কৃষি সংক্রান্ত তিনটি আইন সম্প্রতি দুই কক্ষেই বিল হিসাবে পাশ হয়েছে, রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর হলেই সেগুলি আইনে পরিণত হবে। যদিও রাজ্যসভায় রবিবার 20 সেপ্টেম্বর যেভাবে বিরোধীদের ভোটাভুটির দাবি অগ্রাহ্য করে সন্দেহজনক সংখ্যাগরিষ্ঠতার মধ্যে ধ্বনিভোটে দু’টি বিল পাশ হয়েছে, তাতে বিরোধীরা রাষ্ট্রপতির কাছে তাতে সই না করার আর্জি জানিয়েছেন। যদিও রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। তিনটি আইনের প্রভাবই ভারতীয় কৃষির উপরে সুদূরপ্রসারী এবং ব্যাপক হবে– এই নিয়ে কারও সন্দেহ নেই, তা কেউ এই পরিবর্তনের পক্ষেই হোন বা বিপক্ষে। তিনটি আইনের মোদ্দা কথা হল- (1) কৃষিপণ্যের কারবারে সরকারের ভূমিকা হবে অতি সামান্য, অন্যান্য পণ্যের মতোই তার বাজার প্রায় অবাধ করে দেওয়া হল, (2) চুক্তিভিত্তিক চাষের দরজা পুরোপুরি খুলে দেওয়া হল এবং (3) কৃষকের পণ্য যে কোনও জায়গায় যে কাউকে বিক্রি করার দরজা খুলে গেল, নির্দিষ্ট এলাকার মান্ডিতে বিক্রির বাধ্যবাধকতা রইল না।
সরকারের দাবি অনুযায়ী এই নতুন কৃষি আইন কি দীর্ঘদিনের মৌলিক সমস্যা, চাষি ও বাজারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা ফড়ে বা মিডলম্যানদের সরাতে পারবে? নাকি, গ্রামাঞ্চলের ছোট ছোট অসংখ্য ফড়েকে সরিয়ে তার জায়গায় বড় বড় কোম্পানিকে এই ব্যবসায় ঢোকার রাস্তা খুলে দেবে। এটাই আসল প্রশ্ন। পশ্চিমবঙ্গ সহ বহু রাজ্যেই কৃষি মান্ডির মাধ্যমে এখনও পর্যন্ত চাষিরা ধান, গম বিক্রির সুযোগ পায়। এই ব্যবস্থা ত্রুটিমুক্ত নয়। কিন্তু নতুন আইনে তো রাজ্যের কৃষি মান্ডি ব্যবস্থাকেই পুরোপুরি পাশ কাটিয়ে নতুন ব্যবস্থা করা হয়েছে। বড় পুঁজি কৃষিপণ্য কেনাবেচার ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার করতে সময় নেবে না। এর সঙ্গে চুক্তি ভিত্তিক চাষের ব্যবস্থাকে মিলিয়ে দেখতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের আলু চাষিরা এই চুক্তি চাষের সুবিধা পেয়ে লাভবান হচ্ছে। বাজারে দাম পড়ে গেলেও তারা চুক্তি অনুযায়ী আগের দাম পাচ্ছে। কিন্তু যেহেতু এখনও এর ব্যপ্তি সামান্য, তাই এর ফলাফল নিয়ে বলার সময় আসেনি। তবে এটুকু বলা যায়, নতুন আইন বলবৎ হলে তার সুযোগ নিতে চুক্তি চাষ দ্রুত বাড়বে। তখন কৃষিপণ্যের বাজার ছোট ও মাঝারি ব্যাপারিদের হাত থেকে বৃহৎ ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাবে। অসংখ্য কোল্ড চেইন তৈরি হবে বিপুল পুঁজি বিনিয়োগে। দেশ জুড়ে কৃষিপণ্যের একটা অখণ্ড বাজার তৈরির লোভনীয় স্বপ্ন সামনে আসবে। কিন্তু চাষি তার ইচ্ছা মতো উৎপন্ন পণ্যের বিপণনের অধিকার পাবে কি? মনে হয় না। বরং এখন সে ফড়েদের নিয়ন্ত্রণাধীন, তখন একচেটিয়া পুঁজির অধীনে আসবে।
বারবারা হোয়াইট দীর্ঘদিন শান্তিনিকেতনে এগ্রো ইকনমিকসের সঙ্গে বীরভূম ও বর্ধমানের চাষিদের সম্পর্কে গবেষণা করে তাঁর বিখ্যাত ‘রুরাল কমার্শিয়াল ক্যাপিটাল’ বইয়ে সিদ্ধান্তে এসেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে ভূমি সংস্কার, অপারেশন বর্গার মতো বৈপ্লবিক কাজ হওয়া সত্ত্বেও গরিব চাষিরা যে গরিবই থেকে গেল, তার কারণ বাজারে তারা কখনও পৌঁছতেই পারেনি। মধ্যসত্ত্বভোগী ফড়েরা সব ফসলের লাভ তুলে নিয়ে গেছে। এখন নতুন আইনে দেশের সর্বত্র চাষিদের একই হাল হওয়ার আশঙ্কা।
এখানে আরও কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। ভারতের সর্বত্র কৃষিজমি ও চাষির অনুপাত সমহারে নেই। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের জাঠল্যান্ডের চাষিরা বৃহৎ জোতের মালিক। এরা প্রধানত গম উৎপাদন করে। একই কথা প্রযোজ্য মহারাষ্ট্রের তুলা ও আখ চাষিদের ক্ষেত্রে। সেখানে এমনিতেই বৃহৎ পুঁজি খাটে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা সহ দেশের বহু রাজ্যে চাষ হয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জোতে। সেখানে প্রান্তিক ও ছোট চাষিরা পুঁজির অভাবে এবং ইনস্টিটিউশনাল ফিনান্সের অভাবে গ্রামের মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। বিনিময়ে তাকে ফসল তুলে দেয় স্বল্প দরে। সরকারের কিষান কার্ড ব্যবস্থা থাকলেও তা এই ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। এই মহাজনই একাধারে কৃষিঋণ দেয়, বীজ সার ও সেচের পাম্প ধার দেয়। আবার বাজারে ও সরকারি শস্যভাণ্ডারে সহায়ক মূল্য পেয়ে ফসল বিক্রি করে। এই চড়া হারে ঋণের ফাঁদে পড়েই দেশে কৃষকদের আত্মহত্যা এখন দৈনন্দিন ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন কৃষি আইন এই ব্যবস্থাকে নির্মূল করার বদলে আরও বড় সংগঠিত পুঁজির হাতে তুলে দিতে চলেছে। পাঞ্জাব, হরিয়ানার কৃষকদের প্রতিবাদ কেন সারা দেশে সাড়া জাগাতে পারেনি, সেটার কারণও আগের ব্যাখ্যার মধ্যেই নিহিত। সত্তরের দশকে তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের সঙ্গে দেশে ধনী কৃষকরা সংগঠিত হতে শুরু করে। উত্তরপ্রদেশের মহেন্দ্র সিংহ টিকায়েৎ, মহারাষ্ট্রের শারদ জোশীরা ফসলের ন্যায্য মূল্য ও অন্যান্য দাবিতে সরকারকে চাপ দিতে শুরু করে। এই ফার্মার্স লবি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে সরকারকে নতিস্বীকার করতে বাধ্য করে। মনে রাখতে হবে, তখন কৃষিপণ্যের অবাধ বাণিজ্য ও রফতানি বন্ধ ছিল। সরকার কতটা চাপে থাকত, তার একটা উদাহরণ 2001-02 সালে পাঞ্জাব হরিয়ানায় বাম্পার ক্রপ হল। সরকারের মজুত ভাণ্ডার তখন আগে থেকেই ভর্তি। এই অবস্থায় সেই গম খোলা মাঠেই পড়ে থাকল, এবং রোদে বৃষ্টিতে নষ্ট হতে লাগল। বাজপেয়ী সরকার 1200 কোটি টাকা দিয়ে সেই গম কিনে মাঠেই ফেলে রেখে নষ্ট করতে বাধ্য হল। এখন যে নয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে পাঞ্জাব, হরিয়ানার কৃষকরা (টিকায়েতের তৈরি ভারতীয় কিষান ইউনিয়ন বা বিকেইউ এই প্রতিবাদে সামিল) প্রতিবাদে সোচ্চার, তার কারণ আমার কাছে পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। মনে হয়, দীর্ঘদিন ধরে মান্ডিকেন্দ্রিক যে বিপণন ব্যবস্থার উপর তারা নির্ভরশীল, তা আরও বৃহৎ পুঁজির আক্রমণে ভেঙে যেতে বসেছে দেখে তারা বিভ্রান্ত। নতুন আইনে তাদের কৃষি বিপণনের পুরো ধারা বা চেনটির মধ্যে বাহুল্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। কিন্তু তার বিনিময়ে লাভের অংশটা কোটি কোটি কৃষক এবং কৃষিজীবীর কাছেই পৌঁছাবে, এমন নিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছে না।