4thPillar


পরিযায়ী না-ভোটারের নয়া পথের পাঁচালি

বিতান ঘোষ ও রজত রায় | 16-04-2020May 20, 2023
পরিযায়ী না-ভোটারের নয়া পথের পাঁচালি

এই সুবৃহৎ ভুবনগ্রামের প্রত্যন্ত কোনও অখ্যাত স্থানে এদের বাড়ি। একটু ভালভাবে বাঁচবে বলে একদিন তারা গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছিল। তাদের এই চলন ছিল প্রাক-ধনতান্ত্রিক কাঠামো থেকে ধনতান্ত্রিক কাঠামোর দিকে। স্থবির জীবন থেকে তুলনায় সংগ্রামের জীবনের দিকে। কিন্তু এই দুঃসময়ে তারা সবকিছু ছেড়ে আবার তাদের শিকড়ে ফিরতে চাইছে।

ওরা পরিযায়ী শ্রমিক। সাঁতরাগাছি ঝিলে পরিযায়ী পাখি না এলে, তবু অল্পবিস্তর লেখালিখি হয়। কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকরা কীভাবে বাঁচে, কীভাবে তাদের দৈনন্দিন বাঁচার লড়াই চালায়, সেই নিয়ে কেউ খোঁজখবর রাখে না। যে রাজ্য থেকে ওরা কাজ খুঁজতে যায়, সেই রাজ্য যেমন তাদের সমস্ত দায় ঝেড়ে ফেলে, তেমনি যে রাজ্যে ওরা কাজ পায়, তারাও নিতান্ত করুণার চোখে এদের দেখে। করোনা মহামারীতে বিপর্যস্ত সারা বিশ্ব। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির বিবর্ণ ছবিটা ধীরে ধীরে প্রকট হয়ে উঠছে। এই ঝড়ের প্রকোপে সবচেয়ে দিশাহারা অবস্থা দেশের অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিকের। দেশে লকডাউন ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই এদের কাজ বন্ধ। সামান্য যেটুকু সঞ্চয় ছিল, এতদিনে সেইটুকুও ঘুচেছে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র কী করছে? কেন্দ্রীয় খাদ্য সরবরাহ ও উপভোক্তা বিষয়ক মন্ত্রী রামবিলাস পাসওয়ান মার্চ মাসের গোড়া থেকে নিয়ম করে বলে যাচ্ছেন, দেশে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য মজুত আছে। প্রত্যয়ী মন্ত্রী অবশ্য এই খাদ্য মজুতের কারণ হিসাবে কোনও সুদূরপরাহত জাতীয় বিপর্যয়ের আশঙ্কার কথা তুলে ধরেছেন। এই ভেবে বিস্মিত হতে হয় যে, গোটা বিশ্বের এত বড় বাস্তব বিপর্যয়ের সামনেও তিনি এক অলীক বিপর্যয়ের আশঙ্কায় খাদ্যশস্য মজুত করে যাচ্ছেন। এদিকে অভুক্ত শ্রমিক খিদের তাড়নায় ঘরে ফিরতে মরিয়া হয়ে উঠছে।

ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়ার সাইটে জ্বলজ্বল করছে সারা দেশে শুধুমাত্র ফেব্রুয়ারি মাসেই ৫ কোটি ৮৪ লক্ষ টন খাদ্যশস্য (শুধু চাল ও গম) মজুত রাখা হয়েছে। তা ছাড়াও রয়েছে দুই কোটে ৮৭ লক্ষ টন ধান। এই পরিসংখ্যানে একটা বিষয় স্মরণে রাখতে হবে, এই সময় কিন্তু রবি শস্যের সম্ভাব্য পরিমাণ জানা যায়নি। বোরো ধান মাঠ থেকে গুদামে এলেও মজুতের পরিমাণ আরও বাড়বে। এটা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, আমাদের দেশ তার নাগরিকদের মুখে দু'বেলা দু'মুঠো তুলে দিতে অন্য কোনও রাষ্ট্রের সাহায্য প্রত্যাশা করবে না। আজ এই ব্যাপারে ভারত সম্পূর্ণ স্বনির্ভর।

কিন্তু সরকার এই বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্যকে অকারণে ধরে রেখে দেশে কি কৃত্রিম দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি করছে না? প্রথমে দিল্লির আনন্দ বিহার, তারপর মহারাষ্ট্রের বান্দ্রা, তারপর দিল্লির যমুনা নদী তীরবর্তী অঞ্চল- দিকে দিকে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিচ্ছে। তাদের অনেকেই সংবাদমাধ্যমের সামনে রাগ-দুঃখ উগড়ে দিয়ে বলছেন, সামান্য অন্ন, খাবার জল ও প্রয়োজনীয় ওষুধ থেকে বঞ্চিত তারা। তাই, সোশ্যাল ডিসটেন্সিংয়ের শর্ত লঙ্ঘন করেই তারা নিজেদের বাড়িতে ফিরতে চাইছেন।

দেশের অসংখ্য (প্রায় ৪০ কোটি) মানুষকে এভাবে কেন মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে সরকার? স্থানীয় প্রশাসনই বা এমন নির্বিকার ভাবে চোখ বন্ধ করে বসে আছে কেন? পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর রাজ্যের শ্রমিকদের খাদ্য ও বাসস্থানের বন্দোবস্ত করার জন্য সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো সমন্বিত ভারতবর্ষে অন্য রাজ্যের মানুষের খাদ্য বাসস্থান সুনিশ্চিত করার দায় সেই রাজ্যের প্রশাসনের নেই? তার জন্য অন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখতে হবে?

লকডাউন পর্বে প্রধানমন্ত্রী পূর্ব ঘোষণা মোতাবেক তিন তিনবার টিভির পর্দায় এলেন। ভাল-মন্দয় মেশানো বেশ কিছু জরুরি ঘোষণা করলেন। বাতি জ্বালানো, ঘন্টা বাজানোর মত কিছু 'সচেতনতামূলক' টাস্কও দিলেন। কিন্তু এই শ্রমিকরা, যারা এতকাল স্থানীয় অর্থনীতিকে মজবুত করেছে, তাদের জন্য একটা কথাও বললেন না! এদের ভবিষ্যৎ, জীবনধারণের উপায়ও বাতলালেন না। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন করোনা মোকাবিলার অর্থনৈতিক দাওয়াই ঘোষণা করতে গিয়ে, সপার্ষদ ঘোষণা করেছিলেন, দেশের ৮০ কোটি মানুষকে বিনামূল্যে অতিরিক্ত ৫ কেজি খাদ্যশস্য দেওয়া হবে। কিন্তু প্রথমত তার এই মহতী ঘোষণার বাস্তব প্রয়োগ কতখানি হয়েছে, তার কোনও সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়ত, সরকারি গুদামে যে পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুত আছে বলে স্বয়ং সরকারি সংস্থাই জানাচ্ছে, সেই অনুপাতে এই 'দান' নস্যি মাত্র।

কার্গিল পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত সাবধানী আর সঞ্চয়ী হতে গিয়ে বাজপেয়ী সরকার কয়েক লক্ষ মেট্রিক টন গম সরকারি গুদামে নষ্ট করে ফেলেছিল। সেই সময় তা এটা নিয়ে প্রবল বিতর্কও হয়েছিল। এখনকার এই ত্রস্ত সময়ে এই অতি সাবধানতা ডেকে আনতে গিয়ে অন্য বিপদ ডেকে আনবে না তো মোদী সরকার?

পরিযায়ী শ্রমিকদের বিপক্ষে যেটা যায়, সেটা হল, তারা তাদের কর্মস্থলের ভোটার নয়। স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয় প্রশাসনের দয়ামায়া তাদের ওপর কম। আবার ভোটের সময় তারা নিজেদের রাজ্যেও ভোটটা দিতে পারে না অনেক সময়। তাই কেজরিওয়ালের মত 'সুশাসক' কখনও এদের বাসে চাপিয়ে উত্তরপ্রদেশ সীমান্তে রেখে দিয়ে এসে দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলেন, কখনও উত্তরপ্রদেশ পুলিশ রাসায়নিক স্প্রে দিয়ে এদের স্বাগত জানায়। রেলের বিভ্রান্তিকর ঘোষণায় ওরা ভিড় করে স্টেশনে, কখনও অভুক্ত দুর্বল শরীরে তপ্ত পিচ গলা পথে হেঁটে চলে বাড়ির দিকে। পুলিশি নির্যাতনের সামনে ওদের ছেড়ে যাওয়া ছেঁড়া চপ্পল দেশের নতুন পথের পাঁচালি রচনা করছে। তবে এই পথে বিভূতিভূষণের গুলঞ্চলতার সুবাস নেই, আছে কাঁটা, অনাহার, যাতনা।


New
আপনি নিজে কজন মুসলমানকে চেনেন?
নিজবাসভূমে পরভাষী
মহাকুম্ভের অমৃতবারি ও অন্ধদের হস্তিদর্শন


Other Writings by -বিতান ঘোষ ও রজত রায় | 16-04-2020

// Event for pushed the video