করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ যাতে দেশে ব্যাপকহারে ছড়াতে না পারে, সে জন্য দেশ জুড়ে এখন ‘লক ডাউন’ শুরু হয়েছে। রবিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার প্রথম সফল মহড়া হয়ে যাওয়ার পরেই রাজ্যে রাজ্যে লক ডাউন এর মেয়াদ বাড়ানো শুরু হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) র বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনেই এটা করা হচ্ছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনেক ভালো দিকের সঙ্গেই বিপর্যয়ের মুখে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে না পারা, এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারলেও তার দ্রুত রূপায়ণ করতে না পারা যে ভয়ঙ্কর বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পারে, তা এই করোনা মহামারীর প্রেক্ষিতে স্পষ্ট ধরা পড়ছে। কেমন সেই চিত্রটি, তা খতিয়ে দেখা যাক।
চিত্র ১
রবিবার দেশ জুডে লক ডাউনের মহড়ার মধ্যেই পুনে ও মুম্বই থেকে দুটি যাত্রীবোঝাই স্পেশ্যাল ট্রেন হাওড়া স্টেশনে পৌঁছয়। এঁদের অনেকেই মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত অভিবাসী শ্রমিক, যাদের বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়। মহারাষ্ট্রে লক ডাউনের জেরে কলকারখানা বন্ধ, তাই অগত্যা বাড়ি ফিরছেন। এছাড়াও রয়েছেন পুনে ও মুম্বইয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষক এবং আরও অনেকে। শুধু এই দুটি ট্রেনই নয়, একই সময়ে ১২টি স্পেশ্যাল ট্রেনে ভিন রাজ্যের অভিবাসী শ্রমিকদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হয়েছে। লক ডাউনের উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করে দিয়ে মহারাষ্ট্র সরকার এই সব মানুষকে করোনা সংক্রান্ত কোনও প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করেই ট্রেনে তুলে দিচ্ছে বলে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ।
চিত্র ২
লক ডাউন কোন রাজ্যে কখন কতদিন ধরে চলবে, তার মধ্যে কোনও সঙ্গতি নেই। এমনকি, এখনও অনেক রাজ্য নিজেকে লক ডাউনের বাইরে রেখে চলছে। এটা ঠিক যে অমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংবিধানে স্বাস্থ্য যুগপৎ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের আওতাভুক্ত। কিন্ত তার মানে যদি এই হয় যে করোনার মোকাবিলায় কেন্দ্র এক দিকে চলল, আর রাজ্যগুলি আর এক দিকে চলল, তা হলে বিপর্যয় ঠেকানো কঠিন হতে বাধ্য। এমন নয় যে কেন্দ্র একদিকে, রাজ্যগুলি যৌথভাবে আর এক দিকে। বরং, করোনার মোকাবিলায় রাজ্যগুলির মধ্যেও ভিন্ন ভিন্ন পন্থা নিতে দেখা যাচ্ছে। যেমন, এতদিন হাত গুটিয়ে বসে থাকার পরে মহারাষ্ট্র সরকার গোটা রাজ্যকে মঙ্গলবার থেকে কারফিউর আওতায় আনার কথা বলেছে।
চিত্র ৩
ইতালি ও স্পেনের অনুকরণে প্রধানমন্ত্রী ভারতবাসীকে দেশের চিকিৎসক সমাজ ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে রবিবার বিকেল পাঁচটায় হাততালি দিতে প্রস্তাব দিলেন। টিভির পর্দায় দেখা গেল, মোদির ডাকে সাড়া দিয়ে অনেক মানুষ হাততালি দিচ্ছেন, থালা বাজাচ্ছেন, এমনকি বাজি পোড়াচ্ছেন। যেখানে সবার মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখার কথা, সেখানে মহানন্দে ৫০ ৬০ জন গলাগলি করে ক্যামেরার সামনে থালা বাজাচ্ছেন। মোদির নিজের রাজ্য গুরাতের আমেদাবাদের দূশ্য, থালা বাজাতে সবাই রাস্তায় নেমে এসেছেন। অনেকের হাতে জাতীয় পতাকা, চলছে হাততালি, থালা বাজানো, ভিড় দেখে মনে হবে যেন ভারত ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতেছে, তাও পাকিস্তানকে হারিয়ে। এই উল্লাসে মত্ত জনতাকে দেখে সন্দেহ জাগে, আদৌ তাঁরা স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজের স্বীকূতি দিতে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের বিষয়ে অবহিত কি না। তা না হলে জমায়েত করে করোনা প্রতিরোধের গোটা উদ্যোগটাকেই বিশ বাঁও জলে ঠেলে দিতেন না।
চিত্র ৪
টাটা গোষ্ঠী, বেদান্ত, মহিন্দ্র প্রভূতি কতিপয় বড় শিল্প সংস্থা ইতিমধ্যেই তাদের কর্মীদের বেতনের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছে। এমনকি, কাজ বন্ধ থাকলেও ক্যাজুয়াল কর্মীদের বেতন কাটা হবে না বলে জানিয়েছে টাটা কর্তূপক্ষ। এটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ করোনার বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখতে গিয়ে কবে নাগাদ আবার কলকারখানা ও ব্যবসাবাণিজ্য স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবযে, তা এখনই বলা কঠিন। কিন্তু এই সংগঠিত শিল্পে তো দেশের ১০ শতাংশের বেশি শ্রমিক কাজ করে না। দেশের ৯০ শতাংশ শ্রমিক কর্মচারীই কাজ করেন ইনফরম্যাল সেক্টরে। তার মধ্যে দেশের সার্ভিস সেক্টরে কর্মরত লক্ষ লক্ষ কর্মীকেও ধরতে হবে। এদের প্রায় কারুরই কোনও চাকুরির নিরাপত্তা বা নিয়মিত বেতনের গ্যারান্টি নেই। মুম্বই ও পুনে থেকে যে ১২টি স্পেশ্যাল ট্রেন হাজার হাজার অভিবাসী শ্রমিককে নিয়ে তাদের নিজেদের রাজ্যে পৌঁছে দিতে গিয়ে রোগ সংক্রমণের আশঙ্কাকেই বাড়িয়ে দিল, তাদের জন্য কিন্তু কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের তরফে কোনও আপৎকালীন সাহায্য দেওয়া হয়নি। দেওয়া হলে তারা মরিয়া হয়ে ট্রেনে গাদাগাদি ভিড়ের মধ্যে বসে দূর রাজ্যে পাড়ি দিত না।
এরকম আরও কিছু চিত্র তুলে ধরা যায়। তাতে সামগ্রিক চিত্রের বিশেষ তারতম্য হবে না। মোদ্দা কথা, করোনার বিরুদ্ধে ভারতের লড়াই অনেকটাই অসংগঠিত। কোনও কেন্দ্রীয় স্ট্র্যাটেজির বদলে একাধিক পরস্পরবিযুক্ত, কখনও কখনও পরস্পরবিরোধী কৌশল নিতে দেখা যাচ্ছে।