভিবাসী শ্রমিক। ফলে, নিজেদের প্রাণ বিপন্ন করার সঙ্গেই কাজের খোঁজে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়ানো শ্রমিকবাহিনী দেশ জোড়া লক ডাউনকেই ব্যর্থ করে দিতে পারে।
রাষ্ট্রের কর্ণধাররা এ বিষয়ে বিলক্ষণ অবহিত। কিন্তু তাঁরা এমন ভান করছেন যেন এটা স্থানীয় স্তরেই সমাধান করা যাবে এবং এটা নিয়ে দেশজুড়ে কোনও কেন্দ্রীয় উদ্যোগ নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকারই নেই। এর প্রমাণ, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে একটি বিশেষ টাস্ক ফোর্স গঠিত হয়েছে দেশের আর্থিক অবস্থা খতিয়ে দেখে জরুরি কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী মঙ্গলবারই কর্পোরেট দুনিয়ার জন্য অল্প কিছু রিলিফ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রের লক্ষ লক্ষ কাজ-হারানো শ্রমিকের জন্য কোনও রিলিফ ঘোষণার কথা শোনা যায় নি। দেশের কর্ণধাররা ভুলে যাচ্ছেন যে দেশ জুড়ে লক ডাউন শুরু করার সঙ্গেই এই কাজ হারানো অসংখ্য শ্রমিক এবং ঠেলাওয়ালা, মুটেমজুর, কুলি, রিকশা ও ভ্যানরিকশা চালক, ছোট দোকানদার, হকার, ফেরিওয়ালা প্রমুখ অসংগঠিত ক্ষেত্রের নানা পেশার কাজ-হারানো মানুষের হাতে যদি খাবার কেনার ন্যূনতম অর্থ না থাকে, তা হলে সে ঘরবন্দি না থেকে কারফিউ ভেঙে খাবার সন্ধানের মরিয়া চেষ্টা করবেই। তাই লক ডাউন সফল করতে হলে একই সঙ্গে দরকার এই সব প্রান্তিক মানুষদের পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
কেন্দ্রের বি জে পি সরকার এ দিকে নজর না দিলেও রাজ্য স্তরে কিছু কিছু চেষ্টা শুরু হয়েছে। কেরলের বামপন্থী সরকার সবচেয়ে প্রথম এই বিষয়ে নজর দেয়। কেরলের পিনারাল বিজয়ন সরকার রাজ্যের সমস্ত বি পি এল তালিকাভুক্ত রেশন কার্ডধারীকে আপাতত বিনা পয়সায় রেশন দিতে শুরু করেছে। তার পরে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সরকার একই সঙ্গে বি পি এল এবং এ পি এল কার্ডধারী সবাইকে ২ টাকা কিলো দরে চাল দিতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে রাজ্যের স্কুলগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গেই মিড ডে মিল বন্ধ হওয়ার ধাক্কা যাতে গরিব ছাত্রছাত্রীদের গায়ে না লাগে, সে জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার আপাতত সব ছাত্রছাত্রীকে ১৫ দিনের চাল ও আলু দিয়েছে। একই সঙ্গে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক কর্মীদের আপাতত ১০০০ টাকা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যদিও কত শ্রমিক এই প্রকল্পের আওতায় আসবেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়। পঞ্জাব সরকার তার রাজ্যের নথিভুক্ত ৩,২০,০০০ নির্মাণকর্মীকে আপাতত ৩০০০ টাকা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ সরকার রাজ্যের অসংগঠিত ক্ষেত্রের ৩৭ লক্ষ শ্রমিককে ১০০০ টাকা করে দিচ্ছে। তার মধ্যে ১৬.৫ লক্ষ দিনমজুর, বাকিরা নির্মাণশ্রমিক।
এ থেকে একটা কথা আরও জোরালোভাবে সামনে উঠে আসে যে দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত (এখন কাজ-হারানো) যে অসংখ্য মানুষ রয়েছেন, তাদের জন্য রাষ্ট্রকে অবশ্যই জরুরি ভিত্তিতে কিছু করতে হবে। এটা শুধুই শ্রমিকদের অল্প কিছু টাকা দিয়ে হবে না। করোনার ধাক্কা আসার আগে থেকেই আর্থিক মন্দার মধ্যেও যে সব ছোট ছোট শিল্পসংস্থা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল, এখন লক ডাউন এর ধাক্কায় তাদের অবস্থাও সঙ্গীণ। সরকারকে এটাও দেখতে হবে যাতে লক ডাউন উঠে গেলে এই কারখানাগুলি লক আউটের পথে যেতে বাধ্য না হয়। আর এটা শুধু কেরল, পশ্চিমবঙ্গ, পঞ্জাব ও উত্তরপ্রদেশের সমস্যা নয়, এটা গোটা দেশের সমস্যা। তাই, আম্বানি, আদানি, টাটা, বিড়লাদের জন্য রিলিফ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি ও নির্মলা সীতারামনদের এই অসংখ্য ছোট ছোট কলকারখানার জন্য রিলিফের কথাও ভাবতে হবে। লক ডাউন, ফ্রি রেশন, অসংগঠিত ক্ষেত্রে ও বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের জন্য কিছু টাকা এবং বড়, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য কার্যকরী রিলিফ, এ সব মিলিয়েই করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের স্ট্র্যাটেজি গড়ে উঠতে পারে।