4thPillar


আঢাকা মুখের মিছিল

রজত রায় | 02-05-2020May 11, 2023
আঢাকা মুখের মিছিল

ছদ্ম-নিরাপত্তার মাস্কগুলো সরিয়ে এই দু:সময়ে কালি ও কলমে অর্ধভুক্ত-অসহায় মানুষের মুখ দেখেছেন কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত। এঁকেছেন-লিখেছেন ‘নিরন্ন, কর্মহীন’

 

এই মানুষদের চিনতে এতটুকু অসুবিধে হচ্ছে না। কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত যতই দাবি করুন না কেন যে তিনি “এর কপালের নীচে ওর চোখ অথবা এর ঠোঁটের দুপাশে তার গাল বসিয়ে দিয়ে কিছুটা আড়াল” তৈরি করেছেন, যাতে অর্ধভুক্ত, কর্মহীন মানুষগুলোর এতটুকু অসম্মান না হয়, এঁদের দিব্যি চেনা যাচ্ছে। কারণ, আমাদের মধ্যবিত্ত দৈনন্দিন জীবনযাপনের নানা স্তরের সঙ্গে এঁদের জীবনও জড়িত। করোনা মহামারীর জেরে লকডাউন শুরু হওয়ার পরে সেই সম্পর্কে সাময়িকভাবে ছেদ পড়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটা সাময়িক বিচ্ছেদ মাত্র। আমাদের প্রত্যেকেরই পরিচয় রয়েছে পাড়ার ছোট চায়ের দোকানের মালিক কাশেম মন্ডলের সঙ্গে। একাধারে মালিক ও কর্মী কাশেমের দোকানে চায়ের সঙ্গে ঘুগনি পাউরুটি খায়নি এরকম মানুষের খোঁজ মেলা কঠিন। তবে হয়তো কোথাও কাশেমের নাম অনিল পাল, কোথাও মানিক সূত্রধর, কোথাও বা শুধুই মদনদা।

 

আগে বলা হত ঠিকে ঝি বা রান্নার লোক। এখন পলিটিক্যালি কারেক্ট হওয়ার জন্য বলা হয় কাজের মাসি, আরও সোজা বাংলায় বললে ডমেস্টিক হেল্প। এই পার্বতী মাল, রাফিয়া খাতুনরা খুব ভোরের ট্রেনে মফস্বল থেকে ট্রেনে চেপে মহানগরী কলকাতায় এসে ঘরের যাবতীয় কাজ না সামলালে শহুরে মধ্যবিত্ত ডাবল ইনকাম পরিবারে অচিরে বিপর্যয় নেমে আসে। কত ন্যূনতম বেতনে তারা শহরের মানুষের পরিবারে জরুরি সার্ভিস দিয়ে চলে তা ধরা পড়ে যখন আচমকা কামাই করলে সেই কাজ আউটসোর্স করতে হয়। অর্থাৎ, হোম ডেলিভারির মাধ্যমে ডিনার সামাল দিলেও বাসনপত্র ধোয়া, ঘরদোর পরিষ্কার করতে করতে চাকুরিজীবি দম্পতির অনেক সময় কর্মস্থলে পৌঁছতে দেরি অনিবার্য হয়ে পড়ে। 

 

 

বাবুলাল ঘোষেরা বছরের মধ্যে নয় নয়টি মাসই ভিন রাজ্যে নির্মাণশিল্পের সঙ্গে যুক্ত থেকে জীবন ও জীবিকার ব্যবস্থা করে থাকেন। শুধু পশ্চিমবঙ্গ থেকে কেরালা, তামিলনাডু, মহারাষ্ট্র, দিল্লি প্রভূতি রাজ্যে কত লক্ষ মানুষ কাজ করতে যান, তার কোনও হিসাব রাজ্য সরকারের কাছেই নেই। এঁদের কেউ রাজমিস্ত্রি, কেউ তাঁর জোগানদার, কেউ কাঠের মিস্ত্রি, কেউ স্বর্ণশিল্পী, কেউ বা হিরে পালিশের কাজে নিযুক্ত। আবার অনেকে চাষের কাজেও ভিন রাজ্যে পাড়ি দেন। নিজের রাজ্যে কাজের তেমন সুযোগ নেই, থাকলেও মজুরির হার খুবই কম। তাই কেরালা বা মহারাষ্ট্রে গিয়ে কাজ করা।

 

 

অনেক কষ্ট করে একটা ঘরে গাদাগাদি করে থেকে টাকা জমিয়ে মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, নদীয়া বা ২৪ পরগণার গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে সংসারকে কোনওরকমে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা। এই লক ডাউনের সুবাদে এদের ‘মাইগ্রান্ট ওয়ার্কার’ পরিচয়টি এখন সংবাদমাধ্যমে বহুচর্চিত। কিন্তু সেখানেও তাদের সম্পর্কে সমাজের উপেক্ষার মনোভাবটা গোপন থাকে না। লক ডাউনের মধ্যে বিশেষ ছাড় দিয়ে বেনারস ও হরিদ্বার থেকে তীর্থযাত্রীদের গুজরাতে ফিরিয়ে নিতে রাষ্ট্র এগিয়ে আসতে পারে। রাজস্থানের কোটায় পড়তে আসা হাজার হাজার ভিন রাজ্যের ছাত্রছাত্রীকে নিজের নিজের রাজ্যে ফিরিয়ে নিতেও রাষ্ট্র বিশেষ ব্যবস্থায় কার্পণ্য করে না। কিন্তু মাইগ্রান্ট শ্রমিকরা বেতন ও খাবার না পেয়ে বাড়ি ফিরতে চাইলে পুলিশি বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন রাজ্যের কর্মস্থলে আটকে রাখা হয়।

 

একদা ঘুঁটেবিক্রেতা এখন বৃদ্ধবয়সে ভিক্ষাজীবিনী হাসিরানি মালাকার, রেলগাড়ির হকার অনন্ত হাজরা, কিংবা স্টেশন ও বাসস্ট্যান্ডে ডাববিক্রেতা এককড়ি হালদারদের জন্য ভয় হয়। লকডাউন তো একদিন উঠবে, লোকজন আবার অফিসকাছারি করবে, ট্রেন বাস চলবে। কিন্তু এঁরা ততদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারবেন তো?

 

 

 

যেমন ধরা যাক তেলেভাজার দোকানের মালকিন মানদা সাহা, দিনমজুর রফিক আলি, ইটভাটার শ্রমিক মিন্টু শেখ, রাস্তার ধারের ভাতের হোটেলে রান্নার কাজে নিযুক্ত রাধিকা মিশ্র, ফুটপাথের দর্জি বিষ্ণু মাহাতো, রাস্তার ধারে বসে জুতোপালিশ করে পেট চালানো পবন রুইদাসদের সম্পর্কেও একই আশঙ্কা থাকছে। কারণ, সরকারি পরিভাষায় মাইগ্রান্ট ওয়ার্কারদের মতোই এঁরাও অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন।

 

 

মনে রাখতে হবে, দেশের ৯০ শতাংশ শ্রমিকই অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন। ফলে, কয়লা ও অন্যান্য খনি, ইস্পাত, রেল, সড়ক পরিবহন, ব্যাঙ্ক প্রভূতি শিল্পে যুক্ত কর্মীবৃন্দ, বড়চাষি, মধ্যচাষি, এমনকি ক্ষেতমজুরদেরও সংগঠন এবং অনেকেরই ট্রেড ইউনিয়ন থাকলেও অসংগঠিত ক্ষেত্রে তা দিবাস্বপ্ন। তাই এঁদের জন্য সরকারি এককালীন টাকা দেওয়ার কথা উঠলেও তাঁদের সরকারের কাছে আবেদনপত্র জমা দিতে বলা হয়। কারণ, সরকার জানেই না তার রাজ্যে কোথায় কতজন অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করতেন, এখন কাজ হারিয়ে অনাহারে অর্ধাহারে ধুঁকছেন।

 

 

আমাদের পাড়ার মার্কেটের গেটের বাইরে অনেকদিন ধরেই কয়েকজন বৃদ্ধা ভিক্ষের আশায় বসে থাকতেন। কখনও ভিক্ষা মিলত, কখনও মিলত না। গত পৌষ সংক্রান্তির দিন মার্কেট থেকে বেরিয়ে আসছি। হঠাৎ কানে এল ওই ভিখারিনীদের মধ্যে আলোচনার টুকরো টুকরো কথা। একজন বৃদ্ধা বিস্তারিতভাবে বোঝাচ্ছিলেন কীভাবে পায়েস রান্না করতে হয়। মন দিয়ে শুনতে শুনতে মনে হল, আমাদের এবং অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারেই একই রেসিপিতে সংক্রান্তিতে পিঠে পায়েস হয়। মনে ভয় হল, যে ভাবে সামাজিক আর্থিক বিপর্যয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে ওই বৃদ্ধারা একদা সব হারিয়ে রাস্তায় এসে বসেছেন, আমরাও কি বিপদের ওই সম্ভাবনা থেকে খুব দূরে দাঁড়িয়ে আছি? “নিরন্ন, কর্মহীন” বইটি আমাদের চারপাশের এই সব বিপন্ন মানুষদের চিনিয়ে দিয়ে আমাদের সামনেই আয়না ধরেছে।

 

(বই- ‘নিরন্ন, কর্মহীন’। কালি ও কলমে- কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত। প্রকাশনা- উদ্ভাস, চিত্রচর্চার নতুন দিগন্ত। মূল্য- ৮০ টাকা।  ই-মেল: udvasart@gmail.com, ওয়েবসাইট: www.udvas.in)

 



New
বিদায় পিটি নায়ার: কলকাতার ইতিহাসবেত্তা
এগজিট পোল মিলে গেলেও যে প্রশ্ন উঠবেই
কংগ্রেস সেঞ্চুরি না করলে কে রুখবে বিজেপিকে?


Other Writings by -রজত রায় | 02-05-2020

// Event for pushed the video