গত 7 জানুয়ারি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে খবরটি পড়ে চমকে উঠলাম— ভারত সরকারের পশুপালন ও দুগ্ধোৎপাদন মন্ত্রক অনলাইনে অখিল ভারতীয় ‘কামধেনু গৌ-বিজ্ঞান প্রচার-প্রসার পরীক্ষা’ শীর্ষক একটি পরীক্ষা নিচ্ছে। ‘কামধেনু গৌ-বিজ্ঞান’ বলে প্রাণীবিজ্ঞান বা জুওলজির কোনও শাখা আছে বলেই শুনিনি কখনও।
তাতে কী, অনেক কিছুই তো আগে শুনিনি। যেমন আমাদের জাতীয় পক্ষী ময়ূর হল ব্রহ্মচারী। ময়ূর ময়ূরী মিলিত হয় না, ময়ূর কাঁদলে ওর চোখের জলে ময়ূরী গর্ভবতী হয়। এটা কোন বইয়ে আছে? বইয়ে থাকবে কেন, রাজস্থান হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি বলেছেন। আর বিচারপতিরা কখনও ভুল বলেন না, অন্তত যারা হাইকোর্টে বা সুপ্রিম কোর্টে অনেক উঁচু আসনে বসে নানান যুক্তিতর্ক শুনে, মোটা মোটা বাঁধানো বই দেখে ভেবেচিন্তে এক একটা কথা বলেন।
সব কথা বইয়ে লেখা থাকে না। এই যেমন, দেশের প্রধান সেবক জোর গলায়, কোভিড মহামারীর আগে বলেছিলেন- দেবতা গণেশের মাথায় নাকের জায়গায় হাতির শুঁড় হল প্রাচীন ভারতে প্লাস্টিক সার্জারির প্রমাণ।
এটা কোন শাস্ত্রে লেখা আছে আমায় জিজ্ঞাসা করবেন না। উনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপারে আপনার আমার চেয়ে অনেক বেশি জানেন। বিজ্ঞান নিয়ে ক্রিয়েটিভ চিন্তায় আচ্ছা আচ্ছা বৈজ্ঞানিকের নাক কাটতে পারেন। বিশ্বাস না হলে দেখুন, বালাকোট হামলার সময় আকাশে মেঘ দেখে যখন ভারতের বিমানবাহিনী ইতস্তত করছিল, তখন উনিই তাদের পরামর্শ দেন যে, এটাই হল শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করার প্রকৃষ্ট সময়। মেঘের আড়াল থাকায় পাকিস্তানের রাডার আমাদের দেখতে পাবে না; ব্যস, কেল্লা ফতে। তাঁর নেতৃত্বে ও প্রযুক্তির কৌশলে সীমান্তের ওপারে পাকিস্তান কেমন নাস্তানাবুদ হয়েছিল! এর আগের কোনও প্রধানমন্ত্রীর এই ধক ছিল যে, বিমানবাহিনীকে টেকনিক্যাল অ্যাডভাইস দেবে? ওনার বুকের পাটা আছে, সেটা ওনার অতি বড় শত্তুরেও মানে।
এর আগেও উনি আইআইটি-র পাশের নালায় জমা জলের গ্যাস থেকে স্টোভ জ্বালিয়ে ভুজিয়া ও চা বানানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাঁর সাফল্যের মন্ত্র ক’বছর আগে বিভিন্ন চ্যানেলে সবাই দেখেছেন। তবে?
আবার দেখুন, পৌরাণিক যুগে ভারতে এমন উন্নত প্রযুক্তির বিমান ছিল, যা আজকের ফ্রান্সের রাফেল বা রাশিয়ার মিগকে বলে বলে দশ গোল দিতে পারে। সেই সব বিমান দরকার মতো এগোতে পিছোতে পারত। মানে এদের ‘ব্যাকগিয়ার’ ছিল। সাদা চামড়ার সাহেবদের উড়োজাহাজে আছে ব্যাকগিয়ার? বললে হবে? খচ্চা আছে। কোথায় লেখা আছে? আরে বছর দু’য়েক আগে ভারতের ইতিহাস কংগ্রেসে এই বিষয়ে পেপার পড়া হয়েছে। এরপরেও অবিশ্বাস!
তাহলে আজকে কামধেনু বিজ্ঞান পরীক্ষা শুনে চমকে ওঠা কেন? চমকে নয়, ব্যোমকে গিয়েছি ওই সর্বভারতীয় পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রের মাল্টিপল চয়েস কোয়েশ্চেনের কিছু নমুনা দেখে।
“ভারত সরকারের পশুপালন এবং দুগ্ধোৎপাদন মন্ত্রক দ্বারা পরিচালিত প্রথম কামধেনু বিজ্ঞান প্রসার পরীক্ষায় সবাইকে স্বাগত। এ এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। তাই আর দেরি না করে আসুন পরীক্ষা শুরু করা যাক। মনে রাখবেন, এই পরীক্ষায় ভুল উত্তর বলে কিছু নেই, তবে রাষ্ট্রবিরোধী উত্তর রয়েছে।
প্রশ্ন-1) কী করে বুঝবে কোনটা বিদেশ থেকে আনা জার্সি গরু আর কোনটা ভারতীয় দেশি গোরু?
উত্তর- ক) দেশি গোরু শান্ত, ঘরোয়া এবং স্বাস্য্আবিধি মেনে চলে এবং ‘জন-গণ-মন’ বাজলেই উঠে দাঁড়ায়।
খ) জার্সি গোরু অলস এবং অপরিষ্কার। আগের সরকারের আমলে কয়েক দশক ধরে তেল লাগানোর ফলে এর দুধে চর্বির ভাগ বেশি। জাতীয় সঙ্গীতের সুর শুনলেও এর কোনও হেলদোল নেই।
গ) উপরের সবগুলো।
প্রশ্ন-2) মেহবুব খান নির্দেশিত ‘মাদার ইন্ডিয়া’ সিনেমায় মায়ের ভূমিকায় কে অভিনয় করেছিলেন?
উত্তর- ক) ব্রিটেনের চ্যানেল দ্বীপ থেকে আসা শ্রীমতী জার্সি।
খ) নার্গিস।
গ) গোরখপুরের গোমাতা।
প্রশ্ন-3) আমার গ্লাসে গোরুর দুধের রঙ হলদেটে কেন?
উত্তর- ক) ভেজালের লক্ষণ।
খ) এটা আসলে খান মার্কেটের ‘টারমেরিক লাট্টে’ বা হলুদ দেওয়া দুধ,
গ) আনন্দ করো বৎস, এ হল গোরুর দুধে সোনা থাকার চিহ্ন। প্রাচীন বৈদিক জ্ঞানের
সাহায্যে জাতীয়তাবাদী বৈজ্ঞানিকরা দুধ থেকে সোনা বের করার পদ্ধতি আবিষ্কার
প্রায় করেই ফেলেছেন। এর ফলে ভারত 5 ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হয়ে উঠবে।
প্রশ্ন-4) গো-হত্যার বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকরী যুক্তিটি কী?
উত্তর- ক) এর ফলে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয়।
খ) তুমি যদি কেরালা, গোয়া বা উত্তর-পূর্বে বাস করো, তাহলে কিছু হবে না।
গ) বিসারা বা দাদরিতেও নয়।
প্রশ্ন-5) তুমি যে গোরুকে ভালবাস, তা কী করে বোঝাবে?
উত্তর- ক) ওকে নিজের হাতে ঘাস বিচালি খাওয়াও।
খ) বুড়ো হলে রাস্তায় ছেড়ে দাও, নিজেই প্লাস্টিক ও আবর্জনা খেয়ে বাঁচবে।
গ) গোরুর নাম নিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে দাও।
প্রশ্ন-6) সরকার যদি গো সেবক হয় তাহলে নাগরিকদের সুখ-সমৃদ্ধি বাড়ে; সত্যি না মিথ্যে?
উত্তর- ক) সত্যি, খ) মিথ্যে, গ) হাম্বা। [1]
এই পর্যন্ত পড়েই আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। এক গ্লাস গ্লুকোজ জল খেয়ে কাগজটা বারবার দেখলাম, চশমা বদলে তৃতীয়বার। শেষে নিরুপায় হয়ে প্রয়াজনীয় তথ্যসূত্র, তারিখ সব দিয়ে এই লেখাটি 4thpillars.com -এর সম্পাদক মহাশয়কে পাঠিয়ে দিলাম। এখন উনি আর ওনার পাঠকেরা পড়ে বুঝুক গে!
(বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ:- লেখাটি কোনও রম্য বা ব্যঙ্গাত্মক রচনা নয়। একেবারে হার্ড নিউজ। বিশ্বাস না হলে নীচে দেওয়া তথ্যসূত্র থেকে যাচাই করে নেবেন।)
---------------------------------------------------------------------------------------
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস; 7 এবং 13 জানুয়ারি, 2021