4thPillar


‘ভদ্রলোক’, ‘ছোটলোক’দের সঙ্গে নিয়ে তৃণমূলকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে বিজেপি

রজত রায় | 21-02-2021May 19, 2023
‘ভদ্রলোক’, ‘ছোটলোক’দের সঙ্গে নিয়ে তৃণমূলকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে বিজেপি

1980 সাল পর্যন্ত ভারতীয় জনতা পার্টি পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা এবং বিধানসভা মোট ভোটের মাত্র 2% নিজেদের দখলে রাখতে সক্ষম ছিল। 1989-এ 2% থেকে 2019-এ 40%, ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে বিশাল অগ্রগতি হয়েছে। গত লোকসভায় রাজ্যে 18টি আসন পাওয়ার পর বিজেপি রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের সামনে একটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দিয়েছে। এতটাই যে তারা এখন আগামী এপ্রিল-মে মাসে হতে চলা বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে শাসকদলকে ক্ষমতাচ্যুত করার হুমকি দিতে পারছে।

 

প্রশ্ন ওঠে, একটি রাজনৈতিক দল, যারা ঘোষিতভাবে ধর্মকেন্দ্রিক এবং দক্ষিণপন্থী আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করে, তারা কীভাবে ধর্মনিরপেক্ষ, বামমনস্ক এবং উদারবাদী ভোটারদের বিশ্বাস অর্জনে সক্ষম হচ্ছে? এমনকি এই বিশ্বাসী মানুষদের সংখ্যাটাও ক্রমশ বাড়াতে পারছে?

 

এর অনেকগুলি কারণ আছে। পশ্চিমবঙ্গের দেশভাগ পরবর্তী ইতিহাস ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ভরা। দেশভাগের পরে এখানে প্রথম বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনাটি ঘটে 1950 সালের জানুয়ারি মাসে। তা ছাড়াও 1964 সালের জানুয়ারি মাসে এবং 1992 সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর অনুরূপ ঘটনা ঘটে। যদিও বহু দাঙ্গার খবর মূলস্রোতের গণমাধ্যমে অনুল্লিখিত রয়ে যায়। এর একটা কারণ হল তদানীন্তন সরকার, বিশেষত 34 বছর ক্ষমতায় থাকা বাম সরকারের সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের মালিকদের এক অলিখিত বোঝাপড়া। কিন্তু মমতার জমানায় হাওড়া জেলার ধূলাগড়ে, উত্তর ২৪ পরগণার বসিরহাটে, মালদার বৈষ্ণবনগরে বড় মাপের দাঙ্গা প্রমাণ করে, সাম্প্রদায়িক বিভেদের আগুন পশ্চিমবঙ্গের সমাজে ধিকিধিকি জ্বলছে, এবং হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিভেদের দেওয়াল রয়ে গিয়েছে।

 

বাঙালি ভদ্রলোক বামপাশ থেকে ডানপাশে ফিরলেন

 

ধনী ও দরিদ্র, এই দুই ভাগে বিভক্ত বাংলার সমাজে এলিট সম্প্রদায় বা বাঙালি ভদ্রলোক সম্প্রদায় আগাগোড়া কমিউনিস্টদের কমিটেড ভোটার ছিলেন না। উচ্চবর্ণের হিন্দুরা, দেশভাগের পর নিজেদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মানদণ্ডে প্রান্তিক ভাবতে শুরু করেন এবং দেশভাগের জন্য কংগ্রেসকে দায়ী করেন। তাদের বামেদের সমর্থন করার পিছনেও এই কংগ্রেস-বিরোধী মনোভাবটি কাজ করেছিল। কিন্তু, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গেও তাদের মধুচন্দ্রিমাও প্রায় শেষের পথে, কেননা মুখ্যমন্ত্রীর অশোভন ব্যবহার তাদের কাছে অস্বস্তিজনক। মমতার জনসমক্ষে দেওয়া বার্তা, তত্ত্ব, এমনকি তাঁর বাচনভঙ্গিও এই এলিট ভদ্রলোকেদের কাছে উপহাসের বিষয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, মমতার কলকাতাকে লন্ডন এবং দার্জিলিংকে সুইজারল্যান্ড বানানোর নির্বাচনী অঙ্গীকারে এই ভদ্রলোকেদের কাছ থেকে তীব্র সমালোচনা এবং বিদ্রুপ ধেয়ে এসেছিল। মমতার সরকার বিনামূল্যে রেশন, বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা, ছাত্রীদের জন্য আর্থিক সহযোগিতা (কন্যাশ্রী প্রকল্প)-র মতো একাধিক গরিব কল্যাণ প্রকল্প হাতে নিলেও, রাজ্যে বড় শিল্প না আসায় এবং পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায়, মধ্যবিত্ত বাঙালি সম্প্রদায় নিজেদের বঞ্চিত মনে করছে। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে মমতার উপস্থিতি এবং এই পরিসরে তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপন করা, ভদ্রলোক সম্প্রদায়কে আরও বেশি করে ক্ষুণ্ণ করেছে। যেমন, 2019 সালে কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে নামী চিত্রপরিচালক অনীক দত্ত অনুষ্ঠানস্থলে মুখ্যমন্ত্রীর বড় কাট-আউট লাগানোয় প্রকাশ্যেই তাঁর সমালোচনা করেন। এই ঘটনা পরবর্তী সময়ে শিল্পীমহলে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু, এইসবের পরেও রুদ্রনীল ঘোষ এবং একাধিক টলিউড অভিনেতার তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাওয়া আটকানো যায়নি। বিজেপির স্বপক্ষে এদের তেমন কিছু বলতে না শোনা গেলেও, এদের প্রত্যেককেই তৃণমূলের সমালোচনা করতে দেখা গেছে।

 

ধর্মীয় ইস্যুতে জনসমক্ষে মমতার আচরণ মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের একাংশ ভালভাবে নেয়নি। মমতা শুরু করেছিলেন মুসলমানদের তোয়াজ করে। পরে বিজেপির সঙ্গে হিন্দু ভোট পাওয়ার লড়াইয়ে মমতা প্রকাশ্যে নিজেকে একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দু বলে পরিচয় দিতে থাকেন এবং জনসভাগুলিতে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করে বিভিন্ন মন্ত্রোচ্চারণ করতে থাকেন। বাঙালি মধ্যবিত্ত এই আচরণে হিন্দু এবং মুসলিমদের চরমপন্থী অংশের ভোট পেতে তাঁর মরিয়া প্রয়াস লক্ষ্য করল। একইসঙ্গে মমতার সরকারের তরফে কলকাতার ইকোপার্কে পিরামিড, তাজমহল, ক্রাইস্ট দ্য রিডিমারের মতো বিখ্যাত স্থাপত্যগুলির প্রতিকৃতি নির্মাণ এবং লেকটাউনে বিগ বেনের প্রতিকৃতি নির্মাণ এই সরকারকে ভদ্রলোকদের হাসির খোরাক করে তুলল।

 

তৃণমূল নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বড় দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও, তা সরাসরি বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণীকে প্রভাবিত করেনি। যদিও কাট-মানি সংস্কৃতি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ভালভাবে নেয়নি এবং জনগণের টাকা লুট করায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মমতা যে কোনও ব্যবস্থা নিতে পারবেন না— এমন একটা ধারণা তাদের মধ্যে তৈরি হয়ে যায়। অগত্যা, মমতার সযত্নে লালিত সৎ ভাবমূর্তিতে একটা বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন বসে যায়। দু'বছর আগে বিজেপি যখন পূর্ণশক্তিতে এই রাজ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং হিন্দু মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়কে একজোট করার জন্য একটা শক্তপোক্ত জায়গা দেয়, তখন থেকে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। তৃণমূল থেকে নেতা, কর্মীদের প্রস্থান এই ইঙ্গিত দেয় যে, হিন্দু মধ্যবিত্তের মন জয় করতে বিজেপি কিছুটা হলেও সক্ষম হয়েছে।

 

মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারী, শোভন চ্যাটার্জির মতো কিছু হেভিওয়েট নেতা তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গিয়েছেন, যদিও চিটফান্ড কেলেংকারিতে তাঁরা প্রত্যেকেই অভিযুক্ত। এইটুকু অস্বস্তির জায়গা ছাড়া সৌরভ গাঙ্গুলি, মিঠুন চক্রবর্তীর রাজনীতিতে যোগদানের গুঞ্জন প্রমাণ করে বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণীর মমতার প্রতি মোহমুক্তি ঘটেছে। তাদের কাছ থেকে বিজেপির শুধু পূর্ণ সমর্থন আদায়টুকুই বাকি।

 

শ্রমজীবী সম্প্রদায় এবং বিজেপি 

 

শুধু ভদ্রলোক শ্রেণীই নয়। পশ্চিমবাংলার ইতিহাস এবং দেশভাগের যন্ত্রণার মধ্যে এমন কিছু আছে, যা রাজ্যের দরিদ্র এবং শ্রমজীবী সম্প্রদায়কে বিজেপির দিকে ঝুঁকতে সাহায্য করেছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলার নির্বাচনী ইতিহাসে দেখা যায়, উদবাস্তুরা 1950-1980, প্রায় তিন দশক বামেদের সঙ্গে ছিল। কিন্তু যখন এই উদবাস্তুদের জীবনে কোনও বৈপ্লবিক পরিবর্তন এল না, তখন তারা তাদের যাবতীয় দূরবস্থার জন্য মুসলিমদের ওপর ঘৃণা পোষণ করতে শুরু করল। এই ঘৃণা পরবর্তী সময়ে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। মুসলমানদের ওপর এই বিদ্বেষ, যা এতকাল সুপ্ত অবস্থায় তাদেএ মনে ছিল, যা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, তাই এখন বাইরে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে পেয়েছে। তাই, আমরা একাধিক বড় এবং ছোট দাঙ্গা প্রত্যক্ষ করেছি।

 

1991-এর লোকসভা ভোটে, বিজেপি প্রথমবারের জন্য এই রাজ্যে 11% ভোট পায়। প্রত্যাশিতভাবেই এই ভোটের সিংহভাগ এসেছিল, রাজ্যের বাংলাদেশ লাগোয়া 11টি জেলা থেকে। তারপর ভারতের অন্যান্য অংশেও বিজেপির ক্রমিক জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে, রাজ্যের উদবাস্তু নাগরিকরাও বিজেপির পক্ষে সংগঠিত হতে শুরু করে। দেশভাগের  পরে যে মানুষেরা উদবাস্তু হয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসেছিল, তাদের অধিকাংশই ছিল নিম্নবর্ণের মানুষজন। বর্ণহিন্দু ও মধ্যবিত্তরা  তাদের সামারিক ও আর্থিক যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে কলকাতা ও অন্যান্য শহরে জায়গা করে নিয়েছিল। কিন্তু উদবাস্তু কৃষক, তাঁতি, কামার, গোয়ালা ইত্যাদি বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত নিম্নবর্ণের মানুষদের অধিকাংশই (যারা দণ্ডকারণ্যে বা আন্দামানে সরকারি উদ্যোগে পুনর্বাসন পেয়েছিল তারা ছাড়া), রাজ্যের প্রান্তিক জেলাগুলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে বাধ্য হয়। এদের বেশিরভাগ জড়ো হয় সেই 10-11টি জেলায়, যেগুলি পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ)-এর আন্তর্জাতিক সীমান্ত সংলগ্ন জেলায়। যেহেতু তাদের নিজেদের জীবনের বিপর্যয়ের জন্য তারা মুসলমানদের দায়ী করেছিল, তাই বিজেপির মুসলিম-বিরোধী অবস্থান এবং ‘বেআইনি মুসলমান অনুপ্রবেশকারী’-দের বার করে দেওয়ার ঘোষিত অবস্থান উদবাস্তুদের বিজেপি-প্রীতিতে সহায়ক হয়।

 

1991-এর পর পরিবর্তিত পরিস্থিতির ফায়দা নিতে বিজেপি যখন সর্বস্ব নিয়ে ঝাঁপাচ্ছে, তখন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট রাজ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ ধরে এগোতে চেয়েছিল। এর আগে বামেদের একটি বিষয়ে গোঁড়া অবস্থান ছিল। তা হল সাধারণ মানুষের কাছে ন্যূনতম সরকারি পরিষেবা পৌঁছে দেওয়াটাই অগ্রাধিকার পাবে। কিন্তু প্রায় দুই দশক বাম রাজত্বে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা সঙ্গত কারণেই ক্রমশ বাড়তে শুরু করে। তাদের জন্য বামফ্রন্ট সরকারকে তখন বড় শিল্পের কথা ভাবতে শুরু করতে হয়। কিন্তু, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে শিল্পায়ন করতে গিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে বাঙালি ভদ্রলোকদের একটা অংশের কড়া প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়। এই ভদ্রলোক শ্রেণী বামেদের সঙ্গ ত্যাগ করে বিদ্রোহী গরিব কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোয়, বামেরা দুর্বল হয় এবং অচিরেই রাজ্যবাসী এক নতুন মুখ্যমন্ত্রীর জন্ম দেয়।

 

2014-র লোকসভা নির্বাচনের সময়ে সিঙ্গুরে টাটার ন্যানো কারখানায় (বর্তমানে পরিত্যক্ত) নিজেদের জমি চলে যাওয়া একাধিক পরিবারের যুবকরা দাবি করেন, তাঁরা পদ্মফুলে ভোট দিয়েছেন। পদ্মফুল— যা বিজেপির নির্বাচনী প্রতীক। এই প্রসঙ্গে তাঁদের ব্যাখ্যাটা খুব সহজ। একটি বড় রাজ্য, যেটি বড় শিল্পের অভাবে ধুঁকছে, সেখানে নরেন্দ্র মোদীর ‘বিকাশ’ (অর্থনৈতিক উন্নয়ন) স্লোগান যুবকদের মনে প্রভাববিস্তার করেছে। রাজ্যের মফঃস্বল এবং গ্রামীণ এলাকাতেও এমনটা ঘটেছে।

 

আরএসএস-বিজেপির নজর কেন বাংলার দিকে?

 

বিজেপির আদর্শগত পরিচালক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (RSS) এবং সংঘ পরিবারের অন্যান্য অগ্রবর্তী সংগঠন অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিল যে বাংলায় তাদের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলার মাটি হিন্দু দক্ষিণপন্থার চাষ করার মতো উর্বর হয়ে উঠেছে। তখন সংঘ পূর্ণ উদ্যমে বাংলার ময়দানে নামে। সংঘের সূত্র অনুযায়ী, 2001 সালে রাজ্যে সংঘের 1000টি শাখা ছিল। 2020-তে এই সংখ্যাটাই 3300-তে গিয়ে পৌঁছয়। সংঘের পরিকল্পনা হল, রাজ্যের 38,000 গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রত্যেকটিতে অন্তত একটি করে শাখা খোলা। তাছাড়াও ‘সরস্বতী শিশু মন্দির’ এবং ‘একল বিদ্যালয়’ নামে সংঘের দু'টি শাখা সংগঠন বুনিয়াদি স্তর থেকে পড়ুয়াদের মধ্যে সংঘের ভাবধারা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করে চলেছে। এর পাশাপাশি ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বীরভূম, মালদা, উত্তর দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার জেলায় ‘বনবাসী কল্যাণ আশ্রম’ আদিবাসী মানুষদের সংঘবদ্ধ করতে কাজ করছে।

 

ইতিহাসগতভাবে যে রাজ্য হিন্দু-মুসলমানে বিভক্ত, সেই রাজ্যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটানোর মতো অনুকূল পরিস্থিতির জন্য সংঘ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছে এবং ইতিমধ্যে কিছু সাফল্যের স্বাদও পেয়েছে। 2020 সালের জানুয়ারি মাসে যখন গোটা দেশ নয়া নাগরিক আইন (CAA) এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর (NRC) বিরুদ্ধে উত্তাল, তখন বাংলাতেও যে প্রতিবাদী অবস্থান, মিছিলগুলি সংঘটিত হয়েছে, সেখানে প্রধানত নেতৃত্ব দিয়েছেন রাজ্যের গ্রাম, শহর উভয় এলাকার মুসলমান সম্প্রদায়। উদারমনস্ক হিন্দু ভদ্রলোক এই আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, আন্দোলনে তাদের সংহতি জানিয়েছে কিন্তু এদের একটা বড় অংশে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের মুসলিমপন্থী অবস্থান (মূলত সরকারি কোষাগার থেকে ইমাম-মোয়াজ্জেন ভাতা সহ অন্যান্য আর্থিক সুবিধা প্রদান) হিন্দু ভোট একত্রিত করার প্রশ্নে বিজেপির কাজকে সহজ করে দিয়েছে।

 

যদিও যে কোনও দক্ষিণপন্থী দলের মতোই বিজেপি দেশপ্রেম ইস্যুতে নিজের সদস্য-সমর্থকদের উজ্জীবিত করে, প্রতিটি বিরোধী স্বরকে ‘অ-দেশপ্রেমী’ এবং ‘রাষ্ট্রদ্রাহী’ তকমা দেয়। সাধারণ মানুষের কাছে নিজেদের এই দেশপ্রেমকে সমর্থনযোগ্য করতে দলটির প্রয়োজন ছিল দেশের ইতিহাসের কিছু বিখ্যাত চরিত্রকে। তাই গুজরাটে বল্লভভাই প্যাটেল এর মূর্তি স্থাপনের পরে বাংলায় রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দ, ‘নেতাজি’ সুভাষচন্দ্র বসুকেও আপন করা শুরু হল।

 

এটা সত্য যে বাংলা সবসময় রামমোহন রায়, চিত্তরঞ্জন দাশ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিবেকানন্দ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং নেতাজির মতো প্রণম্যদের জন্মভূমি হিসাবেই পরিচিত হয়ে এসেছে। কিন্তু, রূঢ় সত্য এটাই যে, তাঁদের নিয়ে এই চর্চা বা উদযাপনের ক্ষেত্র উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। গ্রামীণ এবং শহুরে এলাকার গরিব মানুষ সমাজে এইসব মানুষদের অবদান এবং ভূমিকা সম্পর্কে খুব সামান্য কিছুই জানতে পেরেছেন। পাশাপাশি, গরিব প্রান্তিক মানুষ এই ব্যাপারে উৎসাহও দেখায়নি। এইসব মানুষদের কাছে মিঠুন চক্রবর্তী কিংবা প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি অনেক কাছের মানুষ। তাই, সংঘ প্রধান মোহন ভাগবতের সঙ্গে মিঠুন চক্রবর্তীর বৈঠকের তাৎপর্যকে এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। মিঠুন গ্রামবাংলার মানুষের কাছে এখনও একটি জনপ্রিয় নাম। তাই এইসব সেলেব্রিটির রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে তাঁর ভক্তরা যখন অল্প হলেও জানতে পারবে, তখন তাদের চোখে ভেসে উঠবে মিঠুন চক্রবর্তী অভিনীত ‘এমএলএ ফাটাকেষ্ট’ ছবির দৃশ্য— যে ‘হিট’ সিনেমায় মিঠুন একজন গুন্ডা থেকে গরিব কল্যাণকামী রাজনীতিকে পরিবর্তিত হয়েছিলেন।


New
মাদক ব্যবসা ও বিভাজনের রাজনীতির আবর্তে আজকের মণিপুর
ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে রাষ্ট্রীয় মদত? বিস্ফোরক রিপোর্ট অসম রাইফেলসের
বিরোধী জোট আছে, রাজনীতি কই?


Other Writings by -রজত রায় | 21-02-2021

// Event for pushed the video