4thPillar


প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মহানায়ক, পীড়িতের পূজ্য ঈশ্বর

রজত রায় | 26-11-2020May 11, 2023
প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মহানায়ক, পীড়িতের পূজ্য ঈশ্বর

মারাদোনাকে আমি মাঠে বসে খেলতে দেখিনি। মেসিকে দেখেছি কলকাতায় প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে এসেছিল যখন। পেলে-ও কলকাতায় প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে গেছেন, কিন্তু তাঁকেও মাঠে গিয়ে দেখা হয়নি। বিদেশের মাটিতে পর্তুগালের হয়ে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে 2018 সালে, 1998 সালের গোটা ব্রাজিল দলকে (বড় রোনাল্ডো ছাড়া) খেলতে দেখেছি, কিন্তু মারাদোনা ও পেলেকে টিভির পর্দায় দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। পেলে বড়, নাকি মারাদোনা বড়, এ নিয়ে তর্কের অবসান হয়নি। আমাদের প্রজন্ম পেলে ও তাঁর দেশ ব্রাজিলের ফুটবলে মজে থাকলেও, মারাদোনার সুবাদেই পরের প্রজন্ম ব্রাজিল থেকে সরে এসে আর্জেন্তিনার ভক্ত হয়েছে। পেলে ও মারাদোনার মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ, এ নিয়ে দুনিয়া জুড়ে তর্কের বিরাম নেই, এমনকি ফিফাও 2000 সালে বিংশ শতাব্দীর (1901 থেকে 2000) সেরা ফুটবলার কে, তা বাছার জন্য অনলাইনে সমীক্ষা করে। মারাদোনা পান 53 শতাংশ ভোট, পেলে 18 শতাংশ। ফিফা অবশ্য দুজনকেই যুগ্মবিজয়ী ঘোষণা করে।

 

বিশ্বের সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে হবে, তা নিয়ে বিতর্ক চলতেই থাকবে। তবে কোনও সন্দেহ নেই যে, মারাদোনা ও পেলে, এই দুজনেই তাঁদের ফুটবল দক্ষতায় নিজেদের সময়ে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ের তকমা পেয়ে গেছেন। যেমন পেলে, তেমনই মারাদোনা, কেউ কারও থেকে কম যান না। কিন্ত মাঠের বাইরে এই দুজনের জীবন আশ্চর্য বৈপরীত্যে ভরা। পেলে সারা জীবন তাঁর ভাবমূর্তিতে কোনও দাগ যাতে না লাগে, সে ব্যাপারে সতর্ক। ব্রাজিলের ক্রীড়ামন্ত্রীও হয়েছেন। বরাবরই প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার অঙ্গ হয়ে থাকতে থাকতে নিজেই একটা প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা হয়ে গেছেন। মারাদোনা ঠিক বিপরীত। তিনি হলেন enfant terrible, যিনি কোনও সামাজিক, রাজনৈতিক এমনকি ধর্মীয় অনুশাসনের তোয়াক্কা করেন না।

 

লাতিন আমেরিকার অধিকাংশ মানুষের মতোই মারাদোনাও রোমান ক্যাথলিক। অল্প সময়ের জন্য কলকাতায় এলেও তিনি মাদার টেরিজার মিশনারিজ অব চ্যারিটিজ’-এ যেতে ভোলেন না। 1984 সালে নেহরু গোল্ড কাপ টুর্নামেন্টে অংশ নিতে এসে গোটা আর্জেন্তিনা দলকেও দেখেছি মাদারের সঙ্গে দেখা করে আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে। মারাদোনা কিন্তু তাই বলে রোমান ক্যাথলিকদের সর্বোচ্চ গুরু, পোপকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করতে ছাড়েন না।

 

লোকে কী বলবে, তার তোয়াক্কা না করে মারাদোনা নিষিদ্ধ মাদক সেবন (প্রধানত কোকেন) চালিয়ে যান। তাতে নিজের স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতি সত্ত্বেও তাঁর মাদকাসক্তি কমানোর চেষ্টা দেখা যায়নি। 1980-র দশকে বেশ কয়েক বছর ইতালির নাপোলি ক্লাবের হয়ে খেলার সময় তাঁর মাদকাসক্তি ও ড্রাগ মাফিয়াদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং ঘনিষ্ঠতার কথা প্রকাশ্যেই চর্চিত হতে থাকে। ওই সময় সেখানে তিনি একটি অবৈধ সন্তানের জন্ম দেন। অনেক পরে, সম্ভবত পিতৃত্বের পরীক্ষায় প্রমাণিত হলে তাকে মারাদোনা নিজের সন্তানের স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হন।

 

তবে তাঁর মাদকাসক্তি, নিত্য নতুন নারী সঙ্গ ইত্যাদিকে ছাপিয়ে আর একটি দিক ক্রমশ বড় হয়ে ওঠে, তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। প্রকাশ্যেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ঘোষিত শত্রু কিউবা ও তার নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সমর্থনে এগিয়ে এসে মারাদোনা বুঝিয়ে দেন, তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান। এই সমর্থন যে নেহাত কথার কথা নয়, তা কাজেও বারবার প্রমাণ করেছেন তিনি। এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ছে, 1995 সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠান কভার করার কথা। বিশ্বের প্রায় 200টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের উপস্থিতিতে গোটা অনুষ্ঠানকে ঠান্ডা যুদ্ধে পশ্চিমী দুনিয়ার বিজয় উৎসবে পরিণত করে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জন মেজর কিউবাকে তুলোধোনা করলেন। বললেন, তাদের কথামতো না চললে আরও বিপদে পড়তে হবে। ফিদেল কাস্ত্রোও সেখানে হাজির ছিলেন। কিউবার তখনকার অবস্থাটা খুবই সঙ্গীন। সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া নেই। চিন মুখে সমাজতন্ত্রের কথা বললেও পুঁজির আরাধনায় মগ্ন। আর এই অবস্থায় আমেরিকার অর্থনৈতিক অবরোধের জন্য কিউবার কী অবস্থা হয়েছিল, তা কাস্ত্রোর মুখ থেকেই রাষ্ট্রপুঞ্জে উপস্থিত সবাই শুনেছিল। শান্ত ভাবে কাস্ত্রো জানিয়েছিলেন, জীবনদায়ী ওষুধের অভাবে প্রতিদিন কিউবায় বহু শিশু প্রাণ হারাচ্ছে। কাস্ত্রোর কথায়, ‘যেন একটা পরমাণু বোমা কিউবায় ফেলা হয়েছে, যার কোনও আওয়াজ নেই, কিন্তু মারণশক্তি আছে।এর একদিন পরেই কিউবার বিদেশমন্ত্রীর কাছ থেকে জানা গেল, মারাদোনা শীঘ্রই সেভ কিউবাপ্রচার আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন। সে জন্য তিনি কিউবা যাবেন। আমার বহু দিনের বন্ধু এবং সিপিআই দলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত নেতা পল্লব সেনগুপ্তর পুরনো বন্ধু কিউবার তদানীন্তন বিদেশ মন্ত্রী। সেই সুবাদেই খবর এল এবং পল্লবেরই আর এক আর্জেন্তিনীয় বন্ধু তখন বামপন্থী আন্তর্জাতিক যুব আন্দোলনের নেতা হিসাবে রাষ্ট্রপুঞ্জে উপস্থিত। মারাদোনার সেভ কিউবাআন্দোলনে যোগ দেওয়ার খবরটি তাঁর কাছেও যাচাই করা গেল। এরপরে খবরটি কলকাতায় পাঠাই ও সেটি প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়। এ নিয়ে কিছু কটাক্ষ কানে এসেছিল, এবং সেটা প্রধানত কতিপয় সাংবাদিক সহকর্মীর কাছ থেকেই। তাদের ধারণাই ছিল না যে, মারাদোনার ফুটবলের বাইরেও একটা জগৎ আছে। যাই হোক, মাস খানেকের মধ্যেই ওই সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় হাভানাতে কাস্ত্রো ও মারাদোনার যুগলবন্দি ছবি প্রকাশিত হয়। অনেকের মনে থাকতে পারে যে, মোটামুটি ওই সময়েই বামপন্থীরা চাল ও জীবনদায়ী ওষুধ সংগ্রহ করে, জাহাজে করে তা কিউবায় পাঠিয়েছিলেন। মারাদোনা 2008 সালে কলকাতায় ফুটবলের প্রচারে এলেও দেখা করতে গিয়েছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে, তাঁর বাসভবনে। সেখানেও অদৃশ্য থেকে কাস্ত্রোই সেতুবন্ধনের কাজ করেছিলেন। মারাদোনা জ্যোতিবাবুকে বলেছিলেন, ‘আমি কাস্ত্রোর ভক্ত। কাস্ত্রোর সঙ্গে আপনি ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন, তাই দেখা করতে এসেছি।জ্যোতিবাবুও মারাদোনাকে কাস্ত্রোর সংক্ষিপ্ত কলকাতা ভ্রমণের ছবির একটা অ্যালবাম উপহার দেন।

 

অনেকে হয়তো জানেন না কাস্ত্রোর প্রতি মারাদোনার অনুরাগ এতটাই গাঢ় ছিল যে, তিনি কাস্ত্রোকে নিজের দ্বিতীয় পিতা বলে মনে করতেন। নিজের যে বাঁ পা দিয়ে বল নিয়ন্ত্রণের জাদুতে গোটা বিশ্বকে মোহিত করতেন, তাতে ট্যাটু করা ছিল কাস্ত্রোর প্রতিকৃতি, আর বাম বাহুতে ছিল চে গেভারা। একাধিক বার নিজের চিকিৎসা করাতে তিনি কিউবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। একটা ফটোর কথা মনে পড়ছে, যেখানে হাভানায় কাস্ত্রো, মারাদোনা ও ভেনেজুয়েলার নেতা উগো চাভেজ ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বলছেন, আর দেওয়ালে ঝুলছে স্প্যানিশ ঔপনিবেশ শক্তির বিরুদ্ধে লড়ে, লাতিন আমেরিকার একাধিক দেশকে স্বাধীন করার নায়ক সাইমন বলিভারের প্রতিকৃতি। কলম্বিয়ার কার্তেহেনা শহরে নির্জোট শীর্ষ সম্মেলন কভার করতে গিয়েছি, সেখানেও কাস্ত্রোর বিপুল জনপ্রিয়তা। যদি নোবেল জয়ী সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ লাতিন আমেরিকার বিবেক হন, কাস্ত্রো অবশ্যই তাদের নেতা। আর মারাদোনা তাদের প্রতিবাদের বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় মুখ।


New
বিদায় পিটি নায়ার: কলকাতার ইতিহাসবেত্তা
এগজিট পোল মিলে গেলেও যে প্রশ্ন উঠবেই
কংগ্রেস সেঞ্চুরি না করলে কে রুখবে বিজেপিকে?


Other Writings by -রজত রায় | 26-11-2020

// Event for pushed the video