4thPillar


স্বাধীনতার কালে বাংলা: প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ

শ্রবসী বসু | 08-08-2022May 11, 2023
স্বাধীনতার কালে বাংলা: প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ

গত কিছুদিন যাবৎ জনগণনা সংক্রান্ত নানারকম বিতর্ক চলছে। তাতে ধর্মসম্পর্কিত প্রশ্ন থাকবে কি থাকবে না, দু লাইন গায়ত্রী মন্ত্র আবৃত্তি করলেই আমরা সংস্কৃত জানি বলব কি না ইত্যাদি নিয়ে চর্চা চলছে।  এগুলির পিছনে প্রধান বিবেচ্য হল, আমরা আমাদের দেশ সম্বন্ধে কী জানতে চাই, কতটা জানতে চাই, ঠিকঠাক জানতে চাই, না কি কারও বিশেষ অ্যাজেন্ডা অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে চাই। 1947 সালে দেশ যখন স্বাধীন হল, সরকারে কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল এইটাই – যে দেশের দায়িত্ব হাতে নেওয়া হল, তার উন্নতি করতে হলে প্রথমে জানতে হবে তার বর্তমান অবস্থা। কারণ তবেই একমাত্র বোঝা যাবে কোন কাজ কোথা থেকে শুরু করলে দেশ গঠনে তার প্রভাব পড়বে সবচেয়ে বেশি।

 

ঠিক এই জায়গাতেই সমকালে স্বাধীনতা লাভ করা বিশ্বের অন্য অনেক দেশের সঙ্গে ভারতের বিশাল ফারাক ছিল। ভারতে ছিলেন প্রশান্ত মহলানবিশ। যাঁকে সাধারণ মানুষ চেনে Indian Statistical Institute - এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। রাশিবিজ্ঞানের দুটি প্রধান স্তম্ভ: প্রথমত অঙ্ক-নির্ভর থিয়োরি আর দ্বিতীয়ত বিভিন্ন ডেটা সংগ্রহ করে তার বিশ্লেষণ, যাতে সমাজ, অর্থনীতি, বাণিজ্য, জনসংখ্যা ইত্যাদি সম্বন্ধে সম্যক জানা যায় দুটিতেই প্রশান্তচন্দ্র আর তাঁর সহকর্মীরা ছিলেন অনন্য। তাঁরা সকলে মিলে ভারতের Census, National Sample Survey Organization আর Central Statistics Organization-এর পরিকাঠামো এমন ভাবে তৈরি করেছেন যাতে দেশের সমস্ত প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ আর সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়।

 

বিজ্ঞানের একটি পৃথক শাখা হিসেবে রাশিবিজ্ঞান খুব বেশিদিন পরিচিতি লাভ করেনি। 1913 সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে B.Sc পাশ করে প্রশান্তচন্দ্র বিলেত গেছিলেন পদার্থবিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষালাভ করতে। কেম্ব্রিজের King’s College থেকে Tripos পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে প্রশান্ত গরমের ছুটিতে বাড়ি আসছিলেন। লাইব্রেরিতে তাঁর হাতে পড়ল বাঁধান কয়েক খন্ড Biometrika পত্রিকা, Karl Pearson সম্পাদিত। প্রশান্ত সেই প্রবন্ধগুলি দেখে এতই প্রভাবিত হলেন যে সবকটি বই কিনে নিয়ে জাহজে উঠলেন, সারা পথ পড়তে পড়তে এলেন, এমনকী প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপকের পদে যোগ দেওয়ার পরেও একমনে বিজ্ঞানের এই নতুন শাখার চর্চা করতে লাগলেন। প্রথম হাতে-কলমে কাজ এল বিখ্যাত দার্শনিক ও দর্শনের অধ্যাপক ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের মাধ্যমে - কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা সংক্রান্ত কিছু ডেটা অ্যানালিসিস| তখনকার দিনে তো এত specialisation ছিল না। মহলানবিশ একাধারে educational statistics, anthropometry এমন কি meteorological data নিয়ে একের পর এক কাজ করেছেন। Mahalanobis D2 statistics - এর উদ্ভব হয় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের দৈর্ঘ্য, মাথার দৈর্ঘ্য, নাকের দৈর্ঘ্য এবং আরো নানা শারীরিক বৈশিষ্টের তুলনামূলক পর্যবেক্ষণের সময়ে।

 

এই সময়ে আবহাওয়া সংক্রান্ত কিছু ডেটা প্রশান্তচন্দ্রর হাতে আসে। এগুলির স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যানালিসিস করে তিনিই প্রথম বের করেছিলেন যে ভূপৃষ্ঠের চার কিলোমিটার ওপরের স্তরে বদলের সঙ্গে ভূপৃষ্ঠের আবহাওয়া বদলের যোগ সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। আবহাওয়া সংক্রান্ত কাজের জন্য তাঁকে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপনার পাশে পাশে কিছুদিন Meteorologist-এর দায়িত্বও সামলাতে হয়।

 

মনে রাখতে হবে রাশিবিজ্ঞানের গবেষণা এখন যেমন, আজ থেকে একশো বছর আগেও একই রকম গণনা-নির্ভর ছিল। আজকের দিনে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটার আমাদের অনেক কাজ অতি সহজে করে দেয়। এক লাখ ডেটা পয়েন্ট আর প্রতিটিতে দেড় হাজার ফিচার অ্যানালিসিস করা আমাদের কাছে অত্যন্ত সহজ।  1920-র দশকে যখন মহলানবিশ anthropometry আর meteorology-র ডেটা নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে গবেষণা করছেন, তখন প্রতিটি গণনা তাঁদের হাতে করতে হত। সুযোগ্য ছাত্র তৈরী না করতে পারলে এসব কাজ করা তাঁর পক্ষে সম্ভবই ছিল না। শুভেন্দু শেখর বোস, হরিশ চন্দ্র সিনহা, রাজ চন্দ্র বোস, সমরেন্দ্র নাথ রায় প্রভৃতি তাঁর একেবারে প্রথম দিকের ছাত্র। তারপরে ছাত্র হয়ে এসেছিলেন C. R. Rao, রাশিবিজ্ঞানী মাত্রেই যাঁর নাম জানেন।


স্বাধীনতার কালে বাংলা: প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ

1925 সাল নাগাদ মহলানবিশ এদেশের মাটিতে ধান চাষ নিয়ে নানান স্ট্যাটিস্টিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন যা Design of Experiment নামক শাখাতে অনেক মৌলিক গবেষণার জন্ম দিয়েছিল। Large scale sample survey শুধু এদেশে নয়, বিদেশেও তখন অজ্ঞাত ছিল। 1938 সালে Indian Central Jute Committee পাট চাষের সার্ভের দায়িত্ব দেয় মহলানবিশকে। প্রশান্তচন্দ্র যে কেমন করে সরকারকে বোঝাতে পেরেছিলেন যে সমস্ত জায়গাটা পরিমাপ না করেও, ছোট একটা জায়গা যদি রাশিবিজ্ঞানের নিয়ম মেনে পরিমাপ করা যায়, তাহলে অনেক কম খরচে, অনেক কম সময়ে সঠিক estimation পাওয়া সম্ভব, সেটাই আশ্চর্য। তবে প্রশান্তচন্দ্রর অন্যকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা ছিল অনন্যসাধারণ। Indian Science Congress প্রথমে রাশিবিজ্ঞানকে আলাদা ভাবে স্বীকৃতি দিতে রাজি হয়নি। তৎকালীন কর্তৃপক্ষের ধারণা হয়েছিল রাশিবিজ্ঞান আর জ্যোতিষ প্রায় একই গোত্রের! 1931 সালে ISI প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। 1938 সাল থেকে মহলানবিশ Indian Statistical Congress-এর সূচনা করলেন, 1942 সাল থেকে Indian Science Congress রাশিবিজ্ঞানকে পৃথক সেশন দিতে রাজি হয়। যদিও দুঃখের কথা হল Indian Science Congress-এ এখন আর রাশিবিজ্ঞানের কোনও আলাদা বিভাগ নেই।

 

1947 সালে মহলানবিশ যে শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী সমাজে একজন সুপরিচিত নাম তা নয়, সরকারি মহলেও তাঁর নাম সকলেই জানেন। 1949 সালে তিনি ভারত সরকরের Honorary Statistical Adviser পদে নিযুক্ত হলেন। তাঁর অধীনে Central Statistical Unit গঠিত হল যা 1951 সালে Central Statistical Organization-এ রূপান্তরিত হয়। 1949 সালে Census and Vital Statistics-এর অফিস স্থাপিত হয়। একই সময়ে National Income Committee তৈরী হয়। তারও চেয়ারম্যান ছিলেন মহলানবিশ। নতুন দেশ, নতুন সরকার, নতুন চিন্তাভাবনা, নতুন পরিকল্পনা। কোনো পরিকল্পনাই কার্যকর হবে না, যতক্ষণ না সম্পূর্ণ দেশের তথ্য পাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু চাইলেন সারা দেশে sample survey হোক। সাত দিনের মধ্যে মহলানবিশ National Sample Survey-র পরিকল্পনা তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর অফিসে জমা দেন। এক বছরের মধ্যে National Sample Survey-র প্রথম রাউন্ডের ডেটা সংগ্রহ করা হয়।

 

ভারতের মতো বিশাল, বহু ভাষা ও অভ্যাসের দেশে এই বিপুল কর্মসূচী সুচারুভাবে পরিকল্পনা এবং সম্পাদনা করা প্রায় অসাধ্য কাজ ছিল। তার ওপর দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক পরিবেশ ছিল অত্যন্তই খারাপ, দাঙ্গা লাগার মতো। সঠিক পরিমাপের জন্য মহলানবিশ এবং তাঁর সহযোগীদের নানান উদ্ভাবনী পন্থার সাহায্য নিতে হয়েছিল। যেমন রায়টের পরে লাল কেল্লার ভেতরে আশ্রয় গ্রহণকারী মুসলমানদের সংখ্যা নির্ণয়| কেল্লার ভেতরে প্রবেশ করে জনগণনা বিপজ্জনক। তার বদলে কতটা পরিমাণ চাল, ডাল আর নুন সেখানে সরবরাহ করা হয়েছে, সরবরাহকারীদের কাছ থেকে তার বিল নেওয়া হল। দেখা গেল সরবরাহকারীরা চাল আর ডালের পরিমান অনেক বাড়িয়ে ধরেছে, যেহেতু সেগুলির দাম বেশি। কিন্তু লবণের পরিমানে ইতর-বিশেষ করা হয়নি, কেননা তার দাম অতি সামান্য। অতএব লবণের পরিমানকে প্রামাণ্য ধরে নিয়ে, মাথাপিছু একজন মানুষের দৈনিক প্রয়োজন কতটা হতে পারে সেই হিসেবে লাল কেল্লার ভিতরের জনসংখ্যা হিসেব করা হয়েছিল।

 

1955 সালে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার দায়িত্বে ছিলেন প্রশান্তচন্দ্র। বিভিন্ন রকম অর্থনৈতিক এবং জনসংখ্যা সংক্রান্ত সার্ভে করে মহলানবিশের মনে হয়েছিল প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। সেগুলির সমাধানের পথ হিসেবে তিনি যা প্রস্তাব করেছিলেন, তা মহলানবিশ মডেল হিসেবে পরিচিত। যদিও মহলানবিশ মডেলেরও কিছু অসম্পূর্ণতা রয়েছে, এটা ঠিক যে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সরকারি উদ্যোগে বৃহৎ শিল্প গড়ে ওঠার মূলে ছিল তাঁরই অর্থনৈতিক ভাবনা।

 

ভাবতে অবাক লাগে একজন মানুষ সারা জীবনে কত রকম ভাবে ভারতবর্ষের statistical backbone তৈরি করে দিয়ে গেছেন। Indian Statistical Institute-এর নাম সারা পৃথিবীর সমস্ত Statistics Department-এ সুপরিচিত, সেখানকার ছাত্রছাত্রীরা সর্বত্র সমাদৃত। মহলানবিশের ছাত্ররা অনেকেই মৌলিক গবেষণার জন্য প্রখ্যাত। মহলানবিশের জীবদ্দশায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্বনামধন্য রাশিবিজ্ঞানীরা ISI-তে এসেছেন, থেকেছেন, গবেষণা করেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাশিবিজ্ঞান বিভাগও মহলানবিশের তৈরী, যদিও রাজনৈতিক অবক্ষয়ের মুখে তার এখন অনেক স্খলন হয়েছে। এদেশের সরকারি ডেটা সংগ্রহ ও তার রিপোর্ট তৈরির ঐতিহ্য অনেক দেশের কাছেই ঈর্ষণীয় হতে পারে। Statistical Quality Control-এর গুরুত্ব বোঝা এবং এদেশে তা পত্তন করার পেছনেও রয়েছেন মহলানবিশ।

 

এছাড়াও প্রশান্তচন্দ্রর একটা সামাজিক ও সাহিত্যিক পরিচিতি আছে। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র, কাছের মানুষ। তা বলে ভক্তিরসে গদগদ তিনি ছিলেন না। প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথের নিজের লেখা কোনো গ্রন্থভুক্ত হবে কি হবে না, সে বিষয়ে কবির বিপরীত মত প্রকাশে তাঁর কোনো দ্বিধা ছিল না। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি ও রাণী মহলানবিশ বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন, সেখান থেকে প্রতিবেদন লিখে পাঠিয়েছেন প্রবাসী ও অন্যান্য পত্রিকার জন্য। এক সুপ্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম পরিবারে প্রশান্তচন্দ্রর জন্ম। ব্রাহ্ম সমাজের নানান কাজে তাঁর বিশেষ অবদান আছে। একজন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক শুধু নয়, সমাজ-সাহিত্য-সমসময়-অর্থনীতি ইত্যাদি বহু ব্যাপারে সারা জীবন প্রশান্তচন্দ্র কাজ করে গেছেন।

 

2007 সাল থেকে তাঁর জন্মদিন 29 জুন ভারতবর্ষে National Statistics Day হিসেবে পালিত হয়।


New
নায়কের খোঁজে বাঙালি
নির্বাচনী বন্ড: সরকারকে সব জানালেও সুপ্রিম কোর্টকে বলতে কেন বিলম্ব স্টেট ব্যাঙ্কের
মুক্তমনের অম্লান ভাষ্যকার


Other Writings by -শ্রবসী বসু | 08-08-2022

// Event for pushed the video