করোনা নিয়ে বিশ্বজুড়ে আতঙ্কের মধ্যে দেশের অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ ও আশঙ্কা চাপা থাকছে না। বলা যায়, ইচ্ছা থাকলেও বেড়ে চলা অর্থনৈতিক সঙ্কটের থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকার উপায় নেই। তিন সপ্তাহ ব্যাপী দেশজুড়ে লক ডাউন (কোনও কোনও রাজ্যে তার আগেই আংশিক লক ডাউন শুরু হয়েছিল।) এর কারণে কলকারখানা, ছোট -বড়-মাঝারি সব মাপের শিল্প বন্ধ হয়। শপিং মল, হোটেল রেস্তোরাঁও বন্ধ হয়। শিল্প ও পরিষেবার ক্ষেত্রে এই লাগাতার বনধের কারণে রোজগার হারিয়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। অসংগঠিত ক্ষেত্রে এই অবস্থাটা আরও ভয়াবহ কারণ সেখানে রুজি হারানোটা সাময়িক ব্যাপার না দীর্ঘমেয়াদী হতে চলেছে, তা স্পষ্ট নয়। কী করে কলকারখানাকে আবার চাঙ্গা করে তোলা যায়, তা নিয়ে সরকারি মহলে, রাজনৈতিক মহলে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে জোরালো আলোচনা চলছে। কিন্ত যেটা নিয়ে প্রায় কিছুই কথা শোনা যাচ্ছে না, তা হল কৃষিক্ষেত্রে এই সঙ্কটের চেহারাটা কীরকম হয়ে উঠছে।
মনে রাখতে হবে, কলকারখানা বন্ধের মতোই কৃষিজ পণ্যের পাইকারি বাজার বা মান্ডি এখন বন্ধ। ফলে, চাষি তাঁর ফসল বাজারে বিক্রি করতে পারছেন না। রবি ফসল (প্রধানত গম, ডাল, সরষে ও আলু) এসে গেছে। বোরো চাষের ধানও কিছুদিনের মধ্যেই এসে পড়বে। পশ্চিমবঙ্গে বোরো ফসলের ধানের ফলন, এ বছর 46 লক্ষ মেট্রিক টন হবে বলে সরকারিভাবে অনুমিত। গত শীতে আমন ধান হয়েছিল এক কোটি আট লক্ষ মেট্রিক টন। 50-60 বছর আগে এই পশ্চিমবঙ্গ ছিল খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি রাজ্য। রাজ্যকে ঘাটতি মেটাতে প্রতি বছর কেন্দ্রের কাছে হাত পাততে হত। এখন পশ্চিমবঙ্গ উদ্বৃত্ত রাজ্য। কিন্ত কৃষির এই উন্নয়ন কি রাজ্যের কৃষিজীবীদের সমস্যা দূর করতে পেরেছে ? মনে হয় না। তাই এত উৎপাদন সত্ত্বেও ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে কৃষককে ফসল নষ্ট করতে হয়, ঋণের ফাঁদে পড়ে পরিণতিতে অনেককে আত্মহত্যা করতে হয়।
রাজ্য সরকার (বামফ্রন্ট বা মমতার তৃণমূল কংগ্রেস) বরাবরই দাবি করে তারা চাষিকে ফসলের ন্যায্য মূল্য দিয়ে ধান সংগ্রহ করে। কিন্তু বাস্তব অবস্থাটা কি তাই বলে ? শান্তিনিকেতনের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বিজয় মুখোপাধ্যায়ের পারিবারিক সূত্রেই চাষবাষের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। তাঁর মতে, এটা ঠিকই যে কেন্দ্রীয় সরকার প্রতি বছর ফসলের যে ন্যূনতম মূল্য (এম এস পি, বা মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস) ঘোষণা করে, রাজ্য সরকার তার থেকে 20-30 টাকা বেশি দেয়। যেমন গত আমন ধানের সময় কেন্দ্রের এম এস পি ছিল কুইন্টাল প্রতি 1820 টাকা। রাজ্য দেয় আরও 20 টাকা বেশি। কিন্তু যে চাষিরা কৃষিব্যাঙ্ক বা মহাজনের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে চাষ করল, তারা কি সরকাকে ওই দরে ধান বিক্রি করতে পারল? বেশির ভাগ চাষিরই তিক্ত অভিজ্ঞতা বলছে, সরকার প্রথমত ফসল ওঠার অনেক পরে, দেরিতে ধান (বা আলুর সময় আলু) কিনতে নামে। নামলেও চাষিদের কাছ থেকে সামান্যই কেনে। ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখা দরকার। সরকারের তরফে ধান কেনার এজেন্ট মুখ্যত ধানকল বা রাইস মিলগুলি। নিজে চাষ করার অভিজ্ঞতায় বিজয় মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, চাষি মান্ডিতে গিয়ে ধান বিক্রি করতে চাইলে লাইন দিয়ে একটা টোকেন পায়। ধরা যাক, 2000 নম্বরের টোকেন পেল। এই টোকেনের নম্বর ধরে ডাক এলে সে রাইস মিলে গিয়ে ধান জমা করতে পারবে। কিন্ত ডাক আসতে আসতে তিন মাস গড়িয়ে যায়। বিজয়বাবুর প্রশ্ন, পশ্চিমবঙ্গের কত জন চাষী ফসল ঘরে তুলে তিন মাস অপেক্ষা করার আর্থিক ক্ষমতা রাখে ? মনে রাখতে হবে, ভূমিসংস্কার ও পরিবারের মধ্যে জমির ক্রমাগত পুনর্বন্টনের কারণে 1990-এর দশকেই পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের মাথা পিছু জমির পরিমাপ 0.83 বিঘায় এসে ঠেকেছিল। অর্থাৎ, রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ চাষিই খুব সামান্য পরিমাণ জমির মালিক, ফলে তার বছরের খোরাকির ধানের অতিরিক্ত উদ্বৃত্ত কমই থাকে। সে জন্য একটা চাষের ফসল বিক্রি করে ধার শোধ করে তাকে আবার পরের চাষের জন্য ধার নিতে হয়। অর্থাৎ, সরকারের ডাকের অপেক্ষায় ঘরে ফসল রেখে বসে থাকার বিলাসিতা অধিকাংশই করতে পারে না। বীরভূমে বিজয় মুখোপাধ্যায়ের মতো অনেকেই দেখেছেন, সরকার ফসল কিনতে নামলেও ব্লক প্রতি দিনে বড়জোর 10 জন চাষির কাছ থেকে এম এস পি-র ধার্য্য করা মূল্যে ধান কেনা হয়। এ ভাবে দিনে 10 জন, মাসে 300 জন, তিন মাসে 1000 জন চাষির ধান বিক্রি হয়। অথচ, এক একটি ব্লকে চাষির সংখ্যা তো বেশ কয়েক হাজার। ফলে, বাধ্য হয়েই বেশির ভাগ চাষি ফড়েদের কাছে সরকারি দর থেকে 400-500 টাকা কম দরে ধান বিক্রি করে দেয়। বিজয়বাবুর ক্ষমতায় কুলিয়েছে, তাই গতবছরের আমন ধান এখনও 80 কুইন্টাল ঘরে ধরে রেখেছেন। সরকারের কাছে ধানবিক্রির জন্য একটা টোকেন ও নম্বর নিয়েছিলেন। কিন্তু তিন মাস পেরিয়ে গেছে, ডাক আসেনি। ওই 80 কুইন্টাল ধান বাজারে বিক্রি করলে অন্তত 40,000 টাকা লোকসান গুনতে হবে। যাদের ধরে রাখার ক্ষমতা নেই, সেই অধিকাংশ ছোট চাষি বাধ্য হয় অনেক কম দরে বাজারে বিক্রি করে দিতে। সরকার ন্যায্য মূল্যে ধান কেনে ঠিকই, কিন্তু বেশিরভাগটাই চাষিদের কাছ থেকে নয়, ফড়েদের কাছ থেকে। এই মধ্যসত্ত্বভোগী ফড়েরা চাষ না করেই শুধু ফসল বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করে বিরাট মুনাফা করে চলে। চাষিরা লোকসানের ফাঁদ থেকে বেরোতে পারে না। চাষির ফসলের উপর এই ফড়েদের নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের মদত ও যোগসাজশেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এতে চাষি ছাড়া গ্রামসমাজের স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মকর্তা, স্থানীয় ব্যবসায়ীমহল, রাইস মিল, ফড়ে এবং সরকারের স্থানীয়স্তরের প্রশাসন (পঞ্চায়েতে ক্ষমতাসীনরা), সবারই স্বার্থ রয়েছে। তাই এই ব্যবস্থা বদলায় না। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপিকা বারবারা হ্যারিস হোয়াইট বহু বছর শান্তিনিকেতনে থেকে বীরভূম ও বর্ধমানের গ্রামাঞ্চলে কৃষিপণ্যের বাজার ও বিপণন ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করে Rural Commercial Capital নামে বইয়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছন যে বামফ্রন্ট সরকার পশ্চিমবঙ্গে ভূমিসংস্কার, স্থানীয় প্রশাসনের বিকেন্দ্রিকরণ (পঞ্চায়েত ব্যবস্থা) ইত্যাদি যুগান্তকারী পদক্ষেপ করার পরেও রাজ্যের গরিব চাষি গরিবই থেকে গেল। কারণ, তাদের উৎপন্ন ফসল বাজারে বিক্রি করার ব্যবস্থার উপরে তাদের নিয়ন্ত্রণের অধিকার কখনও দেওয়া হয়নি। কৃষিপণ্যের বাজারের উপর মধ্যসত্ত্বভোগী ফড়েদের নিয়ন্ত্রণ সরকার কখনই সরাতে আন্তরিক ছিল না। বামফ্রন্টকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার এলেও গ্রামবাংলার ক্ষমতার কাঠামোর পরিবর্তন আসে না।